কাজলরেখা পর্ব ২১

কাজলরেখা পর্ব ২১
তানজিনা ইসলাম

গতকাল আঁধারের থেকে নিষেধাজ্ঞা পেয়ে চাদনীর মনটা এতো খারাপ হয়েছিলো যে, ও আর কারো সাথে কথাই বলেনি। বৃষ্টি আর হাসনা অনেক মেসেজ করেছে ওঁকে। চাদনী রিপ্লাই দেয়নি। মেসেজে না পেয়ে বৃষ্টি একবার ফোন করেছিলো ওঁকে।চাদনী রিসিভ করেনি।যাবে না, কথাটা কেন যেন মুখ দিয়ে বের হচ্ছিলো না৷ এতটা খারাপ লাগছিলো! শেষে টেক্সট করেছে ও যাবে না৷ তারপরের মেসেজগুলো চাদনী আর দেখেইনি।

কলেজে যাওয়ার জন্য একটা সাদা মাটা সালোয়ার পরে নিলো চাদনী। শাড়ি টা পরা হলো না ওর, এই দুঃখ কোথায় রাখবে ও। নেহাতই প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ছে, নয়তো এ দুঃখে কলেজেও যেতে ইচ্ছে করছে না। ও ওর বাবাকে কাল রাতে টেক্সট করেছে, আঁধার ভাই আমাকে শাড়ি কিনে দিচ্ছে না বাবা। আমি শাড়ি পরতে চাই। আমি কোনেদিন শাড়ি পরিনি।’ ওর বাবা সিন করেছে কিন্তু রিপ্লাই করেনি, কলও দেয়নি। তবুও চাঁদনীর শান্তি, এটলিস্ট ও ওর বাবাকে বলতে তো পেরেছে। ওর জীবনের সব অভিযোগ তো ওই একটা মানুষের কাছেই। চাদনী ছোটবেলা থেকেই খুব বেশিই স্বাধীনতা পেয়েছে। ওর বাবা ওর জন্য একটা মুক্তি আকাশ বানিয়ে দিয়েছে। সে আকাশেই চাদনীর উড়াল ছিলো এর বাইরে বেরোনোর সাহস করেনি কোনোদিন। যে স্বাধীনতা ও পেয়েছিলো, সে স্বাধীনতার মান রাখার চেষ্টা করেছিলো সবসময়। অথচ আঁধার ওঁকে বিশ্বাসই করে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চাদনী বেরোনোর আগে চোখের নিচে মোটা করে কাজল দিলো। ওর চোখে কাজল দেওয়াও আঁধারের পছন্দ না। মোটকথা ওর সবকিছুতেই আঁধারের সমস্যা। চাদনী ডিসাইড করে নিয়েছে আঁধারের অপছন্দের কাজগুলোই বেশি বেশি করবে ও। ওর কোনো ঠেকা নাই আঁধারের পছন্দ অনুযায়ী চলতে।
চাদনী সিড়ি বেয়ে নামতেই দেখলো, আঁধার টিভি দেখে দেখে আইসক্রিম খাচ্ছে। অথচ সকাল বাজে নয়টা।ব্রেকফাস্ট করা ছাড়াই, মুখ ধুয়ে এসে আইসক্রিম নিয়ে বসেছে।এই ছেলের কাজকারবারের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। যা ইচ্ছে তাই করে, অথচ আরেকজনের জন্য সীমারেখা টেনে দেয়।
আঁধারকে চোখে পরতেই মুখ বাকালো চাদনী। ওঁকে দেখেও না দেখার ভান করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। অন্যসময় অবশ্য বলে যায়, ‘আমি কলেজে যাচ্ছি।’ আজ সেটাও বললো না।
আঁধার পিছু ডেকে বললো

-“এই দাঁড়া!”
চাদনী থেমে গেলো। কিন্তু পিছু ফিরলো না। আঁধার শাসিয়ে বললো
-“সন্ধ্যার আগে যাতে বাড়িতে দেখি আমি তোকে৷ তোর বন্ধুগুলোর সাথে কোথাও যদি টইটই করে ঘুরতে দেখি খবর আছে৷”
চাদনী হ্যাঁ না কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো। আঁধারের সাথে কথা বলতেও বিরক্ত লাগছে ওর। চাদনী বেরিয়ে যেতেই আঁধার দাঁতে দাঁত চেপে বললো
-“কত্তবড় বেয়াদব! উত্তর পর্যন্ত দিলো না। ম্যানার্স নেই একদম। উফ! এই মেয়েটা কে কখন যে আমি বাগে আনতে পারবো? কখন যে আমাকে একটু মান্য করবে?”

চাদনী মন খারাপ করে বসে আছে ক্লাসে। ক্লাসে তেমন স্টুডেন্ট নেই। সবাই বাইরে বাইরে বন্ধুমহল নিয়ে ঘুরছে। ওর বন্ধুমহল নিশ্চয়ই ক্ষেপে আছে ওর উপর। আদোও কথা বলবে তো মেয়ে দু’টো? ওঁদের যে রাগ? চাদনী গালে হাত দিয়ে এতিমের মতো বসে থাকে। তক্ষুনি ওর বন্ধুদের ক্লাসে ঢুকতে দেখা গেলো। হাসনা আর বৃষ্টি ম্যাচিং করে শাড়ি পরেছে। ওঁদের ঢুকতে দেখেই চাদনী হেডডাউন দিয়ে বসলো। ওরা সবাই এগিয়ে এলো ওর বেঞ্চের কাছে। হাসনা এসেই চেঁচালো

-“কীরে তুই এখানে ঘুমানোর জন্য এসেছিস?”
চাদনী মাথা তুললো না। বৃষ্টি ওর কাঁধ ধরে তুললো ওকে। হাসনা ওর থুঁতনি ধরে, আদর মাখা কন্ঠে বললো
-“কী হয়েছে দোস্ত?”
চাদনীর টলমলে দৃষ্টি। ওর খুব কান্না পাচ্ছে। ওরা দু’জন ম্যাচ করে শাড়ি পরেছে। চাদনী পরতে পারেনি।ওঁদের থেকে কেমন যেন আলাদা হয়ে পরেছে ও। চাদনী তো ওদের মতো সুন্দরও না। শাড়ি পরলে অন্তত ওঁদের মাঝে নিজেকে ওদের বলে মনে হতো। এখন সেটাও মনে হচ্ছে না।
চাদনী মাথা নোয়ালো। বৃষ্টি বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো

-“খুব বেশিই স্ট্রিক্ট তোর ফ্যামিলি?”
-“হু। সরি! যাবো বলেও, কথা রাখতে পারিনি৷”
চাদনীর ভাঙা গলার স্বর। হাসনা মিষ্টি করে হেঁসে বললো
-“ইট’স ওঁকে! সরি কেন বলছিস? সবার ফ্যামিলি তো সেইম না? হয়তো তোর ফ্যামিলি বেশি রক্ষণশীল, আমরা বুঝেছি। এতোটা সেন্টি খাওয়ার কিছু হয়নি।”
তারপর প্যাকেট থেকে একটা লাল পাড়ের, অফ হোয়াইট রঙের শাড়ি বের করে চাঁদনীর হাতে দিয়ে বললো
-“এটা তোর।”
চাদনী পলক ঝাপ্টে তাকালো। হাসনা বললো

-“কাল আমরা তোর জন্যও শাড়ি কিনে নিয়েছিলাম। তুই আসতে পারিসনি তো কী হয়েছে। আমরা তিনজন না ম্যাচিং করবো বলেছিলাম। আমাদের বন্ধু পরতে না পারলে আমাদের ভালো লাগবে বল!”
চাদনীর মুখ দিয়ে কথা বেরোলো না।হাসনা বললো
-“কমন রুমে আয়। বৃষ্টি শাড়ি পরাতে জানে, ও পরিয়ে দেবে তোকে।”
ওরা টেনে নিয়ে গেলো চাদনী কে। সিয়াম আর রেহান ক্লাসে বসে অপেক্ষা করলো ওঁদের আসার।
কমেনরুমে কেও নেই, ওরা খুব তাড়াতাড়িই এসেছে কলেজে। মূলত কাল রাতেই হাসনা আর বৃষ্টি প্ল্যানিং করেছিলো চাদনীকে ওরা কলেজেই শাড়ি পরিয়ে দেবে।

শাড়ির সাথে আর যা যা লাগে সব নিয়ে এসেছে হাসনা। সাথে এক গোছা লাল কাঁচের চুড়ি। চুড়িগুলো না-কি রেহান কিনে দিয়েছে ওঁদের তিনজনের জন্য, সেইম সেইম। ও বন্ধুদের জন্য প্রচুর খরচ করে। বৃষ্টি সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিলো চাদনীকে। হাসনা কুঁচি ধরলো৷ শাড়ি পরানো শেষে হাসনা বললো
-“বিনুনি খুলে দিয়ে খোঁপা করে দেয়? যেহেতু শাড়ি আর চুড়ি মিলিয়ে পরেছি, হেয়ার স্টাইলও মিলে যাক!”
চাদনী ঘাড় কাত করে সম্মতি জানায়। বৃষ্টি সুন্দর করে খোঁপা করে দিলো, ও খুব সুন্দর সাজাতে পারে। সেদিক দিয়ে আবার চাদনী আর হাসনা অষ্টরম্ভা! চাদনীকে রেডি করানো শেষে, হাসনা ওর দুবাহু ধরে বললো

-“পারফেক্ট। খুব সুন্দর লাগছে তোকে চাঁদ! ”
চাদনী এতোক্ষণে মুখ খুললো। ও এতোক্ষণ আবেগে কোনো কথাই বলতে পারছিলো না।
-“হাসনা, বৃষ্টি!”
ওরা কিছু বলার আগেই চাদনী দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো ওঁদের। ভাঙা গলায় আওড়ালো
-“জানিস, আজ পর্যন্ত কেও আমাকে এতোটা স্পেশাল ফিল করায়নি রে! আমার মতো ক্ষুদ্র, শ্যাম একজন মানুষের জন্য যে কেও এতোটা ভাবতে পারে, এতোকিছু খেয়াল রাখতে পারে,আমি কখনো কল্পণাও করিনি। তোরা এতো ভালো কেন?”

-“হয়েছে থাম! সেন্টিখোর মহিলা! মিনিটে মিনিটে সেন্টি খাস তুই। বন্ধুরা না করলে কে করবে?”
নাক মুখ কুঁচকে বললো হাসনা। ওরা যখন সব শেষ করে ক্লাসে এলো, রেহান চাদনী কে দেখে গদগদ হয়ে বললো
-“ওয়াও, দোস্ত! খুব সুন্দর লাগছে তো তোকে! তুই যদি আমার ব্রাদার না হতি, আমি এক্ষুনি তোর উপর ক্রাশ খেতাম!”
-“পাম দিস না!”
মুখ বাকিয়ে বললো চাদনী।সিয়াম রেহানের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বললো
-“যেভাবে মেয়েদের পটানোর চেষ্টা করিস,বিশ্বাস কর ওভাবে হিজরাও পটবে না! বলদ!”
সবাই হাসতে থাকলো ওর উপর। রেহান কিল বসালো সিয়ামের পিঠে।

ওরা পাঁচ বন্ধু যখন ভবন ছেড়ে বেরিয়ে এলো,তখন কলেজ প্রাঙ্গণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়ে গেছে। প্রধান অতিথি হিসেবে আবারো রাতের আগমন ঘটেছে সিটি কলেজে। সেই নিয়ে মেয়েদের ফিসফিসানির শেষ নেই। দেখা যাচ্ছে অনেকেই আবার ছবি তুলছে তার সাথে। সেও হাসি মুখে সবার সাথে মিশছে। কিন্তু আশেপাশে তার চ্যালাপ্যালারা ঘিরে আছে তাকে। সাথে দু’জন কালো পোশাকে আবৃত পালোয়ান সাইজের বডিগার্ড। রাতের হাসিটুকু চাদনীর মেকি মনে হয়। মনে হচ্ছে না পারতে ছবি তুলছে।চাদনী মুখ বাকালো৷ কী গালিই না দিয়েছিলো ওঁকে সেদিন, গায়ে পরাতে। এখন যে মেয়েরা ঢলাঢলি করে ছবি তুলছে ওঁদের তো কিছু বলছে না। সবাই খালি ওকেই কথা শোনাতে পায়। আবার ভাবলো থাক, ওর পক্ষও তো নিয়েছে। সেটাই বা কম কীসের? এতোবড় নেতা ওর সাইড নিয়েছে সেটা কী মুখের কথা।
চাদনী বিরবির করে বললো

-” মেয়েরা কী যে পেয়েছে এই ছেলের মধ্যে, আল্লাহ? এভাবে ঘুরঘুর কেনো করছে তার আশেপাশে। নেতা হয়েছে বলেই এভাবে লাজ লজ্জা ফেলে তার সাথে সেলফি তোলার জন্য মারামারি করতে হবে? দেখেই মনে হচ্ছে বিরক্ত?”
চাদনীর বিরবির করে বলা কথাটাও শুনে ফেললো রেহান। ও ওর ভাইয়ের ব্যাপারে খুব কনসার্ন। কেও রাতের ব্যাপারে কিছু বলা মাত্রই কান খাঁড়া করে শুনে নেয় ও। পুরো দুনিয়া একদিকে ওর ভাই আরেকদিকে। চাদনীর পাশাপাশি হেঁটে ও অস্হির স্বরে বললো
-“আমার ভাই কে নিয়ে কী বলছিস তুই?দেখছিস না, মেয়েগুলো কী করে বিরক্ত করছে! ওইদিনও বিরক্ত হয়েই তোকে ঝেড়েছিলো। এখানে আমার ভাইয়ের দোষ কী?”

-“আমিও তো সেটাই বলছি, কোনো দোষ নেই।”
ওরা চেয়ারে গিয়ে বসতেই,স্টেজ থেকে চাদনীর নাম ধরে ডাকা হলো। অর্থাৎ এখন ওঁকে গান করতে। চাদনী কিছুটা নার্ভাস। এতো মানুষের সামনে কী করে গায়বে ও, সেটার কন্ফিডেন্স পাচ্ছে না। সবকিছুতেই ওর কন্ফিডেন্স এর খুব অভাব।ওর বন্ধুরা ওঁকে সাহস দিলো। হাসনা বললো
-“সবার দিকে তাকিয়ে গায়তে লজ্জা করলে, আমাদের দিকে তাকাবি। দেখিস সব ভালো হবে!”
সিয়াম আজও গিটার নিয়ে এসেছে চাদনীর। ও চাদনীকে গিটার হাতে দিলো
চাদনী দুরুদুরু বুক নিয়ে স্টেজে উঠে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে গিটারে টুংটাং শব্দ তোলে৷ তারপর হাসনার কথামতো ওর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠে

জন্ম মৃত্যুর আবর্তনে, পুনর্জন্ম হবে
তোমার আবার দেখা পাবো, কখন কে জানে
জন্ম মৃত্যুর আবর্তনে, পুনর্জন্ম হবে
তোমার আবার দেখা পাবো, কখন কে জানে
দূরে যাও, সরে যাও
রেখে যাও কিছু সৃতি তোমার আমার
জানি আবার একটি জন্ম আমার, কভু হবে না
জানি আবার এমন করে তোমার, দেখা পাবো না!
সোজা শপটা একটা সত্য কথা বলি
তোমায় ভীষণ রকম ভালোবাসি
হাজার যুদ্ধ বয়ে গেছে মনে
তোমায় এই কথা বলবো বলে
বলা হয়নি কথা কি ছিল এই মনে, বলা হয়নি কথা কি ছিল এই মনে
জানি আবার একটি জন্ম আমার, কভু হবে না
জানি আবার এমন করে তোমার, দেখা পাবো না…..
গান শেষ হতেই তালির বর্ষণ হলো কলেজ প্রাঙ্গণ জুড়ে।

রাত, প্রিন্সিপালের সাথে প্রথম সারিতে বসেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলো ও চাদনী কে। মনোযোগ দিয়ে শুনলো গানটা। এ গানটা খুব পছন্দের ওর। কেন যেন এ গানটা শুনলেই ওর মায়ের কথা মনে পরে। গানের প্রতিটা লাইন ওর জীবনের সাথে মিলে যায়। কষ্ট হয় ওর! পুণর্জন্ম হয়না বলেই বোধহয় এ জন্মতেই আমরা আমাদের সব আশা পূরণ করার চেষ্টা করি৷ না পাওয়া মানুষগুলো এক জীবনেই পেতে চাই। আমাদের জীবনটা আমাদের মতো সাজানোর চেষ্টা করি।কিন্তু রাত ওর জীবনটাকে ওর মতো সাজাতে পারনি। ওর নষ্ট, ঘুণে ধরা জীবন, যেটার কোনো ভ্যেলু নেই ওর কাছে। ওর একজন প্রিয় মানুষও ওর সাথে থাকেনি ওর মা ছাড়া। হয়তো এ জন্যই এ গানটাকে খুব বেশিই রিলেট করতে পারে ও৷ ওইদিনও ক্লাসের সামনে গানটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলো। প্রিন্সিপালের কথা একটাও ওর কানে ঢোকেনি।
চাদনী স্টেজ থেকে নেমে এসে ওর বন্ধুদের সাথে বসলো। এক্সাইটমেন্টে কন্ঠ রোধ হয় ওর।উতলা হয়ে শুধায়

-“ভালো গেয়েছি?”
-“ফার্স্ট ক্লাস!”
একযোগে বললো সবাই।এরপর বৃষ্টিকে ডাকা হলো নাচের জন্য। এরপর সিয়াম আর হাসনা কেও ডাকা হলো। মোটকথা রেহান ছাড়া ওর সব বন্ধুরাই স্টেজে গেলো। রেহানের কোনোকিছুতেই আগ্রহ নেই। ও শুধু কোনোমতে পড়াশোনা টা করে, তাও ঠেলায় পরে। নয়তো ওটাও করতো না।
সবকিছু শেষ হওয়ার পর প্রিন্সিপাল তার বোরিং লেকচার দিচ্ছিলো। ওই সেইম টপিক, ভালো করে পড়াশোনা। এইচএসসি তে গোল্ডেন পাওয়া। প্রতিবারের মতো কেওই মনোযোগ দিয়ে শুনলো না কথাগুলো।
হাসনা ফিসফিস করে বললো

-“এই আজকে সবাই মিলে ঘুরতে যাবি? অনেকদিন একসাথে ঘুরতে যাই না আমরা। সামনে একটা নতুন রেস্টুরেন্ট লঞ্চ হয়েছে, ওখানে গেলে কেমন হয়? তারপর পার্কের ওখানে যাবো? কী বলিস, যাবি তোরা?”
-“অবশ্যই যাবো। যাবো না মানে! আমরা যেসব কম্পিটিশনে পার্টিসিপ্যাট করেছি সেসবের বিজয়ী ঘোষনা শেষ হোক, তারপর অনুষ্ঠানের শেষের দিকে বেরিয়ে যাবো। তাহলে অনেক্ষণ ঘুরতে পারবো। দুপুরের লাঞ্চটাও নাহয় ওখান থেকেই করবো!”

সিয়াম বললো। বৃষ্টিও সম্মতি দিলো। শুধু আপত্তি থাকলো রেহান আর চাদনীর। চাদনী কে আঁধার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিয়েছে, যাতে সন্ধ্যার পর বাইরে না থাকে। কিন্তু ওঁদের সাথে বেড়াতে গেলে নির্ঘাত সন্ধ্যার পর হবেই। এতে কোনো সন্দেহ নেই। যতই হোক, ওঁকে ওই বাড়িতেই ফিরতে হবে, আঁধারের কাছে। সেই নিয়েই ভয়। নয়তো চাদনী আঁধারের কধা জীবনেও মান্য করতো না।

আর রেহানের আজকে অন্যত্র ঘোরার প্ল্যান আছে। রেহানকে রাত কথা দিয়েছিলো ওরা দুইভাই মিলে একদিন
ঢাকা শহরটা পুরো ঘুরবে। রাত টাইম ম্যানেজ করতে পারেনি। তো আজ ঘর থেকে বেরোনোর আগেই রাত বলেছিলো, অনুষ্ঠান শেষে রাত আজকের রাতটা ফ্রি থাকবে। আজকের টাইমটা শুধু রেহানের জন্য। রেহান জানালো কথাটা। চাদনীও নিজের অপারগতার কথা বললো। কিন্তু বাকি তিনজন মানলো না। ওঁদের এক কথা, আজকেই ঘুরতে যাবে ওরা। নয়তো দেখা গেলো,পরে পড়াশোনার বেশি চাপ পরে যাচ্ছে, ঘুরতে যাওয়া আর হচ্ছে না। এভাবে প্ল্যান করতে করতেই পুরো কলেজ লাইফ শেষ হয়ে গেলো। চাদনী আর রেহান তবুও মানছিলো না৷ হাসনা রেগে গিয়ে উঠে চলে গেলো। বৃষ্টিও মুখ বাকিয়ে ওর পিছু পিছু চলে গেলো। অন্য চেয়ারে গিয়ে বসলো ওরা। সিয়াম নিজের জায়গায় বসে থাকলো। ও আবার অতো নাটক পারে না।মেয়েদের ঢং একটু বেশি, ওর মনে হয়। শেষমেশ রেহান আর চাদনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজি হলো।

অনুষ্ঠানের শেষের দিকে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হলো। চাদনী, বৃষ্টি, হাসনা, সিয়াম সবাই জিতেছে। ওরা সবাই একে একে স্টেজে উঠলো পুরষ্কার নিতে। রেহান উৎফুল্ল হয়ে, নিজের ক্যামেরায় বন্দী করলো সকলকে।
সাথে ওরা সব বন্ধু মিলে অনেক ছবি তুললো।
এ দিন যে চলে যাচ্ছে, এদিন আর আসবে না৷ না আসবে ওঁদের সুন্দর সুন্দর, ভালোবাসার মুহুর্তগুলো। তাই স্মৃতিগুলোকে ক্যামেরায় বন্দী করতেই হয়। নয়তো ভবিষ্যতে এসবের গল্প নাতি-নাতনিকে শোনাবে কী করে! খুব দুঃখের দিনে, এ সুন্দর সুখের স্মৃতিগুলো মনে করে মুচকি মুচকি হাসবেই বা কি করে!

রাত গেইটের বাইরে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে রেহানের জন্য। ও বাইরেই দাঁড়াতো। কিন্তু দাঁড়ানো মাত্রই কিছু অসহ্য মেয়ের দল, মৌমাছির মতো উড়তে উড়তে আসবে ওর কাছে। ঘিরে ধরবে ওঁকে। এসব এতো অসহ্য লাগে ওর! রাত ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। রেহান এখনো বেরোচ্ছে না কলেজ থেকে। ওর বন্ধুগুলোকে বিদায় দিয়ে আসা ওর জন্য একটা যুদ্ধসুলভ। ওঁদের কোনোমতে ছাড়তেই পারে না। কিন্তু রেহান ওঁদের বিদায় দিয়ে এলো না। ওঁদের সাথে নিয়েই বেরোলো৷ রাত হাতের ইশারায় ডাকলো ওঁকে। রেহান এগিয়ে এসে মাথা নিচু করলো জানালার কাছে। রাত বললো

-“ঘোরার ইচ্ছে আছে রেহান আমার সাথে?”
-“আছে!”
-“তাহলে? এতো লেইট করছিস কেন?এবার ছাড় বন্ধুগুলোকে।”
রেহানের মুখ দিয়ে বেরোলো না, ‘ভাইয়া আমি আমার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবো। তুমি চলে যাও আজকে। আমরা অন্যদিন ঘুরবো!’
ও ওর বন্ধুদের খুব ভালোবাস, কিন্তু এ দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে ওর বড় ভাইকে। রেহান বলতে লজ্জা পাচ্ছে। তবুও আমতাআমতা করে বললো
-“ভাইয়া আমার ফ্রেন্ডরা আজকে ওঁদের সাথে ঘুরতে যেতে বলছে!আমি ওঁদের মানা করতে পারছি না।”
রাত কপালে ভাজ ফেলে বললো

-“তাই আমাকে মানা করতে এসেছিস? আমার কিন্তু আর টাইম নেই রেহান। আজ বিকাল আর রাতের সময়টা আমি তোর জন্য ম্যানেজ করেছি। কাল থেকে আবারো ভোটের প্রচারণা। তোর বন্ধুদের সাথে অনেকবার ঘোরার সুযোগ আছে তোর। আমার সাথে নেই। ভোট শেষে আবারো চট্টগ্রামে চলে যাবো আমি। কবে ঢাকায় আসবো ঠিক নেই। চয়েস ইজ ইউরস! বাট তুই তোর বন্ধুদের সাথে ঘুরতে চায়লে আমি রাগ করবো না।”
রেহান উদ্বিগ্ন স্বরে বললো

-“ভাইয়া, আমি দোটানায় পরে গেছি। আমার তোমার সাথে যেতে ইচ্ছে করছে। আবার ওরা রাগও করছে ওঁদের সাথে না গেলে। আমার কী করা উচিত?”
-“তোর মনের কথা শোনা উচিত?”
-“আমার মন তোমাদের সবাইকেই চায়ছে। তোমাকেও আমার বন্ধুদেরও।”
-“কিন্তু তা তো সম্ভব না বাচ্চা!”
-“একটা কথা রাখবে আমার? প্লিজ! আমি আর কখনো কিচ্ছু চাইবো না তোমার কাছে।”
-“হু, বল।”
-“আমরা একসাথে ঘুরতে যাই? আমার বন্ধুদেরও সাথে নিয়ে নেই?”
রাত নাকচ করে বললো

-“নোপ৷ একথাটা রাখতে পারলাম না।”
-“প্লিজ ওদেরও নাও। প্লিজ ভাই। আর কিচ্ছু চাইবো না কখনো।”
-” তুই জানিস, শাবিহা আমাকে কতোবার বলেছে ও সহ আসবে। আমি আনিনি কারন আমি শুধু তোর সাথে ঘুরতে চেয়েছিলাম। এখন তুই তোর ফ্রেন্ডদের নিতে চাচ্ছিস!”
-“ওরা আসলে আমার মজাটা আরো দ্বিগুণ হয়ে যাবে ভাই। প্লিজ!”
-“নো!”
-“প্লিজ!”
রেহান খুব রিকুয়েষ্ট করা শুরু করলো।”
শেষমেশ রাত অতিষ্ঠ হয়ে বললো

-“আচ্ছা, নিয়ে আয়।”
-“থ্যাঙ্কিউ। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। তুমি অনেক কিউট ভাই!”
-“হয়েছে যা।”
রেহান খুশিতে দৌড় দিলো ওর বন্ধুদের কাছে। গদগদ হয়ে বললো
-“ভাই রাজি হয়ে গেছে। আজ আমরা সবাই একসাথে ঘুরবো।”
চাদনী বাঁধ সেধে বললো
-“তাহলে আমি যাবো না। তোরা যা!”
-“কেন? কেন যাবি না তুই?” উতলা হয়ে বললো রেহান।
-“আমি শুধু তোদের সাথে যেতে চেয়েছিলাম। তোর ভাই থাকবে এখন!”
-“তো সমস্যা কী? সে সাথে সাথে থাকবে, আমরা আমাদের মতো থাকবো, ঘুরবো। বিশ্বাস কর, সে শুধু রোবটের মতো আমাদের সাথে সাথে হাঁটবে। কথাও বলবে না। ভাইয়াকে অনেক কষ্টে মানিয়েছি। প্লিজ আমার মনটা ভেঙে দিস না। এখন তোকে মানাতে হবে আবার? মানাতে মানাতেই দিন যাচ্ছে আমার!”
উদগ্রীব স্বরে বললো রেহান। চাদনী বললো

-“আমার এতো স্বাধীনতা নেই রেহান।”
-“বড় ভাই হিসেবে যাবে।”
-“তবুও। শাড়ির কাহিনী নিয়েই দেখেছিস, আমার ফ্যামিলি কতোটা স্ট্রিক্ট।”
-“তোর ফ্যামিলি তো আর জানবে না যে ভাইয়া যাচ্ছে আমাদের সাথে।”
-“ভয় লাগছে তবুও।”
হাসনা কোনো কথা না বলে চাদনীর হাত ধরলো শক্ত করে।সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো
-“সবাই গাড়িতে গিয়ে বোস। ও যাবে না ওর ঘাড় যাবে। সবকিছুতে জেদ মেয়েটার।”
-“আমি যাবো না হাসনা!”

কাজলরেখা পর্ব ২০

চাদনী অনুনয় করে বললো। হাসনা কথা শুনলো না। বৃষ্টিও চেপে ধরলো ওঁকে।
-“চল, যাবি তুই। যেতে তোকে হবেই।”
-“আমি যাবো না শোন না, প্লিজ। আমার কপালে শনি ডেকে আনিস না। আমাকে মেরে ফেলবে, এসব জানতে পারলে!”
চাদনীর কথা কেওই কানে তুললো না। ওরা টেনেটুনে নিয়ে গেলো চাদনীকে।
আরেকটু পর সন্ধ্যা নামবে। অথচ মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় চাদনী জানতেও পারলো না, আঁধার ওঁকে কতবার কল দিয়েছে।

কাজলরেখা পর্ব ২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here