কালকুঠুরি পর্ব ৩৩

কালকুঠুরি পর্ব ৩৩
sumona khatun mollika

আমি এই বিয়ে করবনা। বেশ বড় গলায় জবাব এলো ইনায়ার পক্ষে থেকে।
-আমি এই বিয়ে করবনা । আমার কোনো ইচ্ছে নেই এখন বিয়ে টিয়ে করার।
সামির বাঁকা হেসে ধীর কণ্ঠে বললো ,
– বিয়ের কথা কানে যেতেই এত উত্তেজনা! লাফালাফি! পাত্রের নাম শুনলেতো টাল্লি খায়া যাবিগা!

– সে যেই হোকনা কেন আমি এখন বিয়ে করবনা সামির ভাই!
– কেন রে বাঙ্গি মালতী? মাত্র ৫ টা মাস আগের মাথায়ও তো তুই বিয়ের জন্য দুই পায়ে খাড়া ছিলি!
– তখনকার বিষয়টি আলাদা সামির ভাই ।
চাচি উঠে দাড়িয়ে বলল,,
– বিয়ে করতে হবে! আর কতদিন বিধবার দায়িত্ব হয়ে আটকে থাকবি? ইন্টার পাশ করেছিস ২ মাস! সামির বাপ,, কে ছুড়া? নামকি? বাড়ি কই?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– এএ,, জোয়ান ছুড়া চাচিজান্স! দেখতে হেব্বি! বেশ ভদ্র। আমাদের রাজশাহীর ছুড়া!
– নাম কি? আগে থেকে চিনি নাকি তারে?
– হ তো। সো গাইজ আমি সামির বাঙ্গি,,, বাঙ্গিমারা নিউজ চ্যানেলে সবাইকে স্বাগতম! এখন আমি আপনাদের এমন একটা নিউজ শোনাব যে,,৷ যে,৷ যেএ,,, মাল না গিলেই সব টাল্লি খাইয়া যাবেনগা। সো সবাই রেডি?? নেম অব দা বয় ইজ,, মীর মুহিব!

সামির যা বলল কাঁটায় কাঁটায় মিলে গেল। উপস্থিত জনতার সকলের চোয়াল ঝুলে পরল। বিস্তারিত জানতে আগ্রহ কারো দৃষ্টিতে নেই। সবাই হা করে সামিরের দিকে তাকিয়ে রইল একমাত্র সাফিন বাদে। কারণ সাফিন বেশ ভালোই জানে সামির কোনো নিউজ শোনাবে মানে ওটা বোমের মতোই ফাটবে।

চাচি চোখের পলক ফেলে বলল,,
– এক মুহূর্তর জন্য আসলেই টাল্লি খাইছি গা! কোন মুহিব বাপ?
– আমার সমন্ধি মুহিব চাচি।
– মানে মাহার ভাই মুহিব! মুহিবের সাথে এ,, কেমনে কি?
সাফিন বাকি নাটক দেখার জন্য ওখানে দাড়ালোনা চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল। সিভান মাহার পাশে বসে। সালার সিকান্দার জিজ্ঞেস করল,,

– তোকে কে বলেছে ওর বিয়া ঠিক করতে? আমরা আছিত নাকি!
-না নেই। শুভ কামে দেরি করতে নাই। আমি মফিদ চাচারে বলে দিছি। কোনো অনুষ্ঠান হবেনা। আগামী শুক্রবার মানে ৩ দিন পরে ইনায়া আর মুহিবের বিয়ে। এইতো একটু পরেই আসবে ওরা।
মাহা বসে থেকেই জিজ্ঞেস করল,,
– আপনি কি ওদের মতামত নিয়েছেন.?
– কোনো মতামত চলবেনা। যা বলেছি তাই হবে।
যে যার কাজে যাও।

ইনায়া সেখান থেকে দৌড়ে ছাদে চলে যায়। দম আটকে আসছে! সে কিছুতেই মুহিবকে বিয়ে করতে পারবেনা। মুহিব কেন কাওকেই না। যাইহোক সামির সিকান্দার এখন অন্য কারো কিন্তু ইনায়া টা যে ছোট থেকে তাকে নিজের মনে করে এসেছে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে তার চারপাশে যে নামটা ঘুরত সেটা শুধু এবং শুধুই সামির সিকান্দার ।

চোখের পানি মুছে কারেন্টের পোলের দিকে তাকালো ইনায়া। তার ওপর একা একটা কাক বসে আছে। কেন যেন নিজেকেও টিক তেমনি মনে হচ্ছে ইনায়ার। ইনায়া মেটা শান্ত নিষ্ঠ বোকাসোকা একটা মেয়ে। অন্য দের মতো এত ধুর্ত বা চালাক প্রকৃতির হিংসুটে নয়। সবসময় চুপচাপ নিজের কাজ করে। কারো সাথে খুব একটা ঝগড়াও করেনা। তবে সামির সিকান্দার তার জীবনের খুশির কারণ ছিল । এটাও কাওকে বোঝাতে পারেনি কখনো। হয়তো সামির নিজেও বোঝেনি।

পেছন থেকে সামির এসে তার পাশে দাড়ায়!
‎রুক্ষ কণ্ঠে বলে,
– জীবন আমাদের সবসময় যা চাই তা দেয় না। অনেকসময় চরমভাবে হতাশ করে। তবুও জীবনে এগিয়ে যেতে হয়।
আচমকা সামিরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ইনায়া।

– আমাকে বিয়ে দেবেন না সামির ভাই । আমি এই বিয়ে করতে পারবোনা। জীবনে সব প্রাপ্তির খাতায় এই একটা অপ্রাপ্তি আমাকে ছিড়ে খেয়ে ফেলছে। আমি বিয়ে করবনা। আমি বাচবনা ওখানে গিয়ে । আপনাকে পেতেও লোভ করবনা আমি । শুধু চোখের সামনে থাকতে দিন ।

সামির নিশ্চুপ। ইনায়া তাকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরেছে কিন্তু সে তার হাত উঠাতে পারছেনা। নিজেই নিজের মনকে জিজ্ঞেস করছে,,
– কেন রে বাঙ্গির বাচ্চা! শক্তি পাচ্ছিস না? তুই কবে থেকে অন্যের জন্য দুঃখ করতে ধরেছিস। তোর খারাপ লাগছে? এটাও কি সম্ভব! খারাপের কি করে খারাপ লাগতে পারে!

সামির আলগা নিঃশ্বাস ফেলে ডানহাতে ইনাযার বাহু টেনে নিজের থেকে দুরে সরালো। নিরেট কণ্ঠে বললো,,
– বড়রা যা করে ভালোর জন্যই। মুহিব ছেলেটা ভালো। আমাদের জগৎ থেকে অনেক আলাদা ওর জগৎ। স্বাভাবিক জগতের বাসিন্দা সে। তুই ভালো থাকবি ।

কথাটা বলে সামির সেখান থেকে চলে যায়। ইনায়া হাঁটু ভেঙে বসে হাহাকার করে কাঁদতে থাকে। মাহা দুর থেকে দেখে নিজের মনে মনে বলে,,
-ইশশ রে! মন ভাঙার কষ্ট বুঝি এতই প্রখর! আল্লাহ ওর মনটা শান্ত করুন! ওকে মানসিক শক্তি দিন।
চাচি আর সাথি দুইজন ইনায়ার ঘরে বসে আছে। ইনায়া এখনো ছাদ থেকে নামছেনা। সাথি তার মাকে বলল,,

– মা,, আমার বেলায় একবার ভুল করেছ, ইনুর বেলায় একি ভুল কোরোনা। ও এখন বিয়ে করতে চায়না।
– কিন্তু আমি সামির রে ভরসা করি। সামির যেহেতু বলেছে ছেলেটা নিশ্চয়ই ভালো। তাছাড়া মুহিবকে আমরা সবাই চিনি।
– তা তো ঠিকি বলেছ। দেখ যা ভালো মনে করো।

ইনায়ার জন্য আর কেও অপেক্ষা করলনা। যে যার ঘরে চলে গেল। সারাটাদিন ইনায়া নিজের ঘরে বসে রইল । সামির নিজে থেকে কল দিয়ে মফিদ উদ্দিনকে আরো কয়দিন পরে আসতে বলল। সিভান এসে ইনাযার পাশে বসে তার মাথায় হাত দিয়ে বলল,,
– কেদোনা ইনু,, আমাদের ভাগ্য টা খারাপ। কেন জানো, কারণ আমরা সিকান্দার দের রক্ত। সিকান্দার পরিবারের অংশ আমরা । এই নামটাই যে বিষাক্ত করে দিয়েছে বাবা, কাকারা। আপাতত শান্ত হও। কাকা আজকে ওদের আসতে মানা করেছে।

ইনায়া সিভানকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগল৷ ফুফুর আর্তনাদ দেখে সিভানেরো বড্ড কষ্ট হয় তার জন্য ।
ঘরে ঢোকার পর থেকে মাহা বারবার সামিরকে জিজ্ঞেস করছে,,
– আপনার এইরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কি? অন্য কেও কেন নয়? মুহিব ভাই -ই কেন? ইনায়াকে জোর করছেন কেন? বলুন , হঠাৎ করে ওর বিয়ে ঠিক করার মানেকি?
– চোপপ! কানের কাছে প্যান প্যান করেই যাচ্ছে ! সর বাল যা সর! বাঙ্গিমারা পেঁচাল পারতাছে বেরোও ঘর থেকে,,

– আপনি বেরোন!
– আমি বেরোবো মানে এটা আমার ঘর!
-হ্যা তো, এটা আমারো ঘর!
– এই ঘরের বাসিন্দা আমি! মালিকও আমি। অধিকার আমার!
– দেনমোহরের বিনিময়ে কিনেছি আমি। ! আমারো সমান অধিকার ।
– হ্যা বে ফকিন্নির ঝি! ওতেই মুখ নাড়া। তুই এক লাখ দিয়েছিস আমি ৫ লাআআখ!
– তো সেটা আমার প্রাপ্য!

-আমার….
বাকিটুকু আর বলে শেষ করতে পারেনা সামির! দেনমোহর বউয়ের অধিকার হয় পুরুষের নয়! মাহা ঘাড় ওপর নিচে করে ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল,
‎- কি হলো হ্যা? জবান বন্ধ হয়ে গেল কেন? থামিল থিকান্দাল! হেহে।
মাহা বাহাতে মুখ চেপে হাসতে লাগল! হাসির ঝলকানিতে চোখভেসে উঠছে! সামির হুট করে তার বাহু ধরে টেনে থুতনি চেপে ধরে বলল,,

– খুব হাসি পাচ্ছে না? খুব হাসি পাচ্ছে ! আমার নাম ভেঙাচ্ছিস! একদম গলা কেটে দেব! ভুলে যাসনা তুই আমার শত্রু!
– আপনি আমার প্রথম আসামী।
সামির মাহার গলা ছেড়ে দিতেই মাহা জিজ্ঞেস করল,,
– আপনি বলেছিলেন স্যালেন্ডার করবেন!
– লোকের বাল ছিঁড়ব ! আমি বললাম আর তুমি মেনেও নিলে! তুই কে রে! তোর জন্য আমি স্যালেন্ডার করতে যাব ভাগ চোখের সামনে থেকে!

– আপনাকে স্যালেন্ডার করতে হবে।
– অসম্ভব !
সব মোটামুটি ঠিক ছিল তবে বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায়। সামিরের এই সিদ্ধান্ত ইনাযার মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলল! শান্ত শিষ্ট ইনায়া কেমন হিংস্র চোখে মাহার দিকে তাকিয়ে রইল। নুসরাত মাহার চোখমুখ দেখে বলল,,

– তোমার কি হয়েছে?
– পেটে ব্যাথা।
– একবারো বলছনা কেন?
– সেরকম প্রখর নয় আপু।
– ঠিকাছে। দেখ বেশি হলে বলবে কিন্তু । আমিতো তোমার আপাই।
– জ্বি।

ইনায়া হঠাৎই একা একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় । নুসরাত আর সাথি বারবার জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছে! কোনো জবাব দেয় না । মাহা বলে চিন্তা নাকরতে ও নিশ্চয়ই মেধার কাছে যাচ্ছে । যেতে দিন বান্ধবীর কাছে গিয়ে মনটা হালকা হবে৷
কিন্তু মাহা সম্পূর্ণ ভুল। ইনায়া সেখান থেকে সোজা অন্য জায়গায় চলে গেছে। রাগিব দেওয়ান এর ক্লাবে। সামনে বসে রাগিব, সোনালী এবং সোমা।

ইনায়া মুখের মাস্ক খুলতেই রাগিব গাল টেনে হেসে বলে,,,
-এত দ্রুত ধামাকা হতে চলেছে জানতাম না। তুমি শুধু বলে যাও বেবি,, বাকিটা আমি সামলে নেব। বদলে কিচ্ছু দিতে হবেনা। পুরোনো হিসাব আমারো বাকি আছে। তুমি বাড়ি যাও শান্তিতে ঘুমাও। আর প্রস্তুতি নাওএন বিয়ের যা কখনো হবেই না৷

মাহা বারান্দায় দাড়িয়ে চিন্তা করছে,,, সত্যি কি এরা পাতালঘর টর বানিয়ে সোনেমার মতো অত্যাচার করে নারী পাচার করে? নাহলে এত বড় লোক হয় কি করে! সামির সিকান্দার এর আয়ের উৎস তো মাহার জানা হয়ে গেছে। সে সবার পালতু সরকারি কামলা। কন্ট্র্যাক্ট কিলার! ড্রাগস সাপ্লায়ার! কিন্তু সাফিন সিকান্দার আর সিয়াম সিকান্দার? সালার সিকান্দার?

হটাৎই কি মনে হয়ে মাহা নিচে চলে যায়। অপরিষ্কার জঙ্গল হয়ে থাকা বাগান! পা টিপে টিপে হেঁটে কোনো লাভ হয়না সে স্পষ্ট বুঝতে পারে সাফিন একদম সত্যি বলেছে৷ এই জঙ্গলে তেমন কিছু আছে বলে মনে হয়না। তাহলে এদিকটা পরিষ্কার করে না কেন! হটাৎ সামনে পরে থাকা একটা ঔষধের খালি বোতল দেখে মাহার সন্দেহ হয়। বোতলটা উঠিয়ে গন্ধ শুঁকতে নাক সামনে নিলেও শুকেনা। হতেও পারে এটা মাদকদ্রব্যের বোতল। ঘ্রাণে তার ক্ষতি হবে।

জঙ্গল ত্যাগ করে বাড়িতে ডুকতেই সামির জিজ্ঞেস করে,,
– ইনভেস্টিগেশন শেষ ম্যাজিস্ট্রেট আফুজান্স?
– ভাষার কি ধরণ! আফুজান্স !
– ইউনিক ধরণ। আচ্ছা দিবা শোনো,, যাও রেডি হয়ে এসো। বাইরে যাব।
– কোথায়?
– চোখ যায় যেথায়।
– যাবনা।
– ত্যাড়ামি কোরোনা। সিরিয়াস।

মাহা আর কোনো করে বলল না। সোজা ঘরে গিয়ে বোরকা পরে চলে এলো।
-আপনি লুঙ্গি বদলাবেন না?
-না। চলো।

মিনিট কয়েকপর সিটি হসপিটালিটি সামনে বাইক থামায় সামির। মাহা বলে, কে অসুস্থ হাসপাতালে কেন?
– তুমি আবার কে?
মাহা ভেবেছিল সামির খেয়াল করেনি। কিন্তু সে সোজা হাসপাতালে নিয়ে চলে এসেছে।

কালকুঠুরি পর্ব ৩২

তবে ডাক্তারের কেবিনে তাকে ঢুকতে নেয়নি মাহা।। ডাক্তার ও তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বািরে থাকতে বলেছে। বের হওয়ার পর সামির জিজ্ঞেস করে,,
– কি হয়েছে?
-ফুড পয়েসিনিং।
-আর কোনো সমস্যা নাই তো??
-না।
-যাক বাচা গেছে। তুমি এতো কম বয়সে মরলে আমি ঝগড়া করব কার সাথে ! চলো বাড়ি চলো।

কালকুঠুরি পর্ব ৩৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here