কাজলরেখা পর্ব ২৭
তানজিনা ইসলাম
প্রায় একসপ্তাহ যাওয়ার পরও চাদনীর জ্বর ছাড়লো না। এন্টিবায়োটিক খাওয়াতে খাওয়াতে আঁধার অবস্থা কাহিল করে ফেললো ওর। সাথে ওর এক্সট্রা রেস্ট্রিকশন তো আছেই। চাদনী কক্ষের বাইরে পর্যন্ত বেরোতে পারেনি, এতোটা দুর্বল ছিলো ও। আঁধার অনেকবার সরি বলেছে ওঁকে। ও এভাবে মারতে চায়নি, রাগ উঠেছিলো, কন্ট্রোল করতে পারেনি, চাদনীর অবস্থা দেখে এখন ভীষণ অপরাধবোধ ভুগছে ব্লা ব্লা। অথচ চাদনী সরি টা একসেপ্ট করতে পারছে না। ওর মনে ফুটে আছে এখনো সে রাতটা। সে রাতে ঘটা প্রত্যেকটা ঘটনা ওর জন্য নাইটমেয়ার ছিলো। আঁধার কে মাফ করতে পারছে না ও কোনোমতেই।
তটিনী প্রতিদিন আসে ওঁকে পড়াতে। ও জ্বর গায়েই তটিনীর কাছে পড়তে বসে। আঁধার অবশ্য মানা করেছিলো এতো অসুস্থতা নিয়ে পড়াশোনার দরকার নেই। চাঁদনীই জোর গলায় বলেছিলো ও পড়বে। মিডটার্মে দরকার হলে ফেইল আসুক, তবুও ও এক্সাম দেবে। এমনিতেই টিউটোরিয়াল পরীক্ষা একটাও দিতে পারেনি চাদনী। আঁধার ওর কলেজে গিয়ে প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে এসেছে।
ক্লাসের গ্রুপে নোটিশ এসেছে, আর কয়েকদিন পর থেকে মিডটার্ম পরীক্ষা। এদিকে চাদনীর একটা চ্যাপ্টারও ভালো করে পড়া হয়নি। ও খুব সমস্যায় পরে গেছে। প্রথম থেকে স্টেপ বাই না পড়ার ফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ও।তারউপর একটাও প্র্যাক্টিকাল লিখা হয়নি ওর, ওদিকে ক্লাসের সবাই সাইনও নিয়ে ফেলেছে। চাদনীর অবস্থা, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। সব একসাথে এসে পরেছে মাথার উপর।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আঁধার ওঁকে প্র্যাক্টিকাল লিখতে হেল্প করেছে। নিজের পড়াশোনা ম্যানেজ করে, চাদনীকে প্র্যাক্টিকাল লিখে দিয়েছে।
চাদনীকে এখন আঁধারের রুমেই থাকতে হয়। চাদনী অনেক রিকুয়েষ্ট করেছে ওঁকে ওর রুমের চাবি দিয়ে দিতে।
প্রথমদিন থেকে থাকতে থাকতে ঘরটার উপর মায়া বসে গেছে। আঁধারের রুমে কম্ফোর্টেবলি থাকতে পারে না ও। আঁধার শোনেনি। পরে অবশ্য চাদনী পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়ায় ওঁকে রুমের চাবি দিয়েছে৷
পড়াশোনা ও নিজের রুমে করে।রাত হলে আঁধার টেনে নিয়ে যায় ওঁকে নিজের রুমে। শুধু পড়ার জন্যই ও নিজের রুমে আসতে পারে, অন্যথায় সব কাজ ওঁকে আঁধারের রুমেই করতে হয়। বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়ার বর্ডার থাকে ওঁদের মাঝে। কোলবালিশের দুপাশে দু’জন মানুষ, একটা শব্দ কথা বলে না একজন আরেকজনের সাথে। তবুও আঁধার কে নিজের জেদ রচাতেই হবে। এখন সিআইডির মতো পিছে পরেছে চাদনীর। কোনো কাজ চাদনী শান্তিতে করতে পারছে না।
চাদনী পড়ছে। রাত বাজে বারোটা। আঁধারের রুমে না যাওয়ার জন্য এখন ও পড়াশোনার পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পড়া না থাকলেও টেবিলে বসে থাকে। যাতে আঁধার ডাকতে এলে বলতে পারে, এখন পড়ছে ও, ওই কক্ষে যেতে পারবে না। আঁধার শুধু এই একটা ব্যাপারেই চাদনীর সাথে জোর করে না।
চাদনী পৃষ্ঠা ভরে ম্যাথ করে ক্লান্ত হয়ে কলম রাখলো। অনেকক্ষণ ধরে পিঠ ঠেকিয়ে বসতে বসতে, পিঠ ব্যাথা হয়ে গেছে।চাদনী গা ছেড়ে বসলো৷ মোবাইলে একটা গান প্লে করে, শুনতে থাকলো। অন্যমনস্ক হয়ে দরজার দিকে তাকাতেইবুক ধ্বক করে উঠলো ওর।
চাদনী আতঙ্কে চিল্লানি দিলো
-“আআআআাা!”
আঁধার বুকের সাথে দু-হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর মুখে হালকা গোলাপি রঙের মিশ্রণের প্রলেপ লেপ্টানো। চুলগুলো কপালের উপর পরে আছে সবসময়ের মতো। চাদনী উদ্বিগ্ন স্বরে আওড়ালো
-“এগুলো কী? আমি তোমাকে ভুত ভেবেছিলাম।”
আঁধার এগিয়ে গাঁটা মারলো ওর মাথায়।নাকমুখ কুঁচকে বললো
-“এই তোর পড়াশোনা৷ আয় আমার সাথে, আয়।”
চাদনী তড়িঘড়ি করে বললো
-” আরে আমি সত্যিই পড়ছিলাম।ম্যাথ করার ফাঁকে একটু ব্রেক নিয়েছিলাম, তখনই তুমি এলে। অথচ পড়ার সময় দেখো না। আমি যাবো না। আমি এখন থেকে এখানেই থাকবো।”
-“তুই যাবি না, তোর ঘাড় যাবে।”
-“প্লিজ আজকে আমার অনেক পড়া আছে।”
-” তো পড় মানা করেছি আমি তোকে!”
আধার গিয়ে বিছানার উপর বসলো। চাদনী অনুরোধ করে বললো
-“আজকে থেকে এখানে থাকি?”
-“থাক। আমি কি মানা করেছি না-কি! ”
চাদনী মুখ বাকালো। আঁধার মানা করে না, ট্রলি ব্যাগের মতো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। আঁধার বললো
-“পরশু থেকে না তোর এক্সাম? প্রিপারেশন কেমন?”
-“ভালো না!”
-“কোনোমতে টেনেটুনে পাশ করে ইজ্জত টুকু রাখিস আমার!”
চাদনী আঁধারের দিকে তাকালো৷ উদগ্রীব স্বরে বললো
-“তোমার মুখে এগুলা কী?”
-“ফেইস প্যাক!”
-“ছেলেরাও ফেইস প্যাক দেয়?”
-“বাংলাদেশের কোন সংবিধানে লেখা আছে ছেলেরা ফেইসপ্যাক দিতে পারবে না?”
আঁধার মুখ ধুয়ে আসলো বেসিন থেকে। চাদনী মুখ লটকে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। আঁধার টাওয়েল দিয়ে মুখ না মুছে, টিস্যু দিয়ে আলতো করে মুখ মুছলো। বিছানার উপর বসে লিকুইড মাখতে থাকলো মুখে। চাদনী প্রশ্ন করলো
-“আবার এগুলো কী দিচ্ছো মুখে?”
-“সিরাম। চিনিস না?”
-“না তো!”
-“তোকে আমি এমনি এমনি গাইয়া বলি!”
চাদনী মুখ বাকালো।নাক কুঁচকে বললো
-“এসব দিলে কী হবে?”
-“ধবধবে ফর্সা হয়ে যাবো।এগুলো দিলে স্কিন কাঁচের মতো উজ্জ্বল হয়ে যাবে, চকচক করবে।যাকে বলে গ্লাস স্কিন। আমার মুখ সফ্ট আর স্মুথ হয়ে যাবে।তাহলে আর নেতার দিকে চোখ যাবে না তোর!সিরাম ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে, হাইড্রেট করে এবং উজ্জ্বলতা আনে।”
আঁধার ব্যাখ্যা করলো। চাদনী অবাক স্বরে বললো
-“সিরিয়াসলি আঁধার ভাই! ওই কথার রেশ ধরে এতো তোড়জোড় শুরু করেছো। যথেষ্ট ফর্সা আছো। তোমার গায়ের রং আমার ড্রিম।অথচ তুমি আরো ফর্সা হতে চাচ্ছো। আল্লাহর দেওয়া সৌন্দর্য নিয়ে কেন সেটিসফাইড হতে পারছো না! এসব মেখো না, স্কিন খারাপ হয়ে যাবে আরো!”
-“হ, তোরে কইছে! তুই বেশি জানোস! আমি নিজের উপর অনেক কন্ফিডেন্ট ছিলাম, বাট ওইদিন তুই আমার কন্ফিডেন্স ভেঙে গুঁড়া গুড়া করে দিয়েছিস। নেতাকে আমার চেয়ে বেশি ফর্সা বলেছিস। এখন আমি তার চেয়েও অধিক ফর্সা হয়ে দেখাবো। আমি আরো সুন্দর হয়ে যাবো চাঁদ, তখন দেখবি আমাকে তোর আরো ভালো লাগতেছে।নেতার দিকে চোখ দেওয়ার সুযোগই পাবি না!”
চাদনী মনোযোগ দিয়ে শুনলো সব কথা। অতিষ্ঠ হয়ে বললো
-“আমি সেসব দুষ্টামি করে বলেছি, আল্লাহ। কেন সিরিয়াসলি নিয়ে নিচ্ছো! এগুলো কোত্থেকে পেয়েছো তুমি?”
-“তটিনী থেকে স্কিন কেয়ার সম্বন্ধে টিপস নিয়ে ছিলাম। ও অনেক কিছু জানে এসব ব্যাপারে। ওই পাঠিয়েছে। আমি বলেছিলাম আমার জন্য অর্ডার করে দিতে। এসব অনলাইনে অর্ডার করেছে।”
-“এগুলোর নাম কী?”
-“একটু আগে যেটা মেখেছিলাম, ওটা হলো ফেইসপ্যাক, ফ্রেশ রোজ ফেইস মাস্ক। আর এটা হলো ল্যাঙ্কম অ্যাডভান্সড জেনিফিক ইয়ুথ অ্যাকটিভেটিং সিরাম।”
-“বাবাগো! কি কঠিন নাম!”
-“ট্রাই করবি?”
চাদনীর ইচ্ছে করলো, ওরও ফর্সা হতে মন চায়লো আঁধারের মতো। চাদনী উপর-নীচ মাথা নাড়ে। আঁধার নাকোচ করে বললো
-“না,থাক। যেভাবে আছিস সেভাবেই ঠিক আছে৷ এই রূপেই নেতা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকিস তুই। এখনই এই অবস্থা!ফর্সা হয়ে গেলে দেখা যাবে আমাকেই ছেড়ে চলে গেলি, আরেকজন কে নিয়ে। সে ভুল তো আমি করছি না চাদনী! তোকে তো আমি যেতে দেব না।”
চাদনী কিছুক্ষণ বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে৷আবার ম্যাথ করায় মনোযোগ দিলো। আঁধার বসে থাকলো বিছানার উপর। একটু পর চাদনী বললো
-“দাদাভাই, একটা ম্যাথ সল্ভ করে দিবা?”
-“কোন চ্যাপ্টারের?”
-“জটিল সংখ্যা!”
আঁধার এগিয়ে এসে ওর পাশে টুল নিয়ে বসলো। হায়ার ম্যাথ বই হাতে নিয়ে সামনের চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে বললো
-“জটিল সংখ্যা পারিস না! ছিহ। বুঝছি, তোর রেজাল্ট কেমন হবে! ইজ্জত যাবে আমার!”
-“দাও তো দাও। এমনিতেই এতোগুল চ্যাপ্টার একসাথে সল্ভ করতে গিয়ে পাগল হওয়ার জোগাড় আমার। তোমার বাঁশ খেতে পারবো না!”
চাদনী টেনে নিতো চায়লো ওর বই। আঁধার শক্ত করে ধরে বললো
-” ওয়েট, করে দিচ্ছি। রাগছিস কেন!”
আঁধার ম্যাথটা সল্ভ করে চাদনী কে বোঝালো। চাদনী বুঝতে না পেরে বললো
-“আরেকবার বলো!”
-“এতো সহজ বিষয়টা বুঝছিস না!”
চেচালো আঁধার। চাদনী ঝাঝালো স্বরে বললো
-“তোমার মতো অতো ব্রিলিয়ান্ট না আমি!”
আঁধার মাথা ঠান্ডা করে আরেকবার বোঝায় চাদনীকে। এদিকে চাদনীর মাথা হাইপার থাকায় এবারেও বুঝলো না ও। আঁধার আবার চেচালো
-“ধুর! তুই একটা বলদ! পড়াশোনা হবে না তোকে দিয়ে।”
চাদনী এর চেয়েও জোরে চেচালো
-“যাও তো যাও। এর চেয়ে তটিনী আপু ভালো বোঝায়। তুমি আসলে বোঝাতেই পারো না! দোষ দিচ্ছো আমার উপর!”
-“তুই একটা ফালতু স্টুডেন্ট। ঘোড়ার ডিম জানিস তুই! ফেইল করবি, অভিশাপ দিলাম। বড়োদের রেস্পেক্ট করতে জানোস না, বিয়াদব।”
-“এই আঁধার ভাই, একদম উল্টাপাল্টা অভিশাপ দিবা না!ধুর আমি পড়বোই না তোমার কাছে!”
আঁধার উঠে দাঁড়িয়ে তপ্তস্বরে বললো
-“তোরে পড়াবোও না আমি। সহজ কথা একবারে বুঝোস না। মাথায় উল্টাপাল্টা জিনিস ঘোরে তোর, তাই ম্যাথ ঢুকতেছে না!”
চাদনী ফুসতে থাকলো। আঁধার গিয়ে শুয়ে পরলো বিছানায়। গলা পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট টেনে, ঘুমানোর ভং ধরলো। চাদনী এবার উচ্চস্বরে বললো
-“এখানে কেন ঘুমাচ্ছো তুমি? এটা আমার রুম!”
-“আমার ইচ্ছে। এখানেই থাকবো আজ রাতে। আর আস্তে চিল্লা! তোর বাঁশের মতো গলার সাউন্ড টা কমা।”
চাদনী মুখ ফেরালো। মুডটাই খারাপ করে দিয়েছে, এই ছেলেটা। কতো সুন্দর ম্যাথ করছিলো। চাদনী এতোদিন ভেবেছিলো আঁধার চায়লেই তো ওঁকে পড়াতে পারে। আঁধার নিঃসন্দেহে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, ওর চেয়েও অনেক অনেক বেশি। তাহলে তটিনী আপু কে রাখলো কেন? আজ চাদনী বুঝতে পারলো আঁধার তটিনী কে রাখলো কেন? এই যে একবার বোঝাতে না বোঝাতেই হাইপার হয়ে গেছে। চিল্লাপাল্লা শুরু করেছে ওর উপর! সেখানে তটিনী একটা টপিক তিন-চার বার করে বোঝায়। পারলে বলতে বলতেই চাদনীকে মুখস্থ করিয়ে দেয়। আঁধারের নিজের রাগ কন্ট্রোল করে চাদনীকে বোঝানোর সময় কই? চাদনী মুখ বাকালো। আবারো পড়ায় মনোনিবেশ করলো ও।
চাদনী একটানা পড়লো অনেকটা সময়। পিছু ফিরে আঁধার কে দেখলো। ওর মনে হচ্ছে আঁধার এমনিতেই চোখ বন্ধ করে আছে, ঘুমায়নি। ও ডাকলো
-“দাদাভাই!”
-“হু!”
-“ঘুমালে না?”
-“লাইট জ্বলতেছে। ঘুম তো আসে না৷ ”
আঁধার চোখ মেলে বললো।চাদনী বললো
-“আমার এখনো পড়া বাকি। তুমি তোমার রুমে গিয়ে শোও। লাইটের আলোয় কেমনে ঘুম আসবে? তোমার তো আমার মতো আলোয় ঘুমানোর অভ্যাস নেই।”
-“সমস্যা নেই। আমার ওখানে একলা থাকতে ইচ্ছে করছে না।”
-“আগে কী করে একলা থাকতে?”
-“আগে তো তুই ছিলি না। আমার একা একা লাগে রে সব জায়গায়। তোকে জোর করে নিজের কাছে রাখতে ভালো লাগে!এখন তো তোকে জোর করে নিয়ে যেতে পারবো না, কারণ তোর পড়া। কিন্তু আমি তো এখানে থেকে যেতে পারবো!”
চাদনী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আঁধারের দিকে তাকিয়ে বললো
-“তোমার রাগটা একটু কমানো উচিত তোমার মনে হয় না?”
-“হয়তো! কিন্তু পারি না। তুই জানোস চাঁদ, আমি একজন স্যাডিস্ট মানুষ!”
-“কীরকম?”
-“যার পুরোটা সময় স্যাডমুড অন থাকে। ওরা নিজেরাও ভালো থাকে না। অন্যকেও ভালো থাকতে দেয় না। নিজেও কষ্ট পায়। আরেকজনকেও কষ্ট দেয়। নিজেদের রাগ, কষ্ট আরেকজনের উপর এপ্লাই করে।”
-“তোমার কীসের এতো কষ্ট আঁধার ভাই? তুমি তো জীবনে সব পেয়েছো। বাড়ির সব সদস্যের ফেবারিট চাইল্ড তুমি। তোমাকে সবাই কতো আদর করে, তোমার কথা মানে। তারপরও কীসের এতো দুঃখ!”
আঁধার বিমর্ষ স্বরে বললো
-“কি জানি! আসলে কি জানোস, আমি না ঢাকায় আসতে চাইনি। বাবা আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে। আমি চেয়েছিলাম চট্টগ্রামে থাকতে, আমার পরিবারের সাথে। বাবা বলেছে আমি না-কি বিগড়ে যাবো, অতি আদরে। আমার একটু জীবনটা দেখা দরকার, ভালো জায়গায় পড়াশোনা দরকার। আমাকে আঠারো বছর বয়সে এখানে একা পাঠিয়ে দিয়েছে। তাই এখানে এসেই বিগড়ে গেছি। ভালো করেছি না?”
-“ভালো করোনি। বড় বাবা খুব কষ্ট পেয়েছে, তোমার কীর্তিকলাপ শুনে!”
-“আর আমার কষ্টটা চাঁদ? আমার কষ্টটা কিছু না? আমার দুঃখগুলো কেও দেখে না কেন! আমি যখন প্রথম ঢাকায় এসেছিলাম, আমি খুব একা হয়ে পরেছিলাম। আমার আম্মুর কথা মনে পরতো, তোর কথা মনে পরতো, মোঝোবাবা, চাচ্চু সবার কথা মনে পরতো। তোর এখানে এখন যেরকম লাগতেছে আমারও তখন এরকম লাগতো। তুই আমার এটলিস্ট আমাকে নিজের কষ্টগুলো দেখাতে পারিস! আমি কাওকে দেখাতে পারিনি ! বাবা সবসময় আমার উপর সবকিছু চাপিয়ে দিয়েছে। আমি কখনো নিজের ইচ্ছেয় কিছু চুস করতে পারিনি।বিষয়টা আমার উপর ধীরে ধীরে এতোটা প্রভাব ফেলেছে যে, আমি উদ্ধত হয়ে গেছি রে। কারো কথা শুনছি না।
তাই যখন তোকে বিয়ে করতে চাপাচাপি শুরু করলো আমাকে আমার৷ ক্ষোভ টা আরো বেড়ে গেছিলো রে। আমি তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমি মানি। সেটা বাবার উপর রাগ থেকে হোক, বা শ্যামলা বলে। বাট আমি তোকে অপমান করতে চাইনি। কিন্তু বাবার করা কাহিণীর কথা মনে পরলেই আমার রাগ উঠতো। সে রাগ তোর উপর ঝাড়তাম। অসুস্থতার নাটক পর্যন্ত করেছে আমার সাথে দেখিসনি। এভাবে সবসময় নিজের অসুস্থতা কে ব্যবহার করেছে। কিন্তু আমি না চাইলে সেদিন কারো সাধ্য ছিলো না তোকে আমার সাথে বিয়ে দেওয়ার।তুই বলেছিলি আমাকে বিয়ে করবি না, তোর ঠেকা নাই। বড়বাবার কথা রাখতে বিয়ের পিড়িতে বসেছিস।এটা আমার খুব গায়ে লেগেছিলো, ইগো হার্ট হয়েছিলো। এজন্য তোকে বিয়ে করেছি, শিক্ষা দেওয়ার জন্য! চাচ্চু অতি আদরে আদরে বাঁদর বানিয়ে ফেলেছিলো তোকে!”
-“শিক্ষা দিতে পেরেছো?”
-“নাহ! কই পারলাম। এখনো তো বেয়াদবি করিস আমার সাথে!’
চাদনী মুখ কালো করে তাকালো। অতিশয় কষ্ট নিয়ে বললো
-“কিন্তু আমি শ্যামলা সেটা কী আমার দোষ? আমি তো নিজেকে বানাইনি আঁধার ভাই। তুমি কখনো ভেবেছো, তুমি যেসব বলতে আমাকে সেসব আমার মনে কি প্রভাব ফেলতো। এমন লাগতো যে কেও আমার বুকটা এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে, ছুড়ি দিয়ে কুচিকুচি করে কাটছে। তুমি আমাকে কুকুরের সাথে পর্যন্ত তুলনা করেছো!আমার চেয়েও এ বাড়িতে একটা কুকুরের দাম বেশি!”
আঁধার মাথা নাড়লো।
-“নাহ! তুই বুঝতে ভুল করেছিস। আমি কেন তোকে কুকুরের মাথে তুলনা করবো? ওটা কতো বড় একটা কথা, জানোস! তুই বলেছিলি চ্যাম্প কে বের করে দিতে। আমি বলেছিলাম তুই চলে যা। কারণ চ্যাম্প আমার একাকিত্বের সঙ্গী ছিলো। তুই বলেছিলি কুকুর পালা হারাম, আমিও জানতাম সেটা। বাট তারপরও তোকে পিঞ্চ মেরে কিছু একটা বলতে হতো আমাকে। তাই বলেছি তোর মতো বোঝাকে পালতে পারলে, কুকুর পালা বড়ো কিছু না। এটা নিতান্তই তোকে কষ্ট দিতে বলেছিলাম, কুকুরের সাথে কই তুলনা করলাম! আমার আসলে ভালো লাগে কেও আমাকে ভুল বুঝলে। কেও আমাকে ইগোয়েষ্টিক, খারাপ, রুড, কর্কশভাষী এসব ভাবলে আমি মনে মনে শান্তি পাই। কেও আমাকে ঘৃণা করলে আমার ভালো লাগে। ভাবি, এতো ভালো হয়ে কী করবো, একদিন তো মরেই যাবো! ভালোবাসা সবাইচায়৷ আমি না-হয় ঘৃণাটুকুই গ্রহণ করলাম।কিন্তু আমি চাই না তুই আমাকে ঘৃণা কর। ভালোবাসাও চাই না তোর। শুধু তোর সঙ্গ লাগবে, আমার সাথে থাকতে হবে তোকে সবসময়।”
চাদনী মলিন হেঁসে বললো
-“তারপরও, বোঝা তো! তোমার উপর তো বোঝা হয়েই আছি!”
-“থাকবি না। তুই অনেক ভালো করে পড়াশোনা করবি। কয়েকবছর পর অনেক স্ট্যাটাস ওয়ালা বড়োলোক হয়ে ফিল্মি স্টাইলে আমার সামনে আসবি। এসে বলবি, মিস্টার আঁধার শিকদার। মনে আছে, আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আপনি আমাকে কালো বলেছেন। অপমান করেছেন। আমাকে বোঝা বলেছেন। আজ দেখুন, সে আপনি কোথায় আর আমি কোথায়? আপনার লেভেল দেখুন আর আমার লেভেল দেখুন। আমি আপনার চেয়েও যোগ্য হয়ে ফিরেছি। তারপর আমি তোকে সরি বলবো। এর বেশি কিছু করতে পারবো না কিন্তু। তারপর তুই উদার মনের মানুষ হয়ে, মহানুভবতা দেখিয়ে আমাকে মাফ করে দিবি।”
চাদনী বিরক্তি নিয়ে বললো
-“হ্যাঁ, জুতা মেরে গরুদান করবা! কোত্থেকে পাও বলোতো এসব?”
-“শাবনুরের মুভি দেখে মোটিভেট হয়েছি। বিগ ফ্যান তো ওর! তারউপর প্রচুর বাংলা মুভি দেখি!
-“কি বলো? তুমি শাবনুরের ফ্যান! আমি তো জানতাম তুমি শুধু ফরেইন মুভি দেখো!”
-“একটু পশ দেখানোর জন্য দেখতে হয়। বাট আমি মনে প্রাণে বাঙ্গালী। বাংলা মুভির ডিশুম ডিশুম অনেক ফেবারিট আমার!”
কাজলরেখা পর্ব ২৬
-“হইছে থামো। নিজেও ঘুমাও।আমাকেও পড়তে দাও!”
-“আচ্ছা! গুড নাইট!”
আঁধার ঘুমিয়ে পরলো। ও অনেকদিন পর চাদনীর সাথে একটু গল্প করতে পেরেছে। এখন শান্তি লাগছে!