কাজলরেখা পর্ব ২৬

কাজলরেখা পর্ব ২৬
তানজিনা ইসলাম

চাদনীর ঘুম ভাঙার পর দেখলো তটিনী এসেছে। বসে আছে ওর পাশে। চাদনী চোখ কচলে উঠে বসলো। ঘুমঘুম স্বরে ডাকলো
-“আপু।”
তটিনী ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেঁসে বললো
-“উঠে গেছো তুমি। তোমাকে পড়াতে এসেছিলাম, এদিকে তুমি অসুস্থ হয়ে পরে আছো।”
চাদনী লজ্জা পেলো। তটিনী বিছানার হেডবোর্ডের সাথে বালিশ সেট করে দিলো। চাদনী হেলান দিয়ে বসে বললো

-“কখন এসেছো আপু?”
-“বেশিক্ষণ হচ্ছে না।এভাবে জ্বর বাধালে কী করে?”
চাদনী কিছু বললো না। তটিনী ওর গালে হাত রেখে বললো
-“তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। ওই বেয়াদবটা কে অনেক গা*লি দিয়েছি আমি। শয়তানটা নিজেকে কি যে মনে করে!”
চাদনী মলিন হাসলো। আধার তক্ষুনি কক্ষে ঢুকলো। ওর হাতে নাস্তার ট্রে। আঁধার কখনো ওর ফ্রেন্ডদের জন্য একপদের নাস্তা বানাতে পারে না। ওকে তিন-চার রকমের পদ বানাতেই হবে। মাস্ট। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন! ওর ফ্রেন্ডরা ওর হাতে বানানো খাবার খেতে খুব পছন্দ করে। আঁধারের রান্নাগুলো খুব মজাদার হয়। আঁধার সাইড টেবিলে ট্রে রেখে বললো

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“ধর যা যা খেতে চেয়েছিলি।ও চাদনী উঠে গেছে।”
-“হ্যাঁ। আজকে তো ও পড়বে না তাই না?”
তটিনী বললো। আঁধার চেয়ারের উপর পা তুলে বসলো৷ দুপাশে মাথা নেড়ে বললো
-“না। কী করে পড়বে ও? দাঁড়াতে পর্যন্ত পারতেছে না। সুস্থ হোক, তারপর। তোকে যে আসতে বলেছিলাম সেটাও ভুলে গেছি আমি।”

-“আমার কাল রাতে মনে পরলো। আসলে এর আগে কখনো স্টুডেন্ট পড়াইনি তো। কয়েকদিন পর থেকে মিডটার্ম। চাদনীর কলেজেও হয়তো নোটিশ দিয়েছে। এখন আমারই টেনশন লাগছে কি করে সিলেবাস শেষ করবো৷ যে জ্বর উঠেছে এতো সহজে তো সারবে না।বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে তোর একটু মায়া হয়নি জা*নোয়ার।”
শেষের কথাটা রাগ নিয়ে বললো তটিনী। আঁধার জ্বিভ দিয়ে গাল ঠেলে বললো
-“বেয়াদবি করেছে কেন আমার সাথে জিজ্ঞেস কর!”
-“তাই বলে এভাবে মারতে পারবি?”
আঁধার কিছু বললো না। চাদনীর দিকে তাকালো। চাদনী অনেক আগে থেকেই তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

তটিনী চলে গেছে। অনেক্ক্ষণ বসে গল্প করেছে ও চাদনীর সাথে। চাদনী ব্রেকফাস্ট শেষ করে বসে আছে। ও মোবাইল দেখতে পারছে না। স্ক্রিনের দিকে তাকালেই চোখ জ্বলছে ওর। তাই আঁধার ওঁকে ক্লে আর স্লাইম এনে দিয়েছে। চাদনী সেগুলো নিয়ে খেলছে। ক্লে দিয়ে পুতুল বানাচ্ছে। ক্ষণকাল পরপর তাকাচ্ছে আঁধারের দিকে। আঁধার ওর মোবাইল নিয়ে অনেক্ক্ষণ ধরে ঘাটাঘাটি করছে। চাদনী মোবাইল নিতে চাচ্ছে।আধার দিচ্ছে না।
-“আমার মোবাইলে এতোক্ষণ ধরে কী দেখছো তুমি?”
আধার মাথা তুলে তাকালো চাদনীর দিকে।আবারো মোবাইলে মনোযোগ দিয়ে বললো

-“তোদের গ্রুপের কাহিণী দেখছি।”
-“চ্যাটিং করছো ওদের সাথে?”
-“নাহ। জাস্ট ওঁদের মেসেজ দেখছি।ওরা কী সারাক্ষণই ওই ছেলেটা কে নিয়ে কথা বলে?”
-“হাসনা আর বৃষ্টি বলে। ওঁদের ক্রাশ!”
-“তোর? তুই পছন্দ করিস না? এতো সুন্দর একটা ছেলে!”
আঁধার বাশ মারলো। চাদনী নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আঁধারের দিকে। আঁধার বললো
-“আনব্লক করে দিয়েছিস ওঁদের কে!”
-“হুমম। তুমি যদি বলো ওঁদের কে ছাড়তে না পারলে তুমি আমাকে আবার মারবা। তাহলে আমি আবার মার খাবো। তবুও আমি ওঁদের ছাড়তে পারবো না!”
-“এতোটা ভালোবাসিস ওদের! কয়েকদিনই তো হলো ওঁদের সাথে পরিচয় হয়েছে তোর। এই অল্প সময়ে এতোটা প্রিয় হয়ে গেছে ওরা তোর!”

-“প্রিয় হওয়ার জন্য কী খুব বেশি সময়ের দরকার আছে আঁধার ভাই! তাহলে তো আমিও তোমার প্রিয় হতাম। ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি আমরা। অথচ তুমি আমাকে কতটা ঘৃণা করো! ওরা এটলিস্ট আমাকে কালির ড্রাম বলে না৷ আমার গায়ের রং নিয়ে আমাকে প্রতি পদে পদে অপমান করে না, কটাক্ষ করে না। আমার কনফিডেন্স কমিয়ে দেয় না, উল্টো বাড়িয়ে দেয়।ওদের সামনে থাকলে আমি নিজেকে নিচু ফিল করি না। আমি ওঁদের সাথে যতক্ষণ থাকি আমার সময়টা খুব ভালো কাটে। ওরা আমাকে আমার কমতিগুলো নিয়েই ভালোবাসে।”
আঁধার ক্ষীণ স্বরে বললো
-“আমি তো তোকে ঘৃণা করি না চাঁদ! আমি তোকে কষ্টও দিতে চাই না। কিন্তু আমি নিজেই মানি আমি খুব টক্সিক।”
চাদনী আবার ক্লে নিয়ে খেলনার জিনিস বানাতে শুরু করলো। আঁধার বললো

-” আমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো পাইনি। শাড়ি কোথায় পেয়েছিলি তুই? কেন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবি বলে, ওই ছেলেটার সাথে দাঁড়িয়ে ছিলি?”
চাদনী স্বাভাবিক স্বরে বললো
-“আমার ফ্রেন্ডরা ক্যাফিটোরিয়ার ভেতরেই ছিলো। তুমি ওঁদের দেখোনি। ভাইয়াটার সাথে আমি একা যাইনি, আমার বন্ধুরাও গিয়েছিলো৷ আমার ফ্রেন্ডের বড় ভাই ছিলো। আমি যেতে চাইনি ওরা জোর করে নিয়ে গেছে। ওনি আমাকে ক্যাব ঠিক করে দিচ্ছিলো। ওনি আমার জন্য যে কনসার্ন দেখিয়েছে, হাসনা আর বৃষ্টির জন্যও সেম কাজ করতেন। যেহেতু আমরা তার ভরসা গিয়েছিলাম। এখানে আমার জন্য আলাদা করে কিছু করেনি। তোমার ভাবনা গুলো বেশি নেগেটিভ আধার ভাই৷”
আঁধার সরু চোখে তাকিয়ে বললো

-“হ্যাঁ, আমি খুব নেগেটিভ, টক্সিক।আমি তোকে ট্রাস্ট করি, আমি জানি তুই এমন ভুল করবি না যেটার জন্য তোর সম্মানে আঘাত আসবে।কিন্তু আমি চোখের দেখাটা মানতে পারিনি চাদনী। খুব ফাট*ছিলো বিশ্বাস কর। গিয়ে মাত্রই দেখলাম ওই ছেলেটার সাথে শাড়ি পরে, সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছিস।কী উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা যে আসছিলো!”
চাদনী বিমূঢ় স্বরে বললো
-“শাড়িটা আমাকে আমার ফ্রেন্ডরা দিয়েছে। চুড়িগুলোও!আচ্ছা, তুমি ওখানে গেলে কী করে? না মানে, জানলে কী করে আমি ওখানে আছি?”
-“জিপিএস ট্রেক করেছি। তোর মোবাইলে জিপিএস সেট করা ছিলো!”
-“তাহলে প্রথমেই যেতে। তাহলেই তো আমার ফ্রেন্ডদের দেখতে তুমি। তোমার ভুলের কারণে আমি মার খেলাম!২৮০ বার কল করার কোনো কারণ ছিলো না দেখছি।”

-“ওই সিচুয়েশনে আমার মাথায় আসেনি ব্যাপারটা। আমি তোকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম। মনে হচ্ছিলো তুই হারিয়ে গেছিস। তারপর যখন মাথায় এলো গিয়ে দেখলাম ওই নেতা না কেতা তার সাথে দাড়িয়ে আছিস। কিরকম ফিল হয়েছিলো আমার! ইচ্ছে করছিলো দু’টোকে মেরে কবরে পুতে দেই। তারপর ভাবলাম, অন্যের ছেলের কি দোষ!শত্রু তো আমার নিজের ঘরে। অনেক সামলানোর চেষ্টা করেছি নিজেকে, বুঝিয়েছি তুই ছোট।বুঝিসনি হয়তো! কিন্তু তুই ঘরে আসার পর, আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি নাই।”
চাদনী মলিন হাসলো। বললো

-“তোমার তো ভালোবাসার মানুষের অভাব নাই দাদাভাই। কিন্তু আমাকে তো কেও ভালোবাসে না। ওই গুটিকয়েক মানুষই আমাকে প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট দেয়। ওরা আমার জন্য শাড়ি কিনে এনেছে। রেহান চুড়ি কিনে দিয়েছে৷ বৃষ্টি আর হাসনা আমাকে সাজিয়ে দিয়েছে। আমার এ ভালোবাসাগুলো ফেলে আসতে ইচ্ছে করে না। বিশ্বাস করো নেতারে আমি চিনিও না। ওনাকে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যাথা নাই৷ কিন্তু আমি আমার ফ্রেন্ডদের কথা ফেলতে পারি না।
আঁধার কথা ঘোরাতে বললো
-“এটা তুই ঠিক বলেছিস! আমার তো ভালোবাসার মানুষের অভাব নাই। আমি তোকে ছাড়া এ দুনিয়ায় সবাইকে ভালোবাসি।”

চাদনী কিছু বললো না। আঁধার চাদনীর ফোন দেখতে দেখতে বললো
-“তোর ফ্রেন্ডরা ছবি পাঠিয়েছে। একহাজারটা সেল্ফি কে তোলে ভাই?মোবাইল হ্যাঙ মারতেছে। আইফোন পর্যন্ত তোদের ছবির লোড নিতে পারতেছে না।”
-“মাত্র একহাজার! কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করো আরো একহাজার আসবে। আমার বন্ধুরা এতো কম সেলফি তোলে না, ওদের প্রেস্টিজে লাগে।”

মুহুর্তেই আরো একহাজার দুইশো ছবি এসে জমা হলো। আঁধার অবাক দৃষ্টিতে তাকালো চাদনীর দিকে।বন্ধুদের প্রতি কি কনফিডেন্স! ছবি গুলো চেক করতে গিয়ে আঁধারের কপালে ভাজ পরে।সবাই মিলে অনেকগুলো গ্রুপ পিক তুলেছে। আবার হাসনা আর বৃষ্টি রাতের সাথে সিঙ্গেল সেলফি তুলেছে। আঁধার দ্রুত চেক করলো চাদনীর সাথে এমন কোনো ছবি আছে কিনা। নেই দেখে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ও।
আঁধার নেতার ছবি জুম করে করে দেখে। ছেলেটা সুন্দর, হ্যান্ডসাম। তবে ওর মতোই, ওর চেয়ে খুব বেশিও সুন্দর না। কিন্তু আঁধারের হিংসা হয়, গায়ের রংটা ওর চেয়ে বোধহয় একটু উজ্জ্বল। তাও বেশি না সামান্যই। তবুও এ সামান্যটুকু আঁধারের সহ্য হলো না। ও চাদনীকে বললো

-“নেতা দেখি ফিল্টার মাইরা ছবি তোলে!”
-“ফিল্টার নেতা মারে নাই। হাসনা আর বৃষ্টি মারছে। মেয়েরা ফিল্টার ছাড়া ছবি তুলতে পারে না।”
-“তারপরও দেখ চাঁদ, ওনার চেয়ে আমার মুখে মায়া বেশি।আমি ওনার চেয়ে বেশি কিউট না?”
-“অতো কিছু তো বুঝি না। ওনি হাসে না, গম্ভীর থাকে অলওয়েজ। নয়তো ওনাকেও কিউট লাগতো।”
-“এটাও খেয়াল করেছিস?”
-“হ্যাঁ, তোমার চেয়ে বেশি ফরসাও।”
চাদনী বাঁকা হাসলো। আঁধার ওর পাশ ঘেঁষে বসলো। হুড়মুড়িয়ে বললো
-“ওনি তো ফিল্টার দিয়েছেন। আমার চেয়ে বেশি ফরসা হয় কী করে?”
-“বাস্তবেও বেশি ফরসা। সামনাসামনি দেখেছি!”
চাদনী একটু বেশিই ডেসক্রাইব করলো।

আঁধার ফুঁসতে থাকলো। চাদনী মনে মনে খুব আনন্দ পেলো৷ উফ! ওঁকে গায়ের রং নিয়ে খোঁটা দিতে ছেলের মুখে বাঁধে না। অথচ নিজের বেলায় নিতে পারছে না।
আঁধার অনেকটা সময় ওর মোবাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করলো। তারপর চাদনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো
-“ধর। অসুস্থ বলে ছেড়ে দিলাম।নয়তো আজ তোর গলা আমি সত্যিই টিপে দিতাম।”
আধার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো চাদনীর দিকে। দু’দিন চলে গেছে। অথচ এখনো চাদনীর গালের দাগ যায়নি। পাঁচ আঙুলের দাগ এখনো স্পষ্ট। মনে হচ্ছে খোদাই করা হয়েছে। আগে লাল ছিলো, এখন বাদামি রঙ ধারণ করেছে। আঁধারের বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। কি জানোয়ারের মতো মেয়েটাকে মেরেছে ! কতোটা অমানুষ ও!
আঁধার উদগ্রীব স্বরে বললো

-“তোর গালে একটা চু*মু খাই চাদনী?”
চাদনীর চোখে স্পষ্ট আ*ক্রোশ। আঁধারের মুখ খামছে দিতে চায়ছে যেন! কাল রাতেও বদমাশ ছেলেটা অনেক উল্টাপাল্টা কাজ করেছে ওর সাথে। এদিকে ওঁকে কালির ড্রাম বলে, কাইলানি বলে। আবার ওর সাথে ঘেঁষে বসে, এসব উল্টাপাল্টা করে ওর সাথে।
আঁধার ওর গালের উপর তর্জনী ছুঁয়ে বললো
-“লাল হয়ে,ফুলে আছে! আমার ঠোঁটের স্পর্শ না পাওয়া পর্যন্ত ব্যাথা কমবে না। ব্যাথা কমাতে চায়লে আমাকে চু*মু খেতে দে!”
-“আমি বাবাকে সব বলবো আঁধার ভাই। কী কী করতেছো তুমি আমার সাথে।”
-“ছি চাঁদ! এসব চাচ্চুকে গিয়ে বলবি! স্বামী চু*মু খেতে চায়লে সেটা বাবাকে গিয়ে বলতে হয়? মান-সম্মান তো কিছু রাখবি না দেখছি!”

-“তুমি যে আমাকে মেরেছো, সেটা আমি বাবাকে বলবোই। তাহলে বাবা অবশ্যই আমাকে নিয়ে যাবে এখান থেকে!”
চাঁদনীর কথা শেষ করার আগেই, আঁধার জোর করে চু*মু খেলো ওর গালে। চাদনী হাতের তালু দিয়ে গাল মোছে। এমনভাবে অপ্রকৃতস্থভাবে গালে চাপ প্রয়োগ করে যেন চামড়া উঠিয়ে ফেলবে। আঁধার টেডি হেঁসে, এটিটিউড নিয়ে বললো
-“দেখিস আজ রাতের মধ্যেই ব্যাথা কমে যাবে৷ আমার ঠোঁটে জাদু আছে রে চাঁদ!”

চাদনী মুখ বাকিয়ে ফোন দেখে। ছবি গুলোর অবস্থা দেখে বিমুঢ় দৃষ্টিতে আঁধারের দিকে তাকায়। প্রতিটা ছবিতে রাতের অবস্থা দফারফা করে দিয়েছে ও। কিছু ছবিতে রাতকে ক্রপ করে দিয়েছে। বাকি ছবি যেগুলোতে রাত মাঝখানে অর্থাৎ ক্রপ করা যাচ্ছিলো না সেখানে রাতের মুখে ইমোজি দিয়ে দিয়েছে। সাথে এডিট করে উল্টাপাল্টা ড্র করে দিয়েছে রাতের ফেইসে। আঁধার মাথা রেখে শুয়ে পরলো চাদনীর কোলে। ছেলেটা এমন বাচ্চামো করতে পারে, চাদনীর জানা ছিলো না। অথচ নিজেকে বিগ ম্যান, জেন্টেলম্যান বলে।যেখানে কাজ কাম বাচ্চাদের মতো।চাদনী এতোটাই অবাক হলো যে আধারকে কিছু বলতে পারলো না।

আকিব শিকদার অনেক্ক্ষণ ধরে কল করছিলেন চাদনীর মোবাইলে৷ কিন্তু চাদনী ঘুমে থাকায় রিসিভ করতে পারছিলো না।জ্বর হওয়ার পর থেকেই মেয়েটা খালি সময়ে অসময়ে পরে পরে ঘুমাচ্ছে। আর ওর ঘুম এতো শক্ত, ভূমিকম্পে দালান খসে পরলেও ঘুম ভাঙবে না। আকিব শিকদার আর না পেরে আঁধারের মোবাইলে কল করলো। ও তখন ড্রইংরুমে বসে বসে মুভি দেখছিলো। আকিব শিকদার চাদনীর সাথে কথা বলতে চাইলেন। আঁধার উপরে উঠে এলো। এসে দেখলো চাদনী ঘুমাচ্ছে। ওদিকে আকিব শিকদার ডেস্পারেটলি কথা বলতে চায়ছে ওর সাথে।
আঁধার আর উপায় না পেয়ে চাদনী কে ডাকলো। চাদনী পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো।

-“চাঁদ, চাচ্চু কল করেছে। কথা বলতে চাচ্ছে তোর সাথে।”
চাদনী ঘুমঘুম স্বরে বললো
-“আমার ইচ্ছে করতেছে না।আমি ঘুমাবো এখন।”
আঁধার অবাক হলো। চাদনী কথা বলতে চাচ্ছে না ওর বাবার সাথে। যেখানে মেয়েটা ওর বাবার অন্তঃ প্রাণ। বাবাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না।আঁধার উদ্বিগ্ন স্বরে বললো
-“কথা কেন বলবি না?তোকে দেখতে আসেনি বলে রাগ করেছিস? বাবার উপর রাগ করে কেও!
-“তুমিও তো বড়বাবার উপর রাগ করেছিলে, একটা কালির ড্রাম তোমার উপর গছিয়ে দিয়েছিলো বলে। মাসকে মাস ফোন পর্যন্ত করনি, খবর পর্যন্ত নাওনি। আসলে সব দোষ খালি আমার ক্ষেত্রেই হয়।”
আঁধার কি বলবে বুঝতে পারলো না। মেয়েটার রাগ জায়েজ। অনেকদিন ধরে চাদনী ওর বাবাকে বলছিলো ওঁকে নিতে আসতে। অনেকবার কেদেছেও।অথচ আকিব শিকদার নিজের ব্যবসার কাজে এতোটাই ব্যস্ত যে সে নিজের মেয়েকেও দেখতে আসতে পারছে না। আঁধার নরম স্বরে, বুঝ দিয়ে বললো

-“চাচ্চু আসতে চেয়েছিলো তোকে নিতে, আমিই মানা করেছি। আর কয়েকদিন পর থেকে তোর মিডটার্ম এক্সাম। এখন চট্টগ্রামে গেলে পড়াশোনার হিউজ একটা গ্যাপ পরে যাবে।”
-“তোমার চাচ্চু কাল পুরোদিন কোথায় ছিলো? আমি মরে গেছি কি-না একবার খবরও তো নিলো না!”
-“চাচ্চু বিজি ছিলো ইয়ার। সব বিষয়ে এতোটা দোষ ধরলে তো হয় না।”
-“তোমার চাচ্চুর সব ব্যস্ততা খালি আমার ক্ষেত্রেই। একটা ফোন পর্যন্ত করা যায় না আমাকে। আমার প্রতি তার কোনো দায়িত্ব নেই। তাই দু’দিন পরপর কল করে বাবার দায়িত্ব পালন করতে মানা করো।”
চাদনী মাথার উপর ব্ল্যাঙ্কেট টেনে দিলো।আঁধারের খুব লজ্জা লাগলো আকিব শিকদারকে এসব বলতে। ও ফোন নিয়ে রিয়ালাইজ করলো আকিব শিকদার কল কেটে দিয়েছেন। হয়তো তিনি সব শুনে ফেলেছেন।

পুরোদিন চাদনী মোটামুটি সুস্থ থাকে। জ্বর একশো ডিগ্রির উপরে উঠে না। কিন্তু সন্ধ্যা হতে না হতেই একশো চার ডিগ্রি জ্বরে কাহিল হয়ে পরে ও। চোখ মেলতে পারে না। আঁধারের তখন অবস্থা খারাপ হয়। ভয় লাগে। ও চাদনীকে সামলাতে পারে না।
আঁধার ঘরময় পায়চারি করছে। দু’দিন ধরে এ সিচুয়েশন ফেইস করছে ও। তারপরও স্টেবল হতে পারছে না। ইদানীং সবাই খুব বেশি ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। আর এ জ্বরটা খুব মারাত্বক। চাদনী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আঁধার থেমে থেমে চাদনীকে দেখছে আবার পায়চারি করছে।
চাদনী ক্ষীণ স্বরে, থেমেথেমে ডাকলো

-“দাদাভাই!”
আঁধার দৌড়ে গেলো ওর কাছে। ওকে ব্ল্যাঙ্কেটের উপর থেকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বললো
-“চাঁদ, এই চাঁদ। আমার দিকে তাকা একটু।”
চাদনী চোখ বন্ধ অবস্থায় কোনোমতে বললো
-“আব্বুকে একটা কল দাও না! আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আব্বু রাগ করেছে আমার উপর। আমি এভাবে বলতে চাইনি।”
আঁধার কল করলো আকিব শিকদার কে। তবে তিনি ফোন রিসিভ করলেন না। দু-তিন বার কল করার পর আঁধার অসহায় স্বরে বললো

-“রিসিভ করছে না।”
-“আমার জন্য কোনোদিন সময় থাকে না ওনার। আমার কোনো দাম নেই, কারো কাছে।”
চাদনীর চোখের কার্ণিশ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল গড়ালো আঁধার আলতো হাতে মুছে দিলো। চাদনীর গালের সাথে গাল ঠেকিয়ে বসে থাকলো অনেকটা সময়। ওর গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।
আধার ওয়াশরুমে গিয়ে বালতি ভরে পানি নিয়ে এলো। চাদনীর মাথায় মগ দিয়ে পানি ঢালতে থাকলো অনেকটা সময়। অনেক্ষণ পর চাদনীর গায়ের তাপমাত্রা একটু কমলো।
আঁধার ডাকলো

-“চাঁদ!”
-“হু।”
-“ঠিক লাগছে এখন একটু?”
-“নাহ।একটুও ঠিক লাগছে না। অনেক কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে মরে যাবো।আমি মরে গেলেও বাবাকে আসতে বলবে না।”
আঁধার ঢোক গিলে বললো
-“এরকম কেন বলছিস! তুই মরে গেলে আমি কোথায় যাবো! আমার বাড়ি টা আবার খালি হয়ে যাবে। আমি আবার একা হয়ে যাবো। আমি কাকে গালাগাল করবো? কাকে খোঁচা মারবো? তোরে বিরক্ত করা ছাড়া আমার একটা দিন কাটে না। তোকে জ্বালানোর যে শান্তি সেটা আর কোনোকিছুতে নাই। তোরে প্রিজার্ব করে রেখে দিব আমি কেমন!”
চাদনী ছোট ছোট চোখ করে তাকালো। আঁধার হাসলো। বিমর্ষ চিত্ত বললো
-“চাঁদ রে, আল্লাহ তোকে সুস্থ করে দিবে৷ তোর কষ্টগুলো আমি আর নিতে পারতেছি না। আমার থেকে তোর মুক্তি নাই। মরেও মুক্তি পাবি না আমার থেকে, যতদিন না আমি মারা যাই ততোদিন।

শাবিহা বসে আছে ওর কক্ষে।আঁধার কেমন যেন গায়েব হয়ে গেছে। অনলাইনে নাই, ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।ভার্সিটিতে পর্যন্ত আসছে না। আসবে কি করে! ও তো চাদনী কে নিয়েই আছে, সারাক্ষণ চাদনীর ফোন নিয়ে বসে থাকে। নিজের ফোন নেওয়ার সময় কোথায় আধারের! কিন্তু এসব তো শাবিহা জানে না। ও চায়লেই আঁধারের ফ্ল্যাটে যেতে পারে। কিন্তু ওর ইচ্ছে করে না। ও চাদনী কে দেখতে পারে না। ওর কষ্ট হয়! মনে হয় একটা ছোট্ট মেয়ে ওর প্রিয় মানুষটার ভাগ নিয়ে নিয়েছে। বিদ্বেষ ছড়ায় হৃদয়ে। শাবিহা এসব ভাবনায় বুদ ছিলো,রাত তখন রেগেমেগে ঢুকলো ওর কক্ষে।
শাবিহা হকচকিয়ে বললো

-“ভাইয়া।”
রাত কখনো ওর কক্ষে নক করা ছাড়া আসে না। ইভেন আসেই না। ওই যায় রাতের কক্ষে রাতের সাথে দেখা করতে।
রাত রাগী কন্ঠে বললো
-“কোন ছেলের খোজ নিতে বলেছিস তুই আমাকে। যে তোর বয়ফ্রেন্ড ছিলো সে ছেলেটা এখন বিবাহিত! তুই একটা বিবাহিত ছেলেকে ভালোবাসিস, শাবিহা!”
শাবিহা জানতো রাত এটা অবশ্যই জানতে পারবে। রাতের পক্ষে খবর পাওয়া কোনো টাফ বিষয় না। তবুও ও লুকিয়েছিলো। রাতকে এটা বলার সাহস হয়নি। রাত আবারো বললো

-“উত্তর দে। চুপ করে আছিস কেন?”
-“আমি যখন তাকে ভালোবাসতাম তখন সে বিবাহিত ছিলো না।আমি কোনো বিবাহিত ছেলেকে ভালোবাসিনি। বরং আমি ভালোবাসার পর, সম্পর্কে যাওয়ার পর সে বিয়ে করেছে।”
শাবিহা অস্হির স্বরে বললো।রাত শান্ত কন্ঠে বললো
-” যেভাবেই হোক বিয়ে হয়েছে। একটা বিবাহিত ছেলেকে আবদার করছিস আমার কাছে। লজ্জা করলো না তোর? অবশ্য লজ্জা করবে কেন, মায়ের থেকেই তো শিখেছিস এসব!”
শাবিহা নিজের ওড়নার কোনা চেপে ধরলো। রাত এখন ওর মা’কে নিয়ে কথা শোনাবে ওঁকে। যতই হোক, ওর মা যতো খারাপ কাজই করুক, তবুও ওর মা। শাবিহার খারাপ লাগবে।
শাবিহা জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো
-“আমার ভালোবাসা অপরাধ ভাইয়া?”
-“ভালোবাসা অপরাধ না শাবিহা। কিন্তু আরেকজনের স্বামীকে চাওয়া অপরাধ। একটা সংসার ভাঙা অপরাধ, অনেক বড় অপরাধ।তুই তোর মায়ের মেয়ে কিন্তু পাশাপাশি আমার বোনও। আমি তোকে এতো বড় অন্যায় করতে দেবো না।

শাবিহার ভয় লাগছে। রাত সহজে রাগে না। খুব শান্ত একটা ছেলে ও। কিন্তু রাগলে সব শেষ করে দেয়।ধ্বংসাবশেষও রাখে না। শাবিহা মনে সাহস সঞ্চার করে বললো
-” আমি ওঁকে ভালোবাসি ভাই। আমার ওঁকে চাই। আমি ওঁকে অনেক ভোলার চেষ্টা করেছি।মনকে বুঝ দিয়েছি সে বিবাহিত। কিন্তু আমি মুভ অন করতে পারছি না। আমি ওরে ভুলতে পারছি না।
রাত এবার রেগেমেগে বললো

-“ভালোবাসলেই হলো! আরেকজনের স্বামীর উপর নজর দিস লজ্জা লাগে না।মেয়েটার কী হবে একবারো ভেবেছিস? তোর জন্য আরেকটা মেয়ের গায়ে ডিভোর্সি ট্যাগ লাগবে।”
-“তাতে আমার কী? আমি কেন অন্য মেয়ের কথা ভাবতে যাবো! আমার শুধু আমার ভালোবাসা কে লাগবে৷ আমি শুধু আমার কথা ভাববো, অন্য মেয়ে চুলোয় যাক। তুমি যদি তাকে আমার করে দিতে না পারো, তাহলে আমি নিজেরটা নিজেই ভেবে নিবো। আর তুমি আমাকে আটকাতে পারবে না।”
শাবিহা পুরোটা সময় মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিলে। একপলক রাতের পানে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেললো ও। রাত নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো শাবিহার দিকে।
ক্ষণকাল পর একপেশে হেঁসে বললো

কাজলরেখা পর্ব ২৫

-“আমি ভেবেছিলাম, তুই আমার বোন। তোর মাথায় অন্তত এসব আসবে না। তুই আমার কষ্ট দেখিসনি শাবিহা?একটা ব্রোকেন ফ্যামিলি কেমন হয় বুঝোস?তোর মা খুব শান্তিতে আছে, আমার মা’কে অশান্তিতে ফেলে? বারো মাসের মধ্যে এগারো মাস তোর মা-বাপের কথা বন্ধ থাকে। সে অন্যের সংসার ভেঙে সুখী হতে পারেনি, তুইও পারবি না।আমিই বোকা রে। আমি তোকে ওই মহিলার মেয়ে না ভেবে নিজের বোন ভেবেছি।কিন্তু আমার মাথায় রাখা উচিত ছিলো, রক্ত নিজের আসল রূপ তো নিশ্চয়ই দেখাবে। তোর মা আমার মায়ের সংসার ভেঙেছে। কিন্তু তোকে আমি আরেকটা মেয়ের সংসার ভাঙতে দেবো না। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নে।”

কাজলরেখা পর্ব ২৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here