কালকুঠুরি পর্ব ১৪

কালকুঠুরি পর্ব ১৪
sumona khatun mollika

সিয়াম আর নুসরাতের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে সালার সিকান্দার সামিরের খোঁজ করলেন,, সাথি জবাব দিল,, জ্বর এসেছে।
মাঝরাতে ইনায়া চেক করতে গিয়ে দেখে সামির ঘরে নেই। রুমের দড়জা খোলা জানালাও খোলা। ফ্যানটাও চলছে। বরাবরি সামির লাইট ফ্যান বন্ধ না করেই বেরিয়ে যায়। খেয়াল করে না। সাথি যখন জিজ্ঞেস করে,, বলে,
– আমি কি তোদের মতো ফকিন্নির ঝি নাকি, বিল দেয়ার ক্ষমতা আছে আমার।

ইনায়া প্রথমে সাফিনের ঘরের সামনে যায়। ভয়ে ডাকতে সাহস হয়না। সিয়ামের দড়জা থেকেও ঘুরে আসে। নিজের ঘরে গিয়ে দেখে সিভান বসে থেকে চোখ কচলাচ্ছে। ইনায়াকে ঢুকতে দেখে বলে,,
– তুমি কোথায় গেছিলে?
– ওই,, আ,, সিভান,, সামির ভাই ঘরে নেই।
– টেনশন কোরোনা, কাকা হয় চড় খেতে গেছে আর নাহয় কারো মন ভাঙতে গেছে।
– তুই কি করে জানিস?
– জানি জানি,, মাঝেমধ্যেই যায় ।
– যা গিয়ে শুয়ে পড় ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ইনায়ার কথামতো সিভান গিয়ে আবার শুয়ে পরে। যতদিন সিভানের মা বেঁচে ছিল, সাফিনের ঘরেই থাকত। মা মরার পর থেকে ইনায়ার কাছে থাকে। মাঝেমাঝে সামিরের ঘরে শুয়ে পরে। সামির কিছু বলেনা…
সামির সারাদিন প্রায় ঘুমিয়েই ছিল। রাত প্রায় ১২ টার দিকে কল আসে রনির। ” ভাই, রাগিব ভাই ডেকেছে ” কল কেটে সোজা বেরিয়ে যায় সামির।
গলির মোড়ের সেই ক্লাবে গিয়ে দেখে রাগিব দেওয়ান একটা চেয়ারে বসে। সামির হাই তুলে জিজ্ঞেস করে,,
– কি ব্যাপার? রাত বিরাতে আমাকে এভাবে ডাকাডাকি করে কি বোঝাতে চাও,,

রাগিব কোনো কথা না বলে একটা হাজার টাকার বান্ডিল ছুড়ে বলল,,
– এতে চলবে?
– হামাগুড়ি দেবে।
রাগিব বাকা হেসে আরো দুই বান্ডিল ফেলে বলে,,
– শাল্লা,, জাতে মাতাল তালে ঠিক! এবার?
– জগিং করবে। সমস্যা নাই।
– কত সময় লাগবে এটা ডেলিভারিতে?
– সেটা আমার বিষয়। তবে এইটুকু বক্সে আটলো কি করে? কেটে আটিয়েছ নাকি আবার! দাগ থেকে যাবেনাতো?
– সেটা তোর ব্যাপার।

রাগিব আর কিছু বললনা। সামির হাতে গ্লাভস পরে রনির দিকে একটা এগিয়ে দিল। কালো কাপড় দিয়ে চেহারা ঢাকল। দেখে বোঝা যায় দক্ষ ডাকাত! রনি আর সামির বক্সটা ধরে বেধে জীপ গাড়িতে তুলল। টাকার বান্ডিল গুলো গাড়িতে থাকা একটা ব্যাগে রাখল।
গাড়িটা নিয়ে দাড় করালো মাহবুব উদ্দিন এর বাড়ির একটু দুরে। বক্সটা তোলার সময় রনি বলল,,
– ভাই,, একটু বেশি পাতলানা?
– পাতলাতো হবেই,, চিকন কাট যে। আর যে কদিন রাগিবের কাছে ছিল, তোর কি মনে হয় উক্তে উক্তে কোরমা রাইন্দা খাওয়াইছে?
– তা ঠিক না। তবে,,
-আরে বাঙ্গির বাচ্চা,, কথা কম বল। বাঁশ খাওয়াবি নাকি!

দুজন মিলে বক্সটা মাহবুব উদ্দিন এর বাড়ির দড়জায় রেখে যেইনা পিছে ঘুরে দাড়াবে, অমনি একটা কালো কুকুর তাদের তাড়া করে ধরে। মাহবুব বিষয় টা খেয়াল করলেও তেমন পাত্তা দিলনা। রাতের বেলা কুকুরেরা এভাবে প্রায়ই তাড়া করে বেড়ায়।
রনি বলদের মতো সামিরের সাথে সাথে দৌড়াচ্ছে সামির বলে,,
– আরে বাঙ্গির নাতি, অন্য দিকে দৌড়া কোলে কোলে ভাগছিস কেন?

রনি অন্য দিকে গেল ঠিকি কুকুর টা রনিকেই তেড়ে ধরল। সামির পেছন থেকে একটা চেলাকাঠা তুলে দৌড়ে গিয়ে সজোরে দুই বাড়ি মেরে দিল। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করতে করতে দৌড়ে পালালো।
হাঁটুতে ভর দিয়ে দাড়িয়ে রনি জোড়ে জোরে হাঁপ ছাড়তে লাগল । সামির মুখের কালো কাপড় খুলে বলল,,
– মরলেও কি শালা লুঙ্গি টেনে পেছন পেছন যাবি নাকি, কমন সেন্স নাই!
– এরম দৌড়ানি কমি খাইছি ভাই। পুলিশের দৌড়ানির চাই কুত্তার দৌড়ানি মেলা ভয়ানক।

পুনরায় কালো মাস্কের গভীরে চেহারা ঢেকে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
পরেরদিন সকালে,,
মাহবুব সকাল সকাল মাহাকে কল করেছিল, মার্ডার হওয়া ছেলেটার বিষয়ে জানাতে। মাত্র কিছুদিন একাজ ওকাজের ফাঁক ফোকরে মাহবুব মাহার চোখে হারিয়ে যায় । তারো মাহাকে একটু একটু মনে ধরে। কিন্তু কিছু বলতে পারেনা। কারণ কিছুদিন পরই মাহার বিয়ে।

মাহবুব উদ্দিন এর মা ডেকে পাঠালেন,, তার নামে একটা পার্সেল এসেছে। মোটামুটি লম্বা সাইজের স্কচটেপ দিয়ে আটকানো। মাহবুব তার মাকে বলল,,
– এটা এখন খুলবনা। আমার এখন রুমাশাকে খুজতে যেতে হবে।
– আমি খুলি?

খুলো বলেই মাহবুব নিজের ঘরে চলে গেল।
২ মিনিটের মাথায় মাহবুব উদ্দিন এর মা বাড়ি কাপা
কাপানো চিৎকার করে ওঠেন। মাহবুব দৌড়ে নিচে চলে আসলে দেখতে পায় মা অজ্ঞান হয়ে গেছে। সামনে এক ভয়াবহ দৃশ্য।
কার্টুন বক্সটার ভেতরে বড্ড নৃশংস ভাবে স্কচটেপ দিয়ে বেধে প্যাকেট করা হয়েছে রুমাশাকে। চোখ ঝলসে যাওয়া দৃশ্য!!

মাহবুব দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তার মাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিল। আদরের ছোট্ট বোনটাকে এভাবে এই অবস্থায় দেখে রুহটা মচকে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে কল করল থানায় তাড়াতাড়ি আসতে বলল বাড়িতে।
বেলা গড়াতে খবরটা সিকান্দার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেল। সালার সিকান্দার পুরো বর্ণনা শুনে কপাল কুচকে ফেললেন। সাফিন চুপচাপ সব পরিদর্শন করে মাহবুব কে শান্তনা দিতে লাগল।
রাগিব দেওয়ানও সেখানে উপস্থিত ছিল। রুমাশাকে হারিয়ে মাহবুব এর মায়ের আহাজারি হৃদয় ফাটা। যে শুনছে কান্না আটকে রাখতে পারছেনা।

মুহিবের মাধ্যমে খবর পেয়ে মাহা ছুটতে ছুটতে চলে আসে। বড্ড করুণ দৃশ্য ।
‎মাহবুবের মা হাহাকার করে কাদতে কাদতে অস্হির! চোখমুখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। মাহা সহসা ওপরে উঠে গিয়ে দেখল,, মাহবুব জায়নামাজে বসে আল্লাহর দরবারে হাত উচিয়ে কাদছে,, মাহার খুব খারাপ লাগে। দড়জায় দাড়িয়ে থেকে দেখে বোনের জন্য এক ভাইয়ের আহাজারি। মাহবুব নামাজ শেষে চোখ মুছে পেছনে তাকাতেই দেখে মাহা দাড়িয়ে আছে। তাকে ভেতরে আসতে বললে, মাহা অকপট স্বরে বলে,,
– নিজেকে শক্ত করুন। আপনাকে এখনো নিজের বোনের অপরাধী দের খুজতে হবে।

মাহবুব চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকে রাখতে পারছেনা। ভেজা চোখে হাটু ভেঙে বসে করুণ কণ্ঠে বললো,,
– আমার বোনটার সাথেই কেন!! মেরেছেত মেরেছে, একটা গুলি দিয়েই নাহলে মারতো। এভাবে কি মানুষ মানুষকে খুন করে!!

মাহা দুরে দাড়িয়েই বলল,,,
– বাচ্চাদের মতো অভিযোগ করা বন্ধ করুন। আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি আমি। কিন্তু আজ এটা আপনার বোনের সাথে না হয়ে অন্যের বোনের সাথেও হতে পারতো। আমার সাথেও তো হতে পারতো। নিজেকে শক্ত করুন।
মাহবুব এবার ঠান্ডা হয়ে বসল। মাহা একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল,,
– মি, মাহবুব,, রুমাশাকে নিয়ে যেতে এসেছে আপনার নিচে যাওয়া উচিত।

পেছন থেকে কে একজন বলল,,
– আর সাথে তোমাকেও নিতে এসেছে , মিস্টার মাহবুব উদ্দিন।
দুজনেই দড়জার দিকে তাকিয়ে দেখল, সামির সিকান্দার। সাথে সিয়াম সিকান্দার আর কাশেম হালদার। পেছনে মেধা শিকদার। আর তার পেছনে পুলিশের টিম।
মেধা এগিয়ে এসে মাহার পাশে দাড়ালো। আর পুলিশের উদ্দেশ্যে বলল,,
– মাহা কিছু করেনি। ওশুধু এখানে খবর নিতে এসেছিল।

পুলিশের ওসি এগিয়ে গিয়ে বললেন,,
– দেখুন কে কি করেছেন কি করেন নি এটা তদন্ত করে বের করা হবে। কিন্তু আপনারা সবাই সন্দেহের তালিকায় শির্ষে। মিস মাহাদিবা, আপনাকেও আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

সামির বাহাতে ধরে রাখা লুঙ্গি ছেড়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে মাহার পাশে দাড়িয়ে বলল,,
– হ্যাঁ, এটা আরো বড় কালপ্রিট। এটাকেতো আমি মাঝে মাঝে এ বাড়িতে যেতে আসতে দেখেছি। তাছাড়া সে ল এর স্টুডেন্ট হওয়ার পরও আমার বাড়ি গিয়ে বলেছে সে আমার ক্লাসমেট,, বলে আমার খাতা ছিনতাই করেছে। আমি হলাম সাইন্স এর স্টুডেন্ট। সে আমার খাতা নিয়ে কি করবে! ব্যাপারটা সন্দেহের নয়কি?

মেধা মাহাকে টেনে রেখে বলল,,
– কি বলছেন আপনি এসব এসব? আরে, আজ পর্যন্ত শুধু দুইবার এসেছে ও। তাও আমি জানতাম।
সমির বলল,,,
-আচ্ছা দুইবার এসেছে? সেটাও মানলাম কিন্তু কেন? আর বাড়িতেই নকল পরিচয়ে কোন সাহসে গিয়েছিল? তখন বাড়িতে কোনো পুরুষ এর উপস্থিতি ছিল না। জানা সত্বেও সে গিয়েছে।
ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করল,
-সামির তুমি আসলে কি বলতে চাইছো?

সামির আবারো লুঙ্গি উচিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নাজানার ভান করে বলে,,
– দেখেন স্যার, সামনে ইলেকশন। আমার ভাইয়ের পেছনে লাগার মানুষের অভাব নাই। তাছাড়া যদি কেও এর মধ্যে থেকে আমাদের বাড়ির কোনো মেয়ে বা বাচ্চাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়? হতেওতো পারে এরা নারী পাচার বা অবৈধ কোনো ব্যাবসায় জড়িত
মাহা ঘাড় তুলে বলে,,
– আমি যাব অফিসার। তাছাড়া আমি জানি আমি ভুল নই। আমি শুধুই ব্যাক্তিগত দিক দিয়ে মাহবুব উদ্দিন এর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।

মাহবুব সহ মাহাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কাশেম পেছনে থেকে সামিরকে বলে,,
– কিন্তু ভাই, মাহা আপারে ফাসাইলেন কেন?
‎- আরে কাইশসার কাইশসা,, তুই ভুইলা গেছিস? ওয় আমারে কয়ডা চড় মারছে! এটা নিলাম একটা চড়ের শোধ। তাও ফিফটি পার্সেন্ট। বাঙ্গির নাতনি একটা চাচি আছে না? সে তুলবে বাকি ফিফটি। বাকিগুলো পেন্ডিং।

কাশেম বুঝলো,, সামির ইচ্ছে করে মাহার পিছে লাগবে। এমনিতে সামিরের ন্যাকা টাইপ মেয়ে গুলাই বেশি পছন্দ। যতগুলা গার্লফ্রেন্ড ছিল সবছিল ন্যাকুর ন্যাকু,, সামিরের পার্ট টাইম চাকরানি। যখন যেটাকে ভালো লাগে তখন সেটার
সাথে ঘুরে বেরায় । সময় কাটায় ২ দিন পর আবার চেঞ্জ করে ফেলে। কাশেম নিজে সাক্ষী এতগুলো মেয়ের মধ্যে কেও মাহার মতো ছিলনা। নাই এমন পর্দাশীল নাই সাহসী। সেই কারণেই সামির ইচ্ছে করে মাহার পিছে লেগেছে।

তাছাড়া তার কাজই তাই। যতখন কোনো কন্ট্রাক্ট এ জড়িয়ে থাকে ততখন দিনদুনিয়া ভুলে যায়। আর যতখন ফাকা থাকে বখাটেদের মতো এদিকে সেদিকে ঘুরে বেড়ায়, একে ওকে ডিসটার্ব করে বেরায়। তবে এটা সত্যি সাফিনের প্রতি তার অনেক ভক্তি। সাফিন মানা করলে সহজে সেই কাজ করেনা। বলা চলে সাফিনের পা চাটা কুত্তা সামির, সামিরের পা চাটা কুত্তা কাশেম সহ বকি টিম।

মুহিবের কানে খবরটা মেধাই পৌঁছে দিয়েছে। মুহিব ছুটতে ছুটতে থানায় গিয়েছে। তাদেরকে জেলে ঢোকানো হয়নি কারণ যথাযোগ্য প্রমাণ নেই আর মাহবুব একজন পুলিশ কর্মকর্তা। মাহবুবকে দীর্ঘ ১ মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হলো। তাদেরকে ছেড়ে দেওয়ার পরে মাহবুব বাড়ি ফিরে গেল। মাহাকে মুহিব বাড়ি নিয়ে এলে চাচি ঠাস করে একটা চড় মেরে বলল,,
– খুব বেশি বেরেছিস! বাইরে বেরোনো বন্ধ তোর।

তবে অদ্ভুত ব্যাপার, চাচা মফিদ আজকে আটকালেন। মাহাকে মারধর করতে কড়াকরে মানা করলেন। আরো বললেন,, বিয়ে হওয়া পর্যন্ত কেও যেন মাহাকে কষ্ট না দেয়। শরীর স্বাস্থ্য যেন ভালো থাকে।
অন্য কেও হলে হয়ত খুশি হতো। তবে মাহা খুশি হতে পারলোনা। তার এই ব্যাপারটায়ও বড্ড ঘাপলা মনে হলো। চাচা কোনোদিনও তাকে এভাবে যত্ন নেয়ার কথা বলেনি। আজ কেন বলছে,,

কালকুঠুরি পর্ব ১৩

মাহা চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল। ঘরে গিয়ে জামাকাপড় বদলে বািরে আসতেই আত্মা কেঁপে উঠল। বিছানার ওপর সামির বসে আছে। ঢুকলো কোনদিক দিয়ে!! জানালা দড়জাতো সব বন্ধ। তবে আজ মাহা প্রথমেই মুহিবকে ডেকে চেচিয়ে উঠলো। দড়জা খোলা থাকায় মুহিব দৌড়ে ভেতরে ঢুকে দেখল কিছুই নাই।
মাহা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, আসলেও কিছুই নাই। দৃষ্টি ভ্রম ছিল।

কালকুঠুরি পর্ব ১৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here