কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৯

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৯
মিসরাতুল রহমান চৈতী

সকাল হতে না হতেই পুরো শহরে হুলুস্থূল বেঁধে গেছে। সংবাদমাধ্যম, পুলিশ, সাধারণ মানুষ— সবাই যেন প্রস্তুত একটা বড় কিছুর জন্য। কিন্তু কেউ জানে না, আজকের দিনটা ইতিহাসের পাতায় কীভাবে লেখা হবে।
ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো ও কুখ্যাত পতিতালয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রাতুল আহমেদ। চোখেমুখে অদ্ভুত শীতলতা। এক হাতে ফোন, অন্য হাতে শক্তভাবে ধরে রাখা একটা কাগজ, যেখানে কিছু নাম লিপিবদ্ধ করা আছে। তার আশপাশে কিছু তরুণ কর্মী দাঁড়িয়ে, যারা তার নির্দেশের অপেক্ষায়।
আসিফ কাছে এসে বলল, “বস, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। পুলিশও এখনো আসেনি। আমরা কি শুরু করবো?”

রাতুল তাকাল সামনের বিশাল লোহার গেটটার দিকে। গেটের ওপাশে ভীত-সন্ত্রস্ত কিছু মেয়ে মুখ লুকিয়ে আছে, কিছু কৌতূহলী চোখ জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি দিচ্ছে।
“আমি জানি, ওরা ভয় পেয়েছে,” রাতুল ধীর কণ্ঠে বলল, “কিন্তু ওদের জানাতে হবে, আজকের দিনটা অন্যরকম।”
সে সামনে এগিয়ে এসে গর্জে উঠল, “গেট খুলুন! এই জায়গাটা আর চলবে না!”
ভেতর থেকে কারও কণ্ঠ শোনা গেল, “আপনি এখানে যা করছেন, তার ফল ভালো হবে না, মিস্টার রাতুল আহমেদ!”
রাতুল ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বিদ্রূপের হাসি টেনে বলল, “ফল আমি জানি। কিন্তু আজ কোনো আপস নেই। গেট খুলুন, নাহলে আমি নিজেই ভেঙে ফেলবো!”
আসিফ পেছন থেকে ইশারা করল, কয়েকজন কর্মী লোহার গেটের তালায় হাত লাগাল। মুহূর্তেই বিশাল একটা ধাক্কাধড়াম!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রথম ধাক্কাতেই তালা নড়তে শুরু করল। দ্বিতীয় ধাক্কায় ভেতর থেকে আতঙ্কিত কণ্ঠ, “থামুন! পুলিশ আসছে!”
রাতুল নিঃশ্বাস ফেলল, চোখ বন্ধ করল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। সে জানে, এটা শুধু একটা দরজা নয়— এটা ভাঙলেই শেষ হয়ে যাবে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা নারী পাচারের এক অন্ধকার অধ্যায়।
সে আবারও গর্জে উঠল, “গেট খোলেনি তো?”
ধড়াম!

তৃতীয় ধাক্কায় বিশাল লোহার গেটটা ভেঙে পড়ল। ভেতরের পরিবেশ এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।
ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে আর দালালদের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। কিছু মেয়ে ভয় পেয়ে পেছনে সরে গেল, কিছুজন হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
রাতুল ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করল। চারদিকে তাকিয়ে তার চোখ কঠিন হয়ে গেল। এই দেয়ালগুলোর ভেতর কত নারী বন্দী ছিল বছরের পর বছর! কত স্বপ্ন এখানে এসে ধ্বংস হয়েছে!
একজন মধ্যবয়সী মোটা লোক, যে সম্ভবত এখানকার মালিক, তড়িঘড়ি করে সামনে এল। মুখে জোর করে হাসির আভাস এনে বলল, “আপনি কী করছেন, মিস্টার আহমেদ? এটা আইনবিরুদ্ধ!”
রাতুল সরাসরি তার চোখে তাকাল, “আইন? তুমি আইনের কথা বলছো? এই জায়গাটার ভেতর যেসব অন্যায় চলছে, তার জন্য কোনো আইন কি কখনো দাঁড়িয়েছে?”
লোকটা একটু হকচকিয়ে গেল, তারপর বলল, “এখানে যারা আছে, তারা স্বেচ্ছায় আছে। আমরা তো কাউকে জোর করে আটকে রাখিনি!”

এইবার আসিফ সামনে এগিয়ে এসে বলল, “আচ্ছা, এইসব মেয়েদের জিজ্ঞেস করা হোক, তারা কি সত্যিই এখানে থাকতে চায়?”
রাতুল গম্ভীর গলায় বলল, “সবাই বাইরে আসো!”
কিছু মেয়ে ইতস্তত করলেও ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এলো। তাদের চোখেমুখে ভয়, অনিশ্চয়তা।
একটা ছোট মেয়ে, বয়স হয়তো ষোল কি সতেরো, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমরা যেতে চাই। কিন্তু আমাদের কোনো জায়গা নেই…”
রাতুল এবার পেছনে ফিরে তার কর্মীদের দিকে তাকাল।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৮

“আজ থেকে এই জায়গার নাম বদলে যাবে। এটা আর কোনো পতিতালয় থাকবে না। এখানে তৈরি হবে নারীদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র। যেখানে কেউ বাধ্য হয়ে নয়, বরং সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে।”
তার কণ্ঠ বজ্রের মতো গর্জে উঠল, “এই জায়গা আজ থেকেই বন্ধ!”
লোকটা এবার পুরোপুরি হতবিহ্বল। “এটা অসম্ভব! আপনি কিছুই করতে পারবেন না!”
রাতুল এবার কঠিন গলায় বলল, “আমি শুধু শুরু করেছি। বাকিটা সময় বলবে।”
ঠিক তখনই পুলিশের সাইরেন বাজতে শুরু করল।
শহর আজ এক নতুন পরিবর্তনের সাক্ষী হতে চলেছে।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২০