কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২৭

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২৭
মিসরাতুল রহমান চৈতী

সূর্য মাথার ওপরে, দিনের আলো বাইরে ছড়িয়ে আছে। শহরের কোলাহল এদিকটায় কম, তবে মাঝেমধ্যেই গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ধুলোমাখা পথ পেরিয়ে রাতুল নিজের গোডাউনের সামনে এসে দাঁড়াল। গেটের সামনে দু’জন লোক পাহারায় ছিল, তারা রাতুলকে দেখেই সরে দাঁড়াল।
ভেতরে ঢুকতেই একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে আসল—রক্ত, ঘাম আর স্যাঁতসেঁতে বাতাসের একটা মিশ্রিত গন্ধ। আলো কম, তবে জানালার ফাঁক গলে সূর্যের আলো এসে মেঝের কিছু অংশ আলোকিত করেছে।
সামনে সেই লোকটা, যে চৈতীকে মারতে গিয়েছিল। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একটা কাঠের চেয়ারে বসানো। মাথা ঝুঁকে আছে, চুলগুলো এলোমেলো, শরীরজুড়ে কালশিটে দাগ।
রাতুল ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। একপাশে রাখা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, “কেমন আছিস?”

লোকটা মুখ তুলল না, হয়তো ভয়েই কথা আটকে গেছে।
রাতুল চোখ সরু করল, তারপর বলল, “তোর জন্য সময় খুব বেশি নেই, বুঝছিস তো?”
লোকটা কোনো কথা বলল না, শুধু মাথা নিচু করে থাকল। শরীরটা কাঁপছে কি না, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।
রাতুল এক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল, “ভয় পেয়েছিস? ঠিক আছে, ভয় পাওয়া উচিত। তবে ভয় পেলে কাজ শেষ হয়ে যাবে। আমার ধৈর্যও সীমিত।”
সে উঠে দাঁড়িয়ে একপাশে হাঁটতে লাগল। গোডাউনের ভেতর বাতাস ভারী হয়ে আছে, যেন চারপাশের দেওয়ালগুলোও টেনশন অনুভব করছে।
“কে তোর নির্দেশদাতা?”
লোকটা এবার কাঁপতে কাঁপতে মুখ তুলল। ঠোঁট শুকনো, চোখে একটা অসহায় দৃষ্টি।
“আমি… আমি কিছু জানি না…”
রাতুল বাঁকা হাসল। “ভুল উত্তর।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আবার বসল। চোখেমুখে কোনো অনুভূতি নেই, কেবল গভীর মনোযোগ দিয়ে লোকটাকে দেখছে। তারপর নিচু গলায় বলল, “চৈতীর ওপর হামলা করলি কেন? কী উদ্দেশ্য ছিল?”
লোকটা মুখ খুলতে গিয়েও যেন গিলে ফেলল শব্দগুলো।
রাতুল এবার হাতের আঙুলগুলো টোকা দিতে লাগল চেয়ারের হাতলে। “আমি চাইলে তোকে এখান থেকে বের করতেও পারি। কিন্তু তার আগে সত্যিটা বলতে হবে।”
লোকটা একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে লাগল। হয়তো পালানোর উপায় খুঁজছে।
রাতুল এবার ধীর স্বরে বলল, “তোর জন্য দুটো রাস্তা খোলা। এক, সত্যিটা বলবি আর আমি তোকে নিয়ে ভাবব। দুই, চুপ থাকবি, আর আমি নিজেই ব্যবস্থা নেব।”
লোকটা এবার গলা শুকিয়ে বলল, “আমাকে… আমাকে ছেড়ে দেন… আমি… আমি বলছি…”
রাতুল একদম স্থির হয়ে গেল। তার চোখ দুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল।

“বল।”
লোকটা আতঙ্কিত চোখে রাতুলের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আমাকে ভয় দেখাতে না, মেরে ফেলতে বলেছিল!”
রাতুলের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। চোখের গভীরে ঝলসে উঠল একরাশ অস্থিরতা। সে ধীর পায়ে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“কে বলেছে?”
লোকটা গলা শুকিয়ে গেলেও ভয়ে সত্যটা বলেই দিল, “দেলোয়ার খন্দকার!”
রাতুলের মুখে একটুও বিস্ময় ফুটল না। যেন সে আগেই জানত এমন কিছু হবে। ঠান্ডা গলায় বলল,
“তুই নিশ্চিত?”
“হ্যাঁ, আমি মিথ্যা বলছি না!” লোকটা ভয়ে কাঁপতে লাগল, “ও আমাকে টাকা দিয়েছে চৈতীকে শেষ করে দিতে! আমি শুধু সুযোগ খুঁজছিলাম…”

রাতুল এবার মুখে হালকা একরকম উপহাসের হাসি টেনে বলল,
“তাহলে তোরও বাঁচার কোনো সুযোগ নেই।”
লোকটার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, সে আতঙ্কে মাথা নাড়ল, “না, না, প্লিজ! আমাকে ছেড়ে দিন! আমি আর কখনো…”
রাতুল পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে রইল, তারপর নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল।
রাতুল গুদামের নিস্তব্ধতা ভেঙে এক ঝটকায় বের হয়ে এল। মাথায় হাজারও চিন্তা, চোখে স্থির লক্ষ্য। সে এক কথায় গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। অন্ধকার রাস্তা পেরিয়ে, দিনের আলোও যেন অস্পষ্ট হয়ে আসছিল, রাতুল দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চৈতীর দিকে রওনা দিল।

চৈতী বিছানায় শুয়ে, জ্বরে আছন্ন হয়ে ছিল। তীব্র শরীরী ব্যথায় তার চোখ মলিন, আর হাতের ক্ষতটা মারাত্মক। রক্তের দাগগুলো একে একে শরীরের ওপর ছড়িয়ে পড়ছিল। তার নিঃশ্বাস ভীষণ ভারি, যেন প্রতিটি মুহূর্ত তাকে আরও বেশি ক্লান্ত করে তুলছে। তবে তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত নিরবতা, যেন এই মুহূর্তে তার শরীরের যন্ত্রণা নীরব হয়ে গেছে, কেবল রাতুলের আসা অপেক্ষায় ছিল।
রাতুল ধীর পায়ে চেয়ার টেনে চৈতীর পাশে বসে, তার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বললো, “চৈতী, তোমার জ্বর কমেছে?”
চৈতীর চোখে কিছুটা চমক উঠে, তারপর সে তাকালো রাতুলের দিকে। তাদের চোখাচোখি হলো, আর মুহূর্তের জন্য সময় থেমে গেল। চৈতী কিছুক্ষণ চুপ রইল, তারপর হালকা হাসি দিয়ে বলল, “ঠিক আছি আমি।”
নিঃশব্দ ঘরের মধ্যে তাদের শ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। কেবল সময় যেন একে একে কাটছিল, অতিরিক্ত শান্তিতে ভরা।

এই নিস্তব্ধতা ভেঙে রাতুল ধীরে কন্ঠে বলল, “চৈতী, তোমাকে আমি আমার হৃদয় থেকে ভালোবাসি। তুমি আমার এমন ভালোবাসা, যাকে না ছুঁয়েও অনুভব করতে পারি। কিন্তু আফসোস, তুমি বুঝলে না আমার ভালোবাসা।”
চৈতী কিছুক্ষণ চুপ থেকে, তার চোখে গভীর কিছু ছিল, তারপর ধীরে কন্ঠে উত্তর দিল, “আমি ছুঁয়ার আগে, শত নারী ছুঁয়ে দিয়েছে আপনাকে। আমি মেনে নিতে চাইলেও পারছি না।”

রাতুল তার উত্তরের মধ্যে কোনো কষ্ট খুঁজে পেল না, কেবল এক চরম অভ্যস্ত হাসি তার মুখে ফুটে উঠল। তারপর কিছুটা থেমে, একটি আবেগঘন স্বরে বলল, “সবাই তো ছুঁয়ে পেতে চায়, আমি না হয় না ছুঁয়েই পাই। তুমি আমার মনের আকাশের এক ফাঁলি চাঁদ। আর সেই চাঁদের আলোয় আলোকিত হয় আমার অন্ধকার গহ্বরে ঘেরা মনটা।”
চৈতী কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার চোখে কিছুটা অবিশ্বাস, কিছুটা চরম বাস্তবতা, কিছুটা ক্ষোভ, কিন্তু এর মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত শান্তি ছিল, যেন রাতুলের বলা কথাগুলো তার মনকে অজান্তেই স্পর্শ করেছে।
রাতুল তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর ধীরে পেছনে ফিরল। তার চোখে তখন কষ্টের কোনো চিহ্ন ছিল না, বরং এক ধরনের স্থিরতা ছিল, যা চৈতীর কাছে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করেছিল।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২৬

এমন এক মুহূর্তে তাদের মধ্যে সংঘাতময় ভালোবাসার দন্ড অনুভূত হতে থাকল। একদিকে ছিল চৈতীর ভঙ্গুর মন, যে কখনো কোনো আবেগকে আঁকড়ে ধরতে পারছিল না, আর অন্যদিকে ছিল রাতুলের গভীর ভালোবাসা, যে তাকে ছুঁতে না পেরেও, তার মনের অন্ধকারে এক নিঃশব্দ আলো ফেলা চেয়েছিল।
তাদের ভালোবাসা কখনো সহজ ছিল না, কখনো তা ছিল কষ্টের, কখনো ছিল অস্পষ্ট। তবে এই সংঘাতময় ভালোবাসার দন্ড ছিল, যা কখনো একে অপরকে আলাদা করে তোলে, আবার কখনো একে অপরকে অন্ধকারে আলোকিত করে।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২৮