কাজলরেখা পর্ব ৩
তানজিনা ইসলাম
চাঁদনী এক দৃষ্টে চেয়ে আছে ঘুমন্ত আঁধারের দিকে।মেয়েটার ঘুম ভেঙেছে একটু আগেই।
আঁধারের ফর্সা মুখের দিকে তাকিয়ে হিংসা হয় চাঁদনীর!
সুদর্শন স্বামী ওর।সকালের স্নিগ্ধ,কোমল রদ্দুর মুখের উপর পরছে।একটা সূর্যমুখী ফুলের ন্যায় লাগছে ওঁকে। চাঁদনী অপলক তাকিয়ে থাকলো।কালকের কথা মনে পরতেই বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।
আঁধার নড়ে চড়ে উঠতেই,দৃষ্টি ফিরিয়ে তটস্থ উঠে দাঁড়ালো চাঁদনী।তড়িঘড়ি করে গিয়ে বসলো কাউচের উপর।বুক ধুকধুক করছে, ছেলেটা ঘুম ভেঙে ওঁকে ছ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখলে কী যে ভাবতো।চাদনী স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে।
আঁধারের ঘুম ভাঙতেই দেখলো চাঁদনী বসে আছে সোফার উপর,মাথা নিচু করে!আঁধার ঘুমো ঘুমো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে।মেয়েটার ওভাবে বসে থাকার সাইন্স বুঝতে পারলো না। অতো ঘাটালো না ওঁকে। মেঝেতে পা রাখতেই চোখমুখ কুঁচকে ফেললো ও!খেয়াল না করে কাঁচের টুকরো তে পা দিয়ে ফেলেছে।বুড়ো আঙুলে কেটেছে, রক্ত ঝরছে সেখান থেকে।কাচ নিজের জায়গায়ই ছিলো, আঁধার গিয়ে পা কেটেছে সেখানে।এখানে তো কাঁচের কোনো দোষ নেই।দীর্ঘশ্বাস ফেললো আঁধার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওয়াশরুমে গেলো কোনোমতে।
মাথা নিচু করে থাকলেও চাঁদনী পরোখ করলো সবকিছু।মৃদু খারাপ লাগা কাজ করলো মনে।ইশ!একটু দেখে হাঁটবে না ছেলেটা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই আঁধার দেখলো চাঁদনী নেই কক্ষে। হয়তো নিচে গেছে মেয়েটা।
সিঁড়ি বেয়ে গটগটিয়ে নিচে নামলো আঁধার।ডাইনিং এ আসতেই শোনা গেলো বর্ষা বেগমের কন্ঠ।রাফিয়া বেগমের কক্ষের দরজা ধাক্কাচ্ছেন তিনি।রাফিয়া বেগম আঁধারের দাদি!কাল থেকে বৃদ্ধা দরজায় খিল দিয়ে কক্ষে বসে আছে।ছেলেদের উপর বেজায় চটে আছেন তিনি।আসলে তিনি চাননি চাঁদনীর সাথে আঁধারের বিয়ে হোক।তার অমন সুদর্শন নাতীর সাথে কালো,অপয়া মেয়েটাকে কোনোদিক দিয়েই মানাবে না। এই নিয়ে পুরোপুরি বিয়ের বিপক্ষে ছিলেন তিনি।ছেলেদের প্রস্তাব নাকচ করে তাঁদের অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টাও করেছেন বিয়েটা ভেঙে দিতে।কিন্তু ছেলেরা তার কথা আমলে নেননি। সেই নিয়েই ভীষণ ক্ষেপে আছে বৃদ্ধা।
চাঁদনী কে রাফিয়া বেগম ছোটবেলা থেকেই ভীষণ অপছন্দ করতেন।একমাত্র কারণ গায়ের রং।চাঁদনীর মা রুবাইয়া বেগম যখন গর্ভবতী ছিলেন, তখন তিনি ভেবেছিলেন ছেলে হবে।আঁধারের মতো আরেকটা নাতী হবে তার,কিন্তু হলো নাতনী।তারউপর মেয়েটার, অর্পিতার মতো দুধে-আলতা গায়ের রং না!শ্যামলা।কালো ত্বকের ভীড়ে মেয়েটার মায়াবী মুখ চোখে পরলো না তার।মেয়ে হতে হবে রূপসী-অপ্সরা।নয়তো কীসের মেয়ে!কালো মেয়েদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়ায় ভালো।এই সুন্দর পৃথিবীতে অমন কালোদের বেঁচে থাকার দরকার কী!এমনিতেই তার মেয়ে পছন্দ না, তার উপর কালো মেয়ে তো একেবারেই না।তাই আঁধার আর অর্পিতা তার চোখের মণি হলেও, চাঁদনী ছিলো চোখের বালি।
বর্ষা বেগম দরজায় ধাক্কা দিয়ে বারবার বেরোতে বলছেন তাকে।তার কক্ষ টা নিচ তলায়।বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আঁধার। চেয়ারের উপর বসে একাধারে খেয়েই যাচ্ছে চাঁদনী।আশেপাশে কী হচ্ছে তাতে মেয়েটার কিঞ্চিৎ ভ্রূক্ষেপ নেই বললেই চলে।অন্য চেয়ারে জবা বেগম বসা।ওনারও এসব নাটক নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই।দু’দিন পরপরই রাফিয়া বেগম এসব নাটক করে থাকেন।নতুন কিছু না।কাল রাতে মেয়ের টেনশনে কিছু খায়নি সে। সকালে উঠে তার পেট তাকে জানান দিলো খিদের কষ্ট মেয়ের পালিয়ে যাওয়ার কষ্টের চাইতেও অনেক গুণে বেশি।
আঁধার গটগটিয়ে এগিয়ে গেলো রাফিয়া বেগমের কক্ষের সামনে।সে যাওয়ার পরপর আকিব আর অপূর্ব শিকদারও এলেন।একটু পর আরমান শিকদার কেও আসতে দেখা গেলো।আঁধার দরজায় বারি দিলো কয়েকটা।দাদিমা দাদিমা বলে ডাকলো কয়েকবার।নাতির কথা ফেললেন না রাফিয়া বেগম।খট করে দরজা খুললেন!আঁধারের চিন্তিত মুখ দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন।বিলাপ করে বললেন
-“এই বাড়িতে আমার কোনো দাম নাই রে দাদুভাই!কেউ আমারে মানুষ বইলা মনে করে না!গতকাল থেইক্কা দরজা বন্ধ কইরা বইসা আছি কেও একবার ডাকলো না পর্যন্ত! ওই পোড়ামুখী কেই বিয়ে করেছিস তুই তাই না!”
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বৃদ্ধাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো আঁধার। অনেক ভুলিয়ে ভালিয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে গেলো।নাতীর কথা কোনো কালেই ফেলেন না রাফিয়া বেগম।তাই আঁধারের কথা অনুযায়ী গেলো খাবার টেবিলে।চাঁদনী কে গিলতে দেখে মুখ বাকালেন।আঁধারের দিকে তাকিয়ে অভিযোগ ছুঁড়ে বললেন
-“দেখছস কেমন অপয়া!বাড়ির সবাই আমারে কেমুন করে ডাকাডাকি করলো কিন্তু মাইয়াডা গিলতেই আছে!হতচ্ছাড়ি!”
জবা বেগমকে তিনি চোখে দেখলেন না।অথচ সেও ওই জায়গায় বসেই খাচ্ছিলো।
আঁধার কিছু বললোনা।চেয়ার টেনে বসালো রাফিয়া বেগমকে।নিজেও বসলো পাশের চেয়ারে।বর্ষা বেগম সবাইকে খাবার পরিবেশন করেন।আকিব শিকদার বসতে গিয়ে একপলক তাকালেন মেয়ের দিকে।মেয়ে তার মনোযোগ দিয়ে খেতেই আছে।বাকি কোনো কিছু চিন্তা আপাতত নেই তার।দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।
আঁধার খাওয়ার মাঝেই সবাই কে উদ্দেশ্য করে বললো
-“আজকেই ঢাকা ফিরে যাবো!”
-“এই,এসেছিস ক’দিন হলো হ্যাঁ? আজকেই চলে যাবি? বিয়ের কাজে তো, তোকে দেখার সুযোগই পেলাম না আমি।বলেছিনি না দু’মাস থাকবি?” তড়িঘড়ি করে বললেন বর্ষা বেগম।
-“হু!ভেবেছিলাম কয়েকদিন থাকবো।কিন্তু ভাবলেই তো সেটা ফুলফিল হবে না,আমার থাকা তো সহ্য হচ্ছিলো না তোমাদের।”
আঁধারের গম্ভীর কন্ঠে একপলক ওর দিকে তাকালেন অপূর্ব শিকদার।আইঢাই করে বললেন
-“চাঁদ মা’কে নিয়ে যাবে না? দেখো বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন,হয়েছে তো।তিন কবুল বলে, আল্লাহর কালাম পরে বিয়ে হয়েছে তোমাদের।ওঁকে এভাবে অস্বীকার করো না আঁধার।”
-“নিয়ে যাবো।দায়িত্ব যখন কাঁধের উপর গছিয়ে দিয়েছো, তখন পালন করতে পিছুপা হবো না।যতটা দায়িত্বহীন ভাবো ততটা দায়িত্বহীন আমি না।”
চাঁদনী অবাক হলো বেশ।এতোটাই অবাক হলো যে খাবার হাতে নিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকলো আঁধারের দিকে।
মুখ বাঁকালেন রাফিয়া বেগম। চাঁদনী কে নিয়ে যাবে না শুনলে বেশি খুশি হতেন তিনি।
খাওয়া শেষে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে উঠে দাঁড়ালো আঁধার। চাঁদনীকে উদ্দেশ্য করে বললো
-“উপরে গিয়ে জলদি রেডি হবি।দশটায় ট্রেন!”
-“সেকি?বাড়িতে এতোগুলো গাড়ি থাকতে ট্রেনে করে যাবে?”
অপূর্ব শিকদার বললেন। তাচ্ছিল্য করে হাসলো আঁধার। শ্লেষাত্মক স্বরে বললো
-“তোমার বাড়ির কোনো কিছুই নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করবো না আমি।কাল কী করেছো আমার সাথে ভুলিনি এখনো!”
পরক্ষণেই চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে বললো
-“জলদি খা নারে ভাই!এতো কীসের খাওয়া খাচ্ছস বলবি!সেই কখন থেকেই খেয়েই যাচ্ছিস!”
উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে শিকদার বাড়ির সকলে।বাড়ির দুই ছেলে-মেয়ে আজ ঢাকা পাড়ি দিবে।আঁধার ফর্মাল ড্রেসআপে রেডি হয়ে আছে।কিন্তু চাঁদনীর নামার কোনো নামনিশানাও নেই।বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে আছে আঁধার। সেই কতক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে ও।পা ব্যাথা হয়ে গেছে, কিন্তু চাঁদনীর টিকিটারও খোঁজ নেই।এভাবে তো ট্রেনও মিস হয়ে যাবে।
অনেকটা সময় পেরোনোর পর চাঁদনী নামলো।আঁধার গিয়ে গাটা মারলো ওর মাথায়। নাক ফুলিয়ে বললো
-“বাথরুমে বসে গু* খাচ্ছিলি।এতো সময় লাগে ক্যান রেডি হতে?”
উত্তরে মুখ বাকালো চাঁদনী। কেও খেয়াল না করলেও আকিব শিকদার খেয়াল করলেন চাঁদনীর মুখ লাল হয়ে আছে।চোখ ফুলে গেছে। কেঁদেছে মেয়েটা!আঁকিব শিকদারের বুক ভার হয়ে আসে।ধীর পায়ে হেঁটে চাঁদনীর সামনে দাঁড়ান তিনি।চাঁদনী মাথা নিচু করে ফেলে।আঁকিব শিকদার নম্র স্বরে শুধান
-“তোমার আম্মুর রুমে ছিলে এতোক্ষণ?”
উত্তর দিলো না চাঁদনী।অক্লিষ্টে ঢোক গিললেন আঁকিব শিকদার। মেয়েটা কথা বলছে না তার সাথে।তিনি কথা বলতে গেলেই কেমন উপেক্ষা করছে তাঁকে।
-“চাঁদ!আমার বাচ্চা,তাকা আমার দিকে!”
চাঁদনী নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকালো নিজের বাবার দিকে।আকিব শিকদারের কান্নাগুলো ঠেলে আসলো।নিজেকে সামলানোর, শক্ত দেখানোর চেষ্টা করেও পারলেন না।চাঁদনীর হাত ধরে কেঁদে ফেললেন!অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
-“আমার আম্মা!আমি তোর ভালো বাবা হতে পারিনি।মাফ করে দিস আমাকে!নয়তো মৃত্যুর পর রুবাইয়ার সাথে দৃষ্টি মেলাতে পারবো না!”
চাঁদনীর দৃষ্টি টলে না।অনুভূতি শূন্যের ন্যায় তাকিয়ে থাকে ও।শুধু বলে
-“এতোটা বোঝা হয়ে গেছিলাম বাবা তোমার উপর,যে এখন আরেকজনের উপর বোঝা বানিয়ে দিলে!”
এটাই ছিলো শেষ কথা।বাবা আর বড় বাবার সাথে আর টু শব্দ করেনি চাঁদনী।শুধু বর্ষা বেগম আর আরমান শিকদারের সাথে সাথে কথা বলে গাড়িতে তে উঠলো চাঁদনী!
জবা বেগম ওঁদের বিদায় দিতে আসেননি।অপূর্ব শিকদারও অনেকভাবে সরি বললেন চাঁদনী কে, নিজের খেয়াল রাখতে বললেন।আঁধার শুধু অবাক হয়ে দেখে সবাইকে।কেও একবার ওর কাছে ক্ষমা চাইলো না?অথচ সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী ছিলো ও।চাঁদনীর কাছে ক্ষমা চেয়েই ব্যাপার খালাস!হিংসায় পরিপূর্ণ হলো আঁধারের বুক।চাঁদনী যে ওর বাপ-চাচার খুব আদরের সেটা জানা কথা, তবে ওঁকে যে এভাবে অবহেলা করবে সেটা জানা ছিলো না আঁধারের।
আঁধার গাড়িতে উঠার আগে আকিব শিকদার এসে জড়িয়ে ধরলেন ওঁকে। মলিন হাসলো আঁধার। এই মানুষটাকে ও নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে।বাবার সাথেও এতটা বন্ডিং নেই ওর যতটা চাচ্চুর সাথে আছে।আঁকিব শিকদার ছাড়লেন ওঁকে। ভাঙা গলায় বললেন
-“আমার মেয়েটা কে দেখে রেখো আঁধার। ওর কোনো দোষ নেই।ওর গায়ে কোনোদিন একটা ফুলের টোকা লাগতে দিইনি আমি।আমাদের রাগ ওর উপর ঝেড়ো না।কথা দাও দেখে রাখবে ওঁকে।”
-“দিলাম কথা!”
স্টেশনে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামলো দু’জনে। চাঁদনী আঁধারের পিছু পিছু এগিয়ে চলে।টিকেট কাউন্টারে গিয়ে দু’টো টিকিট কাটরো আঁধার। কুলি ওঁদের ব্যাগপত্র বহন করলো।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন এসে থামবে।আঁধার ঘড়ি দেখলো কয়েকবার।চাঁদনী পুলোকিত দৃষ্টিতে তাকালো আশেপাশে। এই প্রথমবার ট্রেনে চড়বে ও।ফিলিংস টা অন্যরকম।বাপ-দাদার অঢেল টাকা থাকলেও বাড়ি আর স্কুলের গন্ডি ছাড়া আর কোথাও পা রাখা হয়নি চাঁদনীর।সে আজ ঢাকা যাবে।চাঁদনী শুনেছিলো ঢাকা শহর অনেক সুন্দর।অগাধ ইচ্ছে ছিলো শহরটি দেখার।এভাবে অযাচিত ভাবে ইচ্ছেটা পূরণ হয়ে যাবে,চাঁদনী ভাবেনি কোনোদিন।
মুহুর্তের মধ্যেই বিকট শব্দে ট্রেন এসে থামলো।চাঁদনী দু’পা পিছিয়ে আঁধারের বাহু আঁকড়ে ধরে।ক্ষণকাল পর আঁধার ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে।গম্ভীর স্বরে বলে
-“ঠিক আছিস তুই? ভয় পেয়েছিস!”
ঢোক গিলে ডানে বায়ে মাথা নাড়ালো চাঁদনী!ট্রেনে উঠতে গিয়ে ভীড়ের মধ্যে আঁধারের পাশ থেকে সরে গেলো চাঁদনী।
ভীড়ের মধ্যে অসহায় হয়ে পরলো মেয়েটা।আশেপাশে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করলো আঁধারকে। সে নেই!কোথাও নেই!চারিপাশে সব অচেনা-অজানা মানুষ।
অজানা আতঙ্কে চাঁদনীর বুক কাঁপলো অচিরাৎ। তখুনি ভরসার হাত হিসেবে একটি বলিষ্ঠ হাত ওর শীর্ণ হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।চাঁদনী টলমল দৃষ্টিতে তাকালো আঁধারের দিকে।আঁধার টেনে নিয়ে গেলো ওঁকে বগির ভেতর।আলাদা কেবিন নিয়েছে ওরা।সাথে আনা ব্যাগগুলো তাকে উঠিয়ে রাখলো আঁধার।কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালো চাঁদনীর সামনে। চোখ পাকিয়ে বললো
-“বাচ্চা না কিরে তুই!ঠিকভাবে হাঁটতে পর্যন্ত পারিস না?এক্ষুনি তো হারিয়ে যেতি!আমার হাতটা ধরে রাখলে জাত যেতো তোর।এতো এটিটিউড কীসের রে তোর?”
-“তুমিই তো ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিলে হাত!”
-“ঝাড়া মেরে কই ছাড়ালাম!ট্রেনে উঠতে হতো তাই ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম আলতো করে, ঝাড়া মেরে ছাড়াতে কই দেখলি তুই!হুদাই বাড়িয়ে বলছিস! হারিয়ে গেলে তখন দেখা যেতো ভ্যা করে কেঁদে লোকের কানের অবস্থা বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছিস!এখন আসছে এটিটিউড দেখাতে, হু!
-“আমি হারিয়ে গেলে তো তোমারই লাভ!আমার মতো বোঝাকে আর বয়ে বেড়াতে হবে না।আমি হারিয়ে গেলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়!হুদাই চিন্তা করছো কেন?”
কেমন করে যেন তাকালো আঁধার!পরক্ষণেই একপেশে হাসলো। বললো
-“সেটা তো আমিও জানি।কিন্তু সমস্যা কী বলতো!তুই হারিয়ে গেলে বাবা-চাচ্চু তো আমাকে আস্ত রাখতো না!ওঁদের কী জবাব দিতাম।তাই না চাইতেও সামান্য চিন্তা করতে হচ্ছে তোর জন্য!এমনিতেই ভোগান্তির শেষ নেই, তোর জন্য আর ভোগান্তিতে পরতে পারবো না!একটু রেহাই দে আমাকে!”
চাঁদনীর এ পর্যায়ে এসে আসলেই মনে হলো কেন ও হারিয়ে গেলো না।তাহলেই তো কারোর ওর উপস্থিতি নিয়ে বিরক্তি ঝড়ে পরতো না সর্বাঙ্গে।চাঁদনী বিরস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।ঠোঁটের কোণে ছড়ায় বিষাদের হাসি।
আঁধার আঁকড়ে ধরলো ওর হাত।সিটের উপর বসালো ওঁকে। কোমল স্বরে বললো
-“একটু বেশিই ভাবিস চাঁদ!এতো ভাবা ভালো না! তুই একটু বোস।আমি একটু আসছি বাইরে থেকে।কাজ আছে।বের হবি না খবরদার!আমি এসে যেন তোকে এভাবেই বসা দেখি!আজাইরা চিন্তা মাথায় নিতে পারবো না।!”
ঠোঁট উল্টে বসে ছিলো চাঁদনী!আধার বেরিয়ে গেলো। ও বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরই ঝঙ্কার দিয়ে ফোন বাজতে শুরু করলো।হকচকিয়ে আশেপাশে চাইলো চাঁদনী! সিটের উপর আঁধারের ফোন রাখা।ফোন রেখেই চলে গেছে ছেলেটা।আঁধার কে ডাকার জন্য উঠে দাড়ালো চাঁদনী।আবার কী মনে করে বসে পরলো।বলেছিলো যাতে সিটের উপর চাঁদনী কে বসা দেখতে পায়, না পেলে তো ওর উপরই চেতবে।
রিংটোন বাজতে বাজতে কেটে গেলো কল। আরেকবার কল আসতেই,আইঢাই করে আঁধারের ফোন হাতে নিলো চাঁদনী!
অর্পিতা নামে সেভ করা একটি নাম্বার,পাশে লাভ শেইপের ইমোজি!চাঁদনীর বুক ধ্বক করে উঠলো।রক্ত সঞ্চালন যেন বন্ধ হয়ে গেলো ওর। এই মেয়ে না পালিয়ে গিয়েছিলো আঁধার কে বিয়ে করবে না বলে!আবার কেন এতো ডেস্পারেটলি ফোন করছে ওঁকে!
বহু কষ্টে সাহস জুগিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কল রিসিভ করলো চাঁদনী!ওপাশ থেকে তড়িঘড়ি করে একটি মেয়ের ডাক ভেসে এলো।
-“হ্যালো আঁধার!”
কাজলরেখা পর্ব ২
আখিতে অশ্রুরা ভীড়লো চাঁদনীর।ওদিকে অর্পিতা হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে। চাঁদনীর কানে একটা কথাও ঢুকছে না। এই জগতে নেই যেন ও!আঁধার ওঁকে না চাক,স্ত্রী হিসেবে না মানুক তবুও বিয়েতো হয়েছে।কবুল বলাটা তো মিথ্যে না!চাঁদনীর ওর সাথে সংসার করার ইচ্ছেটাও মিথ্যে না!ও যে আঁধারের জীবনে সত্যিই থার্ড পারসন হয়ে এসেছে সেটা জানা কথা!কিন্তু অর্পিতা আবার ফিরে আসতে চাচ্ছে?কেন চাচ্ছে? আবার আঁধার কে চায় ও?
না,না!এটা কী করে মানবে চাঁদনী!ওতো ওর স্বামীর ভাগ কাওকে দেবে না।কাওকে না!
চাঁদনী যখন এসব ভাবনায় বুদ তখনই আঁধার এসে ফোনটা ছো মেরে নিয়ে নিলো।