কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ২০

কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ২০
জাওয়াদ জামী

এই অসময়ে আরমানকে দেখে কান্তাসহ সবাই অবাক হয়ে গেছে।
আরমান রোকসানা আক্তারকে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকে, তার কাছে মিষ্টি ও ফলমূলের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়।
কান্তা খাবার রেখে উঠে যায়।
” আপনি হঠাৎ করে আসলেন যে! সকালেও তো কথা হল, তখন বললেননাতো আজকে আসবেন! ” কান্তার চোখেমুখে বিস্ময়।

” এদিকে একটু কাজ ছিল, তাই ভাবলাম সবার সাথে দেখা করে যাই। ” কান্তার প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল আরমান।
” কান্তা, ছেলেটা কতদূর থেকে এসেছে, আর তাকে তুই এসব কি প্রশ্ন করছিস! জামাইকে ভেতরে নিয়ে যা। যাও বাবা, তুমি ফ্রেশ হয়ে এস। এরপর দু’জন একসাথে খাবে। ” রোকসানা আক্তার আরমানকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে দেন।
কান্তার ফুপা ওবায়দুল হক এগিয়ে এসে আরমানকে জড়িয়ে ধরলেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” বুঝলে ইয়াং ম্যান, ছেলেমেয়েরা সবাই দেশের বাইরে থাকে। এতবড় বাসার এক কোনে আমরা দু’জন পরে থাকি। তাই এখানে কেউ বেড়াতে আসলে আমার ভিষণ ভালো লাগে। এবার যাও ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে নাও। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। ”
ফুপা-ফুপুর কথামত কান্তা আরমানকে নিয়ে রুমে আসে।
আরমান রুমে প্রবেশ করেই কান্তাকে হ্যাঁচকা টানে জড়িয়ে নেয়।
আরমানের এহেন কান্ডে কান্তা হতবাক হয়ে গেছে।

এদিকে আরমান কান্তাকে জড়িয়ে ধরেই ওর কপালে চুমু দিয়েছে। কান্তা পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে।
” বুঝলে ঝগরুটে বুড়ি, আজ আমার জীবনে সবচেয়ে খুশির দিন। যা এর আগে একবার এসেছিল। এত সুখ, এত খুশি, এত আবেগ আজ নিয়ে দুইদিন অনুভব করতে পারলাম। ” আরমানের চোখেমুখে খুশির ছাপ স্পষ্ট।
” এত খুশির কারন কি? যে গোমড়ামুখো কখনও হাসতে জানেনা, কিন্তু আজ তার মুখে হাসি ধরছেনা! এত আনন্দের কারন কি আমি জানতো পারি? ”

” তুমি না জানলে কে জানবে! খুশির খবরটা তোমাকে আগে জানাব বলেই তো এখানে ছুটে এসেছি। ”
” তারাতারি বলুনতো কি হয়েছে। আমার আর তর সইছেনা। যে খরব আমাকে ফোনে দেননি, এতদূর ছুটে এসেছেন। নিঃসন্দেহে খবরটা খুশির। এবার ঝটপট বলে ফেলুন। ”
” তুমি আর এখন থেকে নিতাই মাষ্টারের বউ নও। আজ থেকে তোমার পরিচয় সম্পূর্ণ নতুন। ”
” আসতাগফিরুল্লাহ। এসব কি বলছেন! আমি অতীতে আপনার বউ ছিলাম, বর্তমানেও আছি আর ভবিষ্যতেও থাকব। এই অলক্ষুণে সংবাদ দেয়ার জন্যই বুঝি কষ্ট করে ঢাকা থেকে এখানে এসেছেন? ”
কান্তার কথা শুনে আরমান হো হো করে হেসে ওঠে।

” আমি কি একবারও বলেছি, তুমি আমার বউ থাকবেনা? আমিতো বলেছি আজ থেকে তুমি নিতাই মাষ্টারের বউ নও। ”
” ঐ একই হল। কিন্তু আপনি আমাকে এমনভাবে বলতে পারলেন! কি দোষ ছিল আমার? ” কান্তার গলা কাঁপছে।
কান্তার মুখের দিকে তাকিয়ে আরমানের মনে মায়া জন্মায়।
” একি তুমি কাঁদছ কেন! আজকের দিনে অন্তত কেঁদনা। আরে পা’গ’লি মেয়ে তুমি যা ভাবছ, সেসব কিছুই নয়। আজীবন তুমি আমার বউই থাকবে। এবার চোখ মুছে আমার কথা মনযোগ দিয়ে শোন। ”

কান্তাকে একটু ধাতস্থ হওয়ার সময় দেয় আরমান। কান্তা চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।
” এবার শোন। আমাদের বিয়ের প্রায় দশ কিংবা পনের দিন আগে বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছিলাম। একদিন রেজাল্ট বের হল। আমি রিটার্নে টিকে গেলাম। এরপর ছিল ভাইভা। তোমার মনে আছে? একদিন তোমার কাছ থেকে দোয়া চেয়েছিলাম? বলেছিলাম, আমি গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছি? সেদিন ভাইভা ছিল। আজ সকালে ভাইভার রেজাল্ট হয়েছে। তোমার দোয়া বিফলে যায়নি। আমি ভাইভায় সিলেক্ট হয়েছি।

তোমার নিতাই মাষ্টার আর কিছুদিন পর এ এস পি পদে যোগ দিবে বাংলাদেশ পুলিশে। তাই তোমাকে প্রথমেই সংবাদটা জানাতে প্লেনে করে এসেছি। এতবড় একটা সংবাদ ফোনে দিতে মন চাইলনা। অনেক কষ্টে একটা টিকেট জোগাড় করে তোমার কাছে ছুটে এসেছি। ভাগ্যিস সেই এয়ারলাইন্সে আমার একটা বন্ধু জব করে। সে-ই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ” আরমানের কথা শুনে কান্তা আনন্দে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। আরমান কিছু না বলে ওকে বুকে জরিয়ে রাখে।

” তাহলে আপনাকে এখন আর নিতাই মাষ্টার বলতে পারবনা! আপনি এখন পুলিশ কাকু? এখন শরীর-স্বাস্থ মাশাআল্লাহ ঠিক আছে। কিন্তু আর কিছুদিন পর ঘু’ষ খেয়ে ভুঁড়ি বাড়াবেন। সেই ভুঁড়ি ইউনিফর্ম ঠেলে উঁকি দিবে৷ তখন আপনাকে দেখতে বিশ্রী লাগবে। ”

” তুমি আমাকে শুভেচ্ছা না জানিয়ে, এসব বলছ! হায়রে বউ! এতদিন নিতাই মাষ্টার বলতে তা-ও ঠিক ছিল। কিন্তু তাই বলে পুলিশ কাকু! আর কোন সম্ভাষণ ছিলনা? আজব মেয়ে তুমি। শোন মেয়ে, জীবনে অনেক কষ্ট করে আজ এ পর্যন্ত এসেছি। এজন্য টাকা-পয়সার মূল্য আর পাঁচজনের থেকে আমি ভালো জানি। তাই কারও কাছে থেকে তাদের র’ক্ত ঘামানো টাকা আমি নিতে চাইনা। তার প্রয়োজনও পরবেনা। তুমি শুধু দোয়া কর, সারাজীবন যেন সৎভাবে চলতে পারি। ”

দুজন বেশ কিছুক্ষণ খুনসুটিতে মাতে। এরপর আরমান ফ্রেশ হয়ে আসলে, কান্তা ওকে নিয়ে খাবার টেবিলে আসে।
কান্তা খুশির খবর ওর ফুপা-ফুপুকে জানায়। তারাও ভিষণ খুশি হন। আরমানকে প্রানভরে দোয়া করেন দুজনেই।
সেইদিন সন্ধ্যায়ই আরমান ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
কান্তা আজ অকারনেই হাসছে। আজ যেন নিজেকে চঞ্চলা প্রজাপতি মনে হচ্ছে। এত আনন্দও ওর ভাগ্যে ছিল! অনেকক্ষণ যাবৎ নিজে নিজে আনন্দ উদযাপন করে কান্তা ফোন করে শ্রীজাকে। তাকেও খবরটা জানানো দরকার।
শ্রীজা কান্তার মুখে খবরটা শুনে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।

কান্তার সাথে কথা শেষ করে ফোন করে আরমানকে। একে একে সবটা জেনে নেয়।
এরপর কথা শেষ করে ফোন রেখেই দৌড়ে ড্রয়িং রুমে আসে। সেখানে শুভ বাদে বাসার সবাই আছে।
” বাবা, ভাইয়া বিসিএস-এ প্রশাসন ক্যাডারে সিলেক্ট হয়েছে। আজ সকালেই রেজাল্ট হয়েছে। এইমাত্র ভাবি ফোন দিয়ে খবরটা জানাল। ” শ্রীজা খুশির চোটে হাঁপাচ্ছে।
শহিদ আহমেদ ছেলের অর্জন শুনে কেঁদে ফেলেন।
রাজিয়া খানম যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। আকলিমা খানমও তাই।

” সে আবার কবে বিসিএস দিয়েছিল? সত্যিই পাশ করেছে নাকি মিথ্যা বলে এই বাসায় আসার সুযোগ খুঁজছে? দেমাগে দেখিয়ে বের হয়ে যাওয়ার পর বুঝি মনে হয়েছে, এই বাসা ছাড়া তার কোথাও ঠাঁই সেই? আমি বলে রাখছি, একবার যে এই বাসা ছেড়েছে, তার আর এখানে জায়গা হবেনা। ” রাজিয়া খানম ব্যঙ্গ করে বলে।
” আম্মা, তুমি আরমানকে পছন্দ করনা, তা আমি ভালো করেই জানি। তাই আমি আশা করছি, তুমি ওর বিষয়ে কোন কথা বলবেনা। ছেলেটা যে মিথ্যা বলেনা তা আমরা সবাই জানি। অযথা এসব বলে নিজেকে সবার কাছে হাসির পাত্রী বানিওনা। ” ছেলের ঠান্ডা ধমক শুনে চুপসে যায় রাজিয়া খানম।

” দাদিমা, তোমার মুখ থেকে কি কখনোই ভালো কথা বের হয়না? যখনই মুখ খোল, তখনই দুর্গন্ধযুক্ত কথা বের হওয়ার জন্য হম্বিতম্বি করে! তোমার জন্ম নিশ্চয়ই নেগেটিভ ক্ষনে। একটা মানুষ যে এতটা বিরক্তিকর হতে পারে, তা তোমাকে না দেখলে জানতামনা। কারও ভালো দেখলে বোধহয় তোমার কষ্ট হয়? যতসব জ’ঘ’ন্য মানসিকতার মানুষ। ” শ্রীজা কথাগুলো বলেই নিজের রুমে ফিরে যায়।

রাজিয়া খানম নাতনির মুখে এমন কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে বুঝতে পারছে তার রাজত্ব দিন দিন ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছে। আজকাল ছোটরা তাকে সম্মান করছেনা।
খাদিজা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ওদের কথা শুনছিল। কিন্তু সে ওদের কথার কোন মাথামুণ্ডু বুঝতে পারেনা। তবে সে এতটুকু জানে, আরমানের বিষয়ে কথা হচ্ছিল। তার সবটা জানতে হবে৷ তাই গুটিগুটি পায়ে শ্রীজার রুমে যায়। শ্রীজার কাছ থেকেই সব শুনবে।

কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ১৯

আরমান কিছুক্ষণ আগেই বাসায় এসেছে। এখন রাত তিনটা বাজছে। ও ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে। রাত গভীর হলেও ওর চোখে ঘুম নেই। মনে মনে নানান পরিকল্পনা করছে। ওর ট্রেনিং শুরু হবে কিছুদিন পর থেকে। ততদিনে কান্তার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। মেয়েটাকে একা বাসায় রাখার রিস্ক ও নিতে পারবেনা। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় খালাকে ওর কাছে নিয়ে আসবে। তাকে আর ঐ বাসায় যেতে দিবেনা।
খালা আসলে ওর আর কোন চিন্তা থাকবেনা। আগামীকালই ও শ্রীজাকে ফোন করে সব জানাবে।

কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ২১