খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১৭

খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১৭
আনিকা আয়াত

অর্পণের বন্ধুমহলে আলোচনা করার ইদানিং যে ভাইরাল টপিক , সেটা হচ্ছে তৃধা এবং রিয়াদ স্যার! ভার্সিটির ক্লাস চলমান থাকলেও নবীন বরণের দিন থেকে তৃধা একপ্রকার নিখোঁজ। মেয়েটা যেনো চোখের পলকে, হুট করেই লাপাত্তা হয়ে গেলো। আজকাল রিয়াদ স্যারও বিরস মুখে ক্লাসে আসে, সম্পূর্ণ ক্লাসে কাউকে খুঁজে না পেয়ে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গম্ভীর, ফ্যাকাশে চেহারায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ টপিক নিয়ে আলোচনা করার মাঝেই হঠাৎ আনমনা হয়ে যায়। এ বিষয় অর্পণ সহ সবাই খেয়াল করেছে। তৃধার সঙ্গে যোগাযোগ করাও উপায়ও রাখেনি মেয়েটা। ফোন অফ করে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে কক্ষে।

আকস্মিক বান্ধবীর খামখেয়ালি পনায় পৃথার মন খারাপ যেনো বেড়েই যাচ্ছে। সকলের মধ্যে একপ্রকার চাপা গুঞ্জন! কি ঘটেছিল সেইদিন? দুজনের মধ্যে কি এমন হয়েছিল, যার ফলে মেয়েটা ভার্সিটিতে আসে না। স্যারও উদাস মনে নিজের চাকরি রক্ষার্থে নাম মাত্র ভার্সিটিতে আসে। কেননা, স্যার ধ্যাণ-মন সবই যে ইদানীং তৃধা নামক মেয়েটার কাছে পড়ে থাকে। কতগুলো দিন এক পলক দেখা হয়না। স্যার চোখের তৃষ্ণায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে। না পারছে কাউকে বলছে, না পারছে তৃধার সঙ্গে কথা বলতে। এ কেমন যন্ত্রণা! তার মন যে, কোনো কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। সারাক্ষণ হাঁসফাঁস লাগছে। মেয়েটাকে ছাড়া বন্ধুমহলেও হইচই, আড্ডা কমে গেছে। কেউ ক্লাস করছে, আবার কেউ নিজের মর্জিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পৃথাও বিতৃষ্ণা মন দিয়ে তিনদিন পর ক্লাসে উপস্থিত হলো। আজকাল রিয়াদ স্যারের ক্লাসে মজা লাগে না। বিরক্ত, বোরিং লাগে। স্যার প্রতিদিনের মতোই লেকচার দিয়ে ক্লাস কোনোমতে শেষ করলো। পৃথা দরজার বাইরে আসতেই স্যার মৃদু স্বরে ডাকলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ পৃথা! ফ্রি আছো?”
পৃথা আনমনে হাঁটছিল। স্যারের কথায় থমকালো সে। সামনে স্যারের উদাস মুখ পানে তাকিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। বলল,
“ জি স্যার! বলুন। ”
“ একটু আমার সঙ্গে এসো। ”
পৃথা না দুলিয়ে স্যারের পিছু পিছু বারান্দায় গেলো। স্যার হাঁসফাঁস করছে ভেতরে ভেতরে। আজ এমন এক চিপায় পড়েছে যে, ছাত্রীর সঙ্গে একান্তই কথা বলতে হচ্ছে। তাও তার বান্ধবীর সম্পর্কে। লজ্জায় এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে আমতা আমতা করে বলল,

“ তৃধা ঠিক আছে? ”
পৃথার দৃষ্টি সরু হলো। যে জানতো স্যার এসবই বলবে। মেয়েটা হতাশার শ্বাস ফেলতেই স্যার মাথা চুলকে বলল,
“ না মানে! কিছুদিন ধরে ক্লাসে আসছে না। অসুস্থ নাকি? ”
“ স্যার! ওর আপডেট পাচ্ছি না আমি। ফোন অফ করে বসে আছে। ”
রিয়াদ স্যার চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করলো,
“ বাসা চেনো ? ”
পৃথা হাত ঘড়ি দেখে নিল একবার। ব্যস্ত সুরে বলল,
“ জি স্যার! যাবো একসময়। আপডেট জানাবো আপনাকে! ওকে?”

স্যার চটপট চলে গেলো অফিসের দিকে। পৃথাও অলস ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো টলতে টলতে।
অর্পণ ক্যান্টিনে বসে শিহাবের সঙ্গে আলোচনা করছিল ভার্সিটিতে ক্রিয়া প্রতিযোগিতা নিয়ে। তুষিব তাদের জন্য তিন কাপ চা নিয়ে এলো। সঙ্গে নোনতা বিস্কুট! তাদের কথার মাঝে বিরক্ত মুখে ঢুলতে ঢুলতে পৃথা উপস্থিত হলো। অর্পণের পাশের ফাঁকা চেয়ারে ধপ করে বসলো। টেবিলে দুহাত ভাজ করে মাথা রেখে শুয়ে রইলো হতাশ মুখে। শিহাব চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলল,
“ শুয়ে পড়লি কেনো? জামাই ম/রছে? ”
পৃথার দাঁতে দাঁত চেপে তাকাল। তুষিব দাঁত কপাটি বের করে বলল,

“ কাউয়া কাক্কু ম/রেনাই শিহাব ভাই। কট খেয়ে, বিদাশে ঘাপটি মে/রে বসে আছে। সেই কষ্টে আমাগো পৃথা আফা শুকাইয়া গেছে। সত্যি কইছি না আফা?”
বলেই তুষিব গদগদ মুখে পৃথার দিকে চাইল। অর্পণ এতক্ষণ কুল হয়ে চা খেলেও এবার শব্দ করে হেঁসে ফেলে। হাঁসতে হাঁসতে বলল,
“ তুষিব! তুই থাম। এত পাকনামি শিখলি কবে কবে? বাঁচতে চাইলে, মুখে ট্যাপ লাগিয়ে দৌঁড়ে পালা। পৃথা কিন্তু বো/ম হচ্ছে। এখন শুধু ফাটার অপেক্ষা। ”

পৃথা রাগে গজরাতে গজরাতে টেবিলে আঘাত করলো। উঠে সত্যি সত্যি তুষিবের দিকে তেড়ে যেতেই ছেলেটা “ ও মা গো! ” বলেই দৌঁড়ে পালায়। পৃথা তার পেছন পেছন গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে,
“ অসভ্য! পিঠের ছাল তুলে ফেলবো। কাউয়া কাকু মানে কি হ্যাঁ? মা/র খেয়েছিস কখনও? মে/রে হাড়গোড় ভেঙ্গে ফেলবো। ওবায়দুল কাদের বলতে পারিস না? তার সঙ্গে আমাকে জড়াচ্ছিস! সাহস কত!”
পৃথার কান্ড কলাপে হাঁসতে হাঁসতে গড়াগড়ি খেলো দুই বন্ধু। তুষিব পালিয়ে যেতেই পৃথা ক্রোধে ফিরে এলো। টেবিলে রাখা ব্যাগ শব্দ করে রেখে বলল,
“ সমুদ্র কোথায়? বাসায় যাবো। ”
“ দেখ আছে কোথাও। আশেপাশে মেয়েদের দেখলেই বুঝবি, সমুদ্র সেখানে।”
শিহাব ঠোঁট টিপে হেঁসে বলল। পৃথা কটমট করে অর্পণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ তৃধার কি হয়েছে জানিস?”

“ এ জন্য তুই আপসেট? টেনশন করছিস কেনো? ও ভালো আছে। শুধু হাই বোল্ডেজের আদর খেয়ে চিৎপটাং হয়ে গেছে। নিজেকে ঢেউ থেকে সামলাতে কিঞ্চিৎ সময় লাগছে। ব্যাপার না! মেয়েটা শীগ্রই আগের কারেক্টারে ফিরে আসবে। ”
অর্পণ সুখী ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিয়ে কথাটি বললেও পৃথার খচখচানি কমলো না। শিহাব গিটার বের করলো। তৎক্ষনাৎ পৃথা উদাসীন কণ্ঠে বলল,
“ অর্পণ তুই কি জানিস? ওইদিন কি হয়েছিল? ”
“ না জানার কি আছে? তৃধা এতদিন মনে মনে যা চেয়েছিল, তাই হয়েছে। ওর ভালোবাসায় স্যার ডুবে ম/রছে। কূলকিনারা পাচ্ছে না। তৃধাও ফা/জিলের মতো দূরত্ব বজায় রেখে স্যারকে আরোও বেসামাল করে দিচ্ছে। ”
কথাটি বলেই অর্পণ উঠে দাঁড়ায়। দূরে হাঁসতে থাকা সমুদ্র কে ডেকে উচ্চস্বরে বলল,

“ ওই শা/লা প্লেবয়! এদিকে আয়।”
পৃথা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যাওয়ার আগে বলল,
“ কিন্তু তৃধা কি মানসিক ভাবে সুস্থ? ভুলে একা থাকতে থাকতে যদি ভুল ডিসিশন নিয়ে ফেলে? স্যার ইদানীং মন ম-রা থাকে, এসব তো তৃধা জানে না। যদি জানতে পারে, ওর কেমন লাগবে? ও যা চেয়েছে, তাই পেয়েছে। তাহলে এখন কেনো এমন করছে? মেয়েটা কি সত্যি পা*গল হয়ে গেলো? ”
সমুদ্র চটপট তাদের নিকট এসে দাঁড়ায়। পৃথার বাহু ধাক্কা দিয়ে বলল,

“ শা/লী! স্যারের মুখ টা দেখার মতো হয়েছে। এতদিন আমাদের তৃধাকে কষ্ট দিয়েছে। এখন নিজে নিজেই পাচ্ছে। ব্যাপারটা আমি এনজয় করছি। সেই দোস্ত! সেই! এবার বুঝ শা/লা সারাক্ষণ খ্যাঁক খ্যাঁক করলে কেমন লাগে। মেয়েটা কে কতই না কষ্ট দিয়েছে। মেয়ে মানুষ হচ্ছে, মাখনের মতো নরম। তাদের সঙ্গে অলওয়েজ আদর করে বাক্য আদান-প্রদান করা হয়। ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে রাখলেই না তারা কাছে আসে। ”
বলেই সমুদ্র লজ্জায় মিটি মিটি হাঁসলো। রাগে গা পিত্তি জ্বলে উঠে পৃথার। সমুদ্রের পিঠে সজোরে কি/ল দিয়ে বেরিয়ে গেলো। অর্পণ হেলেদুলে হেঁটে সমুদ্রের পেটে পাঞ্চ মে/রে নিজের সঙ্গে নিয়ে পা বাড়ালো মাঠের নিকট। শিহাবের একা বসে গিটার বাজানোর স্বভাব। সব বন্ধুরা চলে যেতেই যে, চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ গুনগুন করে গান গাইলো। পরপর চারটে চায়ের কাপ শেষ করে, হাঁক ছেড়ে আরেক কাপ চা দেওয়ার জন্য। অল্প বয়সী ছেলেটা এই ভার্সিটিতে অনেকদিন হলো আছে। সে চেনে শিহাবদের। ওয়ান টাইম কাপে চা দিয়ে খুশি মুখে আবদার করলো,

“ ভাই! যাওয়ার আগে একটা গান গাইবেন? আপনার গানের ফ্যান আমি। খুব ভাল্লাগে। ”
শিহাব গিটার কাঁধে নিচ্ছিল। সামনে আগ্রহে অপেক্ষা করা ছেলেটির হাঁসি হাঁসি মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাঁসলো। উঠে তার মাথার চুল এলোমেলো করে গাল টেনে বলল,
“ এখন এক জায়গায় যেতে হবে রে! বিকেলে টিএসসি তে আসিস। অর্পণ, সমুদ্র আসবে। তখন রাত পর্যন্ত গান গাইবো। ওকে?”

ছেলেটা মাথা দুলালো। শিহাব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসার মাঝে ভুল বশত ধাক্কা খেলো একটি রমনীর সঙ্গে। যার ধরুন যে উল্টে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলো। কিন্তু সামনের মেয়েটার রক্ষা হলো না। হাতে থাকা একগাদা এসাইনমেন্ট খেলা কাগজ গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে গেলো। মেয়েটাও বসে পড়লো নিচে। কাগজ গুলোর দিকে তাকিয়ে মেজাজের পারদ তরতর করে বাড়ল। শিহাব হকচকিয়ে উঠেছে। আকস্মিক কি ঘটলো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই, সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার পাশে বসে কাগজগুলো খুঁটতে লাগলো। হন্তদন্ত হয়ে বলল,
“ সরি! সরি আপু। আমি দেখতে পাইনি। ”
মেয়েটি রক্তলাল চোখে তাকায়। শিহাবের হাত থেকে কাগজ গুলো ছিনিয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠে।
“ বেলেহাজ ছেলেগুলো জন্মগত-ই এমন। প্রথমে স্ব-ইচ্ছায় সুন্দর মেয়ে দেখলেই গায়ে পড়ে যাবে। ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে বলবে, ‘ সরি! ’ ওসব ঢং আমার সঙ্গে দেখাতে আসবেন না। নাম কি আপনার? কমপ্লেইন করবো আমি। ”
মেয়েটা ফোঁসফোঁস করে সমস্ত কাগজ তুলে উঠে দাড়ালো। শিহাব সেভাবে বসেই ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। হতভম্ব কণ্ঠে বলল,

“ আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছি?”
“ তা নয়তো কি? বেয়াদব ছেলে।”
উচ্চস্বরে কথা বলার ফলে, আশেপাশের সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এখানের বেশীর ভাগ ছেলে-মেয়েই শিহাবকে চেনে। এতবছর ভার্সিটিতে পড়াশোনা করার থেকেও গান গেয়ে বেশ নাম কুড়িয়েছে। কখনওই কোনো মেয়েদের সঙ্গে ঝামেলা হয়নি। কারণ, সমুদ্র যতটা ফ্লার্ট করে বেড়ায়, ততটাই শিহাব মেয়েদের থেকে দূরে থাকে। ভার্সিটিতে এসেই বন্ধু দের সঙ্গে গানে মেতে থাকে। সবাইকে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হলো শিহাব। মেয়েটার রাগান্বিত, অগ্নি দৃষ্টি লক্ষ্য করে বিরক্তে কপাল কুঁচকাল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

“ ওকে ফাইন! ইচ্ছে করেই যখন ধাক্কা দিয়েছি। তাহলে এবার সবাইকে দেখিয়েই দেই। বেয়াদব ছেলেটা কি কি করতে পারে। ”
বলেই তৎক্ষনাৎ শিহাব তার শক্তপোক্ত বাহু দ্বারা ঠাস করে মেয়েটার পিঠে ধাক্কা মা/রলো। হঠাৎ আক্রমণে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হুড়মুড়িয়ে নিচে পড়লো মেয়েটা। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো। সবাই এবার হেঁসে ফেলে। শিহাবও মেয়েটার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেঁসে বলল,
“ কেমন লাগলো রমনী?”
বলেই মুখ বাঁকিয়ে প্রস্থান করলো ক্যান্টিন। রেগে সমস্ত গা জ্বলে উঠে মেয়েটির। এসাইনমেন্টের কাগজ খামচে ধরে ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করে বলল,
“ হতচ্ছাড়া! দেখে নিবো তোকে। ”

স্নিগ্ধার এক আকাশ সম মন খারাপ। সে চুপচাপ ক্লাস করে বসে আছে বটগাছের নিচে। চৈতীর সঙ্গে দেখাও করেনি আজ। প্রতিক্ষণেই তার অজান্তেই মনে পড়ে, অর্ণবের কথা। মেয়েটা আজকাল অনুভব করছে, অর্ণবের প্রতি সে বাজে ভাবে ফেঁসে গেছে। কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে, সব ইগো ছেড়ে ছুঁড়ে অর্ণবকে বলতে,
“ আপনি প্লিজ থেকে যান। ”
কিন্তু বলা যায় না। কোন অধিকারে বলবে সে। সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ছেলেটা কি জা/দু টুনা করলো? স্নিগ্ধা বিরক্ত হলো নিজের বি/ষা/ক্ত অনুভূতির উপর। তার মনো মেয়ে কিভাবে পারে, একটা ছেলের জন্য রাত-দিন মন খারাপ করে শুয়ে থাকতে? কোনো কিছুতেই যে, মন বসছে না। ভেবেছিল ভার্সিটিতে বন্ধু-ক্লাস করলে, ভুলে যাবে। কিন্তু দূরে আসাতে আরোও মনে পড়ছে। ধুর! দুদিন পর যখন সিলেট যাবে অর্ণব! তখন কিভাবে সময় কাটবে তার? রেগে গেলো স্নিগ্ধা। ফোন ব্যাগ থেকে বের করে অর্ণবের ফটোতে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

“ অনুমতি ব্যতীত আমার মন চু/রি করার জন্য আপনাকে খু/ন করবো আমি। অসভ্য! অসভ্য! ”
বলেই ফোন একপ্রকার ছুঁড়ে মা/রলো ব্যাগের ভেতর। এপাশ ওপাশ করে আশেপাশে তাকাতেই চোখ আটকালো দূরে হেঁটে চলা অর্পণের মুখে। তৎক্ষনাৎ বুকের ভেতর ছোট্ট যন্ত্র টা খামচে ধরলো। মনে হলো, এ অর্পণ নয়, অর্ণব। এ কোন অনুভূতি পা বাড়িয়েছে সে। কষ্টে হাঁসফাঁস করে এগিয়ে গেলো ছেলেটার নিকট। সমুদ্র দূর থেকে লক্ষ্য করলো স্নিগ্ধাকে। তৎক্ষনাৎ ফুরফুরে মেজাজে অর্পণকে বলল,

“ আমার স্নিগ্ধু বেবী আসছে দোস্ত। একটু পর যাই!”
অর্পণ ঘাড় ঘুরালো মেয়েটার মুখপানে।
“ আপনার সঙ্গে কথা ছিল। যদিও মনের বিরুদ্ধে বলতে হচ্ছে। বিকজ! কোনো ইচ্ছে নেই আপনার মতো খাটা/শের সঙ্গে কথা বলার। নেহাৎ বিপদে পড়েছি বাজে ভাবে।”
অর্পণের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। কপালের ভাঁজ আরোও গাঢ় হয়। সে চোয়াল শক্ত করে জবাব দেয়,
“ আমি মনে হয় তোর সঙ্গে কথা বলার জন্য মুখিয়ে আছি? ইচ্ছে করছে না যেহেতু তাহলে দূরে যা। কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার সময়ের এত খারাপ দিন আসেনি, তোর সঙ্গে কথা বলে অপচয় করবো। ”
বলেই সমুদ্রের দিকে কটমট করে বলে,

“ বাইকে উঠবি? নাকি চলে যাবো।”
সমুদ্র চটপট উঠে বসে। তার মুখের হাঁসি উধাও হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। মাঝে মাঝে অর্পণের উপর রাগ হয় তার। সুন্দরী মেয়েদের কিভাবে মুখের উপর অপমান করে, কষ্ট দেয়। সে যদি অর্পণের জায়গায় হতো, তবে আদরে মাথায় তুলে রাখতো। যে কোনো প্রয়োজনে দৌঁড়ে আসতো বেচারা। অথচ, সুন্দরী মেয়েগুলোর সঙ্গে হাঁসি মুখে কথা বলতে গেলেই অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এজন্যই বলে ভালো মানুষের দাম নেই। সব দাম অর্পণের মতো খ/চ্চর ছেলেদের। তাদের তিক্ত কথা বেহায়া মেয়েগুলো হজম করে নেয়। বারবার অপমানিত হলেই ফের কথা বলতে আসে। অথচ, সমুদ্র কত কোমল! সচ্ছল। ভালোবাসায় মেয়েগুলোকে আপন করতে চায়, যা নারীজাতির সহ্য হয়না। মুখ ভেঙিয়ে চলে যায় দূরে।
অর্পণ বাইক স্টার্ট দিতেই স্নিগ্ধার ফোঁসে উঠা রাগ গিলে নিলো। কিছু কটুবাক্য শুনিয়ে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে থাকলেও মেয়েটা আলগোছে ঘিম পারিয়ে হাঁসতে হাঁসতে বলল,

“ সমু্দ্র ভাইয়া! আপনি একটু বলুন না! ছোট বোন ভুল করে ফেলেছে। বেয়াদবি করেছে।”
সমুদ্র হা হয়ে যায়। তার সঙ্গে এত গদগদ কণ্ঠে কথা বলছে? সে তব্দ খেয়ে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলো। অর্পণ কপাল কুঁচকে বাইক স্টার্ট দেওয়া থামিয়ে বলল,
“ সময় বিশ সেকেন্ড! যা বলার সোজাসুজি বল।”
“ স্নিগ্ধু তোমার কি শরীর খারাপ? মাথা ঘুরছে? কি হেল্প করতে পারি বলো। বাসায় পৌঁছে দেবো?”
সমুদ্রের বিচলিত কণ্ঠ সম্পূর্ণ এড়িয়ে আসল কথা বলতে থাকে স্নিগ্ধা,
“ অর্ণব কি সত্যি চলে যাচ্ছে?”

অত্যন্ত ইতস্তত করে বলল কথাটা। অর্পণ চট করেই বুঝতে পারলো, মেয়েটার কোমল কণ্ঠের ভেতর লুকিয়ে থাকা বিষাদ। ঠোঁট এলিয়ে হাঁসলো। দরাজ গলায় বলল,
“ জেনেও আমাকে জিজ্ঞেস করার মানে কি? চলে গেলেই তোমার কি? দেখো মেয়ে! বেশী বাড়াবাড়ি একদম পছন্দ নয় আমার। আমার ভাইয়ের থেকে একশো হাত দূরে থাকো। নইলে, ওই হাত আমি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিবো। অর্ণব শেখ আমার পছন্দে রিলেশন করবে। তবুও তোমার মতো অসভ্য মেয়েকে নয়। একজন সহজ-সরল মেয়েকে আমার ভাবী করে ঘরে তুলবো। সেই হবে, অর্ণবের স্ত্রী! তুমি ওর টাইপ নও। বুঝতে পেরেছ? পথ ছাড় এবার। ”
বলেই প্রচন্ড স্পিডে বাইক চালিয়ে ভার্সিটি ত্যাগ করলো অর্পণ। তার জন্মগত ত্যাড়া স্বভাবে স্নিগ্ধা রাগে ফুঁসে উঠে। পায়ের তলার মাটি লাত্থাতে লাত্থাতে হিংস্র কণ্ঠে গর্জে উঠে বলল,
“ অর্পণের বাচ্চা..! তুই অসভ্য! তুই! আজ প্রমিজ করছি কু/ত্তা! তোর চোখের সামনে অর্ণবের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুরে বেড়াবো আমি। এই স্নিগ্ধা প্রতিজ্ঞা করলো! দেখে নিস তুই। ”

চৈতী গেইটে এসে দাঁড়িয়ে আছে জিনিয়ার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর হাতে দুটো ঠান্ডা আইসক্রিম এনে এগিয়ে এলো চৈতীর নিকট।
“ শ্রাবণ ঢাকা আসবে কবে?”
চৈতী হাতে আইসক্রিম নিয়ে উত্তর দিলো ছোট্ট করে,
“ রাতে কথা হয়েছে। বলল আজ বিকেলেই ফিরবে। ”
“ ছেলেটাকে ছাড়া ভাল্লাগে না। তাই না? সবসময় হাঁসি খুশি হয়ে মাতিয়ে রাখে সবাইকে। ”
চৈতী খেতে খেতে বলল,
“ হুহ। ”
জিনিয়ার ফোন বেজে উঠে তৎক্ষনাৎ। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো, স্নিগ্ধার নাম। সে চটপট রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে বলল,

“ কই তুই? ”
“ গেইটে! তুই কোথায়? আজকে তো ভার্সিটি-তে দেখলাম না। আসিস নি? ”
“ চৈতীও আছে?”
“ হ্যাঁ! কেনো?”
স্নিগ্ধা রিকশায় বাসায় ফিরতে ফিরতে বলল,
“ বাসায় যাচ্ছি। আমার খুব কষ্ট লাগছে জিনিয়া। তাই দূরে দূরে থেকেছি। ”
“ কিন্তু কেনো?”
“ পরে বলবো। রাখছি। ”
ফট করে কল কেটে দিলো স্নিগ্ধা। জিনিয়া হতভম্ব মুখে ফোন হাতে রেখে থমথমে স্বরে বলল,
“ যাক বাবা! এই স্নিগ্ধার আবার কি হলো?”
“ কি বললো?”
চৈতীর কৌতুহল কণ্ঠস্বর। জিনিয়া ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল,

“ কি জানি। ওসব বাদ দে। আমি যাচ্ছি। ”
বলেই জিনিয়া বিদায় জানাল চৈতীকে। আইসক্রিম শেষ অংশ তৃপ্তি নিয়ে খেতে খেতে পা বাড়ালো হলের নিকট। আনমনে রাস্তার কিনারা দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ বাইকের হর্ণের তীব্র আওয়াজে ভয়ে হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। চট করে সামনে অর্পণ আর তুষিবকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে। বুকে হাত রেখে বার কয়েক ঘনঘন শ্বাস ফেলে বলল,

“ আরেকটু হলেই হার্টফেল করে বসতাম। ”
“ ভাইজান কাছে থাকতে কস্মিনকালেও হার্টফেল করতে পারবেন না চৈতী আফা। ”

খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১৬

দাঁত কেলিয়ে উচ্চস্বরে হাঁসলো তুষিব। চৈতী ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে পড়লেও কটমট করে তাকাল। অথচ অর্পণ নির্বিকার! নির্লিপ্ত! চৈতীর ধীর পায়ে হাঁটার তালে তালে সেও বাইক লো স্পিডে চালাচ্ছে। মেয়েটাকে অস্বস্তিতে ফালানোর জন্যই এত আয়োজন। চৈতী কাঁধের ট্যুট ব্যাগটা চেপে ধরে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে। তৎক্ষনাৎ কানে আসলো এক ঘায়েল করা কণ্ঠস্বর,
“ সেকি চুমকি! তোমার গাল লাল হলো কেনো?”

খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১৮