খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৪
আনিকা আয়াত
“ এ বাসায় নতুন উঠেছেন নাকি? আগে কখনও দেখিনি!”
যুবকটির হেয়ালি কথা শুনে স্নিগ্ধা যেনো আকাশ থেকে পড়লো। মেয়েটা হতবাকের ন্যায় হা করে দুই কদম এগিয়ে আসে। ভ্রু জোড়া ভীষণভাবে কুঁচকে আশ্চর্য সুরে বলল,
“ মাথার নাট কি ঢিলে গেছে? রাতারাতি চুল কেটেছেন! চোখে চশমা আর ইনোসেন্ট ফেইস নিয়ে আমার সামনে আসলেই আপনি অন্য কেউ হয়ে যাবেন? দেখুন অর্পণ শেখ! এসব নাটক বন্ধ করুন। সত্যি করে বলুন, আমাকে ফলো করছেন কেনো? কি মতলব আপনার? সকালে ঠান্ডা মাথায় অপমান করলেন, এখন বাসা পর্যন্ত চলে এসেছেন। ”
স্নিগ্ধার অনর্গল কথায় হকচকিয়ে উঠলো সামনের যুবক। কপাল কুঁচকে প্রথম কথাগুলো শুনে মেজাজ চটে গেলেও, শেষ কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। তারমানে, এই মেয়ের সাথেও অর্পণের দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে! আবার ছোটখাটো ঝগড়াও? এই পৃথিবীতে কি একটাও মেয়ে নেই? যার সাথে অর্পণের সাক্ষাৎ হয়নি! কথাটি ভেবে হতাশ হলো ছেলেটি।
যুবকটি পূর্বদৃষ্টি মেলে রমনীর দিকে তাকালো। মেয়েটা রাগে ফোঁসফোঁস করছে। জেনো, তার উত্তর শুনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। ওড়নার কোনা অনবরত পেঁচাচ্ছে আঙুল দিয়ে। যুবকটি গোপনে হাঁসলো! নাক ফুলিয়ে থাকা, মেয়েটির রাগান্বিত চোখের দিকে তাকিয়ে, একটু বাজিয়ে দেখার জন্য বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ তাই নাকি? কিন্তু জানলাম কিভাবে? যে আপনি এখানে থাকেন?”
“ আপনার ওই বখাটে চ্যালারা নিশ্চিত খবর দিয়েছে!”
যুবকটি মনে মনে পেট ফাটা হাঁসি হেঁসে চুপচাপ ছাদের রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটি কি বোকা! এখনও বুঝেনি, অর্পণ ভিন্ন একটি পুরুষ । সে তীক্ষ্ণ চোখে স্নিগ্ধাকে পরখ করলো। মিষ্টি এতক্ষণ তাদের তর্ক দেখলেও এবার বোনের কানে কানে বলল,
“ ছেলেটাকে চিনিস কিভাবে? এতো সুন্দর ছেলে। বল না আপু। প্রমিজ করছি, আম্মু টুঁ-শব্দও জানবে না। তোর কসম। ”
রেগে স্নিগ্ধা চোখ রাঙালো। মিষ্টি চো-রা চোখে যুবকটিকে দেখে মিটি মিটি হেঁসে বলল,
“ আচ্ছা আপু! তোদের মাঝে কি চক্কর চলছে? এজন্যই এ বাসায় উঠেছি? আজ ছাঁদে আসার মূল কারণ সামনের ছেলেটি? ”
স্নিগ্ধা তখন গভীর চিন্তায় বিভোর। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ চুপ করবি? ওই অর্পণ শেখ একটা অসহ্য ছেলে। লাফাঙ্গা কোথাকার। ”
মিষ্টি খিলখিল করে হাঁসলো। ফোনের ক্যামেরা অন করে তার দক্ষ হাতে টপাটপ কয়েকটা ছবি তুললো যুবকটির। তৎক্ষনাৎ ধরা পড়লো সে। কারণ ছেলেটি যে ওদেরকেই দেখছিল। সে ঠোঁট টিপে হাঁসলো। তীক্ষ্ণ চোখে যুবকটি মিষ্টিকে বলল,
“ ছবি তুলছ? আগে বলবে না? দাঁড়াও রেডি হয়ে দাঁড়াচ্ছি।”
যুবকটি টানটান হয়ে দাঁড়ালো। মুখে চমৎকার হাঁসি ফুটিয়ে ইশারা করলো ছবি তুলতে। মিষ্টি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। মুখে প্লাস্টিক হাঁসি ঝুলিয়ে অসহায় চোখে স্নিগ্ধার দিকে তাকায়। স্নিগ্ধার চোখ থেকে র-ক্ত ঝরছে। সে চোয়াল শক্ত করে মিষ্টির হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নিলো। শক্ত গলায় উচ্চস্বরে বলল,
“ আপনার লাফাঙ্গা ছেলেপুলেদের বলুন। আমার মতো অভদ্রের ফোনে ছবি তুলবেন কেনো?”
যুবকটি রেলিঙ থেকে এগিয়ে এসে শব্দ করে হাঁসলো। চোখের চশমা ঠিকঠাক করে, রঙ্গন গাছের সামনে দাঁড়িয়ে রসিকতার সুরে বলল,
“ অর্পণ শেখ আপনাকে খুঁচা দিয়েছে? এতো রাগ কেনো তার প্রতি? ”
স্নিগ্ধার রাগ যেনো তরতর করে বাড়ছে। এই ছেলে এমন নাটক করছে জেনো কিছুই জানে না। নাটকবাজ লোক। সে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ঘুরলো। তখনও যুবকটির চোখ তার দিকে স্থির। মনে মনে অস্বস্তিতে পড়ল সে। সামনে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করলেও, ভেতর ভেতরে লজ্জা করছে। লোকটা কেমন নির্লজ্জের মতো চেয়ে আছে। লজ্জায় চোখ নত করার সময়ই তার নজর পড়ে, ছেলেটির ফর্সা উদাম পায়ে। তৎক্ষনাৎ বেহায়া চোখ সেখানেই আটকে যায়। সে এক দৃষ্টিতে ঘোরের মাঝে তাকিয়ে রইলো। যুবকটি কপাল কুঁচকে বলল,
“ অর্পণ শেখ! আর কি কি করেছে? চুমু টুমু খেয়েছে? ”
“ চুমু টুমু খায়নি। তবে একজন রমনীকে ভর বিকেলে সিডিউস করেছে।”
“ হোয়াট! ”
যুবকটির চিৎকারে ভয়ে কেঁপে উঠে স্নিগ্ধা। গভীর ধ্যান ভেঙে যায় মুহুর্তেই। সে চোখ খিঁচে ছিঃ ছিঃ করলো নিজের কল্পনা আর কথাকে। হায় খোদা এসব মুখ থেকে কিভাবে বেরুলো? নিজের প্রতি লজ্জায় আড়ষ্ট হলো স্নিগ্ধা। ভেতরে ভয়ংকর অস্তিত্ব তাকে ঘিরে ধরেছে। নাহ! এখানে আর একমুহূর্ত নয়। যত সময় যায়, এই লোকটা তাকে আকর্ষণ করিয়ে দেয়। এতো বেয়াদব কেনো? দামড়া ছেলে হয়ে, হাফ-প্যান্ট পড়ে এসেছে। তাও আবার ছাঁদে। এখানে কত মানুষ আসে। স্নিগ্ধা চারপাশ পরখ করে দেখল, কিছুদূরে চার-পাঁচ জন মানুষ নিজেদের মতো গল্প করছে। বিকেলটাও ধীরে ধীরে সন্ধ্যায় রূপ নিচ্ছে। তার বোন মিষ্টি শুধু মুচকি মুচকি হাঁসছে। স্নিগ্ধা লম্বা শ্বাস ফেলে মিষ্টির হাত ধরে সিঁড়ি ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
“ কিছু না। ”
তৎক্ষনাৎ স্নিগ্ধার সামনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একটি অষ্টাদশী মেয়ে প্রবেশ করলো। হাঁটুতে দু-হাত ভর করে হাঁপাতে হাঁপাতে আশেপাশে কাউকে খুঁজে। এদিক ওদিক সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
“ অর্ণব ভাইয়া..! আম্মু তোমাকে ডাকছে। অর্পণ ভাইয়া আজও কাকে জেনো মে/রেছে। বাসার ভেতর হুলুস্থুল কান্ড। আম্মু আজ মে/রেই ফেলবে ভাইয়া কে। তুমি প্লিজ বাঁচাও। ”
মেয়েটি বলেই আগের মতো দৌঁড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ি বেয়ে চলে গেলো। অথচ, সামনে দাঁড়ানো স্নিগ্ধা আর মিষ্টি বিস্ময়ে হতভম্ব চোখে পেছনের অর্ণবকে দেখছে। মেয়েটি কি বললো? অর্ণব? তবে অর্পণ কে? এসব হচ্ছে টা কি? অর্ণব স্নিগ্ধাকে পাশ কেটে নিচে যেতে যেতে বলল,
“ অর্পণ নয় আমি অর্ণব শেখ! আপনার লাফাঙ্গা অর্পণের টুইনস! ”
স্নিগ্ধার ভেতর লজ্জা কাঁচুমাচু করে। এবার যা বুঝার সে খুব ভালো করেই বুঝে গেছে। এতক্ষণ নিজের কান্ডে তার লজ্জায় ম/রে যেতে ইচ্ছে হলো। ছি! না জেনে কি কি বললো মানুষটাকে। নিশ্চয়ই বেয়া/দব মেয়ে ভাবছে? সে হালকা ঢোক গিলে মিষ্টির দিকে তাকায়। মিষ্টিও কাঁদো কাঁদো মুখ করে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পর দুজনেই ছাঁদ কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলল,
“ অর্পণ আর অর্ণব শেখ টুইনস? এসব হচ্ছে টা কি? ”
স্নিগ্ধা একপ্রকার দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল,
“ আমি পা-গল হয়ে যাচ্ছি মিষ্টি। যেদিন থেকে ওই অর্পণের সঙ্গে দেখা, সেইদিন থেকেই আমি শেষ। গোছানো জীবনটা উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। ”
থার্ড ফ্লোরে আসতেই স্নিগ্ধার চোখে পড়লো, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সুখের ভঙ্গিতে সি-গারেট খাচ্ছে অর্পণ। তার পাশেই অর্ণব চিবিয়ে চিবিয়ে তাকে শাসিয়ে যাচ্ছে। স্নিগ্ধাকে দেখে অর্পণ ঠোঁট এলিয়ে হাঁসলো। সি-গারেট ঠোঁট থেকে নামিয়ে গোল আকৃতি ধোঁয়া নাক-মুখ দিয়ে বের করে, বলল,
” আমার বাসার ঠিকানায় চলে এসেছ? দাঁড়াও তোমার টাকা পরিশোধ করে দিচ্ছি সুন্দরী। ”
অর্ণব রেগে গেলো। ত্যাড়া ছেলেকে এতক্ষণ ধরে বুঝিয়েও লাভ হচ্ছে না। সে তেড়ে গিয়ে অর্পণের কলার চেপে ধরে বলল,
“ আমি তোকে কিছু বলছি। প্রতিদিন কেনো গ্যাঞ্জাম করিস? অহেতুক মা/রা মারি করলে, নেক্সট টাইম জেলে পুড়ে দিবো!”
স্নিগ্ধা সি-গারেটের ধোঁয়ায় কেশে উঠে। ওড়না দিয়ে নাক চেপে মিষ্টির সাথে, নিরব শ্রোতা হয়ে দুই ভাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এতটাও নিখুঁত হতে পারে? অর্ণবের চুলগুলো অর্পণের মতো বড় হলে, একদম ধরাই যাবে না। শুধু দুজনের চুলটাই পার্থক্য! আর কিছুই স্নিগ্ধার চোখে পড়লো না। তার ভাবনার মাঝেই অর্পণ পকেট হাতড়ে ত্রিশ টাকা বের করলো। স্নিগ্ধার হাতে ধরিয়ে বলল,
“ সুদ সমেত ৩০ টাকা। ২০ টা আসল। বাকি ১০ হচ্ছে দেরী হওয়ার জন্য! এবার যাও। নেক্সট টাইম আমার বাসার আশেপাশে ভুলেও এসো না। আম্মা জানতে পারলে, তোমাকে দুভাগ করবে। যেখান থেকে এসেছ, সেখানে যাও। এ বাসায় কি? ”
স্নিগ্ধা কিংকর্তব্য বিমুঢ়! সে নিশ্চলভাবে অবাকের ন্যায় অর্পণের পানেই তাকিয়ে। এরকম খচ্চর ছেলে তার লাইফে সে কখনোই দেখেনি। তাকে আবার অপমান! আর কি বললো? আমার বাসা? তার মানে এটা অর্পণদের বাসা? রাগে সারাদেহ তার রি রি করে উঠছে। স্নিগ্ধা হাতের টাকা মুচড়ে ফেলে শক্ত গলায় বলল,
“ আর একবার টাকার কথা বললে আপনাকে আমি মে/রে ফেলবো। অসভ্য ছেলে। ইচ্ছে তো করছে! আসলে আমার কপাল খারাপ! নাহলে, বারবার কেনো আপনার সাথে দেখা হবে? রাস্তায় বেরুলেও আপনি! ভার্সিটি গেলেও আপনি। এখন যে বাসায় থাকছি, সেখানেও আপনি। অসহ্য। বিরক্ত আমি।”
বলেই সে গটগট পায়ে চলে গেলো।
“ এই যা। ওই মেয়েকে বাসা ভাড়া দিলো কে? তুই? ”
অর্ণব দাঁতে দাঁত চেপে তাকায়। অথচ অর্পণ উচ্চস্বরে হেঁসে সিগা-রেটে একটা টান দিয়ে অর্ণবের মুখে ধোঁয়া ছাড়লো। তৎক্ষনাৎ রেগে বলল,
“ আমি তোর বড় অর্পণ। বড় ভাইয়ের সামনে সিগারেট খাচ্ছিস?”
“ কিসের বড়? প্রমান কি?”
“ আম্মা বলেছে। আমি তোর পাঁচ মিনিট আগে পৃথিবীতে ল্যান্ড করেছি। ”
অর্পণ গা ছাড়া ভাব নিয়ে দরজায় করাঘাত করে বলল,
“ চুপ মায়ের চামচা! আব্বা কইছে আমি বড়। যাহ ফুট!”
“ অর্পণ। আমি তোর বড়। ”
“ না আমি। আর একটা আওয়াজ করলে, মাথা ফাটায় দিমু।”
তাদের ঝগড়ার মাঝে দরজা খুলে দিলো অষ্টাদশী মেয়ে তৃষ্ণা! দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেঁসে বলল,
“ আমি তোমাদের বড়। হইছে এবার! অর্পণ ভাই বাসায় আসো। তোামর বিচার হবে। আম্মু হাতে ঝাড়ু নিয়ে বসে আছে। তোমাকে বরন করবে।”
অর্ণব চোখ দিয়ে শাসিয়ে ভেতরে চলে গেলো। অর্পণ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে দুইহাতে গায়ের শার্ট ঝেড়ে ভেতরে ঢুকে। ড্রয়িং রুমে পা দিতেই বুঝতে পারে, ঘটনা সুবিধার নয়। কপালে আজ শনি, রবি, সোম, মঙ্গল সবই আছে। পায়েল শেখ অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাতে ঝাড়ু নিয়ে তেড়ে এলো, অর্পণের দিকে। হুংকার ছেড়ে বকাঝকা করতেই অর্পণ এক দৌঁড়ে নিজের রুমে ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো। পায়েল শেখ অতিরিক্ত রাগে উত্তেজিত হয়ে দরজায় ঝাড়ু দিয়ে বারি মে/রে বলল,
“ শয়তানের বাচ্চা দরজা খুল। তুই কি আমারে শান্তি দিবি না। সারাদিন কই থাকিস? গুন্ডামী করার জন্য এতো বড় করলাম? প্রতিদিন বাসায় অভিযোগ আসে কেনো? তোর বাপ একজন! শাসন করার বদলে, ছেলেকে আরোও লেলিয়ে দেয়৷ তুই খালি বের হ রুম থেকে। অর্ণবকে দেখে কিছু শিখতে পারিস না?”
রুমের ভেতর আরাম বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে অর্পণ হাঁসলো। অর্ণব বছর তিনেক আগে আর্মিতে জয়েন হয়েছে। আর সে? আরামে বাপের হোটেলে পায়ের উপর পা তুলে খাচ্ছে। এটাই পায়েল শেখের সহ্য হচ্ছে না। বড় ছেলেটার একটা গতি হয়েছে। যথেষ্ট ভদ্র। আর অর্পণ?
সে যেনো, অর্ণবের পুরাই উল্টো! সারাদিন ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়। জীবনের কোনো রুলস নেই। লক্ষ্য নেই! কি হবে ভবিষ্যতে! ছেলেটার বখাটেপনায় পায়েল শেখ অতিষ্ট।
অর্পণ এজন্যই ওই হতচ্ছাড়া অর্ণবের উপর রেগে যায়। জমজ হয়েছে অথচ, তার পুরোই উল্টো স্বভাবের! কেনো অর্পণের মতো হলো না। সে বিছানা থেকে উঠে দ্রুত পায়ে বারান্দায় গেলো। অর্ণব টবে পানি দিচ্ছিল। অর্পণ তৎক্ষনাৎ তেড়ে গিয়ে তার উপর আক্রমণ করে বসে। টি-শার্ট চেপে ধরে চোয়ালে মৃদু ঘুষি দিয়ে বলল,
“ অর্ণবের বাচ্চা। এতো ছোট বয়সে ভদ্রলোকের চাকরি করতে বলেছে কে? তোর জন্য রাত-দিন কথা শুনতে হয়। তুই কালই চাকরিতে রিজাইন দিবি। ওসব আর্মি-টার্মি বাদ। এতো ভদ্র আমার সহ্য হচ্ছে না। আমার সাথে ভার্সিটি যাবি। এলাকা চুষে খাবি! ”
“ চৈতী এদিকে এসো!”
কলেজ ক্যাম্পাসে বসে চৈতী পড়ছিল। হঠাৎ তৃধার গলা শুনে পেছন ঘুরে তাকায়। হাতের বইটা রেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ জি আপু। কিছু বলবেন?”
“ কিছু না। তুমি একা বসে আছ। তাই ডাকতে এলাম। চলো আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিবে।”
তৃধা মেয়েটির হাত ধরে সামনে হাঁটতে ধরে। চৈতী কিছুদূরে নজর দিয়ে দেখলো, সেখানে দুইটি ছেলে বসে আছে। ব্যাপারটা ভালো লাগলো না তার। কেনো এই মেয়ে তাকে ডাকছে? সে হাঁটা থামিয়ে বলল,
“ আপু আমার ফ্রেন্ড আসছে। গেইটে যেতে হবে। আপনারা আড্ডা দিন।”
তৃধা তার কথা গুরুত্ব না দিয়ে বলল,
“ আরেহ চলো তো।”
চৈতী গাইগুই শুরু করে। জোরপূর্বক তৃধার হাত ছাড়িয়ে বুঝাতে লাগলো। তৎক্ষনাৎ সেখানে প্রচন্ড স্পিডে বাইক নিয়ে ভার্সিটিতে ঢুকে অর্পণ। পেছনে তুষিব! তৃধা হেঁসে হনহনিয়ে যায় তার কাছে। চৈতী হাঁপ ছেড়ে গেইটের দিকে পা বাড়ালো জিনিয়াকে আনতে। অদূরে চোখের চশমা এক টানে খুলে অর্পণ চৈতীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে বাঁকা হাঁসি দিলো।
ভার্সিটি ছুটির পর বটগাছের নিচে বসে চৈতী বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ সেখানে হিমু একটি মেয়ের সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলে এগিয়ে এলো। শ্রাবণের পাশে ধপ করে বলে বলল,
“ আমার নতুন বন্ধু স্নিগ্ধা! ভীষণ মিষ্টি মেয়ে। পরিচিত হয়ে নে।”
চৈতীর মনে ঈর্ষা হলো। পৃথিবীর সব কিছু ভাগ দিলেও বন্ধু আর প্রিয় মানুষ কখনও কাউকে ভাগ দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। সেখানে হিমু দুইদিনেই নতুন মেয়ের সাথে ফ্রেন্ডশীপ করলো? ভেতরে ভেতরে সে হিংসায় জ্বলে উঠে। তার মানে এখন থেকে সব কিছুতে এই মেয়েটিও থাকবে! চৈতীর হৃদয় ব্যথিত হলো। সে মুখ ফুলিয়ে বইয়ের দিকে চোখ ডুবিয়ে রাখে। জিনিয়া আর শ্রাবণ খুশিতে গদগদ হয়ে পরিচিত হলো। স্নিগ্ধা মিষ্টি হেঁসে চৈতীকে বলল,
“ নাম কি তোমার?”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও চৈতী বই থেকে মুখ তুলে মৃদু হেঁসে বলল,
“ চৈতী। ”
আজ ভার্সিটি বন্ধ! চৈতী রেডি হয়ে বেরিয়েছে জিনিয়ার সঙ্গে জরুরি কথার উদ্দেশ্যে । রিকশায় বসে মেয়েটি চিন্তা করছিল টিউশনির কথা। অন্তত একটা টিউশন জোগাড় হলেই টেনশন থাকতো না। এই দুপুরের খরখরে রোদে গলা শুঁকিয়ে আসছে চৈতীর। গায়ের ওড়না দিয়ে মুখ-গলা মুছে সে লম্বা শ্বাস নিলো। হালকা ঢোক গিলে রিকশাওয়ালা মামাকে বলল,
“ মামা! সামনের দোকানে একটু থামাবেন! ”
মিনিট দুয়েক পর একটি দোকানে রিকশা থামলো। চৈতী একটি ঠান্ডা পানির বোতল কিনে ঢকঢক করে গিলে তপ্তশ্বাস ফেলে। এবার একটু ভালো লাগছে। সে আরেকটি বোতল হাতে নিয়ে, রিকশায় উঠার সময় হঠাৎ পেছন থেকে একটি ছেলে দৌঁড়ে তার আগেই রিকশায় উঠে বসলো। মামাকে তাড়া দিয়ে বলল,
“ মামা জলদি স্টার্ট করুন। আমার বাইকসহ তুষিবকে আশিকের দল আটকে রেখেছে!”
চৈতী থমকে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই । রিকশাওয়ালা মামা চৈতীকে উঠার জন্য তাড়াহুড়ো করলো। মুহুর্তেই অর্পণ পাশে তাকিয়ে দেখলো চৈতীকে। ভ্রুদ্বয় ভাজ করে ক্লান্ত গলায় বলল,
“ এ্যাই মেয়ে। আমার ঢঙ করার সময় নেই। তারাতাড়ি রিকশায় উঠ। ”
চৈতী তখনও চুপ। অর্পণ এমনিতেই রেগে আছে। চৈতীকে নড়াচড়া করতে না দেখে, সে বিরক্ত হয়ে সিট থেকে দাঁড়ায়। হঠাৎ আকস্মিক কান্ডে হকচকিয়ে উঠে মেয়েটি। অর্পণ তার বাহু শক্ত করে ধরে রিকশায় টেনে উঠাচ্ছে। চৈতী ভয়ার্ত কণ্ঠে কিছু বলার আগেই তার দুই কাঁধ খামচে ধরে ধপ করে, পাশের সিটে বসিয়ে বলল,
“ চুপচাপ বসে থাকো। নয়তো নেমে যাও। আমার সময় নেই। তুষিবকে ওরা বেঁধে রেখেছে।”
ভয়ে, আতঙ্কে চৈতী এখনও হতবিহ্বল হয়ে অর্পণের পানে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে। সে আনমনে বলল,
“ কেনো?”
অর্পণ ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত ঘড়ি দেখে সামনে তাকিয়ে বলল,
“ কয়’দিন আগে ভরা রাস্তায় রড দিয়ে পিটিয়েছিলাম।”
“ কেনো?”
“ ওসব অনেক কথা। আশিক পিচ্চি ছেলের কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নিয়েছিল। এরপর ওই ছেলেটা আমায় জানায়। আমি প্রথমে মৃদু হাতে চড় মা/রি পিচ্চিকে। তারপর ছেলেপেলে নিয়ে ওই আশিক কে পিটাই।”
অর্পণের গা ছাড়া কথায় ভয় পেলো চৈতী। অর্পণ জানালো, ছেলেটা ফুল বিক্রি করে সংসার চালায়। আর সেই কষ্টের টাকা আশিক কেঁড়ে নেয়। সাধারণ নেশার ঘোরে আশিকের বুদ্ধি লুপ পেয়েছে। শুধু টাকার জন্য চোখ উঁকি ঝুঁকি করে। আজ তুষিবকে একা পেয়ে আটকে রেখেছে। গ্রামের সাধাসিধা মেয়েটা এসব কথায় শিউরে উঠে। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৩
“ কিন্তু আপনি পিচ্চিকে মে/রেছেন কেনো?”
অর্পণ বিরক্ত চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। চৈতীর নিকট ঝুঁকে বাঁকা হাঁসলো। হিসহিসিয়ে বলল,
“ ও কেনো প্রতিবাদ করলো না? আমরা যতদিন নিজেকে অসহায় প্রকাশ করবো! ততদিন সবাই সুযোগ নিবে।”
চৈতী অনুভব করলো সে ঘামছে। সে যথেষ্ট চেপে বসেছে অর্পণের থেকে।ভুলেও যাতে স্পর্শ না লাগে। মেয়েটি তৃষ্ণায় কম্পিত হাতে পানির বোতল ঠোঁটের কাছে নিতেই অর্পণ খপ করে নিয়ে নিলো। অর্ধেকের বেশী পানি পুরোটাই নিজের পেটে চালান করে ফাঁকা বোতল ছুঁড়ে মা/রলো দূরে। চৈতী রেগে তাকিয়ে বলল,
“ আমি কি খাবো? আমার তৃষ্ণা পেয়েছে।”