কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৭
মিসরাতুল রহমান চৈতী
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা দশজন লোক তাদের চারপাশে ঘিরে ফেলেছে। চৈতী আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল। আসিফ এক ঝলকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করল, তারপর ধীরে ধীরে রাতুলকে শক্তভাবে ধরে রাখল।
“আমরা কি ফেঁসে গেলাম?” চৈতী ফিসফিস করে বলল।
আসিফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এখনো না। কিন্তু আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে।”
দশজন লোক তাদের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তাদের মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা, হাতে ভারী লাঠি ও অস্ত্র।
“কোথায় যাচ্ছো তোমরা?” এক মোটা গলায় কেউ একজন বলল।
চৈতী গলা শুকিয়ে এল। পাশে থাকা ডাক্তার কাতরাচ্ছে, রাতুলের শরীর নিস্তেজ হয়ে আছে। তাদের হাতে লড়াই করার মতো কিছুই নেই।
আসিফ শক্ত কণ্ঠে বলল, “আমরা কোনো ঝামেলা চাই না। আমাদের যেতে দাও।”
“যেতে দিব?” লোকটার হাসি বিকৃত শোনাল। “তোমরা আমাদের এলাকা দিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলে, তাই না? এখন কই যাবে?”
চৈতীর হাত ঘেমে গেছে। আসিফ ধীরে ধীরে নিজের কোমরে রাখা ছোট ছুরিটা শক্ত করে ধরল। এটাই তার একমাত্র অস্ত্র।
একজন মুখোশধারী সামনে এগিয়ে এলো, তারপর হাত তুলে সংকেত দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাকি সবাই থমকে দাঁড়াল।
“তাদের মেরে ফেলতে হবে না। শত্রুরা ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা শুধু… ওদের বন্দি করে নিয়ে যাবো।”
চৈতী শিউরে উঠল। বন্দি! তাহলে ওরা শত্রুদের কাছে হস্তান্তর করবে?
আসিফ দ্রুত চোখের ইশারায় চৈতীকে সংকেত দিল। এই মুহূর্তে কিছু একটা করতে হবে, নাহলে সবাই ধরা পড়বে।
চৈতী নিচু গলায় বলল, “আমরা কি পারব?”
আসিফ ফিসফিস করে বলল, “আমি ওদের মনোযোগ সরানোর চেষ্টা করব। আপনি সুযোগ বুঝে ভাইকে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করবেন।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চৈতী শ্বাস বন্ধ করে মাথা নাড়ল।
লোকগুলো আর এগিয়ে আসছে না, যেন কোনো নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। আসিফ হঠাৎ করেই এক লাফে সামনে চলে গিয়ে তার ছুরিটা এক লোকের হাতে সজোরে বসিয়ে দিল!
লোকটা চিৎকার করে উঠল, সাথে সাথে চারপাশে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে গেল।
চৈতী সুযোগ বুঝে রাতুলের হাত ধরে টান দিল। ডাক্তারও কষ্ট করে উঠে আসার চেষ্টা করল।
“ভাবী! দৌড়ান!” আসিফ চেঁচিয়ে উঠল।
চৈতী আর দেরি করল না। রাতুলকে টেনে নিয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করল।
আসিফ তখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু শত্রুর সংখ্যা অনেক বেশি।
চারপাশে ধুলো উড়ছে, চৈতী পেছনে ফিরে তাকানোর সাহস পেল না।
শত্রুরা একসঙ্গে তেড়ে এলো, চারপাশে উত্তেজনার উত্তাপ। আসিফ কোনো সময় নষ্ট না করে প্রথম আঘাতটা হানল, এক লোকের পেট বরাবর লাথি মেরে তাকে ফেলে দিল। তারপর হাতের ছুরিটা শক্ত করে ধরে পাশের আরেকজনের বাহুতে গভীরভাবে বসিয়ে দিল।
চৈতী ভয় পেয়ে পেছনে তাকাল। আসিফ একের পর এক আঘাত হানছে, কিন্তু শত্রুর সংখ্যা বেশি। এই মুহূর্তে পালানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
চৈতী দ্রুত রাতুলকে ধরে নিয়ে ছুটল ঝোপের দিকে। রাতুলের শরীর নিস্তেজ, ওর ভারে চৈতীর হাঁটু কাঁপছে, কিন্তু থামলে চলবে না।
“ভাবী! দেরি করবে না, গাড়িতে ওঠেন!” আসিফ চিৎকার করল, দুইজনকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে।
চৈতী কোনোভাবে রাতুলকে গাড়ির সিটে বসিয়ে দরজা আটকালো। পেছন থেকে ডাক্তারও হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এল।
আসিফ তখনো শত্রুদের সাথে লড়াই করছে, কয়েকজনকে আহত করে সে ডাক্তারকে ধরে নিয়ে ঝোপের দিকে দৌড় দিল।
“ওঠেন! দেরি কোইরেন না!” চৈতী দরজা খুলে ডাক্তারকে টেনে তুলল।
আসিফ লাফিয়ে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসল।
“সবাই শক্ত হয়ে বসো!”
পরক্ষণেই ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল, আর আসিফ পাগলের মতো স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি স্পিড তুলে দিল।
পেছন থেকে চিৎকার, বন্দুকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু আসিফ কারও কোনো তোয়াক্কা না করে সামনে দৃষ্টি স্থির রেখে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগল।
“আমরা এখনো নিরাপদ না,” আসিফ কঠিন স্বরে বলল, “কিন্তু খুব দ্রুত এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে!”
গাড়ি ধুলোর ঝড় তুলে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল…
গাড়ির ইঞ্জিন গর্জে উঠল, আসিফ পাগলের মতো স্টিয়ারিং ধরল। চারপাশে ধুলো উড়তে থাকল, শত্রুরা পিছু নেওয়ার চেষ্টা করলেও গাড়ির গতির কাছে তারা হাল ছেড়ে দিল।
চৈতী পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল, রাতুলের চোখ আধখোলা, নিঃশ্বাস ভারী। ডাক্তার দ্রুত তার নাড়ি পরীক্ষা করল।
“রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হবে। বেশি দেরি হলে ওর অবস্থা খারাপ হতে পারে,” ডাক্তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল।
“আরেকটু ধৈর্য ধরো, আমরা এখনো নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাইনি।” আসিফ ঠোঁট চেপে বলল, গতি আরও বাড়িয়ে দিল।
চৈতী রাতুলের হাত ধরে শক্ত করে বসে রইল। আসিফ অন্ধকার রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল, সামনে কোথায় যেতে হবে সেটা ঠিক করার চেষ্টা করছে।
“আমাদের কোথায় যেতে হবে?” চৈতী জিজ্ঞেস করল।
“একটা সেফ হাউজ আছে, ওখানে পৌঁছাতে পারলে একটু স্বস্তি পাবো,” আসিফ বলল, চোখে সতর্ক দৃষ্টি।
রাত নিস্তব্ধ, কেবল গাড়ির গতি আর চৈতীর উদ্বিগ্ন নিঃশ্বাস চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।
গাড়ির স্পিড এতটাই বেশি যে রাস্তার দুই পাশের গাছপালা ঝাপসা দেখাচ্ছে। চৈতী পেছনে তাকিয়ে দেখল, শত্রুরা আর পিছু নেয়নি, তবে আশঙ্কা এখনও পুরোপুরি কেটে যায়নি।
রাতুলের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। সে চোখ খুলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। চৈতী ভয়ে তার হাত শক্ত করে ধরল।
“আমরা কত দূরে?” চৈতী কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল।
“আর দশ-পনেরো মিনিট, এরপর একটা পুরনো ফ্যাক্টরিতে পৌঁছাবো। সেখানে কয়েক ঘণ্টা লুকিয়ে থাকতে পারবো,” আসিফ দ্রুত বলল, গাড়ির গতি কমিয়ে আঁকাবাঁকা পথ পার করছে।
ডাক্তার ততক্ষণে রাতুলের কপালে হাত রাখল। “ওর শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে। আমরা কিছু সময়ের জন্য থামতে পারলে ভালো হয়।”
“এখন থামা যাবে না!” আসিফ দৃঢ় কণ্ঠে বলল। “ওদের কাছ থেকে পুরোপুরি মুক্ত না হয়ে থামলে বিপদ বাড়বে।”
চৈতী উদ্বিগ্ন চোখে রাতুলের দিকে তাকাল। এই মুহূর্তে কিছু করার নেই, শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া।
গাড়ি কাঁচা রাস্তা ধরে আরও কিছুক্ষণ চলার পর সামনে পুরনো একটা ফ্যাক্টরির ধ্বংসাবশেষ দেখা গেল। আসিফ গাড়ি নিয়ে একটা আড়াল জায়গায় থামাল।
“এখানে নেমে যান। দ্রুত ভেতরে চলুন,” আসিফ বলল, চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিশ্চিত হলো কেউ পিছু নেয়নি।
চৈতী রাতুলকে ধরে গাড়ি থেকে নামল। আসিফ এবং ডাক্তারও দ্রুত বেরিয়ে এল।
“ওকে ভেতরে নিয়ে চলো,” ডাক্তার বলল। “আমি যতটুকু পারি ওর যত্ন নেবো।”
চৈতী আর এক মুহূর্ত দেরি করল না, রাতুলের নিস্তেজ শরীর ধরে পুরনো ফ্যাক্টরির ভেতরে ঢুকে গেল।
বাইরে হালকা বাতাস বইছে, কিন্তু ভেতরে যেন এক অজানা বিপদের অপেক্ষা…
ফ্যাক্টরির ভিতরে প্রবেশ করেই চারপাশের নিস্তব্ধতা তাদের অভ্যর্থনা জানালো। পুরনো, ক্ষয়ে যাওয়া দেয়াল এবং ভাঙা কাচের জানালা অন্ধকারে ঢাকা ছিল। চৈতী রাতুলকে হাতে ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল।
ডাক্তার তাড়াহুড়ো না করে, শান্তভাবে রাতুলের শরীর পরীক্ষা করতে লাগল। “রক্ত ক্ষরণ অনেকটা কমে গেছে, কিন্তু ওকে যতটা সম্ভব বিশ্রাম দিতে হবে।”
চৈতী রাতুলের পাশে বসে তার হাত ধরে ধীরে ধীরে কাঁপছিল। সে জানত, এ মুহূর্তে রাতুলের জীবনের উপর গভীর অশঙ্কা আছে।
আসিফ ফ্যাক্টরির চারপাশে সজাগ চোখে তাকাচ্ছিল, যেন কোনো শত্রু আক্রমণ করতে আসছে। সে আরেকটু সামনে গিয়ে অন্ধকারে খোঁজ নিতে শুরু করল।
“সবকিছু ঠিকঠাক আছে, কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে।” আসিফ ফিরে এসে বলল। “এখন এখান থেকে বের হতে হবে, কিন্তু যতটা সম্ভব শত্রুদের চোখে পড়বে না।”
“ওরা যদি আমাদের সন্ধান পায়?” চৈতী হালকা শঙ্কিত কণ্ঠে বলল।
“তাহলে আমাদের জন্য কোনো সুযোগ থাকবে না,” আসিফ দৃঢ়ভাবে উত্তর দিল। “তাই আমরা যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে হবে।”
ডাক্তার রাতুলের শরীর একটু উল্টে তাকে আরামদায়কভাবে শুইয়ে দিল। “ওকে একটু সময় দিন।”
চৈতী রাতুলের পাশে বসে, তার কপালে হাত রেখে বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আসিফ দিকে তাকিয়ে বলল, “যতটা সম্ভব তোমাকে শক্ত থাকতে হবে। আমাদের এখানে স্থির থাকতে হবে না, যত দ্রুত সম্ভব গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।”
এবার সবাই নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আর রাতুলের সুস্থতার জন্য যতটা সম্ভব সময় কাটানো শুরু হয়ে গেল।
চৈতী জানত, আর কোনো দেরি করলে বিপদ আরও বাড়বে। সময় সীমিত, আর শত্রুদের কাছ থেকে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে।
ফ্যাক্টরির ভিতরের অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা যেন ঘোরের মতো পরিবেশ তৈরি করেছে। চৈতী রাতুলের পাশে বসে ছিল, কিন্তু তার মন অস্থির ছিল। শত্রুদের কথা, তাদের উপস্থিতি, সেগুলো বারবার তার মাথায় ঘুরছিল। সে জানত, এক মুহূর্তের ভুলে জীবন হাতে চলে আসতে পারে, আর রাতুলের অবস্থা… সেই চিন্তা চৈতীকে একদিকে বিপদে ফেলছিল।
ডাক্তার কিছুটা সময় পরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওর শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা কমেছে। তবে, তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে কয়েক ঘণ্টা লাগবে।”
“তবে, আমাদের খুব দ্রুত এখানে থেকে বের হতে হবে,” আসিফ তাড়াহুড়ো করে বলল। “এখানে বেশি সময় কাটালে আমাদের অবস্থান জানা যাবে, আমরা বিপদে পড়ব।”
চৈতী রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে কি আমরা এখান থেকে চলে যাবো? ওনার তো এখনও পুরোপুরি জ্ঞান ফেরেনি!”
“দেখুন আপনি যেভাবে ভাবছেন, তার থেকে অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হল নিরাপদে এখান থেকে বের হওয়া। ভাই যতটা সম্ভব সাবলীল হতে পারলে আমরা বের হতে পারব,” আসিফ তীক্ষ্ণ চোখে চারপাশের পরিস্থিতি দেখছিল।
চৈতী হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “আপনি ঠিক বলেছেন। আমাদের আর কোনো উপায় নেই।”
ডাক্তার রাতুলের কপালে ত্বকের গরম অনুভব করে বলল, “ওর শরীর একটু ঠান্ডা হলে, চলাফেরা সহজ হবে। তবে, তাকে কখনোই একা ছাড়লে চলবে না।”
আসিফ এবার স্থির হয়ে বলল, “আমরা একটা সুযোগ পেলে পালাতে পারব। তাতে এখন সময় নষ্ট করা যাবে না।”
১ ঘন্টার পর ওরা ফ্যাক্টরি থেকে বের হলো,,
তারা সবাই প্রস্তুত হতে শুরু করল, দ্রুত গতিতে গাড়ি বদলে অন্য রাস্তায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে। সবাই জানতো, যত বেশি সময় এখানে কাটাবে, ততই শত্রুদের কাছে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
“এখান থেকে বের হতে আর দেরি করা যাবে না। সবাই প্রস্তুত হও,” আসিফ কঠিন কণ্ঠে বলল, গাড়ি চালানোর প্রস্তুতি নিতে।
চৈতী নিজের আশপাশে তাকিয়ে দেখল। তারা বিপদমুক্ত হয়ে যাবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা ছিল না, তবে এখনই পালাতে না পারলে হয়তো আর কখনোও পারবে না।
রাতুলের শরীর ধীরে ধীরে আরও স্থিতিশীল হচ্ছিল, কিন্তু এখন তাকে কিছুটা সময় লাগবে। এর মধ্যেই, সময় আরও পিছিয়ে যাচ্ছে।
আসিফ একবার ফিরে তাকিয়ে চৈতীকে বলল, “সব ঠিক থাকবে, শুধু আমরা যদি দ্রুত চলে যাই।”
চৈতী মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, ঠিক আছে।”
তারা একে একে গাড়িতে উঠে বসল। আসিফ গাড়ি চালাতে শুরু করল, তবে তার চোখ চারপাশে সতর্কভাবে নজর রাখছিল, যেন শত্রুরা কোন জায়গা থেকে আক্রমণ করতে পারে।
ফ্যাক্টরির বাইরের রাস্তা এখন আরো তলিয়ে যাচ্ছে, কেবল তাদের দ্রুত গতির গাড়ির শব্দ ভেসে উঠছে।
গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন ভেতরকার সুনসান পরিবেশে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করছিল। আসিফ গাড়ি চালাচ্ছিল দ্রুত, কিন্তু তার চোখ ছিল চারপাশে। সময় যেন থমকে দাঁড়ানোর মতো মনে হচ্ছিল, কিন্তু শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি ছিল প্রতিটি মুহূর্তে।
চৈতী রাতুলের পাশে বসে, তার শ্বাসপ্রশ্বাসে এক ধরনের গতি ফিরতে দেখল। ডাক্তার আস্তে আস্তে রাতে তার শরীরের পরীক্ষা করতে লাগল, কিন্তু তারপরও রাতুল পুরোপুরি জ্ঞান ফেরেনি।
“ওর অবস্থা কিছুটা উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু এখনো সময় লাগবে,” ডাক্তার বলল, কিছুটা চিন্তিত। “কিন্তু সঠিক সময়ে যদি ওর যত্ন না নেওয়া হয়, তো বড় বিপদ ঘটতে পারে।”
চৈতী কপালে হাত দিয়ে রাতুলের মুখের দিকে তাকাল, স্নেহ ও উদ্বেগের মিশ্রিত অনুভূতি তার চোখে স্পষ্ট ছিল। “ওনি কি সুস্থ হবে?”
আসিফ গাড়ি চালাতে চালাতে সোজা হয়ে বলল, “এটা বলতে পারছি না, তবে আমরা যতটা সম্ভব দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাবো। যদি কোনো বিপদ হয়, তাহলে আমাদের অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।”
চৈতী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তার মনে হচ্ছিল, যতটা সময় কাটবে, শত্রুর কাছ থেকে পালানোটা আরো কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু এখনকার মতো রাতুলের সুস্থতা একমাত্র প্রাধান্য ছিল।
গাড়ি চলতে চলতে আসিফ এক চোখে রঙিন আলো দূরে দেখতে পেল। কিছু সময় পরেই তারা এক রেললাইন পার হয়ে, নির্জন এক গ্রামের মাঝখানে পৌঁছাল।
“এখানে থামুন,” ডাক্তার বলল। “রাতুলকে এখানেই কিছু সময় বিশ্রাম নিতে হবে।”
আসিফ থামাল গাড়ি। গ্রামের নির্জন রাস্তায় তারা একটা পুরনো বাড়ির কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।
“এখানে আমরা কিছু সময় নিরাপদে থাকতে পারব।” আসিফ বলল, গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর।
চৈতী, আসিফ ও ডাক্তার রাতুলকে ধীরে ধীরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল। বিকেলের আলো দূরে কোথাও ঢলে পড়ছে, আর তারা জানতো—এখন, সময়টা তাদের পক্ষে নেই।
কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৩৬
“এখানে যদি কেউ আসে, আমরা পালানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে,” আসিফ সতর্ক কণ্ঠে বলল।
“হ্যাঁ, কিন্তু ওনি সুস্থ না হলে পালাতে হবে কীভাবে?” চৈতী উদ্বেগ নিয়ে বলল।
“যত দ্রুত সম্ভব, আমরা ঠিকমতো চিকিৎসা নিতে পারলে, তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করবো,” ডাক্তার আশ্বস্ত করে বলল।
এখানে, এই নির্জন জায়গায় তারা আবার কিছু সময়ের জন্য স্বস্তি পেল, কিন্তু জানতো, এই মুহূর্ত শুধু সাময়িক।