খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১৮
আনিকা আয়াত
“সেকি চুমকি! তোমার গাল লাল হলো কেনো?”
হাস্কি স্বরের কথাটা শুনেই চৈতীর বুক ধক করে উঠে। অজান্তেই বাম হাত চলে গেলো দুগালে। তৎক্ষনাৎ শব্দ করে হেঁসে ফেললো অর্পণ। চৈতী নিজের বোকামী বুঝতে পেরে লজ্জায় আরোও লাল হয়ে উঠল। অর্পণ গুনগুনি বলল,
“ ওমাহ! এখন আরোও রক্তলাভ হয়ে উঠেছে তোমার ওই টসটসে স্ট্রবেরির মতো গাল দুটি। কি মিষ্টি লাগছে। ইরমান হাশমির ভাষায় হট এন্ড স্পাইসি। বেশ রসালো গালখানা। ”
অর্পণের মুখে এসব কথা অ/শ্লী/ল ঠেকলো তার নিকট। অশালীন কথাবার্তায় চৈতী হাঁসফাঁস করে উঠে ভেতরে ভেতরে। তার হাত-পা টলছে। হেঁটে যেতেও যেনো বেগ পেতে হচ্ছে। কান দিয়ে গরম ধুঁয়া বের হওয়ার মাঝেই শুনতে পেলো তুষিবের রসিয়ে রসিয়ে কিছু বাক্য,
“ ওহ-হো! কিয়া রোমান্টিক সিন হ্যাঁ ইয়ার। ভাইজানের দিল মে লাড্ডু ফুটা! আমি জানতাম, অতি শীগ্রই আপনাদের মধ্যে কিছু-মিছু হইবোই। ”
অর্পণ কটমটিয়ে, তৎক্ষনাৎ কনুই দিয়ে পাঞ্চ মা/রলো তুষিবের পেটে। ছেলেটা মুহূর্তেই ব্যথাতুর শব্দ করে উঠল। অর্পণের রাগান্বিত চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে যায়। অর্পণ কথা ঘুরানোর জন্য জিজ্ঞেস করে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ দুপুরে খেয়েছ চুমকি?”
লজ্জায়,জড়তায় গলার নিচে থুতনি ঠেকিয়ে আনমনে হাঁটছিল চৈতী। সে পারেনা, এই অসভ্য দুটির থেকে বাঁচতে বুকে থুতনী ঠেকিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যেতে। অর্পণের প্রশ্নে খুব কষ্টে নড়েচড়ে বলল,
“ হলে ফিরে খাবো। আপনি প্লিজ চলে যান। সবাই আড়চোখে আমাদের দেখছে! উল্টাপাল্টা ভাব্বে। ”
“ তো? ভাবুক। তাতে কি যায় আসে? আমি কি তোমাকে চুমু খাচ্ছি? ভরা রাস্তায় জড়াজড়ি করছি? অযথা ন্যাকামু করে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? ”
চৈতীর পা থমকে গেলো সেখানেই। লজ্জায় কাঁপা-কাঁপি শুরু হলো। অতিরিক্ত জড়তায় ইচ্ছে করছে সামনের বেফাঁস কথা বলা অর্পণের মুখ থেঁতলে দিতে। কি নির্বিকার ভঙ্গিতে যা তা বলে যাচ্ছে। চৈতী ঘাড় উঠালো। পাশ ফিরে অর্পণের তীক্ষ্ণ চোখে চোখ রেখে গলা উঁচিয়ে বলল,
“ দেখুন! বাজে কথা বলবেন না..! নয়তো?..”
“ নয়তো? তাহলে কি বলবো? তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছ? গরম দুটো চুমু খেয়েছ? ”
বলেই অর্পণ বাইক থামিয়ে দিলো। তুষিব পেছনে বসে নিরব দর্শকের মতো, দুহাতে মুখ ঢেকে খিলখিল করে হেঁসে পেট ব্যথা করে ফেলছে। তার খুব আনন্দ লাগছে এদের কান্ড দেখে। চৈতীর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। ডান হাত উঁচিয়ে তর্জনী তাক করে হিসহিসিয়ে বলল,
“ চুপ! আর একটাও বাজে কথা নয়। আমি হলে যাচ্ছি। একদম আমার পিছু আসবেন না। ”
অর্পণ গাঢ় চোখে তাকাল। মেয়েটির লাল হয়ে উঠা মুখশ্রী -তে চোখ রেখে বিড়বিড় করে বলল,
“ এই মুহুর্তে আমার মন অনেক কিছুই চাইছে চুমকি। কিন্তু..· যাগ্গে ওসব বাদ দাও। আপাতত বে-হায়া মনকে শাসিয়ে ইচ্ছে করছে, চুমকির পিছু নিতে। সো, তুমি চাইলেও বাঁধা দিতে পারবে না। কারণ, অর্পণ অলওয়েজ নিজের মর্জিতে চলে! কারোও অর্ডারে নয়। চুপচাপ হাঁটতে থাকো। আমি তোমার হাঁটা দেখবো।
বলেই চৈতীর বারবার ঢোক গিলতে থাকা, উদাম গলায় চোখ আটকালো। সে কপাল কুঁচকে সেখানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে হরহরিয়ে বলল,
“ এ্যাই চুমকি? গলা ন-গ্ন কেনো? তোমার উদাম গলা দেখে এলাকার বখাটেগুলো তাদের চোখ দিয়ে কুনজর দিবে। সবাই কি আমার মতো সুশীল? ভদ্র?আমি বলে, তোমাকে সাবধান করলাম। লু-চ্চামি করলেও তোমার কিছু করার ছিল না কিন্তু আমি তা করবো না কারণ আমি ভদ্র ছেলে। স্পষ্ট ভাষায় ফরফর করে সব বলে দেই! বাজে সাজে মতলব আমার নেই। বুঝলে? ”
চৈতী হা হয়ে যায়। গলা থেকে ওড়না শুধুমাত্র একটু সরে গেছে তাই এই অসভ্য লোকটা ন-গ্ন বলবে? ছিহ কি বাজে কথা। ভাবতেই চৈতীর নাক-মুখ কুঁচকে গেলো। যদিও ভেতরে ভেতরে লজ্জা করছে। একজন পুরুষ কিনা তার গলায় নজর দিয়েছে? তাও আবার আঙুল তুলে দেখিয়েও দিলো? ইশশ! মেয়েটা অস্বস্তিতে দ্রুত ওড়না দিয়ে সম্পূর্ণ গলা ঢেকে তিরিক্ষি মেজাজ বলল,
“ অ/শ্লী/ল! আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ভদ্রভাবে কথা বলতে পারেন না?”
“ সামনে ত্যাড়া রমনী থাকলে,অ/শ্লী/ল হওয়াই স্বাভাবিক! সব দোষ তোর! তাই না তুষিব?”
বলেই অর্পণ ফোঁস করে নিশ্বাস নিলো। তুষিব ঘনঘন মাথা নেড়ে তার কথায় স্বায় জানায়। হাঁসলো অর্পণ! হতাশা ভরা বুকে বলল,
“ চুমকির বাচ্চা.! আমাকে ভালো হতে দিলি না। ”
চৈতী বিরক্তে হাত সরিয়ে নিল। হনহনিয়ে চলে গেলো হলের নিকট। অর্পণ বাইকে গা এলিয়ে তুষিবের কাঁধে মাথা রেখে এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো, মেয়েটার পিঠে ঝমঝমিয়ে নৃত্য করা লম্বা বিনুনি! হাঁটার তালে তালে বিনুনি টাও দুলছে! এই মুহুর্তে তার কাছে সামনের হেঁটে চলা রমনীকে মনে হলো, অসাধারণ কেউ! তার প্রতিটি দৃশ্য নিখুঁত। চিকন গড়নের চৈতীর কোমর সুনিপুণে এঁকেবেঁকে চলছে সামনে! যা অর্পণের হৃদয়ে ঝড় উঠাতে একদম যথেষ্ট!
“ ভাইজান! স্ট্যাচু হইয়া গেছেন? আফা চইলা গেছে।কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরা আহেন। আবার কাল -কা মন ভইরা দেইখেন। ”
অর্পণের ঘোর ভাঙল তুষিবের কথায়। সে নড়েচড়ে হেঁসে ফেললো। মাথার চুল এলোমেলো করে হঠাৎ ই শক্ত গলায় বলল,
“ চুমকির সঙ্গে মজা করি মানে এই নয়, তাকে আমার ভালো লাগে। যতসব ফা/লতু চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে এই মুহুর্তে ঝেড়ে ফেল তুষিব। পজিটিভ চিন্তা কর। মেয়েটা সবার মতোই সাধারণ! বিশেষ কোনো ব্যাপার নেই। সবাইকে যেমন একটু বাজিয়ে দেখি। ওকে-ও দেখলাম। এই তো। সুন্দরী, মায়াবী ও ভীতু মেয়েগুলোর অস্বস্তি মুখ দেখতে পৈশাচিক আনন্দ আছে। ওদের থতমত, ভরকানোর ফেস দেখে আমি শান্তি পাই। মাথায় গেছে?”
তুষিব মুখ বাঁকাল। সে ভালো করেই জানে, অর্পণ পুরোপুরি সত্যি বলে নি। সে ভেংচি কেটে বলল,
“ মাথায় গেছে। তবে, এসব অযৌক্তিক কথা মানতে পারলাম না। যত যাই বলুন! আমার সিক্স সেন্স বলছে, খুব শীগ্রই কিছু-মিছু হবেই। যদি নাও হয়, আমি তো আছি। নাকি? সব কৌশলে সেট করে দেবো। ”
শেষের কথাগুলো গুনগুনিয়ে বলল। অর্পণ বাইক চালাতে চালাতে কিছুক্ষণ আগে লজ্জায় লাল হওয়া চৈতীর মুখ কল্পনা করলো। রক্তিম গাল দুটো চোখে ভাসতেই মনে মনে বলল,
“ কল্পনার চেয়েও হাজার গুন সুন্দর তুমি! যার রূপের মুগ্ধতা ছড়ায় প্রতিক্ষণে। ”
তৃধার মায়ের নম্বর পৃথার কাছে থাকলেও ইতস্তত বোধ করায় কল করা হয়নি। সে বারবার ফোন হাতে নিয়ে তৃধার নম্বরে ডায়াল করছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। পৃথা ফোন বিছানায় ছুঁড়ে মা/রতেই তীব্র কর্কশ শব্দে মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ধরফর করে উঠে বসলো পৃথা। স্ক্রিনে ভাসছে, আন্টির নম্বর। পৃথা উত্তেজনায় কাঁপছে। রয়ে সয়ে ফোন রিসিভ করে বলল,
“ আসসালামু আলাইকুম আন্টি! ”
ওপাশ থেকে পৌর মহিলা সালামের উত্তর নিয়ে বলল,
“ বাসায় এসো পৃথা! ”
পৃথা কারণ জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানালেন, তৃধা ইদানীং পা-গলামি করছে। ঠিক মতো খাচ্ছে না! গোসলে যাচ্ছে না। সারাক্ষণ রুমে খিল দিয়ে হাঁসে। কখনও বা ফুল স্পিডে বক্সে গান বাজিয়ে একা একাই নাঁচে। তিনি একয়েকদিনে মেয়ের পা*গলামিতে অতিষ্ঠ। বোঝে উঠতে পারছে না, হয়েছে কি? রাতারাতি সুস্থ, ভোলা ভালা মেয়েটা পা-গল হয়ে গেলো? হসপিটালেও নেওয়া যাচ্ছে না। মেজাজ দেখাচ্ছে খুব। সারাদিন-রাত ম*রার মতো পরে থাকে বিছানায়। হুটহাট দরকার হলে, শুধু বের হয়। তার মা ডাকলেই দৌঁড়ে পালায় রুমে। তিনি এসবে ক্লান্ত!
পৃথা ঝটপট রেডি হয়ে তৃধার বাসায় পৌঁছাল। ওর মা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো যেনো পৃথাকে দেখে। সোফায় বসিয়ে নাস্তা দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ তুধা কতদিন আমার সঙ্গে কথা বলে না। হাঁসে না। ঘর থেকে বের হয়না। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম প্রথমে। তোমার আঙ্কেল কে বিষয়টা জানানোর পর বললো, তৃধাকে বিয়ে দেওয়া উচিৎ। তবেই, মেয়ের মাথা থেকে এসব উদ্ভব ভুত পালিয়ে যাবে। আগের তৃধা ফিরে আসবে। এরপর হঠাৎ একদিন জানালেন, মেয়েকে দেখতে আসবে তার বস। ওকে রেডি কে রেখো। দুদিন আগে তোমার আংকেলের বসের ছেলে দেখতে এসেছিল তৃধাকে। সে কি রাগ ওর! কিছু-তেই রেডি হবে না। বের হবে না রুম থেকে। পাত্রপক্ষের সামনে যাওয়া তো দূর, তাদের কথাই শুনতে পারলো না। সে-কি বিশ্রী অবস্থা। চিল্লাচিল্লি করে,বাসা মাথায় তুলে ফেললো। আমাদের তো মানসম্মান সব মাটিতে মিশে যাওয়া যাওয়ার অবস্থা!
মেয়ের অভদ্র কান্ডে পাত্রপক্ষের সামনে মুখ দেখানোও দুষ্কর হয়ে উঠছিল। সেই সময় অবাক করে দিয়ে, পাত্র নিজেই মিষ্টি করে আমাকে বলল, ‘ আন্টি আমি একটু ডেকে দেই?’ আমি ওর বেয়া-দবী আচরনে তার সামনে লজ্জায় আমতা আমতা করলেও ছেলেটার আবদারে অমত করিনি। ছেড়ে দিয়েছি ওদের। ওমাহ! বিস্ময়কর ব্যাপার কি জানো? লক্ষী ছেলেটার কথায়, কয়েক মিনিট বাদেই মেয়েটা রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো। তাও আবার সেজেগুজে শাড়ি পড়ে ভদ্র মেয়ের মতো। দেখা সাক্ষাৎ শেষে আলাদাও দুজনকে কথা বলতে দিয়েছিলাম, কিন্তু পাত্রপক্ষ চলে যাওয়া পর ভেবেছিলাম তৃধার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু মেয়েটা সেই থেকে আরোও চুপ। পাগ*লামি বেড়েছে দ্বিগুণ। মাঝরাতে, চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়। এখন কি করবো? কিভাবে ঠিক হবে আমার মেয়ে? যদি বিয়ে না করে তাও বলুক। না করে দিবো। তবুও আগের মতো জীবনযাপন করতে বলো। এরকম পা-গলামি করার কারণ কি? অনেক হয়েছে, আর নয়। ”
হতাশায় একদমে কথাগুলো শেষ করলো তৃধার মা। পৃথার কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো। চোখ-মুখে বিস্ময়। গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার মাঝে আন্টির কথা শুনে বেখেয়ালি বশত জিহ্ব পুঁড়ে গেলো। সে বিরক্তে চা রেখে দিলো টেবিলে। তৃধার মা আবারোও বলতে শুরু করে,
“ মেয়েটা ভালো মন্দ কিছু বলছে না। হ্যাঁ! না! কিছু তো বলবে? এক ছাঁদের নিচে থেকেও মেয়েটার সঙ্গে দেখাই হয়না। মতামত জানবো কিভাবে? ছেলেটা ভীষণ সুদর্শন! কথা-বার্তার ধরণ মার্জিত। ব্যবহারও মাশাল্লাহ! কি মিষ্টি -লক্ষী ছেলে। একদম পরিপাটি। এরকম ছেলে পাওয়া দুষ্কর। আমার অগোছালো, পা-গল মেয়েকে সেই পারবে সুখে রাখতে। তুমি একটু বুঝাও তৃধাকে। আমার ধারণা রাজি হবে। রাজি না হওয়ার তো কোনো কারণ দেখছি না৷ তুমি যাও! একান্তে কথা বলো। তাকে বলো! বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে বিয়ের। এখনই সময় ভালো প্রস্তাব এসেছে। বিয়ে করে নিতে। ”
পৃথার নাস্তা খাওয়া ফট করে বন্ধ হলো। বিস্ময়ে চট করে উঠে তৃধার রুমের নিকট দাঁড়ালো। মনে একগাদা কনফিউশান! কে সেই অসাধারণ পুরুষ? যার জন্য তৃধা নিজের কল্পনার প্রেমিক রিয়াদ স্যারকে ভুলে শাড়ি পড়ে সাজগোছ করেছে। ক্রমাগত দরজায় করাঘাত করে চেঁচিয়ে উঠে,
“ ওই তৃধার বাচ্চা! সমস্যা কি তোর? দরজা খুল শয়-তান!”
ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। পৃথার রাগ তরতর করে বাড়ল। আজ যখন এসেছেই! এই মেয়ের ঢং ঘুচিয়ে দেবে। চিৎকার চেঁচামেচি করে অনবরত দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো। মেয়েটাকে সামনে পেলে কি যে করবে। খানিকক্ষণ বাদে খট করে দরজা খুলে যায়। পৃথা হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো, অনিচ্ছায়, জোর পূর্বক মুখখানা গম্ভীর রাখা তৃধার উপর।
“ তৃধার বাচ্চা! আমাদের সবাইকে টেনশনে ফালিয়ে দিব্যি নিজে মাস্তি করছিস? খুব মজা পাচ্ছিস তুই? ”
তৃধা খিলখিল করে হেঁসে ফেললো। গজগজ করা পৃথার হাত খপ করে ধরে নরম বিছানায় শুয়ে পড়লো দুজন। পৃথা পাশ ফিরে গলা চেপে ধরলো,
“ হাঁসবি না একদম। ”
তৃধার হাঁসি জেনো থামছে না। সে খুব কষ্টে হাঁসি থামিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। গলা থেকে পৃথার হাত ছাড়িয়ে উঠে বসে বলল,
“ আরেকটু হলে ম/রেই যেতাম। ডাইনির মতো গলা টিপে দিচ্ছিলি। ”
বলেই তৃধা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো। চিরুনি হাতে নিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে চুল আঁচড়াতে থাকে। গুনগুনিয়ে গান গেয়ে আয়নার ভিতর থেকেই পৃথার কৌতুহল মুখের দিকে তাকিয়ে তড়াক করে পেছন ঘুরলো। কণ্ঠে আহ্লাদ মেখে বলল,
“ আচ্ছা! রিয়াদ স্যার ভার্সিটিতে যায়? আমার কথা জিজ্ঞেস করে? ”
পৃথা মুখ বাঁকাল। বালিশে মাথা রেখে ভেংচি কেটে বলল,
“ ওসব জেনে কি করবি? তোর পেটের গোপন কথা আমাকে এখনও বলিস নি। ”
“ প্লিজ! প্লিজ বল না।বেবী!”
তৃধার কণ্ঠ অধৈর্য্য! পৃথা ভেংচি কেটে ফোন ঘাঁটতে লাগলো।
“ আচ্ছা সব বলবো। তার আগে কথা দে। সব শুনে হার্টফেল করবি না। ”
পৃথার অজানা কৌতুহলে চোখ-মুখ চকচক করে। সে ঝটপট উঠে বসে বলল,
“ করবো না। ”
তৃধা গলা ঝাড়ল। লজ্জায় মস্তক নত করে হাঁসফাঁস কণ্ঠে বলল,
“ নবীন বরণে স্যার আমার গালে হামি খেয়েছে দোস্ত!”
“ হামি?” অত্যন্ত থমথমে স্বরে বলল পৃথা। তৃধা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“ হ্যাঁ খাঁটি বাংলায় চুমু। আমি তো লজ্জায় পারিনা সেখানেই ম/রে যেতে। স্যারও নিজের কান্ড বুঝতে পেরে আমাকে ছেড়ে দূরে সরে যায়। আমি কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না কি করবো! লজ্জায় ইচ্ছে করছিল, সেখানেই জ্ঞান হারাই। এ মুখ কিভাবে স্যার-কে দেখাবো? ভাবলেই শিরশির করে উঠে দেহটা। মনে হচ্ছিল, ফ্লোর খুঁড়ে ভেতরে ঢুকে পড়ি। কিন্তু ওসময় সেসব না করে এক দৌঁড়ে পালিয়ে বাসায় চলে আসি। সেই থেকে মায়ের ভাষায়, আমি উন্মাদ হয়ে গেছি। ”
পৃথা স্তব্ধ চোখে হা করে আছে। তৃধা মিটি মিটি হাঁসলো। বলল,
“ বিশ্বাস কর! আমিও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না স্যার ওসব করবে আমাকে ডেকে। সেই বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারিনি বলেই আমি নিজেকে রুমে আটকে রেখেছি। এরপর গুটি কয়েক দিন পরে আবারোও আমাকে বিস্মিত করে দিলো রিয়াদ স্যার! আমি কথা বলার ভাষা এবার পুরোপুরি হারিয়ে ফেললাম। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না পৃথা। মনে হচ্ছে সব কল্পনা। ভার্সিটি-তে গেলেই উধাও হয়ে যাবে সব। তাই ঘরবন্দী আমি।”
“ আরেক দফা বিস্মিত করে দিয়েছে মানে? নবীন বরণের পর তো ভার্সিটি-ই যাস নি। স্যার তাহলে তোকে বিস্মিত করলো কিভাবে? ঘর থেকে না বের হলে, দেখা হলো কিভাবে? ফোন ও তো অফ। ”
পৃথার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তৃধা ঠোঁট টিপে হাঁসলো। বলল,
“ দুদিন আগে আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল জানিস? ”
পৃথা চটপট জবাব দিলো,
“ হ্যাঁ! কিন্তু..! ”
কথাটি বলেই মেয়েটা হকচকিয়ে উঠে। চোখ বড় বড় করে তৃধার দিকে তাকিয়ে দেখলো, লাজুক ভঙ্গিতে হাঁসছে তৃধা। দুহাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে দেহ কাঁপিয়ে হাঁসছে। পৃথা উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠে,
“ কি? তার মানে আঙ্কেলের বসের ছেলেই রিয়াদ স্যার? স্যারের কথাতেই তুই শাড়ি পড়ে সাজুগুজু করেছিস?”
তৃধা বারবার মাথা ঝাঁকালো। পৃথা আন্টির কথা দুয়ে- দুই চার মিলিয়ে দৌঁড়ে এলো তৃধার নিকট। আকস্মিক কান্ডে মৃদু ভয় পেলো মেয়েটা। পৃথা উত্তেজনায় ধরফর করে বলল,
“ স্যার! স্যার তোকে দেখতে এসেছে? স্যার কি আগে জানতো আঙ্কেলের মেয়ে তুই? এতদিন মজা নিয়েছে? এখন তুই তাহলে রাজি হচ্ছিস না কেনো? ”
“ আমি তো চার পায়ে রাজি! শুধু লজ্জায় আগ বাড়িয়ে মাকে বলতে পারছি না। জানিস তো, বেলেহাজ মনে করবে, লজ্জা সরম নেই মেয়েটার! যদি বলি আমি রাজি। এখনই ডাকো কাজি। শুধু ঢং করছি যে, আমি মুটেও এতটা আগ্রহী নই। কিন্তু সত্যি এটাই, রিয়াদ জান যেদিন দেখতে এসেছিল, সেদিন জোর করে বিয়ে করলেই আমি লাফিয়ে ওর কোলে চড়ে বসতাম।” বলেই মুখ ঢাকলো তৃধা। মনে পড়লো, রিয়াদ স্যারকে পাত্র বেশে দেখার মুহূর্তটা! মায়ের জোড়াজুড়ি তে কোনোমতেই সে বের হবেনা রুম থেকে। রাগে একাই বাসা মাথায় তুলে ফেললো। ঠিক সেই সময় আকস্মিক শুনতে পেলো তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষের মিহি কণ্ঠ,
“ তৃধা! শুনতে পাচ্ছ? বাইরে আসবে না? তোমাকে না দেখেই ফিরে যেতে হবে? আমি পাত্র রিয়াদ মাহমুদ বলছি! ভার্সিটির অধ্যাপক। তোমাকে বিয়ের করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছি! ফিরিয়ে দিবে এভাবে? বের হবেনা?”
চমৎকার এই কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিল তৃধা। হতভম্ব! চমকানো দৃষ্টি তে তাকিয়ে ছিলো দরজার দিকে। বন্ধ দরজার দুপাশে দুটি নর-নারী। যাদের চোখের তৃষ্ণায় এতদিন খরা জন্মেছে। একে অপরকে দেখার কত আকাঙ্খা। রিয়াদ স্যার নিজ ইচ্ছায় এত নিকটে এসেও তৃধা দেখতে পারবে না। মেয়েটা থ বনে যায়। উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের দেখা! সবই জেনো বুঝলো স্যার। মৃদু হেঁসে ফের বলল,
“ অপেক্ষা করছি আপনাকে দেখার। এই কয়েকদিনে চোখ, হৃদয় সব-ই খরায় জর্জরিত। আপনি দয়া করে দর্শন দিয়ে আমার তৃষ্ণার্ত চোখ-বুককে শান্ত করুন। দ্রুত বেরিয়ে কাছে আসুন। অনেক হলো, দূরে দূরে থাকা। এখনই সময় কাছে আসার। আর দূরে নয়। ”
তৃধা লজ্জায়, আনন্দে এবং উত্তেজনায় কূল পাচ্ছিল না কি করবে। হালকা ঢোক গিলে, ঝটপট কাবার্ড থেকে সবগুলো শাড়ি বের করে রুম এলোমেলো করলো। আয়নায় নিজের গায়ে প্রতিটি শাড়ি জরিয়ে সে কনফিউজড হয়ে যায়। কোনটা পড়লে সুন্দর লাগবে তাকে? পরিশেষে মেরুন রঙের জামদানী শাড়ি পড়ে হালকা সেজে বেরিয়ে আসলো। মায়ের সঙ্গে গিয়ে তার ব্যক্তিগত পুরুষের সামনে বসতেই হাঁসফাঁস করে উঠে। রিয়াদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দূর থেকেই তাকে কাঁপিয়ে তুলে।সে বুঝতে পারে, স্যার ওই অসভ্য আঁখি দিয়েই তাকে গিলে খাচ্ছে। টুকটাক কথা শেষে একান্ত কথা বলার সুযোগ চায় রিয়াদ। বাঁধ সাধে না কেউ! মেয়ের বাবা-মায়ের অমত নেই। কিন্তু তৃধার পা হিম হয়ে আসে। খুব কষ্টে বেলকনির কর্নারে দাঁড়িয়ে রয়। রিয়াদ স্যার সামনের রমনীকে গাঢ় চোখে দেখে বলে উঠে,
“ বিয়েতে তোমার কোনো অমত আছে? আশা করি নেই। যদি ভুলেও অমত থেকে থাকে তাহলে নবীন বরণের দিনের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটবে।বুঝতে পেরেছ? ”
তৃধার বুক কাঁপছে। সে খামচে ধরলো শাড়ির আঁচল। রিয়াদ স্যার সবই পর্যবেক্ষণ করে এগিয়ে গেলো তার নিকট। মাঝের সমস্ত দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেললো। স্যারের উত্তপ্ত নিশ্বাস উপচে পড়ছে তার মুখে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় তৃধা। রিয়াদ স্যার মুখ এগিয়ে নিলো মেয়েটির কানের নিকট। ফিসফিস করে বলল,
“ তোমার কথাই সত্যি হচ্ছে মেয়ে। তুমি বলেছিলে, আমার পাশের বালিশ দখল করবে। আমার চার নম্বর বাচ্চার জননী হবে। ওকে ফাইন। দেরীতে হলেও এবার সত্যি সত্যি হতে যাচ্ছ। ”
বলেই ঠোঁট কান থেকে সরিয়ে আনলো। নাকে নাক ঘঁষে অধর বাঁকিয়ে হাঁসলো। তৃধা চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস আঁটকে রেখেছে। দুহাতে শাড়ি খামচে ধরে ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। তা লক্ষ্য করে স্যার হাঁসলো। মেয়েটার এইরূপ তাকে পা*গল করে দিচ্ছে। আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলেই সে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবে। যদি নিজের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে না পেরে ভুলে কিছু করে বসে? সেই ভয়েই দূরে সরে বেরিয়ে গেলো। বিয়ের পরেই নাহয় উজার করে আদর করবে। ছোট্ট করে যাওয়ার আগে বলেছিল,
“ হবু স্বামী হিসেবে নয়। স্যার হিসেবে বলছি, বাধ্য ছাত্রীর মতো আর ফাঁকি দেওয়া চলবে না। অনেক হলো ফাঁকি ঝুঁকি! ক্লাসে এট্যান্ড করবে কাল থেকে। সুন্দরী ছাত্রী ক্লাসে না দেখলে, পড়ানোর মুড থাকে না। বোরিং ফিল হয়। ”
বলেই চলে গেলো। কিন্তু রেখে গিয়েছিল অনবরত ঘামতে থাকা তৃধাকে। অজানা শিহরণে মেয়েটা নিজেকে সামলাতে পারছিল না। লজ্জায় স্যারের কথাও রাখতে পারেনি। সে ক্লাস তো দূর! রুম থেকেই বের হয়নি। খুশিতে, উত্তেজনায় আরোও নিজেকে বন্দী রাখে কক্ষে। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়,
“ রিয়াদ স্যার! খুব শীগ্রই আপনি শুধু তৃধার। আপনার পা থেকে মাথা পর্যন্ত এই আমার। সব! সব! সব! শুধুই তৃধার অধিকার। রিয়াদ স্যার! অন্য নারীর সঙ্গে এই জিনিসের ভাগ হবে না আজীবন। ”
পৃথার কি/ল খেয়ে ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলো তৃধা। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে দেখলো, পৃথা হা হয়ে আছে। গরগর করে বলল,
“ আন্টিকে তাহলে জানিয়ে দেই। তবে, বিয়ে খাচ্ছি তাই তো? ওদিকে রিয়াদ স্যারও উতলা হয়ে আছে। আজ আমাকে জিজ্ঞেস করেছে তোর কথা। কিন্তু এসব বলেনি ওই বদলোক।”
“ সত্যি? ”
“ হুম। ”
“ আমার লজ্জা করছে দোস্ত। এখন স্যারকে দেখলেই আমার কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়। এমনকি ফটো দেখলেও আমার বুক কাঁপে। সে কি ধারালো দৃষ্টি। ভয়ে অসাড় হয়ে যাই। আমি কিভাবে ভার্সিটি যাবো পৃথা। স্যার যদি রেগে কিছু করে বসে। শুনছি, প্রতিদিন বাবাকে চাপ দিচ্ছে রিয়াদ স্যারের বাবা। আমার মতামত কি জানার জন্য। রাজি থাকলে দ্রুত বিয়ে সেরে ফেলতে চান। কিন্তু আমার না লজ্জা করছে। আগে মজা করলেও, এবার সত্যি সত্যি স্যারের বউ হবো ভাবলেই গা শিউরে উঠছে পৃথা। স্যার যখন আদর করবে তখন? তখন কি করবো? আমি-তো ম-রেই যাবো দোস্ত.. ”
পৃথা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। শা/লা পল্টিবাজ মেয়ে কোথাকার। পৃথা মনে মনে ভাবলো, সব বন্ধুদের আজই সে সব বলে দিবে। একটা কথাও চেপে রাখা যাবেনা। কারণ, কিঞ্চিৎ পরিমান কথা গোপন রাখলেই তার পেট ব্যথা শুরু হয়ে যায়। আর এই রকম ঝাকানাকা ব্রেকিংনিউজ না বললে সে ম/রেই যাবে। সবাইকে বলতে হবে, তাদের অগোচরে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। যেখানে, তৃধা এবং রিয়াদ স্যার মূল চরিত্র। আন্টির সঙ্গে কথা বললেই সব সেটিং! বিয়েও পাক্কা। তারপর সব বন্ধু মিলে শপিং করবে জমিয়ে। একদম ফাটিয়ে দেবে বিয়েতে।
পায়েল শেখ আদরের বড় ছেলের জন্য পছন্দের সব খাবার রান্না করছেন। সকাল থেকেই বাসার পরিবেশ থমথমে। তৃষ্ণা ভাইয়ের শোকে কাতর! মুখটা কালো করে সেই যে বসে আছে আর নড়াচড়া নেই। মুখে কখনও প্রকাশ না করলেও ভীষণ ভালোবাসে অর্ণবকে। লাইফের সব কঠিন মুহূর্তেও অর্ণব পাশে দাঁড়ায়। তার জন্য চকলেট, প্রিয় রঙের জামা, জুতা এবং কোচিং-য়েও দিয়ে আসতো। কিন্তু অর্পণ? অসম্ভব! তৃষ্ণার মনেই পড়েনা, অর্পণ কবে তাকে একটা চকলেট কিনে দিয়েছে। অর্ণব যতটা কেয়ারফুল ঠিক ততটাই অর্পণ সব ব্যাপারে কেয়ারল্যাস!
রাত হয়েছে অনেকটা! অর্ণব ব্যাগ গুছিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। মায়ের কড়া বাক্য ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারেনা সে। উনার কথামতো টুকটাক জিনিস প্যাক করতে করতেই জীবন শেষ। ব্যাগপত্রও হয়েছে একগাদা। অর্ণব হাত মুখ ধুয়ে নিলো। বারান্দায় ফিরে তার শখের গাছগুলোর টবে পানি দিয়ে ডাকলো তৃষ্ণাকে। মেয়েটা এলোমেলো পায়ে এসে বলল,
“ কি হয়েছে ভাইয়া?”
অর্ণব ক্যামেলিয়া, অর্কিড এবং গাঁদা ফুলে পানি দিয়ে রুমে গেলো। এখন শীত কাল! এই শীতের মৌসুমে বিভিন্ন বাহারের ফুল তাদের রূপে ফুটে উঠে। দেখতেও চমৎকার লাগে! অর্ণব ছোট থেকেই শৌখিন, দক্ষ এবং ট্যালেন্টেড বয়! পরিপাটি ও গোছানো থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এসব ছোট্ট ছোট্ট অসাধারণ গুণের জন্যই সবাই ভীষণ ভালোবাসে থাকে। কাজিন মহলে একটা নামই জ্বলজ্বল করে, তা হলো অর্ণব শেখ। গুণে গুনীবান ছেলে! যে সর্বদা দেশ এবং প্রিয় মানুষদের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত। অর্পণের সঙ্গে তার দা কুমড়ো সম্পর্ক হলেও এই প্রিয় মানুষের জন্য জীবন দেওয়ার ব্যাপারটা শুধু মিলে। এই এক জায়গাতেই নো কম্প্রোমাইজ!
“ আমি চলে গেলেও গাছগুলোর কোনো ক্ষতি যেনো না হয়! প্রতিদিন যত্ন করে ওদের আগলে রাখবি। মনে করবি, ওদের মাঝেই আমি লুকিয়ে আছি। ”
অর্ণবের মাথার চুল বড় হয়ে গিয়েছিল। আজই একদম ছোট করেছে। সেগুলোয় হাত চালাতে চালাতে বলল। তৃষ্ণা মাথা দুলিয়ে আশ্বস্ত করলো,
“ চিন্তা নাই ভাইজান। ”
পায়েল শেখের রান্না বান্না শেষ। তিনি হাঁক ছেড়ে ডাকলো। দুই ভাই-বোন চলে গেলো ড্রয়িংরুমে। অর্ণবের প্রিয় গরম গরম শিং মাছের ঝোল, রুই মাছের মাথার মুড়িঘণ্ট আর গরুর মাংস সামনে রাখলেন। অর্ণব হাঁসলো মায়ের পা-গলামি দেখে। জামিল শেখকে না দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ আব্বু কই? বাসায় নেই?”
পায়েল শেখ “ না” সূচক মাথা নাড়াল। প্লেটে চিকন চালের সাদা ভাত আর চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা দিয়ে বলল,
“ জানিস-ই তো রাজনীতি করে। কোথায় যেনো মিটিং আজকে। সেখানেই খেয়ে ফিরবে। তুই নিশ্চিন্তে খা বাবা। ”
অর্ণব প্রতিটি খাবারের নিকট ঝুঁকে ঘ্রাণ নিতে নিতে লম্বা শ্বাস নিলো। মুখে “ আহা ! কি মিষ্টি ঘ্রাণ” বলেই হাঁসলে। অতঃপর জিজ্ঞেস করে ,
“ শেষ দিনটাও অর্পণ – কে ছাড়াও খাবো? ও কোথায়? কল করে আসতে বলো। ”
পায়েল শেখ নাক-মুখ কুঁচকে দরাজ গলায় বলল,
“ আসতে বলিনি? ওর কি এসবে চিন্তা আছে? জিজ্ঞেস করে দেখ, জানে কিনা! তুই কবে যাচ্ছিস। ফা-জিল ছেলে বানিয়েছিলাম আমি। একমাত্র বড়ভাই কাল ভোরে চলে যাবে। তাও খেয়াল নেই। আছে শুধু বাঁ/দ/রামী করার ধা/ন্দায়। তুই খা বাপ। আমি নিজের হাতে খাইয়ে দেই? ”
অর্ণব মায়ের আহ্লাদে হাঁসলো। বলল,
“ এখনও ছোট নেই আম্মু। এত্ত বড় হয়ে গেছি। তুমি বসে থাকো আমি খাচ্ছি।”
“ না বাপ। একটু খাইয়ে দেই?”
অর্ণবের কিছু বলার আগেই তৃষ্ণা গপাগপ খাওয়া থামিয়ে চিল্লিয়ে বলল,
“ আম্মু! কোনোদিন তো আমাকে খাওয়িয়ে দাওনা। সব ভালোবাসা, আদর শুধু ভাইয়ার জন্যই?”
অর্ণব হেঁসে উঠে। বোনের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
“ পা*গলি মেয়ে। কে বলেছে তোকে কেউ ভালোবাসে না? আমরা সবাই তোকে ভালোবাসি। ”
বলেই তৃষ্ণাকে একপলক দেখে নিলো। মেয়েটা অর্ণবের গাল টেনে চুপচাপ খাওয়ায় মন দিলো। অর্ণব আনমনে তাকিয়ে রয়। সেই ছোট্ট বোনটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে যাচ্ছে। পায়েল শেখ এর কথায় ঘোর ভাঙলো! সামনে প্রতিটি লোভনীয় পদ দেখে লোভ সামলাতে পারলো না। ক্ষুধায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে তার। চটপট খাওয়া শুরু করে মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো,
“ উফফ! মা! তোমার হাতের রান্না কি বলবো? লাজবাব আম্মু। একয় মাস খাবার খাইয়ে একদম লোভী বানিয়ে দিচ্ছ। কাল থেকে তো ওসব ভাজাপোড়া পেটেই সইবে না। ”
এতক্ষণের পায়েল শেখের হাঁসি হাঁসি মুখ মুহূর্তেই চুপসে গেলো। ওড়না মুখের সামনে এনে ভরে উঠা চোখে ছলছল করে তাকায়। মায়ের ফুঁপানি আওয়াজে অর্ণবের মনে পড়লো, নিজের বলা বাক্যের কথা। তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে বলল,
“ আম্মু! বাচ্চাদের মতো কাঁদছ কেনো? প্রতিবার বাচ্চামো করো। আমি কি এখনও ছোট? চাকরিতে যখন গিয়েছি, তখনও দেশের জন্যও লড়া/ই করবো। আমাকে ফিরতেই হবে। মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে থাকলে চলবে না। ওসব কা-পুরুষের কাজ। আমি অন্তত কা-পুরুষ নই। তোমাদের ইমোশন গায়ে মাখলে কাজ হবেনা আম্মু। বরং পদে পদে দূর্বলতা নিয়ে আঘাত হানবে শ-ত্রু দল। কারণ মানুষের বড় শ-ত্রু হচ্ছে, তাদের দূর্বলতা।”
পায়েল শেখ তবুও নিজের মনকে বুঝাতে পারলো না। হু হু করে কেঁদে চলে গেলো বারান্দায়। অর্ণব ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। অর্ধ খাওয়া ভাতের প্লেট সেভাবেই রেখে উঠে গেলো বেসিনে। তৃষ্ণার কান্না পাচ্ছে। সে আকুল গলায় বলল,
“ ভাইয়া খাবে না?”
“ পড়ে খাবো। তুই না খেয়ে উঠিস না। ”
কুয়াশার আচ্ছন্নে ঢাকা সম্পূর্ণ শহর! হাড় কাঁপুনি শীতে কম্বলের নিচ থেকে বের হওয়াও দ্বায়। শিরশিরে বাতাসে গা কাটা দিয়ে উঠে। শীত নিয়ন্ত্রণ উষ্ণ কাপড়েও ইদানীং কাজ হচ্ছে না। হঠাৎ করেই জেনো শীতটা বেড়ে গিয়েছে। এই কনকনে ঠান্ডায় স্নিগ্ধা গায়ে শুধু ফিনফিনে একটা টি-শার্ট এবং প্লাজু পড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। খোলা জানালা গলে, বাইরে থেকে হুড়মুড় করে আসছে হীম শীতল বাতাস। যা গায়ের শিরা-উপশিরায় কম্পন ধরাচ্ছে। তবুও আনাচন মন বড্ড বেহা-য়ার মতো দেহের কষ্ট ভুলে মনের ব্যথায় কাতর হতেই ব্যস্থ। স্নিগ্ধার সম্পূর্ণ দেহটাই জমে যাচ্ছে যেনো। সামনের বাসার ছাঁদে মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে, তার দৃষ্টি সেদিকেই। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে নিলো। এতটা খারাপ, চাপা কষ্ট আগে কখনও অনুভব করেনি। অর্ণব কি তার হৃদয়ে হানা দিলো? সত্যি চলে যাবে কাল? মনে পড়লেই দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকা হাত দুটি বুকে চেপে ধরলো। র*ক্ত শূন্য ঠোঁট দুটি বিড়বিড় করে কিছু বলতেই উপস্থিত ঘটে মিষ্টির।
“ আপু..! ছাঁদে যাবি? অর্ণব ভাইয়া ডেকেছে। ”
তার কণ্ঠ অত্যন্ত সতর্ক! নিচু স্বর! ঘুনাক্ষরেও যেনো তার মা টের না পায়। বোনের মন ইকটু আধটু হলেও বুঝতে পারে সে। এই যে খামখেয়ালি, আনমনা সবই যে, ওই চাশমিশ ছেলেটির জন্য। কনকনে শীতের মাঝেও গায়ে গরম কাপড় কিংবা চাদর পড়েনি এসব তো এমনি এমনি নয়। প্রতিবছর মিষ্টির থেকেই স্নিগ্ধা শীতে বেশী কাঁপে। গায়ে জড়ায় অনেক কাপড়। অথচ আজ একটাও জড়ায় নি? তাও এই তীব্র শীতে.? যেখানে মিষ্টির হুডি, চাদর পড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও বেগ পেতে হচ্ছে। ভেবেই বোনের যন্ত্রণায় চোখ দুটো ভরে এলো তার। বোনের ঠান্ডা দেহটা জাপ্টে ধরলো। ইশ! কি ঠান্ডা! কতটা কষ্টে থাকলে মানুষ নিজেকে কষ্ট দেয়। তাড়াহুড়ো করে বলল,
“ ও আল্লাহ! তোর গা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে আপু। দ্রুত সোয়েটার পড়। আরেকটু সময় পেরিয়ে গেলেই ম/রে যাবি। ”
স্নিগ্ধা চুপ! মুখে নেই কোনো বাক্য। তার ভাবাবেগ লক্ষ্য করা গেলো না। আগের মতোই পাথর হয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। মিষ্টির মুখটা থমথমে হলো। পেছন থেকে বোনের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“ আম্মু ঘুমিয়ে পড়েছে। তুই যা আপু। আজই শেষ সুযোগ। ভাইয়া নাকি ভোরেই চলে যাবে। তোকে কি যেনো বলবে। একটু শুনে আয়। ”
মিষ্টির অনবরত ঘ্যানঘ্যানে স্নিগ্ধা বিরক্ত ভরা মুখে পিছু ঘুরলো। শিরশির করে ঠান্ডা বাতাস গায়ে আসতেই বলল,
“ অকালে প্রয়োজনের থেকেও বেশী পেঁকে গিয়েছিস মিষ্টি। একা থাকতে দে। চুপচাপ ঘুমা। ”
“ না তুই ছাঁদে যাবি বল।”
স্নিগ্ধা ঘরে এলো হনহনিয়ে। বিছানায় অবহেলায় পড়ে থাকা চাদরটা কোনোমতে গায়ে জড়িয়ে ছুটে চললো বাইরে। ধীর গলায় মিষ্টিকে বলে গেলো,
“ লাইট অফ করে দে। আম্মু যেনো কখনও বুঝতে না পারে। ”
ছাদের রেলিঙের হাত রেখে উদাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এক টগবগে যুবক। যার দেহের প্রতিটি অংশে দাম্ভিক! পা থেকে মাথা পর্যন্ত শৌখিনের ছোঁয়া। চোখের চশমাটা এই বিষণ্ণ ঠান্ডায় ঘোলা হয়ে গেছে। সে সামনের কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু আলসেমির তাড়নায় হাত উঠিয়ে চশমা মুছতেও মন স্বায় দিচ্ছে না। তবে, এই ব্যাপারটাও এডভেঞ্চার! আমরা মানুষ বড্ড অদ্ভুত। মন না চাইলে, কিছুই করতে পারিনা। এইযে, কুয়াশায় ঢাকা শহর। বাইরের রাস্তায় যানবাহনের কোলাহলের বিকট শব্দ। মৃদু শিরশিরে বাতাস। তবুও ভালো লাগছে না। আশেপাশের কিছুই অর্ণব পরিষ্কার দেখতে না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মিনিট পাঁচেক যেতেই নির্জন ছাঁদে নুপুরের শব্দ তার কানে পৌঁছাল। নুপুরের ঝুমঝুম আওয়াজে রমনী ধীর পায়ে তার কাছে আসছে। ওই শব্দটাও আস্তে আস্তে তার নিকট এসে থামলো।
“ হঠাৎ এত রাতে জরুরী তলব? বিশেষ কোনো কারণ?”
স্নিগ্ধা মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডায় কথা বলতে পারছে না। তবুও খুব কষ্টে বলল। অর্ণব আগের মতোই ঠাই দাঁড়িয়ে ধীর গলায় বলল,
“ ডাকতে পারিনা? নিষেধ আছে কি?”
স্নিগ্ধা মুখ তুলে সামনে চাইলো তৎক্ষনাৎ অর্ণবও পিছন ফিরে। পরক্ষণেই ছেলেটার চোখ-মুখের বিবর্তন পাল্টে গেলো। কপাল কুঞ্চন করে স্নিগ্ধার নিকট এসে অস্থির কণ্ঠে বলল,
“ সেকি? ঠান্ডায় মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে ! গায়ে কাপড় কই? সোয়েটার কোথায়? এই শীতে প্লাজু কোন পা*গলে পড়ে? মাথা খারাপ মেয়ে। ”
স্নিগ্ধা একপলক নিজেকে দেখে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“ কেউ না পড়লেও আমি পড়ি। কোনো প্রবলেম? মিস্টার চশমা ছাড়া কানা অর্ণব? ”
হতভম্ব হয়ে গেলো অর্ণব। কপাল কুঁচকে গাঢ় চোখে তাকিয়ে মেয়েটার হীম হওয়া দেহটা দেখতে লাগলো। চাদরটাও অবহেলায় নামমাত্র জড়িয়ে আছে। তীব্র ঠান্ডায় মেয়েটার ঠোঁট এবং মুখ র-ক্তশূন্য হয়ে গেছে। হতাশার শ্বাস ফেললো অর্ণব। দুজনের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে কোনো পারমিশন ছাড়াই শক্ত করে জড়িয়ে নিলো নিজের উষ্ণ, গরম দেহের সঙ্গে। অর্ণবের গায়ের হুডি টা উঁচু করে তৎক্ষনাৎ মেয়েটার মাথা ঢুকিয়ে বুকে লুকালো। মেয়েটা আকস্মিক কান্ডে হকচকিয়ে উঠে। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে নাড়াচাড়া শুরু করে দেয়।
“ কি করলেন এটা? আমাকে বের করুন এখান থেকে। অস্বস্তি হচ্ছে খুব। ”
মেয়েটা লাফালাফি করতে করতে অর্ণবকে অতিষ্ঠ করে তুললো। বিরক্ত হলো সে। দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে স্নিগ্ধার মাথা নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে মাথা ঠেকালো মেয়েটার মাথায়। অধৈর্য্য স্নিগ্ধার পিঠে আলতো হাতে চাপ্পড় দিতে দিতে কোমল কণ্ঠে বলল,
“ শান্ত! শান্ত! আর একটুও জড়াজড়ি নয়। আপনি যতই নড়বেন আমার হৃদয় ততই অশান্ত হবে স্নিগ্ধা। তখন আপনার-ই বিপদ। এই নির্জন! নিস্তব্ধ রাতে টগবগে এক যুবক মানবীর অগোচরে অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। আপনার স্পর্শে এলোমেলোও হতে পারি। সো কুল থাকুন। আমার বুকে ঘাপটি মে-রে পড়ে থাকুন। আমি একটু প্রশান্তি অনুভব করি! হ্যাঁ?”
খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ১৮
বলেই অর্ণব স্নিগ্ধার কোমরে ঝুলতে থাকা লম্বা চুলের আগায় হাত বুলানো। অর্ণবের প্রতিটি হৃদয় কাঁপুনি কথায় তার নড়চড় অজান্তেই বন্ধ হয়ে যায়। সে ঠান্ডা হাত দুটো দিয়ে হুডির ভেতর থেকেই অর্ণবের কাঁধ খামচে ধরলো। অনুভূতির জোয়ারে ভেসে চুপটি করে রইলো অর্ণবের বুকে। তৎক্ষনাৎ অতিরিক্ত খুশিতে স্নিগ্ধার গাল বেয়ে উপচে পড়ে দু ফোঁটা জল। সে খুশিতে আজ পা-গল হয়ে যাবে। খুব! খুব উন্মাদ ।