কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২৫
মিসরাতুল রহমান চৈতী
রাত গভীর। সেহরির সময় ঘনিয়ে আসছে। চৈতী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, শরীরের তাপমাত্রা বেশ বেড়ে গেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। বিছানার একপাশে শুয়ে থাকা চৈতীর দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলো রাতুল।
রাতুল আর আসিফ রুমের এক কোণে বসে আছে। চারপাশে নীরবতা, মাঝে মাঝে বাইরে থেকে ভেসে আসছে গাড়ির হর্ন । টেবিলে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনে কিছু ফাইল ওপেন করা, হাতে ধরা মোবাইলের স্ক্রিনে বারবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে রাতুল। একসময় চোখ তুলে আসিফের দিকে তাকিয়ে বললো—
— “ভিডিও কখন আসবে?”
আসিফ কিছুক্ষণ ফোন স্ক্রলে চোখ বুলিয়ে উত্তর দিলো,
— “এসে যাবে ভাই, ওতো টেনশন করবেন না।”
রাতুল মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে থাকলো। তারপর একরকম ফুঁসে উঠে বললো—
— “টেনশন কি স্বাদে হচ্ছেরে! কাল দেলোয়ার খন্দকারের একটা প্রেস মিট আছে, তার ঠিক আগেই সব ডকুমেন্ট আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেবো। এরপর সে কি বলে সেটাই দেখার বিষয়। কিন্তু দেলোয়ার তো এখানেই থামবে না, সে বদলা নেবেই।”
আসিফ গভীরভাবে শুনছিল, কিছু বললো না। রাতুল আবার বলতে শুরু করলো—
— “দেলোয়ারের পরে আরো বড় দুজন নেতা আছে, তাদের সাথে কৌশলে মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের একটা ভুল হলেই পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।”
আসিফ গম্ভীর গলায় বললো—
— “ভাই, ভাবীর ওপর যে আক্রমণ করেছে, তাকে কে পাঠাতে পারে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাতুল মৃদু হাসলো, তবে সেই হাসির মধ্যে তীব্র রাগ আর হিসেব-নিকেশের ছাপ স্পষ্ট। তারপর ধীর গলায় বললো—
— “আসিফ, আমি যদি ভুল না করি, তাহলে এই কাজটা দেলোয়ার ছাড়া আর কেউ করবে না।”
রাতুলের চোখের কোণায় উত্তপ্ত এক ধরনের ঝলক দেখা গেলো। মনে হচ্ছে, ভেতরে ভেতরে সে খুব দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আসিফও বুঝতে পারছে, এবার রাতুল শুধু পাল্টা চাল দেবে না— পুরো খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যই এগোবে।
রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। বাইরে মসজিদ থেকে ভেসে আসছে হুজুরদের জিকিরের মৃদু ধ্বনি। কোনো কোনো মসজিদে গজল চলছে, আবার কোথাও কোরআন শরিফের তিলাওয়াত শোনা যাচ্ছে। পুরো পরিবেশে এক ধরনের প্রশান্তি, এক ধরনের আধ্যাত্মিক সুর বইছে, কিন্তু রাতুলের মনে ঝড়।
আসিফ একবার মোবাইলে সময় দেখে বললো—
— “ভাই, সেহেরি করবেন না?”
রাতুল ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে বললো—
— “ওই অসুস্থ মানুষটাকে না খাইয়ে আমি কী করে খাই বলতো? ওকে না খাইয়ে কিছু মুখে তুলতে পারবো না।”
আসিফ গভীর দৃষ্টিতে রাতুলের দিকে তাকালো, তারপর গলায় উদ্বেগ নিয়ে বললো—
— “ভাই, আজকে দিনভর অনেক কিছু সামলাতে হয়েছে। তার উপর কালও বড় ঝড় আসবে। না খেয়ে রোজা রাখলে শরীর সহ্য করতে পারবে?”
রাতুল ধীরস্থির কণ্ঠে বললো—
— “ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ ঠিক চালিয়ে নেবে। তুই খেয়ে নে যা, আমি পরে দেখবো।”
আসিফ মাথা নাড়িয়ে বললো—
— “ভাই, মাফ করবেন, আপনি না খেলে আমি খেতে পারবো না। বেশি কিছু না খান, অন্তত কিছু ফল আর জুস খান। সারাদিনের শক্তি দরকার হবে।”
রাতুল আসিফের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নীরব রইলো, তারপর হালকা হাসলো। এক হাতে আসিফের পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে বললো—
— “আসিফ, তুই আমার দুঃসময়ের সঙ্গী। কখনো একলা ফেলে যাস না ভাই।”
আসিফ চোখেমুখে দৃঢ়তা এনে বললো—
— “যাবো না ভাই, আল্লাহ কসম। আপনি বসেন, আমি সেহেরি নিয়ে আসছি।”
রাতুল আসিফের দিকে তাকিয়ে থাকলো। একেকজনের সাথে সম্পর্ক রক্তের বাঁধনে হয়, আবার কিছু সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় তৈরি হয়। আসিফ ছিলো রাতুলের জীবনের ঠিক এমনই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সে আর আসিফ একসাথে সেহেরি করছে। রাতুল কোনো রকমে দু-চার লোকমা মুখে তুললো, তারপর আর দেরি না করে উঠে গেলো চৈতীর কাছে। মেয়েটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, অসুস্থ শরীর নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাতুল আলতো করে চৈতীর কপালে হাত রাখলো— শরীর এখনো গরম। ফোঁস করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে।
তারপর উঠে গিয়ে ওযু করলো। ঘড়িতে এখনো বেশ সময় আছে, তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো সেই সময়টুকু তাহাজ্জুদের নামাজে কাটাবে। জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়াতেই পাশ থেকে আসিফও দাঁড়িয়ে গেলো।
দুজন দুই পাশে, দুজন দুই জীবন থেকে আসা, কিন্তু একসাথে একই সৃষ্টিকর্তার সামনে নতজানু। ভোরের আলো ফোটার আগেই তারা শুদ্ধ হয়ে নিতে চায়, মনের গহীনে জমে থাকা ক্লান্তি ধুয়ে ফেলতে চায়।
শহরের ঘুমন্ত অন্ধকারের মাঝে তাদের নামাজের সুর গুমোট বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো।
নামাজ শেষ করে রাতুল আর আসিফ একসাথে জায়নামাজ গুটিয়ে রাখলো। বাইরে তখনো গভীর রাতের নিস্তব্ধতা।
কিন্তু তাদের দৃষ্টি আটকে আছে ল্যাপটপের স্ক্রিনে।
দুজনই অপেক্ষা করছে, কখন সেই গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও ক্লিপ আসবে। রাতুল বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, আর আসিফ আনমনে ল্যাপটপের কী-বোর্ডে আঙুল চালাচ্ছে। সময় যেন থমকে গেছে তাদের জন্য।
হঠাৎ ‘ডিং!’ করে একটা নোটিফিকেশন এল। আসিফ দ্রুত মাউস ক্লিক করলো, আর পর্দায় ফুটে উঠলো সেই ভিডিও ক্লিপ। অবশেষে তাদের অপেক্ষার অবসান হলো।
রাতুল গভীর দৃষ্টিতে পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকলো, যেন আগত ঝড়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে।
রাতুল চোখ সরু করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। আসিফ দ্রুত ভিডিওটি প্লে করলো। পর্দায় দেলোয়ার খন্দকারের এক গোপন মুহূর্ত ফুটে উঠলো—একটি বিলাসবহুল রুম, নরম হলুদ আলো, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে এক তরুণী। মেয়েটি স্পষ্টতই অস্বস্তিতে, কিন্তু দেলোয়ার খন্দকার তাকে জোর করে ধরে রেখেছে। মুহূর্তের মধ্যে সে মেয়েটিকে কাছে টেনে নিলো, আর ভিডিও সেখানেই শেষ।
আসিফ ধীরে ধীরে মুখ তুললো রাতুলের দিকে। “ভাই, এইটা তো ধামাকা! প্রেস মিটের আগে এটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিলে ওর কোনো সুযোগই থাকবে না নিজেকে পরিষ্কার করার।”
রাতুল ঠোঁট চেপে ধরলো। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো, “এটা একদিক দিয়ে আমাদের জন্য ভালো, কিন্তু ওই মেয়েটার কী হবে? দেলোয়ার তো যেকোনো মূল্যে ওর পরিচয় বের করবে। আমরা এমন কিছু করতে চাই না, যাতে একজন নির্দোষের জীবন নষ্ট হয়ে যায়।”
আসিফ কাঁধ ঝাঁকালো। “কিন্তু ভাই, এই ভিডিওটায় প্রমাণ আছে যে দেলোয়ার খন্দকার কতটা নোংরা। এটাই তো ওকে শেষ করার মোক্ষম অস্ত্র!”
রাতুল চোখ নামিয়ে ভাবলো। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বেশি সময় নেই। ঠিক তখনই চৈতী ঘুমের ঘোরে একটু কেশে উঠলো। রাতুলের দৃষ্টি তার দিকে গেলো। চৈতীর জ্বর এখনো কমেনি। তার অসুস্থ শরীরের দিকে তাকিয়ে রাতুলের মনের ভেতর কিছু একটা শক্ত হয়ে উঠলো।
সে গভীর শ্বাস নিয়ে বললো, “ভালো করে চিন্তা করতে হবে। আমরা এই ভিডিও ব্যবহার করবো, তবে বুদ্ধি করে। আমাদের এমন কৌশল নিতে হবে, যাতে দেলোয়ারের পতন হয়, কিন্তু সেই মেয়েটার জীবনও নষ্ট না হয়।”
আসিফ মাথা নেড়ে বললো, “তাহলে এখন কী করবো ভাই?”
রাতুল চোয়াল শক্ত করলো। “প্রেস মিটের আগেই ভিডিওটা ছড়াতে হবে, কিন্তু শুধু দেলোয়ারের অংশটুকু। মেয়েটার চেহারা ঝাপসা করে দিতে হবে, যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে। আমাদের লক্ষ্য দেলোয়ার খন্দকারকে ফাঁসানো, কাউকে বিপদে ফেলা না।”
আসিফ দ্রুত ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেলো, ভিডিও এডিট করতে। রাতুল এক ঝলক তাকালো চৈতীর দিকে। তার মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ রাতুলকে মনে করিয়ে দিলো—এ লড়াই শুধু তার নিজের জন্য না, যারা নির্দোষ তাদের জন্যও।
আসিফ দ্রুত ভিডিওটি এডিট করতে লাগলো, দেলোয়ার খন্দকারের মুখ স্পষ্ট রেখে মেয়েটির চেহারা ঝাপসা করে দিলো। ভিডিওর শেষে বড় হরফে লেখা উঠলো— “এই কি আমাদের নেতা?”
রাতুল গভীর চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর আসিফ বললো, “ভাই, পোস্টটা একবার দেখে নেন। সব ঠিক আছে তো?”
রাতুল মাথা নাড়িয়ে বললো, “পোস্ট করো। ঠিক দেলোয়ারের প্রেস মিটের আধাঘণ্টা আগে এটা ছড়িয়ে দিতে হবে।”
আসিফ দ্রুত কাজ শুরু করলো। রাতুল উঠে গিয়ে চৈতীর কপালে হাত রাখলো। শরীর এখনো উষ্ণ। আস্তে করে কম্বলটা ঠিক করে দিলো তার ওপর, তারপর জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ভোরের আলো ফুঁটে উঠছে। দূরের মসজিদ থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে এলো।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। অপরিচিত নম্বর। রাতুল কল রিসিভ করলো।
“ভাই, সাবধান! দেলোয়ার খন্দকার টের পেয়ে গেছে ওর বিরুদ্ধে কিছু একটা হচ্ছে। ওর মানুষজন আপনাকে খুঁজছে!” অপরপ্রান্ত থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় কেউ বললো।
রাতুলের চোখ কুঁচকে গেলো। “কে বলছেন?”
“এটা জানার দরকার নেই। শুধু বলছি, ও আপনাদের শায়েস্তা করতে চাইছে। সাবধানে থাকবেন ভাই!”
লাইন কেটে গেলো।
কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২৪
রাতুল ফোনটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরলো। পেছন থেকে আসিফ বললো, “ভাই, ভিডিও পোস্ট হয়ে গেছে। এখন দেলোয়ার খন্দকার কী করে দেখি!”
রাতুল ধীরে ধীরে ঘুরে তাকালো। চোখেমুখে অদ্ভুত এক কঠিন অভিব্যক্তি। তারপর নিচু স্বরে বললো, “এখন খেলাটা শুরু হলো, আসিফ!”
