কাজলরেখা পর্ব ২৯

কাজলরেখা পর্ব ২৯
তানজিনা ইসলাম

আঁধার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। গতকাল রাতে কোনো এক অজানা কারণে ওর ঘুম হয়নি। ইদানীং চাদনীর জন্য খুব মন পুড়ে ওর। মেয়েটা ওর সাথেই আছে, তবুও বুকের মধ্যে কেমন যেন খালি খালি লাগে! এই অদৃশ্য দূরত্ব ওর ভালো লাগে না। না ভালো লাগে চাদনীর অবজ্ঞা। ওদিকে মেয়েটার এক্সাম কেমন হচ্ছে কে জানে? আঁধার উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখে।
প্রফেসর লেকচার দিচ্ছে বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে। আঁধার আর বন্ধুরা লাস্টের বেঞ্চের আগের বেঞ্চে বসে আছে।
আঁধার মাঝখানে বসে ঘুমাচ্ছে।ওর দু’পাশে গাদাগাদি করে বসেছে আমান, মাহাদী, রাবিব।
সামনে তটিনী আর শাবিহা বসেছে। সবাই ক্লাসে খুব মনোযোগী। আঁধার সেই ক্লাসে আসা থেকেই ঘুমাচ্ছে।
প্রফেসর লেকচার দিতে দিতে ক্লাসের শেষ প্রান্তে এগিয়ে এলেন। আমান কনুই দিয়ে গুঁতো দিলো আঁধার কে। ফিসফিস করে বললো

-“অন্ধকার, স্যার আসছে। উঠ। আজকে তোর ইজ্জত নিলামে উঠবে নয়তো! এই বেডা উঠঠঠ!”
আঁধার চবর্গীয় শব্দ করে হাত সরিয়ে দিলো ওর। তিনজন অনেক গুঁতিয়েও আঁধার কে তুলতে পারলো না। প্রফেসর এর ওঁকে চোখে পরতেই সেখানে দাড়ালেন তিনি। ভ্রু উচিয়ে দেখলেন আঁধারকে। গম্ভীর স্বরে বললেন
-“ও ঘুমাচ্ছে কেন?”
-” অসুস্থ স্যার। হেডেক হচ্ছে তাই হেড ডাউন দিয়ে রেখেছে।”
মাহাদী ঝটপট মিথ্যা বললো। ও মিথ্যা বলায় খুব পারদর্শী। সিচুয়েশন খুব সহজে হেন্ডেল করতে পারে। প্রফেসরের বিশ্বাস হলো না বোধহয় ওর কথা। এমনিতেই আঁধার কে তেমন একটা পছন্দ না ওনার। এই বদমাশ একটা মেয়েবাজ! প্রতি সপ্তাহেই একে নতুন মেয়ের সাথে দেখা যায়, ক্যান্টিনে, লাইব্রেরি তে বসে থাকতে দেখা যায়।
আর এসবের ঘোর বিরোধী তিনি। খালি পড়াশোনায় ভালো হলেই তো হয় না। চরিত্রটাও থাকতে হয়। গম্ভীর স্বরে ডাকলেন

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“আঁধার। এই ছেলে!”
আঁধার উঠলো না। প্রফেসর ধমকালেন।আঁধার চোখ কচলে উঠে বসলো। হামি তুলে, বহু কষ্টে চোখ মেলে স্যারের দিকে তাকালো। ওর চোখদুটো টকটকে লাল হয়ে আছে।প্রফেসর
ভ্রু কুঁচকে বললেন
-“এটা ঘুমানোর জায়গা? লেকচার শোনার দরকার নেই?
রাতে ঘুমোওনি?”
আঁধার মনে মনে কয়েকটা গালি ঝাড়লো। কিন্তু কাতর হয়ে মুখে বললো
-“স্যরি স্যার!”
-“বেরোও ক্লাস থেকে!”
-“বাট স্যার..
-“যাও!”
আঁধার মুখ ফুলিয়ে বেরিয়ে গেলো ক্লাস থেকে। ও নিঃসন্দেহে বেশিরভাগ প্রফেসরের চোখের মনি।গুটিকয়েক প্রেমবিদ্বেষী টিচার ছাড়া বেশিরভাগ টিচারই আঁধারকে ফেবারিট স্টুডেন্ট মানে।ওর প্রেজেন্টেশন, প্রজেক্ট খুব ভালো হয়। আর ফিমেল টিচাররা তো চোখে হারায় বললেই চলে। এ প্রফেসর কে ওর একদম পছন্দ না। সারাক্ষণ খিটমিট করতে থাকে ওর সাথে।

ক্যান্টিনের টেবিলে বসে একটা জবরদস্ত ঘুম দিলো আঁধার। ওর বন্ধুরা সবাই সেই প্রফেসরের ক্লাস করেই ওকে খুজতে বেরিয়ে এসেছে। সবাই ক্যান্টিনে বসে আছে। শাবিহা গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত আঁধারের দিকে।সূর্যরশ্মি গলিয়ে পরছে ওর মুখে। আচ্ছা, ছেলেটা দিন দিন এতো ফর্সা হয়ে যাচ্ছে কেন? কেন এতোটা সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। শাবিহার আফসোস আরো তড়তড়িয়ে বেড়ে যায়। বুকের হাহাকার শূণ্যতা পাল্লা দিয়ে বাড়ে।আঁধার উঠে বসে জিন্সের পকেট থেকে সিরাম বের করে, আবারো সিরাম মাখলো।
ওর চোখের মণি গাঢ় বাদামি।রোদের তাপে জ্বলজ্বল করছে।শাবিহা দৃষ্টি সরালো।ছেলেটা সকাল থেকে কিছুক্ষণ পরপর এসব মাখছে। তটিনীর দিকে তাকিয়ে চিন্তিত স্বরে বললো

-“ও কী পাগল হয়ে গেছে?”
তটিনী উত্তর দিলো
-“ফর্সা হওয়ার ভুত চেপেছে মাথায়।”
-“আর কতো ফর্সা হতে চাচ্ছে ও? এরপর কী কোরিয়ান হবে না-কি!”
-“হয়তো।ওর তো সবকিছুতেই বেশি বেশি। বলদ একটা! ও যে পাগল সেটা আজকের কথা!”
-“তাও ঠিক।”
আঁধার বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো ওঁদের দুজনের দিকে।রাবিব আর আমান মাহাদী কে নিয়ে কথা বলছে। মাহাদী বহু কষ্টে একটা গার্লফ্রেন্ড জোগাড় করেছে। ওর অতিরিক্ত মিথ্যা কথা বলার জন্য কোনো মেয়ে ওর সাথে একমাসের বেশি টিকে না। ওর ধারণা মিথ্যা বলা একটা আর্ট। আর মাহাদী সে আর্টের আর্টিস্ট। মাহাদী ওর গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে এলো, ওর ফ্রেন্ডদের সাথে পরিচয় করাতে। একটা সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে এসে ওঁদের সাথে পরিচয় করিয়ে বললো

-“মিট উইথ হার। আমার গার্লফ্রেন্ড!”
আঁধার অবাক স্বরে বললো
-“আনায়া।”
মেয়েটি খুশি হয়ে ডাকলো
-“আঁধার, তুমি?”
-“তুই ওঁকে চিনিস আঁধার?”
মাহাদীর কথায়, আঁধার আমতা আমতা করে বললো
-“হ্যাঁ। ওঁদের অরিএন্টেশনের দিন পরিচয় হয়েছিলো। ওঁকে কলম দিয়ে হেল্প করেছিলাম।”
-“কোন কলম দিয়েছে জিজ্ঞেস কর!”
আমান ঝটপট বললো।আঁধার আগুন দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো
-“বলপেন দিয়েছিলাম। মেটাডোর অলটাইম!”
মাহাদী কিছুক্ষণ মুখ লটকে তাকিয়ে থাকলো ওদের দিকে।পরক্ষনে হাইপার হয়ে বললো
-“কলমই তো দিয়েছিস না, অন্যকিছু তো দিস নি!”
আঁধার দুপাশে মাথা নেড়ে বললো
-“নাহ! আর কি দেবো? আমার মতো গরিবের কাছে আর কি থাকতে পারে?”
-“আছে আছে।অনেক কিছুই তো আছে। অন্যের গার্লফ্রেন্ডকে পটানোর একটা হাইডেন টেলেন্ট আছে তোর কাছে। আর কি লাগে!”

মাহাদী দাঁতে দাঁত চেপে বলবো। পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে দেখে, আনায়া নিজের ক্লাসের দিকে হাটা দিলো। মাহাদী ধপ করে বসলো চেয়ারে। কপাল চাপড়ে বললো
-“ফ্লার্টিং করার জন্য আমার গার্লফ্রেন্ডটাকেই পেয়েছিলি। এই তুই কিছু করিসনি তো?”
আঁধার ভ্রু কুঁচকে বললো
-“কী করতে বলছিস?”
-“বুঝো না তুমি? সুজি খাও?”
-“আমার বউ আছে রে ভাই, কেন আমি অন্য মেয়ের সাথে উল্টাপাল্টা করতে যাবো।”
-“আমি চাদনী কে সব বলবো আঁধার, দেখিস তুই।
-“বললেও কী? কী করতে পারবে ও আমার?”
গা ছাড়াভাবে বললো আধার।
-“খুউউব অহংকার তোর তাই না? বিশ্বাস কর, আমার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে চাদনীর জন্য। এই বারোভাতারিই পেয়েছিলো ওর কপালে জুটতে!”

-“আমার মতো সুন্দর একটা ছেলেকে পেয়েছে সেটা ওর সাত কপালের ভাগ্য, বুঝেছিস।”
-“সুন্দর ধুয়ে পানি খাবে না ও, নিশ্চয়ই? চরিত্র টা মেটার করে।”
আঁধার ক্ষীণ স্বরে বললো
-“সুন্দর ধুয়ে পানি খাবে না, কিন্তু খাবে তো।”
শাবিহা উঠে হনহনিয়ে চলে গেলো। আমান ধুম করে চাপড় বসালো ওর পিঠে।
-“অশ্লীল! নষ্টা*মি আর কতো করবি!”
-“ভাই আমি কী করলাম?”
রাবিব বিজ্ঞের মতো হাত নাড়িয়ে বললো
-“ভার্সিটির মেয়েদের সাথে রিলেশনে যাওয়ার সম্য, তোরা ভাই একটু সাবধানে রিলেশনে যাস। কোনটা আঁধারের ইউস করা পরে যায়! পরে মাহাদীর মতোই আফসোস করতে হবে।

প্রায় একমাস পর, চাদনীর সাথে ওর বন্ধুদের দেখা হয়েছে।ওরা সবাই কি যে খুশি হয়েছিলো চাদনীকে দেখে।হাসনা আর বৃষ্টি তো শুধু পুরো সময় এটাই ব্যাখ্যা করে গেছে ওরা এই এক মাস কখন কখন, কীভাবে কীভাবে চাদনীকে মিস করেছে। তবে ওঁদের সিট একসাথে পরেনি। শুধু চাদনী আর রেহানের সিট একসাথে পরেছে। ভাগ্যক্রমে দু’জনের রোল কেমন করে যেনো মিলে গেছে।তুমুল কপি পেস্ট মেরেছে একজন আরেকজন থেকে। দু’জনের খাতা মিলিয়ে দেখলে একটা অক্ষরেরও পার্থক্য পাওয়া যাবে না।পেপার বেশ ভালোই গিয়েছে সবার।
হাসনা, বৃষ্টি আর চাদনী মিলে গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। রেহান আর সিয়াম প্ল্যান করে কোথাও ঘুরতে গেছে।ওঁদের না-কি আগে থেকেই প্ল্যান ছিলো এক্সাম শেষে কোথাও ঘুরতে যাবে। হাসনা আর বৃষ্টি যায়নি।চাদনী এবারে আর কোনো রিস্ক নেয়নি।বন্ধুদের প্রশ্নের সম্মুখে ও বলেছে, ওর ফ্যামিলি ওঁকে সে রাতে অনেক বকেছে।ওরা খুব করে স্বান্তনা দিয়েছে চাদনী কে। কিন্তু ওরা কী করে জানবে, এর চেয়েও অনেকটা খারাপ ঘটেছে চাদনীর সাথে!
চাদনীর মন খারাপ হবে বলে বৃষ্টি আর হাসনাও ঘুরতে যায়নি। ওরা কথা বলতে বলতে গেইটের বাইরে বেরিয়ে এলো।

আঁধার গেইটের বাইরে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ওর চোখে রোদচশমা। শার্টের হাতা গুটিয়ে রেখেছে কনুই পর্যন্ত।চাদনীকে দেখতেই ও এগিয়ে এলো। প্রশ্ন করলো
-“এক্সাম কেমন হলো?”
-“ভালো!”
বৃষ্টি একপলক আঁধারের দিকে তাকিয়ে, চাদনীর কানে কানে বললো
-“উনি কে?”
চাদনী পরিচয় করিয়ে দিলো
-“আমার বড়ো ভাই।”
-“হাই ভাইয়া!”
আঁধার মিষ্টি করে হাসলো ওঁদের দিকে তাকিয়ে। হাসনা চাদনীর পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো

-“ওয়াও চাদনী! তোর যে একটা বড় ভাই আছে সেটা তো বলিসনি কোনোদিন! তোর ভাইটা কি সুন্দর রে!কিউটের ডিব্বা! আমার ক্রাশ লিস্টে জায়গা করে নিলো।”
চাদনী বোকা বোকা হাসলো। আঁধার কোণা চোখে তাকালো চাদনীর দিকে। চাদনী ঢোক গিললো। এখন আবার গালি না খায় ও! আঁধার বলেছিলো চাদনী যাতে ওর বন্ধুদের বলে দেয় ও বিবাহিত। কিন্তু চাদনী বলেনি। রুচি হয়নি কেন যেন! নিজেই তো ওঁকে পরিচয় দেয় না৷ ওর এতো কীসের ঠেকা যেচে যেচে পরিচয় নেওয়ার। আঁধার হেঁসে বললো
-“ভালো আছো তোমরা?”
-“জ্বি ভাইয়া, আপনি কেমন আছেন?চাঁদ আমাদের একবারো বলেনি ওর যে একটা বড় ভাই আছে!”
হাসনা বললো। আধার স্বাভাবিক ভাবে বললো
-“বড় ভাইয়ের কথা না বললেও এটলিস্ট এটা তো বলতে পারতো, ওর যে একটা স্বামী আছে। তোমাদের বান্ধবী তো সেটাও বলেনি।”
-“কী চাঁদের বিয়ে হয়ে গেছে?” দু’জন একসাথে কিছুটা চিল্লিয়ে বললো।
আঁধার বললো

-“হ্যাঁ! কেন তোমাদের বলেনি ও?”
-“না তো!এই চাঁদ তোর বিয়ে হয়ে গেছে?”
চাদনী অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো আঁধারের দিকে। আঁধার কুটিল হাসলো। ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বোঝালো, এবার তোর বান্ধবীরা তোকে মিথ্যুক ভাববে।
হাসনা কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকালো চাদনীর দিকে। গাল ফুলিয়ে বললো
-” এতো কম বয়সে বিয়ে হয়ে গেছে তোর? একবার বললিও না। অথচ আমরা তোর সাথে নিজেদের সব সিক্রেট শেয়ার করি! কীসের এতো লুকোচুরি তোর? আমরা কী তোর জামাই নিয়ে পালিয়ে যেতাম?”
চাদনী কিছু বলতে গেলো। হাসনা আর বৃষ্টি ওর কথা শুনলো না৷ হাসনা আঁধারের দিকে তাকিয়ে বললো
-“ওর হাসবেন্ড কী খুব বেশিই স্ট্রিক্ট ভাইয়া? চাদনী আমাদের সাথে ঘুরতে যেতে পারে না। ওর না-কি সেই অনুমতি নেই।”

-“না তো! আমাকে দেখে তোমার স্ট্রিক্ট মনে হয়! ওর নিজেরই যেতে ইচ্ছে করে না। সে দোষ আমার উপর চাপিয়ে দেয়। অথচ ওর মন ফ্রেশ থাকার জন্য, আমি ওঁকে ঘুরতে যেতে বলি সবসময়।”
চাদনী হা করে তাকালো আঁধারের দিকে। কী ডাহা মিথ্যেবাজ! হাসনা উদ্বিগ্ন স্বরে বললো
-“আপনি ওর হাসবেন্ড?”
-“হ্যাঁ!”
-“কিন্তু বললো যে বড় ভাই।”
-“দু’টোই। ও আমার চাচাতো বোন!”
হাসনা অদৃষ্টে কপাল চাপড়ালো। চাদনীর পাশ ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে বললো
-“হায়রে! শেষমেশ বান্ধবীর জামাইয়ের উপর ক্রাশ খেলাম। বলদি তুই বলবি না, ওনি যে তোর হাসবেন্ড!”
-“বাদ দে না এ টপিক!”
-“তুই বললি না কেন?”
-“ইম্পর্ট্যান্ট মনে হয়নি। পরে বলবো সব কাহিনী।”

-“প্লিজ কিছু মনে করিস না! তোর জামাই রে আমি এখন থেকে ভাইয়ার চোখে দেখবো। বাট হি ইজ সো কিউট। জিতেছিস চাঁদ!”
চাদনী মলিন হাসলো। জিতেছে ও?সত্যিই জিতেছে? কিন্তু আঁধার তো হেরে গেছে ওঁকে পেয়ে। প্রতি পদে পদে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। চাদনী জেতার খুশি টা অনুভব করতে পারেনি। বাহ্যিক দিকটা সবাই দেখে৷ কিন্তু মনের খবর রাখে কয়জন!”
,
আকিব শিকদারের মনটা খারাপ হয়ে আছে ভীষণ। বেশ কয়েকদিন ধরে ওনি চাদনীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।অথচ মেয়েটা কথা বলছে না তার সাথে। প্রতিবার ওনি কল করলে আধারই রিসিভ করে৷ ওনি চাদনীর খোঁজ খবর নেন ওর থেকে। কিন্তু আরেকজনের থেকে মেয়ের খবর জানা আর নিজে কথা বলার মধ্যে অনেক ফারাক আছে। তার দেহটা এখানো আছে, কিন্তু মন পরে আছে চাদনীর কাছে। চাদনীর অসুস্থতার কথা জানার পর বহু কষ্টে উনি সময় ম্যানেজ করেছিলেন ঢাকায় যাওয়ার জন্য। ভেবেছিলেন এবারে গিয়ে চাদনীকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু তার পরিকল্পনা সফল হয়নি। ব্যবসার কাজে আবারো বাইরে যেতে হয়েছিলো তাকে।যার ফলে উনি ঢাকায় যেতে পারেননি। চাদনী খুব অভিমান করে আছে তার উপর, তিনি বুঝতে পারছেন। সে তার দোষ অস্বীকার করে না।

মেয়েটার উপর একটার পর একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার নিরীহ, নির্দোষ মেয়েটা, কীসের কারণে এতোটা কষ্ট ভোগ করছে! অথচ যারা আসল দোষী তারা দিব্বি আছে।অর্পিতা ফিরে এসেছে বাড়িতে। যদিও আরমান শিকদার আর বর্ষা বেগম বড় মুখ করে বলেছিলেন, অর্পিতার দায়িত্ব তারা নিজেরাই নিবেন। এ বাড়িতে ওর জায়গা দিতে হবে না। কিন্তু ঠিকই অর্পিতা আর ওর স্বামী কে বাড়িতে জায়গা দিয়েছেন। এবং সবচেয়ে খারাপ লাগার বিষয়টা হচ্ছে, অর্ণব শিকদার প্রথমে একটু বকাঝকা করলেও, দিন গড়াতে মেনে নিয়েছেন ওঁদের। থাকতে দিয়েছেন বাড়িতে। অথচ বাড়ির সম্মানের কথা ভাবতে গিয়ে চাদনীর জীবনটা শেষ করে দিয়েছেন তিনি।

এবার তাকে যে করেই হোক ঢাকায় যেতেই হবে। বাড়ি, ব্যবসা চুলোয় যাক। কেন সবসময় তাকেই বাড়ি ব্যবসা নিয়ে ভাবতে হবে? অন্যদের তো কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। চাদনী কে বাড়িতে নিয়ে আসবেন যেকোনো মূল্যেই। পরিবার নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিজের সন্তানের দিকে তাকানোর সময় পর্যন্ত পাচ্ছে না সে।উনি কেন ওনার মেয়ের ফিউচার টা নষ্ট করে দেবেন।এমনিতেও নষ্ট করতে কোনোকিছু বাকি রাখেননি। কিন্তু এবার আর না। চাদনী মেয়ের দায়িত্ব অনেক পালন করেছে। এবার তার বাবার দায়িত্ব পালন করার পালা!

ষোলোদিন ব্যাপি চাদনীর এক্সাম শেষ হয়েছে কালকে৷ এই ষোলোদিন ওর উপর কি যে গেছে! চাদনীর মনে হয়, পড়াশোনা করার চেয়ে সংসার করা বেশি সোজা। সারাদিন শুয়ে বসে থাকা যায়। আরাম করা যায়। অথচ পড়াশোনা করতে গিয়ে শরীর,মস্তিষ্ক সবকিছুর বেহাল দশা। চোখ ব্যাথা, হাত ব্যাথা, পা ব্যাথা। পুরোদিনের জার্নি। গাড়ির জার্নি, এ সবকিছু একসাথে কাটাতে গিয়ে রীতিমতো হাপিয়ে উঠেছে চাদনী।
ড্রইংরুমে গালে হাত দিয়ে অসহায়ের মতো বসে আছে চাদনী। আঁধার ওকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো৷ দেখে মনে হচ্ছে এ দুনিয়ায় চাদনীর চেয়ে অসহায় মানুষ আর একটাও নেই।
আঁধার ডাকলো

-“চাঁদ! এভরিথিং ইজ ওঁকে?”
-“নো! কিচ্ছু ঠিক নেই। বাবার কথা মনে পরছে৷”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো চাদনী৷ আঁধার কিছুটা দূরত্ব নিয়ে বসলো ওর থেকে। উদগ্রীব স্বরে বললো
-“তুই চাচ্চুর সাথে কথা বলছিস না কেন, চাঁদ?”
-“তোমার চাচ্চুর আমার সাথে কথা বলার সময় নেই।”
-“ভাই তুই চাচ্চুর দিকটা একটু বোঝ না!ধরতে গেলে পুরো ব্যবসা সামলাতে হয় চাচ্চু কে। বাবা আর মেঝোবাবা শুধু নামে আছে। সময় করে উঠতে পারে না। তুই এসব মনের মধ্যে পুষে রাখলে হবে?”
চাদনী এসবের উত্তর না দিয়ে আঁধারের দিকে তাকিয়ে বলল

-“তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে, আমার এক্সাম শেষ হলে চট্টগ্রামে নিয়ে যাবে। এখন তোমার কথা রাখার পালা!”
-“এখন তো আমার এক্সাম পরেছে। কেমনে রাখবো কথা বল!”
-“বাবাকে কল করে বলবো?মনে হচ্ছে আসবে না। আমার জন্য তো তার সময় নেই। একটা মানুষের সেইম কথা কয়বার বলতে ইচ্ছে করে। বাবার আমার কথা মনে পরে না আঁধার ভাই। সে তো নিতে আসছে না, তুমিও নিয়ে যাচ্ছো না। খুব অসহায় লাগতেছে নিজেকে বিশ্বাস করো।”
-“চাচ্চু নিতে আসলেও,তোকে আমি যেতে দিব না।তুই গেলে আমার সাথে যাবি। নিয়ে যাবো যখন বলেছি, তখন কথা রাখবো। বাট আমাকে একটু সময় দিতে হবে।”
চাদনী মুখ কালো করে তাকালো।

-“পুরো বিজনেস বাবাকেই কেন সামলাতে হয়? আমি এসব নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। বাট সব কষ্ট আমার বাবাকেই কেন করতে হবে? তুমি একটু হেল্প করতে পারো না। এদিকে ইচ্ছে মতো টাকা উড়াও।”
আঁধার চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। এটিটিউড নিয়ে বললো
-“তোর বাপ জেঠার বিজনেসে যখন লাল বাত্তি জ্বলে, তখন সবুজ বাতি জ্বালানোর জন্য আমাকেই লাগে ওঁদের। বুঝছোস! আর টাকা উড়ানোর মতো এবিলিটি আছে তাই উড়াই। তুই ভাবিস না আমি বাপের টাকায় বসে বসে খাই। বিজনেসে আমার কন্ট্রিবিউশান তোর বাপ-জেঠা থেকে অনেকাংশে বেশি। ওরা কাজ করে, আমি প্ল্যান দেই। পথপ্রদর্শক আমিই। মূল কন্ট্রিবিউটর ছাড়া বিজনেস চলে না!”
সোফার উপর হাঁটু তুলে, তাতে থুঁতনি ঠেকিয়ে বসলো চাদনী। অনেক্ষণ নিরবতায় কেটে গেলো। নিরবতার ভেঙে আঁধার বললো

-“চাঁদ, ছাদে যাবি?”
-“ছাদে কেন?”
-“এমনিই। কতোদিন হচ্ছে এসেছিস, অথচ ছাদেই যাওয়া হলো না।রুফটপের ভিউটা খুব সুন্দর! সূর্যাস্ত দেখা যাবে ওখান থেকে। তোর মন ভালো হয়ে যাবে।”
-“চলো তাহলে।”
আঁধার উঠে দাঁড়ালো। চাদনীর হাত ধরে বললো।
-“চল!”
-“হাত ছাড়ো!”
-“না, ছাড়ার জন্য তো ধরিনি। অনেকগুলো সিড়ি পারি দিতে হবে, তুই একা পারবি না।”

কাজলরেখা পর্ব ২৮

-“একা একা সবকিছু করতে শিখতে তো হবে। সবসময় তো তুমি আমার সাথে নাও থাকতে পারো!”
-“আমি সবসময় তোর সাথে থাকবো চাঁদ। সবসময়। প্রতিটা সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা। প্রতিটা সুন্দর বিকেলে। প্রতিটা অসুন্দর মুহুর্তে। না আমি তোকে ছাড়বো, আর না তুই আমাকে ছাড়তে পারবি! জীবনের প্রতিটা ধাপে তুই আমার সাথে থাকবি। তোর মুক্তি নেই!”

কাজলরেখা পর্ব ৩০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here