কালকুঠুরি পর্ব ৩০
sumona khatun mollika
সকালে ঘুম ভাঙতেই মাহা নিজেকে গাড়ির ভেতরে আবিষ্কার করলো। পড়নে রাত্রের অশুদ্ধ বস্ত্র নেই। চুলগুলো ভেজা মনে হচ্ছে মাত্র গোসল দিয়ে এসেছে। সামির গুনগুনিয়ে গান গাইছে আর আপন মনে স্টেয়ারিং ঘোরাচ্ছে । মাহা চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,,
– স্বপ্ন দেখছি? এত রিয়ালাস্টিক!!
সামির বাকা একটু হেসে মাথা ঝাড়া মারতেই ভেজা চুলের পানির ছিটা গিয়ে মাহার চোখে মুখে পড়ে।
– উমমহ! কি করছেন?
– প্রুফ দিলাম যে এসব স্বপ্ন নয়।
– আমি ড্রেস কখন বদলালাম? চুল,, চুলও ভেজা!
– তুমি কাল রাইতে আমার অতি উত্তেজনা সামলানোর জন্য উত্তেজিত হয়ে আমার উত্তেজেনার পেছন মেরে নিজে উত্তেজনার ঠেলায় অজ্ঞান হয়ে গেছিলে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– কিই!!
– হুমম,, তারপর সকালে ডাকলাম না তাকিয়ে জবাব আইলো উঠতে পারবোনা মাথা ব্যাথা। আমি ভাবলাম আর কইকই যে ব্যাথা তাই ডাকিনাই।
– আমার জামাকাপড় বদলালো কে? চুল ভিজলো কি করে?
– আমি বদলে দিয়েছি।
– কিন্তু আমি একটুও টের পাইনি? কেন?
– আমার শখ হইলো তারপর ভাবলাম তুমার ঘুম নষ্ট করমু না। তারপর সাদা ধুবধুবা রুমালে বিষ মাখায়া তোমারে ভালোবাসা দিলাম তুমি আধা ফটকে গেলে তারপর তোমারে লুমান্তিক স্টাইলে কোলে তুললাম তারপর বাথরুমে গেলাম তারপর তোমারে নামালাম তারপর তোমার জা,,,
কথাটুকু আর শেষ করতে দিলনা মাহা। মুখের কথা টেনে নিয়ে বলল,,
– বুঝেছি। এখন কোথায় যাচ্ছি??
– মধুচন্দ্রিমায়,,,, তবে স্পেশাল গন্তব্য,,
– কোথায়??
– অজানার পথে,,,,
– মানে?? এত ইমারজেন্সির কি ছিল?
– ইমারজেন্সি,,, ? হ ঠিক কইছাও। মারা খাওয়ার ডেট আইছে পলাইছি।
– পালায়ছি মানে?
– পালাইছি মানে,,, গতদিন একটা ছোট্ট মুরগি মার্ডার করেছিলাম,, সেই মুরগী আবার পুলিশ কমিশনারের ফার্মের।
– কার?
– পুলিশ কমিশনারের ছেলে। আর,,,
– আর,, মানে? আর কাকে? কিভাবে? কখন?
– বিগত নিশিতে। ক্লাবে। ২ জনরে। কাঁটাচামচ দিয়ে। বেশি খারাপ কিছু করিনি সিরিয়াস। শুধু চোখ দুটো তুলে ফেলেছি।
– ইশশহ! নাউজুবিল্লাহ ! সত্যি?? সেটা ছোট অপরাধ?? আল্লাহ! আপনার ভয় লাগেনি?
– ভয় লাগলেতো জাউরা নাম্বার ১ হতাম না।।
দৃশ্যটা কল্পনা করতেই মাহার দেহ শিউরে উঠলো।
মাহা কপাল জড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,,
– তারমানে পুলিশের হাত থেকে পালিয়েছেন,, আমাকে কেন এনেছেন?
– শখ হয়েছে।
– কতদিন পর ফিরবেন?
– ঠিক নাই। সেজন্যই তো তোমারে নিয়াইছি।
– আমার পরীক্ষা?
– রিপিট দিতে পারবা। কাশেম সেদিকে সামলে নেবে ।
মাহা আর কোনো কথা বললনা। গাড়ি ছুটে চলেছে আপনমনে। খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে সামির আবারো গান ধরলো,,
Kashmir may
Tu kanya kumari……
বেশ লম্বা সময় গাড়ি ছোটানোর পরে মাহা বলল,,
_ আমার পিপাসা লেগেছে পানি খাবো গাড়ি থামান ।
– পানি খাবাতো গাড়ি থামাবো কেন? পেছনে পানির বোতল আছে নিয়ে গেলো ,,।
– এতসময় রাইডের অভ্যাস নেই। গাড়ি থামান রে ভাই।
– শালার বাঙ্গিমারা জিন্দেগী! আমি তর ভাই লাগি??
– না। লাগেন কিছু একটা।
সমির ঘাড় ঘুরিয়ে নিতেই দেখতে পেল পেছনে পুলিশের গাড়ি। গাড়ির স্পিড বারিয়ে ঢুকে গেল নিশুতি রাস্তায়। বড্ড শুনশান এলাকা। নাটোর পেরিয়ে চলে এসেছে খানিকটা। গাড়ি ছুটিয়ে যেখানেই যাক না কেন পুলিশ অতিদ্রুত তাদদের ধরে ফেলবে। প্রযুক্তি এত উন্নত হবে কে জানতো। সামির গাড়ি থামিয়ে মাহাকে বলে,,
– নামো। এখান থেকে হাঁটতে হবে।
– হাঁটতে হবে কেন? হেঁটে কতদূরে যাবেন?
আমি অতো হাঁটতে পারিনা।
– তাহলে চলো তোমাকে শারুক খানের মতো কোলে তুলে নিয়ে যাই।
– দরকার নাই। আল্লাহ পা দিয়েছেন।
বলেই মাহা গাড়ি থেকে নেমে গেল। তারপর বলল,
– ঘুমের ঘোরে উঠিয়ে এনেছেন ভালো কথা বোরখাটা আনেননি কেন?
– কমিশনারতো আমার নানা লাগে যে কইবো যাও আমি বইসে আছি তুমি তোমার জামা কাপড়, জাইঙ্গা , লুঙ্গি , সব নিয়ে যাও।
– আমার এভাবে ঘোরাঘুরি করার অভ্যাস নাই।
– জানি। বেশি দূরে যাবনা। আশেপাশেই কোথাও থাকবো।
প্রত্যন্ত অঞ্চল। জনমানবহীন বললেও ভুল হবেনা। আবার ভুলো হবে। কারণ আঁকাবাকা মেঠোপথের দুধারের ফসল দেখে বোঝাই যাচ্ছে অতি যত্নে চাষ করা। সবুজ শ্যামল ফসলগুলো বাতাসের তালে তিরতির করে নাচছে। অক্টোবর মাস শুরুর ঠান্ডা বাতাসে মাহার চুলগুলো ঝিরঝির করে উড়ছে। পড়নের চুড়িদার টা পাতলা হওয়ায় হাটতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না।
বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোনো হতোনা। চাচা চাচিরা সবাই মাঝেমধ্যে ঘুরতে গেলেও মাহাকে কখনো সঙ্গে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি । চারপাশের চোখ ধাধানো মনমাতানো প্রাকৃতিক পরিবেশ তার মনে বিপুল আবহা স্মৃষ্টি করছে। মুখ লুকিয়ে লুকিয়ে মিটিমিটিয়ে হাসছে। সেই হাসি সামির সিকান্দার এর দৃষ্টিগোচর হয়নি। তবে ইচ্ছে করে খোঁচাখুঁচি ও করেনি। মাহা সহসা নিজেই বলতে শুরু করল,,,
– জনমানবহীন এলাকাও এক ভয়াবহ সৌন্দর্য বহন করে,, রাস্তা টা শুনশান লাশের মতো কিন্তু কি সৌন্দর্য তার,, আঁকাবাকা মেঠোপথের দুধারের নারকেল গাছের সারি দুইপাশ চোখ ধাধানো মনমাতানো ফসলের জমি। , আকাশে পাখিরা ডাকছে, থেকে থেকে কাশফুল ফুটে আছে,,
– কি হয়েছে তোমার?
মাহা চোখ পাকিয়ে তাকালো,, ঘাড় ঘুরিয়ে নিতেই সামির তার হাত টেনে ধরে তার দিকে ঘোরালো,,
– এই ডিপজলের মা,, কি হয়েছে তোমার? জ্বীনে আছর টাছর করছে নাকি?
– ছাড়ুন তো আশ্চর্য কি বলছেন কার ভেতর?
– তোমার মুখ দিয়ে মধুর বাণি সইছে না।
– সইবেওনা কুত্তার পেটে ঘি সয়না।
– পয়দার পরে কি কেও মুখে মধু দিছিলনা?
– আমার মুখে দিয়এছে আপনার কানে দেয়নি।
– ওহ! কানেও দিতে হয় নাকি!
– হুমম, আপনার তো দিতেই হতো বাকিদের জানিনা।
– চলো হাটো!
– আমার ক্ষুধা লেগেছে । কাল রাত থেকে অভুক্ত আমি!
সামির পিঠের ব্যাগ নামিয়ে একটা গোল পাউরুটি এগিয়ে ধরে বলল,,
-ধরেনাও এডভেঞ্চার এ এসেছি অতো কোলা ভরে গেলার টাইম নাই।
মাহা পাউরুটি টা নিয়ে বলল,,
– হাঁটছি আর হাটছি,, যাচ্ছি টা কোথায়?
– স্বর্গে।
– ইয়ার্কি করার ইচ্ছে নেই। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আর পাও ব্যাথা ধরেছে।
সামির এবার একটু থমকে দাড়ালো। পিছের দিকে তাকিয়ে দেখল হাঁটতে হাঁটতে অজানা গ্রামটার অনেক গভীরে চলে এসেছে। পেছনে যতদুর দেখা যায় কেনো মানুষ নেই। চারপাশে ঝিঝি পোকা ডাকতে শুরু করেছে। ক্লান্ত পাখিরা ফিরে যাচ্ছে আপন নীড়ে । শুষ্ক একটা ঢোক গিলে সামির বলল,,
– আব,,, চলেত এসেছি অনেকটা দুরে। পুলিশ রা মনে হয়না এতদূর পৌছবে। বেলাও ঢলে যাচ্ছে ,, এখানেই স্টপ হও।
– এই ডুবন্ত বেলায় মেঠোপথের মাঝখানে স্টপ হবো?
– পায়ে ব্যাথা না করলে চলো এগোই। যেহেতু গ্রাম নিশ্চয়ই জনবসতি তো থাকবেই। চলো আরেকটু সামনে এগোই।
হাটতে হাঁটতে দুজন আরো সামনে এগোলো। ধীরে ধীরে রাত ঢলে গেছে। সৌভাগ্য বশত জনমানবের দেখা মিলেছে। একটা চোট নিন্মবিত্তের বাড়ি। সেখানে বসবাস দুই বুড়ো-বুড়ির। ছেলে শহরে চাকরি করে। পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকে বছরে এক াধবার আসে দু চারদিন থেকে আবার চলে যায় । মেয়ের বিয়ে হয়েছিল বড়লোক বাড়িতে । জামাই নেশাখোর। ঘরে বুড়োর মেয়ে টাকে রেখে আবার আরেকটা বিয়ে করেছিল। সেই শোক সামলাতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে মেয়েটা বেশ কিছু বছর। এটাই তাদের জীবনবৃত্তান্ত। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলে তাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয় মাহা আর সামির। রাতের বেলা বাইরে এসে দাড়ায় মাহা। সামির বািরেই ছিল। আকাশের কৃষ্ণ গহবর ভেঙে চকচকে রূপালী চাঁদ বেরিয়েছে।
একটা জলধারার কাছে এসে থমকে দাড়ালো মাহা। সামির জিজ্ঞেস করল,,
– কি হইল? আসো?
– আপনি এখানে আসেন!
সামির খুব একটা বাধালোনা। চুপচাপ মাহার পাশে গিয়ে দাড়ালো। মাহা বিলের দিকে হাত বারিয়ে দেখালো,,, পানির ওপর চাঁদের প্রতিচ্ছবি কি অমায়িক সুন্দর লাগছে। মাহা তাকিয়ে রইল আকাশের চাঁদ টার দিকে,, সামির চোখ ঘুরিয়ে মাহার দিকে তাকালো। চাঁদের আলোয় মেয়েটার চেহারা বড্ড মাযাবী লাগে।
ছোট্ট বাচ্চার মতো মাহা বিলের জলে আঙুল তাক করে বলল,,
– ওদিকে দেখুন,, আমায় একটা এনে দেবেন?
– হ বাল! আমি এখন ওই নাটকিই করবতো! জীবনে কোনোদিন শাপলা দেহনাই!!
– দেখেছি তাতে কি? আপনি আমাকে ওই ফুল এনে দিবেন মানে দিবেন।
– বাধ্য নই। সাপে কোব বসাইবো!
– স্ত্রীর আবদার পূরণ স্বামীর ধর্ম।
– তোমার মনে হয় আমি খুব ধর্ম পালনকারী ধার্মিক ব্যাক্তি?
মাহা মুখ বেকিয়ে দূরে সরে দাড়িয়ে অন্য দিক ঘুরে তাকালো। সামির মাহাকে নাকের পাটা ফুলাতে দেখে গাল টেনে একটু হাসলো। তারপর নিজের লুঙ্গি উচিয়ে কাছা বেধে পানিতে নেমে গেল। ফুটন্ত কয়েকটা শাপলা তুলল নাগালের মধ্যে থেকে। পুকুর ভর্তি শাপলা ছিল সামিরো নিজের হাত ভর্তি করেই শাপলা তুলেছে। ওপরে উঠে এসে
লুঙ্গিটা ঝেড়ে শাপলার গোছাটা ঘাড়ের পাশ দিয়ে মাহার দিকে এগিয়ে ধরল মাহা যেন আনন্দে আত্মহারা !
– মাথাটা গেল নাকি?
- কেন?
– তোমাকে কখনো এভাবে হাসতে দেখিনি আমি।
– ওহ! ধন্যবাদ । কি সুন্দর না এগুলো? একদম ভিষণ সুন্দর ।
সামিরের কেমন অদ্ভুত অনুভূত হলো। ভেতরে কিছু একটা ঢিপঢিপ করছে। মনে মনে শান্ত হতে বললেও ও শালা কথা শুনছে না৷ মাহার হাসি সেই মাত্রা আরো বারিয়ে দিচ্ছে।
– কি দেখছেন?
সামির কোনো জবাব দিলনা। ধির পায়ে মাহার দিকে এগিয়ে গেল। মুখের ওপর জ্বালাতণ করা এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে আচমকা মাহাকে জড়িয়ে ধরল! মাহার মাথাটা তার বুকের সাথে আটকে রইল স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে সামির সিকান্দার এর বুকের ভেতরের ঢিপঢিপ আওয়াজ। মাহা শুষ্ক একটা ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল,,
– কি সমস্যা ? কোনো সমস্যা? শরীর খারাপ নাকি?
– তুমি সেই চিন্তা করো?
মাহা চুপ করে রইল । সামির তাকে পাজা কোলে তুলে ছনের চালের ঘরে ঢুকে দড়জা সেটে দিল । মাহার হাতের ফুলগুলো নিয়ে নিচে ছুড়ে মারলো।
হঠাৎই মাহার অধর চেপে ধরল নিজের ওষ্ঠ দিয়ে । মাহা ধাক্কা দিতে চাইলে সামির হাতদুটো উচিয়ে ধরে হাস্কি স্বরে আওড়ালো,,
– আমি বলেছিলাম মধুচন্দ্রিমায় যাচ্ছি। তো,,, আটকানোর সাহস দেখিওনা চড়ওয়ালী । আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিনা কারণ সঙ্গে করে মাল আনতে ভুলে গেছি। আর এখানে তুমি বাদে আর কোনো অপশন নাই।
কথাগুলো শেষ করে সামির নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেল। মাহা নিজের চোখমুখ সিটিয়ে চুপ হয়ে রইলো। কি দুর্ভাগ্য! আটকানোর কোনো অধিকার মাহার নেই। চাইলেও বাধা দিতে পারবেনা। । তাছাড়া সে নিজেই সামিরকে বলেছে তার যখন ইচ্ছে সে মাহাকে ব্যাবহার করতে পারে। ।
রাত ঢলে যায় ,, সকালে মাহার ঘুম ভাঙে পাখির কলকাকলিতে । বুড়ি মহিলা টা দড়জায় টোকা দিয়ে দিয়ে ডাকছে,,
– ও মেয়ে উঠেছ নাকি?? খাবেনা? বেলা হয়েছে।
মাহা উঠে গিয়ে দড়জা খুলে দিলে বুড়ি বলল,,
– এসো, তোমার সোয়ামী রেও তুইলা লিয়া এসো। খাবেনা?
– জ্বি আসছি।
কথাটা বলেই মাহা দড়জা লাগিয়ে সামির কে ডাকতে লাগল।
– এইযে উঠুন, দাদিমাটা ডাকছে। উঠবেন নাকি পানি ঢেলে দেব?
– এত্ত ছ্যাগা পারো ক্যান বাল! একটু পিরীত কইরাও তো ডাকতে পারো।
– ষাঁড় কে আবার পিরীত করে ডাকে কিভাবে?
– উমম? ষাঁড়? কাল রাইতে কি ভর বেশি মনে হয়ছে নাকি?
-বিরক্তিকর! উঠবেন কিনা? এখান থেকে বেরোবেন কখন?
সমির উক্ত প্রশ্নের কোনো জবাব দিলনা। চুপচাপ হাই তুলে উঠে গেল। হাড়িভর্তি পান্তা আর বিলের মাছ ভাজা দেখে নাক শিটকোলো সামির,,
– এসব কি?
বুড়ো আঙুল নেড়ে জবাব দিল,,
– বিলের তাজা মাছ বাপ। খাইয়াই দেহ কি মজা লাগে।
মাহা বুড়িটাকে বাসন ধুতে সাহায্য করছিল । বুড়ি তার দিকে তাকিয়ে বলল,,
– ও মেয়ে, তোমার সোয়ামী বুঝি বেশ বিত্তবান তাইনা? মাছ কি খাতে পারবিনি? নাকি ডিমের খোজে যাই?
– না দিদা। উনি ওরকমি, সিনেমার ভিলেনদের মতোন। শতভাগ ঠিক থাকলেও ভুল ধরবে এমন লোক ।
মাহা সামিরের পাশে দাড়িয়ে বলল,,
– এটাই চুপচাপ খেয়ে নিন। যদি নাই খাবেন,, পালানোর আগে ভাবা দরকার ছিল , এই নিস্তার গ্রামে নয় ফাইভস্টার হোটেল বুক করতে হতো। না খেলে পেটে খিল এটে বসে থাকুন!
মাহার জ্ঞান বাকিগুলো কেমন বিরক্তিকর আর অপমানজনক মনে হলো সামিরের। বড্ড অরুচি নিয়েও এক লোকমা ভাত মুখে তুলল। মনে মনে ভাবলো,, কি বাঙ্গিমারা মন মাইরি চাইলেই এখনি বুড়োবুড়ি দুটোকে পটল ধরিয়ে দিয়ে শোধ তুলতে পারি কিন্তু বউ বাঙ্গি ইনসাল্ট করে দিল ।
ভাবতে ভাবতেই সামিরের কেন যেন মনে হলো খাবারটা যতটা রুচিহীন ভেবেছিল ততটা রুচিহীন নয়। বুড়োর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,,
– কিভাবে রান্দে এটা? উমমম ভালোই খারাপ না।
– দেখছাও মেয়ে তোমার কথায় চিড়া ভিজেছে। তোমার সোয়ামীর খানা পছন্দ হইছে৷
মাহা বুড়োর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। সামির তার দিকে কেমন বাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। দুপুরের দিকে বিলের ধারে বসে বুড়ি আর মাহা কথা বলছিল। ভাগ্য অনুমান করতে পারি বলে, বুড়ি কাপা হাতে মাহার হাতটা টেনে ধরে উল্টো ঘুরিয়ে বলল,,
– ও মেয়ে,, ৷ এই দেখ এই দাগ,, তোমার তিনখানা ছানা হবে। দুইখানা তো হবেই হবে।
– কি বলছেন,, এসব অন্ধবিশ্বাস! আল্লাহ নারাজ হবেন দিদা।
– বাকিসব তো জানিনা গো মেয়ে তবে তোমারে কিন্তু খুব ভালোবাসবে গো। খুব ভালোবাসবে।
– কে দিদা?
– কে আবার? তোমার সোয়ামী গো মেয়ে। তোমার সোয়ামী।
বুড়ো ডাকেতই বুড়ি উঠে চলে গেল। মাহা বিলের পানির দিকে তাকিয়ে গাল টেনে হেসে নিজে নিজেই আওড়াল,,
– তোমার সোয়ামী গো মেয়ে,, তোমার সোয়ামী,,, সোয়ামী ,,
– এখানে,,, তোমার সোয়ামী এখানে,, একা একা কি ভাবছ সোয়ামীর ইস্ত্রী?
– কিছুনা। এখান থেকে বেরোবেন কবে?
– বেরোবোনা। থাকবো ২, ৩ দিন। কোনো সমস্যা?
– নিজে পান্তা খেতে পারেন না আমাকে জিজ্ঞেস করছেন সমস্যা কিনা? সমস্যা কার তাতো দেখাই যাচ্ছে।
– তোমারে চাটায় দুটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে। চড়ওয়ালী।
– মারেন,,
– জানো কেন?
– না বললে জানবো কি করে?
– তুমি ওই বুড়োর সামনে থোবড়া ঢাকনা ক্যান?
– আপনি বলার কে?
– তোমার সোয়ামী গো মেয়ে,
মাহা সামিরের হোহো করে হেসে উঠলো। দুজনে হাসাহাসির ঠেলায় ভুলবশত বিলের পানিতে পরে গেল। ভিজে একাকার হয়ে গেল। সামির শয়তানি করে দাকা মেরে মাহাকে গভীর পানির দিকে ঠেলা মারতেই মাহা পিছলে গেল। আওয়াজ উচিয়ে বলল,,
– আরে সামির সিকান্দার! আপনার মাথায় বাঙ্গি ভাঙি আমি সাঁতার জানি না।
– ওয়াওহ! আমার সাইলেন্ট বোম একদম পয়েন্টে ব্লাস্ট হয়েছে। আমি আসছিগো মেয়ে,, তোমার সোয়ামী আসছে।
হাস্যকর ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে সামির সাতরে মাহার কাছে চলে গেল ।
– আররে চ্যাগাইয়োনা! হাত ধরো ডুববানা ।
মাহা সামিরে কাধের ওপর ভর দিয়ে দম ফেলে তাকাতেই দেখল বিল ভর্তি শাপলার ভেতরে তারা দুজন ভাসছে। দম ফেলে সামির ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,,
– তাকাও ডুববানা আমি আছি৷
কথাটা বলতেই মাহার কর্ণকুহর কেঁপে উঠল। চোখের পাতা ফেলে সামিরের হাসি মাখা মুখের দিকে তাকালো। কানে বাজতে লাগলো বুড়ির কথাটা,,
” তোমার সোয়ামী তোমারে খুব ভালোবাসবে গো মেয়ে ”
– অয়?? কি দেখছো?
– দাক্কা মারলেন তো বাচালেন কেন?
– শখখখখ!!
তারপর দুজনে ওপরে উঠে এলো। সামির না চাইতেও বুড়োর লুঙ্গি পরে বাইরে গাছের ডালে চড়ে বসল। চারপাশে সবুজ ফসলের মাঝে নিচু নিচু মোটা ডাল বিশিষ্ট একটা গাছের ডালে আধ শোয়া হয়ে বিলে পরার পর মাহার দৃষ্টির দৃশ্য স্মরণ হতেই সামির
গান ধরলো,,,
মন মাঝি খবরদার,
আমার তরী যেন ভেরে না
আমার নৌকা যেন ডুবে নাআ
মন মাঝি খরবদার।
মাহা হাটতে হাটতে তার কাছে গিয়ে দাড়ায়। সামির গান থামিয়ে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বুড়ির বাসন্তী রঙের শাড়িতে মাহাকে কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। সামির জিজ্ঞেস করে,,
– ইশশ কি ভালোবাসা একটু দুরত্বও সয়না রেহ! কি ভালোবাসা রেহ!! রইতে পারলেনা গো মেয়ে??
– এখান থেকে যাবেন কখন?
– যাব যাব। কিছুদিন থাকতে সমস্যা কোথায় ? তবে চড়ওয়ালী,, তোমাকে কিন্তু বুড়িটার শাড়িতে হেব্বি লাগছে।
– কি ভাষা!
– এখানে উঠে বোসো।
মাহা উঠতে পারছেনা দেখে সামির হাত বারিয়ে দিলে মাহার আবারো বুড়ির কথাটা কানে বাজতে থাকে!
– তোমার সোয়ামী তোমাকে খুব ভালোবাসবে গো মেয়ে!
– এভাবে তাকিয়ে কি দেখছ?
– কিছুনা। দেখছি সৃষ্টি কর্তার সৃষ্টি কত সুন্দর !
– উমমম আমিও কিন্তু,,, সুন্দর আছি কি বলো?
– হুমম ষাঁড় ও তো দেখতে সুন্দর।
– শালার বাঙ্গিমারা জিন্দেগী! এ,, চড়ওয়ালী,, ওদিকে দেখ,, আমি যখন ছোট ছিলাম একবার এমন একটা জায়গায় ঘুরতে গেছিলাম। কাওকে না জানিয়ে। তখন ওইরকম দেখতে একটা গাছের সাথে ভাঙা টিন আমায় ঝুলিয়ে রেখেছিল । পরে যখন খুলে দিল মনে হচ্ছিল সব উল্টা উল্টাই ঠিক ছিল! আজব হলেও সত্যি এরকম জায়গায় আমি আগে কোনোদিন ও আসিনি। এই প্রথম।
সামির আপনমনে কথা গুলো বকে যাচ্ছে । আচমকা বাজ পরার মতো মাহা অন্য দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল,,
– সামির সিকান্দার? আপনি কি কোনোদিনও কাওকে ভালোবাসেন নি? সত্যি ? কাওকে বাসার চান্সও কি নেই?
সামির ভুত দেখার মতো মাহার দিকে তাকিয়ে রইল,, মাহা গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল,,
– এভাবে দেখার কি আছে?
– তুমি সমানে একের পর এক বোম ফাটিয়ে যাচ্ছ সাইন্ট বোম!
মাহা আর কিছু বললনা। দুজনেই চুপচাপ বসে রইল মাহা পরে যাবে মনে করে সামির মাহার শাড়ির আচলের এক কর্নার ধরে রইল। মাহা বিষয়টা খেয়াল করলেও কিছু বললনা । বারবার বুড়ির কথাগুলো কানের গোড়ে ভো ভো করছে!
বাতাসে মাহার চুলগুলো তিরতির করে উড়ছে। সামির অপক্ব হাতে মাহার মাথায় একটা হাতখোপা করে দিয়ে বলল,,
– ইতিকে করে দিত সাথি এভাবে। আমিও ট্রাই করলাম একটু। থাক খুইলোনা।
মাহা সামিরের কথা রাখল খোপাটা খুললোনা। বাতাসের দোলায় ভালোই লাগছিল। সামির জিজ্ঞেস করল,,
– আচ্ছা তোমার বাপ মা মরার কাহিনী ডা একটু কওতো,, শুনি,,
– আমার বাবা মা? তারা একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। লাভ ম্যারেজ। মায়ের বাড়ি থেকে মেনেছিলনা। তাতে কিছু আসে যায় নি। বাবা মাকে এতটাই ভালোবাসতো কখনো কারো অভাব মনে হয়নি। আমি তাদের প্রথম সন্তান ।৷ চকচকে আলোকিত এক দিনে নাকি আমার জন্মহয়েছিল। বাবা নিজের বড় মেয়ের নাম বড্ড শখে দিয়েছিলেন দিবা। মায়ের নাম ছিল মিতা। সেখান থেকে মাহা। তারপর তাদের একটা ছেলে সন্তান হয়। নাম মিলিয়ে রাখা হলো মুগ্ধ । মীর মুগ্ধ । বেশ ভালোই দিনকাল কাটছিল। তবে এডভোকেট হওয়ায় বাবার অনেক বিরোধী ছিল।
একদিন আমার হালকা জ্বর ছিল। মুগ্ধ তখন ছোট্ট। মা হাসপাতালে অসুস্হ দাদা কে দেখতে গিয়েছিল। আমি রইলাম বাড়িতে আমার ফুফু মনিরার কাছে। বাবা তাদের হাসপাতাল থেকে আনতে গিয়েছিল । আমি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম চেচামেচি তে ঘুম ভাঙলো। কিছুতেই নিচে যেতে দিচ্ছিলনা ফুফু। জবরদস্তি নিচে গিয়ে দেখি তিনটা সাদা কাপড়ে ঢাকা দেওয়া মাছের মতো স্তুপ। কেমন ভয়ানক অনুভূতি হলো। কাঁপা হাতে সাদা কাপড়ের কোনাগুলো একটা একটা করে ওঠাতেই দৃশ্যমান হলো ভয়াবহ এক দৃশ্য । আমার বাবা, মা ভাই! রক্তাক্ত তাদের চেহারা। চলছেনা নিঃশ্বাস ! হাহাকার করে তাদের ডাকলাম খুব ডাকলাম কিন্তু তারা সাড়া দিলনা। পুলিশ জানালো,,
তারা তিনোজনই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। ব্যাস! জীবনের মোড় সেখান থেকেই বদলে গেল। সব পরিবর্তন হয়ে গেল। তারা তিনজন আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল ,,,,,, ।
কালকুঠুরি পর্ব ২৯
– সামান্য এটুকুই?
– এটা সামান্য?
– আমার হিসেবে সামান্যই তো,,
– ভালো।
বেশ কিছুসময় নিরবতার পরে দুজন নেমে কুড়েঘরের দিকে হাঁটা দিল।
