কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩০

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩০
মিসরাতুল রহমান চৈতী

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে চৈতী, সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে। গাঢ় নীল আকাশের বুকজুড়ে লালচে-কমলা আভা ছড়িয়ে পড়েছে, হালকা বাতাস বইছে। সে নির্বাক দৃষ্টিতে আকাশ দেখছে, যেন হারিয়ে গেছে কোনো গভীর চিন্তায়।
রাতুল এসে চুপচাপ তার পাশে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ চৈতীর শান্ত মুখটা দেখল, তারপর আস্তে ধীরে জিজ্ঞেস করল,
— “কি হয়েছে? মন খারাপ?”
চৈতী চোখ নামিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
— “হুট করে মা-বাবার কথা মনে পড়ছে… ওনাদের কবরটা দেখতে ইচ্ছে করছে, এমপি আহম্মেদ! অনেকদিন হলো ওনাদের কবর দেখি না, জিয়ারত করাও হয় না।”
রাতুল গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল চৈতীর মুখের দিকে। তার কণ্ঠের বিষণ্ণতা রাতুল অনুভব করতে পারল।
— “তুমি যেতে চাও?”
চৈতী চুপ করে রইল।
রাতুল হালকা হেসে বলল,

— “যাও, গিয়ে রেডি হয়ে নাও। আমরা এখনই বেরিয়ে যাবো। সমস্যা নেই, আমার মুখে মাস্ক থাকবে, আর সাথে কোনো বডিগার্ডও থাকবে না। একদম সাধারণভাবে যাবো।”
চৈতীর ঠোঁটের কোনে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠল।
রাতুল চৈতীর মুখের সেই হাসিটা দেখেই শান্তি অনুভব করল।
চৈতী ধীরে ধীরে রুমের দিকে পা বাড়াল, আলমারি খুলে একটা ভালো জামা আর বোর্খা বের করে নিল। তারপর ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল প্রস্তুতি নিতে।
চৈতী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল, বোরকা পরে, কিন্তু মাথার হিজাবটা ঠিক করতে একটু সমস্যা হচ্ছিলো। এমন সময় রাতুল ব্যস্ত পায়ে বেলকনি থেকে রুমে এসে পৌঁছালো। চুপচাপ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, রাতুল চৈতীর কাছে গিয়ে হিজাবটা হাতে নিয়ে, তার মাথায় যত্ন সহকারে পড়িয়ে দিলো। চৈতীর চোখে এক ধরনের শান্তি ও আস্থার আলো ফুটে উঠলো।
রাতুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিল। কালো রঙের সরল ডিজাইনের পাঞ্জাবি, কোনো বাড়াবাড়ি নেই, তবু তার ব্যক্তিত্বে একটা আলাদা দৃঢ়তা এনে দিয়েছে।
কোনো কথা হলো না তাদের মধ্যে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একটি বাক্যও নয়।
শুধু দুজনের মাঝে ছড়িয়ে রইল এক গভীর নীরবতা।
চৈতী দরজার দিকে পা বাড়াল, রাতুল পেছন পেছন এগিয়ে এল।
গাড়ির দরজা খুলতেই চৈতী চুপচাপ বসে পড়ল। রাতুলও পাশের আসনে বসল, ইঞ্জিন চালু করল, আর গাড়িটা ধীরগতিতে বেরিয়ে গেল শহরের কোলাহলের দিকে।
সন্ধ্যার ব্যস্ত ঢাকা।
রাস্তার প্রতিটি মোড়ে গাড়ির লম্বা সারি, রাস্তায় থেমে থাকা রিকশা আর পথচারীদের আনাগোনা। ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে থাকা গাড়িগুলো ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।
রাতুল একবার পাশ ফিরে তাকাল চৈতীর দিকে।
চৈতী জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়েছে, বাইরে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে।
কোথাও কোনো কথা নেই, তবু চারপাশের কোলাহলের মাঝেও ওদের মাঝে একধরনের বোঝাপড়া স্পষ্ট হয়ে আছে—শব্দ ছাড়াই।
গাড়িটা বনানী ক্রস করতেই শুরু হলো সেই চিরচেনা যানজট। চারপাশে থমকে থাকা গাড়ির দীর্ঘ লাইন, ক্ল্যাক্সনের অবিরাম চিৎকার, মোটরসাইকেলের বিশ্রী শব্দ—সব মিলিয়ে এক জটিল অবস্থা।
চৈতী ক্লান্ত চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফল বিক্রেতা, রিকশাওয়ালা, ফুটপাতে বসা ভিক্ষুক—সবকিছু তার চোখে ধরা দিল, কিন্তু মনোযোগ কোথাও স্থির হলো না।
প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে থেমে থেমে চলার পর তারা অবশেষে গাবতলী পার হলো। হালকা শ্বাস ফেলল রাতুল।
— “আরেকটু এগোলে শহরের কোলাহল থেকে বের হয়ে আসতে পারবো। তারপর গ্রামের পথ ধরবো।”
চৈতী শুধু মাথা ঝাঁকাল।

শহরের ব্যস্ততা পেছনে ফেলে তারা যখন সাভারের শেষ প্রান্ত ছাড়িয়ে গেল, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। চারপাশে আলো-আঁধারের খেলা।
গাড়ির জানালা দিয়ে হালকা শীতল বাতাস চৈতীর চুল এলোমেলো করে দিল। তার চোখের দৃষ্টি গভীর হয়ে এল—শহর থেকে গ্রামে ফেরার অনুভূতি যেন এক অন্যরকম।
কিছুক্ষণ পরই গাড়িটা ছোট্ট বাজার পেরিয়ে কাঁচা রাস্তার মুখে এসে থামল।
রাতুল এবারই প্রথম চৈতীর দিকে তাকিয়ে বলল,
— “পৌঁছে গেছি…”
চৈতী একবার সামনে তাকিয়ে দেখল সাইনবোর্ড—
“কাঞ্চনপুর গ্রাম”
তার চোখের ভেতর এক অজানা অনুভূতি খেলা করল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরে ধীরে দরজা খুলে গাড়ি থেকে নামল।
চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা। দূরে কয়েকটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে হালকা বাতাসে নারকেল পাতার খসখস শব্দ ভেসে আসছে।

রাতুল গাড়ির দরজা বন্ধ করে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল, তারপর কোনো কথা না বলে এগিয়ে গেল সামনে।
চৈতী একবার চারপাশটা দেখল। কতদিন পর এখানে আসা, একটা অদ্ভুত অনুভূতি তার ভেতর কাজ করছে। এই মাটির প্রতিটি ধুলোবালি যেন তার চেনা, তবুও আজ সবকিছুই যেন কেমন অচেনা লাগছে।
রাতুল নিরবে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলল, চৈতী তার পেছনে হাঁটতে শুরু করল।
কয়েক কদম হাঁটতেই একটা পুরোনো লোহার গেট দেখা গেল। গেটের ওপাশে বিশাল একটা বটগাছ, তার ছায়ায় ঢাকা পড়েছে একটা ছোট্ট কবরস্থান।
চৈতী দাঁড়িয়ে পড়ল গেটের সামনে।
তার বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল।
এইখানেই তার মা-বাবা শুয়ে আছেন… চিরনিদ্রায়…
চৈতী ভেতরে ঢুকল।
মাটির ওপর ঘাস জন্মে গেছে, কয়েকটা শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে এদিক-ওদিক। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, হাত বাড়িয়ে কবরের ওপর হাত রাখল।
কোনো শব্দ নেই।

কেবল নিঃশব্দ কান্না গড়িয়ে পড়ছে তার চোখ থেকে…
রাতুল একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখল।
সে জানে, এই মুহূর্তে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই।
শুধু এই নীরবতাটুকুই যথেষ্ট…
রাতুল কিছুক্ষণ চৈতীর দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর ধীরে পেছন ফিরল।
কবরস্থানের ঠিক পাশেই একটা পুরোনো মসজিদ। ছোট্ট, সাদামাটা, কিন্তু খুব পরিচ্ছন্ন।
মসজিদের চারপাশে নারকেল গাছ আর কাঁঠাল গাছের সারি। একপাশে রাখা অজুখানা, সামনে বিস্তৃত উঠান, আর মূল দরজার ওপরে নীল রঙের নামফলক—”নূরজাহান জামে মসজিদ”।
রাতুল ধীর পায়ে মসজিদের ভেতরে ঢুকল। মসজিদের ভিতরে একটা নরম প্রশান্তির অনুভূতি আছে। মেহগনি কাঠের মিহি খোদাই করা মিম্বরটা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে কয়েকটা সাদা জায়নামাজ বিছানো, আর দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারে নামাজের সময় লেখা।
ভাগ্যক্রমে, ইমাম সাহেব সেখানেই ছিলেন।

বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, মাথায় সাদা টুপি, মুখে হালকা দাড়ি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি ও পাজামা। তিনি মসজিদের একপাশে বসে কোরআন তিলাওয়াত করছিলেন।
রাতুল ভদ্রভাবে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো,
— “আসসালামু আলাইকুম, হুজুর।”
ইমাম সাহেব মাথা তুলে তাকালেন, শান্ত গলায় জবাব দিলেন,
— “ওয়ালাইকুম সালাম, বাবা। বলো বাবা কি সাহায্য করতে পারি?
রাতুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
— “আমার স্ত্রী অনেকদিন পর তার বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করতে এসেছে। আমি চাইছিলাম, আপনি যদি কিছু দোয়া পড়ে দিতেন…”
ইমাম সাহেব স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে রাতুলের দিকে তাকালেন।
— “নিশ্চয়, বাবা। কবর জিয়ারত বড় সওয়াবের কাজ। চলো, যাই।”
তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, কোরআন শরিফটা আলমারিতে রেখে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলেন।
রাতুল তার পাশে পাশে চলল।

চৈতী তখনও কবরের সামনে বসে আছে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে।
ইমাম সাহেব এসে কাছে দাঁড়ালেন, চৈতী একটু নড়েচড়ে বসলো, চোখের পানি মুছে নিলো।
ইমাম সাহেব নরম কণ্ঠে বললেন,
— “বেটি, মন শক্ত করো। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমরা সবাই দুনিয়া থেকে চলে যাই। এসো, সবাই মিলে দোয়া করি।”
তারপর তিনি হাত তুললেন, রাতুল ও চৈতীও হাত তুলল।
নিঃশব্দ সন্ধ্যায় শুধু ইমাম সাহেবের কণ্ঠ ভেসে এলো,

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ২৯

— “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম…”
হালকা বাতাস বয়ে গেল, নারকেল পাতাগুলো নিঃশব্দে দুলে উঠল।
চারপাশে এক গভীর প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল…

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩১