কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২১
মিসরাতুল রহমান চৈতী
শহরের গভীর রাত…
ঢাকার এই অংশটা যেন রাতের পর রাত অন্য এক দুনিয়া হয়ে ওঠে। দিনের আলোয় যে শহরকে স্বাভাবিক মনে হয়, রাত গভীর হতেই সেখানে জন্ম নেয় ভয়, নিষিদ্ধতা আর ক্ষমতার খেলাঘর। এই শহরের কিছু অন্ধকার কোণে জমে ওঠে অপরাধের বাজার, যেখানে টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয় বিবেক, ন্যায়বিচার আর মানুষ।
রাতুল এই শহরের এই নোংরা রূপের সাথে পরিচিত। তবে আজ সে এখানে আসছে নতুন এক পরিচয়ে—একজন ধ্বংসস্রষ্টা হয়ে।
কিন্তু তার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও…
একটা ছোট্ট ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল চৈতী।
তার চোখ বারবার ফোনের স্ক্রিনে চলে যাচ্ছিল। একটা মেসেজ, একটা ফোনকল—কিছুই আসেনি।
হঠাৎ বুকের মধ্যে কেমন যেন অজানা ভয় দোলা দিয়ে উঠল।
সে জানে না, এই শহরেরই অন্য এক গলিতে, তার জন্য একজন জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে।
রাতুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত গুটিয়ে নিচ্ছিল। আজ তার চোখে অন্যরকম এক আগুন। প্রতিশোধের আগুন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আগুন।
ঘরের দরজায় আসিফ দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ভাই, ভাবীর সাথে দেখা করবেন না?”
রাতুল গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে বলল,
“উঁহু, এখনো নয়।”
তার কণ্ঠে দৃঢ়তা ছিল, কিন্তু কোথাও যেন এক অদ্ভুত কষ্টও লুকিয়ে ছিল।
“আমি এখন গেলে ওর বিপদ হতে পারে। চারপাশে শকুনের দল উৎপেতে আছে। আমার মাধ্যমে ওর ক্ষতি হতে পারে। তাই এখন যাবো না। কিন্তু ছায়ার মতো ওর সাথে থাকবো।”
তারপর ধীরে ধীরে একটা সাদা কাগজ টেনে নিল টেবিল থেকে। পেন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল।
তারপর লিখতে শুরু করল…
চিঠিটা শেষ করে ভাঁজ করল সে, তারপর আসিফের দিকে বাড়িয়ে দিল।
“তুমি এটা গোপনে ওর কাছে দিয়ে আসবে। যাতে কেউ টের না পায়।”
আসিফ মাথা ঝাঁকাল।
“এখন চলো ক্লাব ঘরে যাই।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শহরের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, বিত্তশালী আর নীতিহীন মানুষগুলো এখানে এসে জড়ো হয়।
রাতুল গাড়ি থেকে নামল। তার চোখেমুখে ভয়ানক প্রশান্তি, কিন্তু ভেতরের আগুন ঠিকই বোঝা যাচ্ছিল।
তার সাথে আসিফ আর কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোগী।
আসিফ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল, “বস, ভেতরে পুলিশের প্রটেকশন থাকতে পারে।”
রাতুল ঠোঁটের কোণে একটুকরো তাচ্ছিল্যের হাসি টানল।
“তাহলে পুলিশকেও শিক্ষা দিতে হবে।”
ডায়মন্ড ক্লাবের প্রবেশপথে বিশাল দেহরক্ষীরা দাঁড়িয়ে ছিল।
তারা রাতুলের দলের দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটা প্রাইভেট ক্লাব, তোদের মতো রাস্তার কুত্তারা এখানে ঢুকতে পারে না!”
এক মুহূর্তের জন্য রাতুল স্থির হয়ে রইল। তারপর সজোরে ঘুষি মারল লোকটার মুখে!
“তোর সাহস হয় কী করে আমার সামনে এভাবে কথা বলার?”
লোকটা ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল।
বাকিরা কিছু বোঝার আগেই রাতুলের লোকগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল।
মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো ক্লাব দখলে চলে এলো।
মদের বোতল ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে, জুয়ার টেবিল উল্টে যাচ্ছে, মেয়েরা আতঙ্কে ছুটোছুটি করছে।
একটা মোটা গলা হুংকার দিয়ে উঠল, “তোরা জানিস না এটা কার জায়গা? তোর বাপের জায়গা ভাবছিস নাকি?”
রাতুল ধীর পায়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
একটা চেয়ার টেনে বসল।
“আজ থেকে এটা আর কারো জায়গা না।”
তারপরই শুরু হলো ভয়ানক সংঘর্ষ!
কেউ পিস্তল বের করতে গেলে তার হাত মুচড়ে ফেলা হলো, কেউ লাথি মারতে এলে তাকে মাটিতে ফেলে দেওয়া হলো!
“তোদের সময় শেষ। এখন আর ক্ষমতা বাঁচাবে না।”
সেই নেতা থরথর করে কাঁপছিল।
আর রাতুল ধীর পায়ে পিছনে ফিরে হাঁটতে লাগল।
শহরের অন্য এক প্রান্তে, জানালার পাশে বসে ছিল চৈতী।
রাত অনেক হয়ে গেছে, কিন্তু তার ঘুম আসছে না।
হঠাৎ তার কানের কাছে একটা নরম শব্দ হলো। সে দ্রুত তাকিয়ে দেখল, জানালার ফাঁক দিয়ে একটা খাম পড়ে আছে টেবিলে!
হাত কাঁপতে কাঁপতে খাম খুলল চৈতী।
তার চোখ স্থির হয়ে গেল প্রথম কয়েকটি লাইনে—
“আমার চৈতী,
আমার পৃথিবী, আমার সমস্ত…”
চৈতীর নিঃশ্বাস ধরা পড়ে গেল।
**”তুমি হয়তো ভাবছো, আমি কেন আসিনি। আমি কেন তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলছি না। জানো? আমি পারি না। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। আমি তোমার পাশে দাঁড়ানোর মতো একজন সাধারণ মানুষ নই, আমি এক অন্ধকারের সৈনিক। তুমি যদি আমার পাশে দাঁড়াও, তবে তোমার গায়ে রক্তের দাগ লাগবে। আমি জানি না, এই শহরের রাস্তাগুলো কখনো আমাদের জন্য হবে কিনা, আমি জানি না, আমার নামের পাশে তোমার নাম লেখা থাকবে কিনা… কিন্তু আমি জানি, আমার প্রতিটা নিশ্বাস তোমার জন্যই।
তুমি এই শহরের সমস্ত মায়া, সমস্ত আলোর প্রতিচ্ছবি। আমি সেই আলো থেকে দূরে থাকলেও, আমি তোমার আকাশের চাঁদ হতে চাই, যা তোমাকে সবসময় আলো দেবে, কিন্তু কখনো ছুঁবে না।
তুমি ভয় পেও না, চৈতী। আমি তোমার পাশেই আছি।
তোমার—
রাতুল।”**
চৈতীর হাত কাঁপছিল। তার চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
বাইরে, শহরের বাতাস ভারী হয়ে আছে।
আর কোথাও, অন্ধকারের মাঝে, একজন সৈনিক যুদ্ধ করছে। শুধুমাত্র একটিমাত্র মানুষের জন্য।
চৈতী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। জানালার ওপাশে রাত নীরব, কিন্তু তার ভেতরে এক তীব্র অস্থিরতা কাজ করছে। চিঠিটা এখনো তার হাতেই ধরা, আঙুলের স্পর্শে কাগজের ভাঁজগুলো যেন আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ধীরে ধীরে সে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। চিঠিটা যত্ন করে রেখে দিল সেখানে, তারপর তার হাত ধরা থাকল বুকের ওপর, ঠিক যেখানে হৃদস্পন্দন অনুভব করা যায়।
তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল পাশের রুমে। হাত ধুয়ে ওযু করল, ঠান্ডা পানি যেন তার গরম হয়ে ওঠা মনের ওপর শান্তির ছোঁয়া দিয়ে গেল।
সাদা একটা জায়নামাজ বের করে বিছিয়ে দিল মেঝেতে। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু তার হৃদস্পন্দনের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
সে তাকবির বলে নামাজ শুরু করল। প্রতিটি রাকাত, প্রতিটি সিজদায় তার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছিল জায়নামাজ। মনে হচ্ছিল, সে আল্লাহর সামনে তার সমস্ত কষ্ট উজাড় করে দিচ্ছে, সমস্ত ভয়, সমস্ত অস্থিরতা।
নামাজ শেষ করে সে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে একটা তসবিহ হাতে নিল।
“সুবহানাল্লাহ… আলহামদুলিল্লাহ… আল্লাহু আকবার…”
প্রতিটি শব্দ তার মনের অস্থিরতা কিছুটা প্রশমিত করছিল। প্রতিটি উচ্চারণ যেন রাতুলের জন্য একেকটা দোয়া হয়ে আকাশে উড়ছিল।
তারপর কোরআন শরীফটা খুলল সে। চোখের সামনে পবিত্র আয়াতগুলো ফুটে উঠতেই তার বুকের গভীরে একরকম প্রশান্তি ছড়িয়ে গেল।
সে পড়তে লাগল…
আস্তে আস্তে শব্দগুলো তার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, মনে হচ্ছিল, এই রাতে শুধু সে না, বরং কোথাও কোনো এক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাও এই শব্দের সুর শুনতে পাচ্ছে।
এভাবেই সে বসে রইল, রাতের গভীরে ডুবে যেতে যেতে, দোয়ায় দোয়ায় প্রিয় মানুষটার জন্য আলোর পথ খুঁজতে লাগল।
চৈতী জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছিল। শহরের অন্ধকার রাতে সমস্ত কিছু যেন একেবারে নিস্তব্দ হয়ে গিয়েছিল। কোথাও কেউ নেই, শুধু বাতাসের মৃদু শীতলতা, আর তাতে মিশে থাকা এক অদ্ভুত শূন্যতা। তার হাতের মধ্যে সেই চিঠি ছিল, কিন্তু সে জানতো, সেই চিঠি আর কিছুই নয়, রাতুলের অঙ্গীকার, একটি প্রতিশ্রুতি। তবে তার মানে কী ছিল?
ঘরের কোণায় থাকা আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখল। সে খুবই একা, যেন তার চারপাশে ভীষণ শূন্যতা। একটা মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, সে এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে, কোথাও নেই, কোথাও যাবার মতো কিছু নেই। শুধু রাতুলের প্রেতরূপে শূন্য জায়গায় হাঁটছিল সে।
তার মন তখন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। এক দিকে, তার নিজের সাহসিকতা, অন্য দিকে, রাতুলের পথের অন্ধকার। সে জানতো, রাতুল এক যুদ্ধে রওনা হয়েছে, আর সে সেই যুদ্ধের অংশ হতে পারবে না। শহরের অন্ধকারের মাটিতে একটি প্রেম, একটি প্রতিশ্রুতি গভীর হয়ে বসে আছে, আর চৈতী জানতো, এই অন্ধকারে এক মুহূর্তের জন্য সে সঠিক দিকটি খুঁজে পাবে না।
কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২০
ফলে, সে চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার সিদ্ধান্ত ছিল একেবারে স্পষ্ট। রাতুলের যুদ্ধে তার কোনো ভূমিকা হবে না। তবে, তার মন সে জায়গায় পৌঁছাল, যেখানে সে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে চেয়েছিল। সেখানে না রাতুল, না অন্ধকার, শুধু চৈতী এবং তার নিজের অস্তিত্ব ছিল।
সেদিনের রাত চৈতীর জীবনের একটি নতুন সূচনা ছিল, যেখানে নিজেকে বুঝতে পারার মতো শান্তি মিলেছিল।