কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৫
মিসরাতুল রহমান চৈতী
মধ্যরাত।
রাতুলের শরীর ভীষণ গরম হয়ে উঠেছে। জ্বরটা পুরোপুরি পেয়ে বসেছে তাকে।
ডাক্তার ব্যতিব্যস্ত হয়ে রাতুলের কপালে হাত রাখল, তারপর দ্রুত একটা ইনজেকশন বের করে প্রিপেয়ার করতে লাগল। চৈতী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে—
‘ঠাস!’
বাড়ির গেটের সামনে থাকা লাইটটা ভেঙে পড়ল!
চারপাশে সেই বিকট শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো, রাতের নিস্তব্ধতা মুহূর্তেই চুরমার হয়ে গেল।
চৈতীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
আসিফ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। কোমরে গুঁজে রাখা চেম্বারটা এক ঝটকায় বের করে নিল।
“কে আছে?” তার কণ্ঠ দৃঢ়, চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল।
ডাক্তার থমকে গেল, হাত থেকে ইনজেকশন প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। চৈতী দ্রুত রাতুলের গায়ের চাদর ঠিক করে দিল, যেন ওর সামান্য নড়াচড়াও না হয়।
বাইরে এবার ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল।
আসিফ চৈতীকে চোখে ইশারা করল, “পিছনে থাকুন।”
চৈতী নিঃশব্দে মাথা নাড়ল, কিন্তু তার চোখ আতঙ্কে স্থির।
ঘরের বাতিটা নিভিয়ে দিল আসিফ। এক মুহূর্তেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল, শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় রাতুলের মুখটা আবছা দেখা যাচ্ছে।
বাইরে কে আছে?
পায়ের শব্দ থেমে গেছে।
চৈতী গভীর শ্বাস নিল। তার হাত শক্ত হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে এই মুহূর্তেই যেন কিছু একটা ঘটে যাবে…
রাতুলের শরীর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, জ্বর তাকে পুরোপুরি কাবু করে ফেলেছে। তবুও অনেক কষ্টে চোখ খুলল সে। দৃষ্টি ঝাপসা, তবু একবার তাকিয়ে দেখল চৈতীকে, তারপর আসিফের দিকে নজর ফেলল।
তার কণ্ঠ ক্লান্ত, তবু দৃঢ়—
“আসিফ… চৈতীর নিরাপত্তা তোর কাছে। ওর গায়ে যেন একটা আঁচড়ও না লাগে। এখন যেভাবে অক্ষত আছে, ঠিক তেমনই যেন থাকে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আসিফ দ্রুত রাতুলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, শক্ত করে তার হাতটা ধরে বলল—
“ভাই, আপনাদের আমি নিজের জীবন দিয়ে হলেও আগলে রাখব।”
রাতুলের ঠোঁট সামান্য নড়ল, যেন কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।
পরের মুহূর্তেই তার শরীর নিস্তেজ হয়ে এল—
প্রচণ্ড জ্বরে অজ্ঞান হয়ে গেল সে!
চৈতী আতঙ্কে রাতুলের দিকে ঝুঁকে পড়ল, তারপর অসহায়ের মতো আসিফের দিকে তাকাল।
“আসিফ ভাই, এখন কী করব?”
তার কণ্ঠ কাঁপছিল।
ঠিক তখনই—
‘গ্যাচাং!’
বাইরে গেট ভাঙার শব্দ!
চৈতীর বুক কেঁপে উঠল।
আসিফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল—
“ভাবী, দেরি করা যাবে না! আমাদের এখনই এখান থেকে বের হতে হবে!”
সে এক ঝলকে ডাক্তারকে লক্ষ্য করল।
“ডাক্তার সাহেব, দ্রুত আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন, ব্যাগটা তুলে নিন!”
ডাক্তার আর এক মুহূর্তও নষ্ট করল না। দ্রুত ব্যাগের চেইন টেনে ধরে সব গুছিয়ে নিল।
আসিফ গভীর নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর রাতুলের দিকে তাকাল।
“এখন শুধু বের হওয়ার পালা!”
সে কোনো দ্বিধা না করেই রাতুলকে দুই হাতে তুলে নিয়ে নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিল।
রাতুল নিস্তব্ধ, কিন্তু তার শরীরের তাপ এখনো টের পাওয়া যাচ্ছে।
চৈতী সঙ্গে সঙ্গে পাশে এসে দাঁড়াল।
আসিফ কোনো শব্দ না করে ডান দিকের লোহার দরজার দিকে হাঁটা দিল—
বাইরে গেট ভাঙার শব্দ আরও জোরালো হচ্ছে।
সময় কমে আসছে!
আসিফ রাতুলকে কাঁধে তুলে নিয়ে এক মুহূর্তও নষ্ট করল না। ধীর, কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। চৈতী সঙ্গে সঙ্গে তার পেছনে চলল।
রুমটা অদ্ভুত রকমের গোপনীয়। চারপাশে আধো-অন্ধকার, আর দেয়ালে সাজানো পুরোনো কাঠের আলমারি।
আসিফ দরজার কাছে গিয়ে চৈতীর দিকে তাকাল।
“ভাবী, দরজাটা লক করে দিন।”
কণ্ঠে কোনো আবেগ নেই, শুধু গম্ভীর নির্দেশ।
চৈতী দ্রুত হাত বাড়িয়ে দরজার লক লাগিয়ে দিল।
বাইরে তখনও হট্টগোল, গেট ভাঙার শব্দ ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে। সময় কমে আসছে!
আসিফ এবার দ্রুত চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল—
“ভাবী, ওই লালচে ফুলদানিটা দেখছেন? ওটা ঘুরান, সময় নষ্ট করবেন না!”
চৈতী কিছু না বুঝেই হাত বাড়িয়ে দিল।
সামনে রাখা টেবিলের ওপর পুরোনো মাটির একটা লালচে ফুলদানি!
সে ফুলদানিটা দু’হাতে ধরে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে দিল—
‘ক্লিক!’
একটা মৃদু শব্দ হলো, আর সঙ্গে সঙ্গেই দেয়ালের এক পাশে একটা সরু দরজা খুলে গেল!
চৈতী বিস্ময়ে পেছনে সরে এলো, মনে হচ্ছে এ যেন কোনো গোপন পথ!
আসিফ আর দেরি করল না।
“আসেন, আমার সাথে! এইটা একটা সুরঙ্গ, এই পথ দিয়ে গেলে আমরা বাইরে বের হতে পারব। আগে বের হই, তারপর ভাবা যাবে কী করতে হবে!”
কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৪
তারপর রাতুলকে শক্ত করে ধরে নিয়ে সুরঙ্গপথে প্রবেশ করল।
চৈতী আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না, দ্রুত তার পিছু নিল।
পেছনে দরজাটা আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেল—
বাইরে তখনও ভাঙচুরের শব্দ!
তারা কি সত্যিই বের হয়ে যেতে পারবে? নাকি আরও বড় কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে সামনে? জানতে হলে গল্পের সাথে থাকুন।