গোধুলির শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ৩১

গোধুলির শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ৩১
Raiha Zubair Ripti

পড়ন্ত বিকেল,,খাওয়া দাওয়া শেষ রজনী দের। রজনী এখন বসে আছে সাদমানের সাথে প্যান্ডেলের ভেতর সাজানো চেয়ারে৷ রুয়াত শাফায়াত বাড়ির ভেতরে নাইমুর সানজিদার কাছে। একটু পরই বের হবে সবাই। রজনীর ওয়াশরুমের চাপ পেলো। সেজন্য বসা থেকে উঠে সাদমানের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ আমার একটু ওয়াশরুমে যেতে হবে। আমি আসছি একটু।

সাদমান মাথা ঝাকিয়ে আচ্ছা বলল। রজনী চলে গেলো বাড়ির ভেতর। দোতলায় ওয়াশরুম। রজনী দোতালায় চলে গেলো। করিডোর পেরিয়েই লাস্টের দিকে গেস্ট রুমে ওয়াশরুম আছে। রজনী করিডর পেরিয়ে রুমের ভেতর ঢুকলো। ওয়াশরুমের দরজা ধরে ধাক্কা দিতেই দেখলো ভেতর থেকে আটকানো। রজনী বুঝলো ভেতরে কেউ আছে। তাই অন্য রুমের ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ ভেসে আসে কানে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রজনী পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকায়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসা এক মুখশ্রী দেখার সাথে সাথে রজনীর হৃদপিণ্ড টা কেঁপে উঠে। মনে হলো পৃথিবী থমকে গেছে তার। দু কদম পিছিয়ে গেলো। আজ কয়টা বছর পর এই মুখশ্রী দেখছে রজনী। শ্বাস আটকে গেলো। কণ্ঠনালী কেউ ধরে রেখেছে। সামনে থাকা মানুষটার ও কি একই অবস্থা রজনী কে দেখে? কোলে আছে সেই তখনকার বাচ্চা টা।

পড়নে ব্লু কালারের স্যুট। আগের থেকেও সুদর্শন লাগছে। আচ্ছা বাচ্চা টা নওফিল এর কি হয়? মেয়ে? নওফিল তাহলে বুঝি বাচ্চা পেয়ে এখন পরিপূর্ণ তাই না? রজনী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। মুখ চেপে চলে আসলো। রুম থেকে বের হতেই চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি বের হতে লাগলো। আহ্ আবার সেই কষ্ট। রজনী তো এবার মরেই যাবে। কি দরকার ছিলো এতো গুলো মাস পর আবার এই মুখশ্রী কে চোখের সামনে নতুন রূপে দেখার?

নওফিল নিজেও পাথরের মতো জমে আছে। এতোদিন পর প্রাক্তন কে দেখে হৃদয়টায় কেমন একটা অনুভূতি হলো। মেয়েটার সাজ দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা ভালো আছে। আচ্ছা সত্যি রজনী ভালো আছে সুখে আছে তাই না? ও কি বিয়ে করেছে? ও কি নওফিল নামক মানুষ টিকে ভুলে গেছে? নাহ্ ভুলে নি। ভুললে কি চলে যেত এভাবে মুখ চেপে? মেয়েটা কে কম করে তো আর ভাঙে নি নওফিল। নিশ্চয়ই ঘৃণা ও করে নওফিল কে। মেয়ের হাতের স্পর্শে ঘোর কাটলো নওফিল এর। এসেছে দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাইয়ের বউ ভাতে৷ যদি কোনো ভাবে জানতো এখানে রজনী আসবে। তাহলে কস্মিনকালেও এই মুখ দ্বিতীয় বার দেখাতো না রজনী কে।

নওফিল বেরিয়ে আসলো রুম থেকে। আজ আবার যেতে হবে নাইমুর এর শ্বশুর বাড়ি।
সাদমান আকস্মিক রজনী অস্থির হয়ে দৌড়ে ছুটে আসতে দেখে ভারি চমকালো। রজনীর বাহু ধরে বলল-
-“ কিছু হয়েছে রজনী?
-“ আ..আমি বাসায় যাব সাদমান। প্লিজ আমাকে বাসায় নিয়ে যান। আমি আর থাকতে পারবো না এখানে। আই নিড মেডিসিন। তা না হলে যে কোনো কিছু ঘটিয়ে ফেলবো নিজের সাথে।
কেঁপে কেঁপে বলল কথাটা রজনী। সাদমান বুঝলো না হুট করে রজনীর এমন কথা বলা দেখে। রজনী কে আস্বস্ত করে বলল-

-“ ব্রো আর রুয়াত ওদের নিয়ে আসুক। তারপর…
-“ কোনো তারপর এরপর নয়। আপনি না পারলে বলুন আমি একাই চলে যাব।
রেগে বলল কথাটা রজনী। সাদমনে বিস্ময়ের চরমে। সাদমান ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলো রজনীর শরীর স্বাভাবিকের তুলনায় অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। এই ঠান্ডা আবহাওয়া তেও বাজে ভাবে ঘামছে। সাদমান বুঝে নিলো কিছু একটা হয়েছে যার কারনে রজনীর এমন অবস্থা হচ্ছে। পকেট থেকে ফোন বের করে শাফায়াত কে চলে যাওয়ার টেক্সট পাঠিয়ে রজনী কে নিয়ে চলে গেলো।

সাদমান রজনী কে নিয়ে নিজেদের বাসায় আসে। রজনী নিজের রুমে ঢুকে মেডিসিন টা খেয়ে নেয়। পড়নের শাড়ি খুলে কামিজ পড়ে নেয়। ব্যথায় বুক ভারি হয়ে আসছে। বুকে হাত ঘষে সারা রুম পায়চারি করতে লাগলো। সাদমান এতক্ষণ বসার রুমে ছিলো। এখন রজনীর রুমের সামনে আসলো। দরজা বন্ধ ভেতর থেকে। সাদমান টোকা দিলো।
-“ রজনী দরজা টা খুলুন।

রজনী সাদমানের গলার আওয়াজ শুনে দরজা টা খুলে আবার পায়চারি করতে লাগলো। সাদমান টেনে বসালো রজনী কে খাটে। রজনীর এমন অবস্থা জাস্ট নিতে পারছে না সাদমান। গালো আলতো করে হাত রেখে বলল-
-“ হোয়াট হ্যাপেন্ড’স রজনী? কি হয়েছে আপনার? এমন দেখাচ্ছে কেনো? বলুন আমায়?
রজনী জোরে জোরে শ্বাস নিলো।
-“ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে সাদমান।
রজনীর গলার স্বর শুনে সাদমানের ভেতর আত্মা টা কেঁপে উঠলো।
-“ কোথায় ব্যথা হচ্ছে আমায় বলুন?
রজনী বুকে হাত দিয়ে বলে-

-“ আমার এইখান টায় ব্যথা হচ্ছে সাদমান। আমি পারতেছি না এই ব্যথা সহ্য করতে। মনে হচ্ছে আমি ম’রেই যাব। আমাকে মে’রে ফেলুন না সাদমান। সত্যি আমি এই ব্যথা নিতে পারতেছি না। উফ কি অসহ্য ব্যথা।
রজনীর চোখ দিয়ে সমান তালে জল পড়তে লাগলো।
সাদমান জড়িয়ে ধরলো রজনী কে। মাথায় হাত রেখে বলল-
-“ হঠাৎ এতো কষ্ট পাচ্ছেন কেনো রজনী? কি হয়েছে আমাকে বলুন না। আপনার চোখের জল আমাকে বড্ড পিড়া দিচ্ছে।
রজনী এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। সাদমান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল-

-“ জানেন আমি আজ নওফিল কে দেখেছি। ও ছিলো বিয়ে বাড়িতে। ঐ যে আমরা যেই বাবু টাকে কোলে নিলাম না? ঐ বাবু টা ওর কোলে ছিলো। নওফিলের বাবু হয়েছে। ও সুখী আছে। ও চোখের সামনে আসার পর থেকেই আমার বুকে ব্যথা করতেছে সাদমান। আমি কি এই বুকে ব্যথা নিয়ে ম’রে যাব?
সাদমান বুঝে গেলো। ঐ নওফিল ই সেই নওফিল। কি এক ভাগ্য। ঘুরে ফিরে সেই নওফিল কেই কেনো রজনীর সামনে আসতে হবে? রজনী তো সাদমান এর সাথে নতুন জীবন শুরু করতে চাইছিল আর হুট করে এই লোকের আগমন।

রুয়াত শাফায়াত নাইমুর সানজিদা কে নিয়ে নাইমুর দের বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শাফায়াত হাত ঘড়ি টার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ দাঁড়িয়ে আছিস কেনো নাইমুর? ওঠ গাড়িতে।
নাইমুর এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল-
-“ আরে আমার এক দূর সম্পর্কের কাজিন যাবে। তারজন্য ই অপেক্ষা করছি।
নাইমুর ফোন দিলো নওফিল কে। ফোন রিসিভ হতেই বলল-

-“ আপনি কোথায় ভাইয়া?
নওফিল তার নিজের গাড়িতে বসে আছে নাইমুর এর বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে।
-“ তুমও যাও নাইমুর। লোকেশন টা সেন্ড করো আমি চলে যাব নওরিন কে নিয়ে।
নাইমুর লোকেশন টা সেন্ড করে সানজিদা কে নিয়ে উঠে বসলো গাড়িতে। শাফায়াত ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ তোর দূর সম্পর্কের কাজিন আবার কে?

-“ চিনবি না। আমি নিজেও চিনতাম না। মাস কয়েক হলো চিনেছি। আমার বাবার চাচার চাচার ঘরের নাতি সে। আম্মার সাথে পরিচয় হয়েছে মাস খানেক আগে। আমরা কুয়াকাটা গেলাম না? তখন। এই শহরেই নাকি থাকে এখন মেয়েকে নিয়ে।
শাফায়াত গাড়ি চালানো তে মনোযোগ দিলো। বাড়ির কাছে এস গাড়ি থামিয়ে ভেতর ঢুকে সবাই৷ নাইমুর সোফায় বসে বারবার সদর দরজার দিকে তাকায়। রুয়াত নিজের রুমে যায় শাড়ি চেঞ্জ করতে। শাফায়াত বারবার সদর দরজার দিকে তাকাতে দেখে বলে-

-“ তর কাজিন কতদূর ফোন দিয়ে দেখ।
নাইমুর ফোন দেওয়ার জন্য পকেট থেকে ফোন বের করতে নিলে দেখে সদর দরজা দিয়ে নওফিল তার মেয়ে নিয়ে ঢুকছে। নাইমুর ফোন টা পকেটে ঢুকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ ঐ তো এসে গেছে।
শাফায়াত তাকালো। নওফিল এগিয়ে আসলো। নাইমুর বলল-

-“ এটা হচ্ছে আমার কাজিন নওফিল। আর ভাইয়া এ হচ্ছে আমার ফ্রেন্ড শাফায়াত।
নওফিল সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিয়ে কুশলাদি করলো। নামটা শুনে শাফায়াত এর কিছুটা খটকা লাগলেও তা পাত্তা দিলো না। সোফায় নওফিল কে বসতে বলে নিজেও বসে পড়লো। রুয়াত শাড়ি পাল্টে থ্রিপিস পড়ে বসার ঘরে আসতেই পা জোড়া থেমে যায়। এই অভদ্র লোক তাদের বাসায় কেনো? এই লোক কে তার বোন দেখলে তো হুলস্থুল কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়বে। রুয়াত এগিয়ে আসতে নিলে শাফায়াত বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রুয়াতের দিকে এগিয়ে আসলো। রুয়াত থেমে গেলো। শাফায়াত এর দিকে তাকিয়ে বলল-

-“ এই লোক এখানে কেনো?
-“ এখানে কেনো মানে? এটা নাইমুর এর কাজিন।
-“ কিহ! এটা তো সেই নওফিল। আপনি বুঝতে পারছেন আপু দেখলে কি হবে? ওরে বের করেন বাসা থেকে।
শাফায়াত রুয়াতের হাত টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো। বেরিয়ে যেতে বলবে এটা কোন ধরনের কথা। সবার সামনে সিনক্রিয়েট করার কোনো মানেই হয় না৷ এখন অতিথি বাসার নওফিল। একটা লোককে অসম্মান করবে এভাবে?
বিকেলে রাস্তার পাশ ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছে নীতি। গন্তব্য ইউনিভার্সিটি। সেখানে গিয়ে যথাসম্ভব সব কাজ শেষ করে ঢাকা চলে যাবে। ভার্সিটির গেটের কাছে আসতেই দেখা মিলল নীলয়ের। রোজকার নিয়ম করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ একা না। পাশে তিন চারজন ছেলেও আছে। নীতি উপেক্ষা করে চলে আসতে নিলে নীলয় হাত টেনে ধরে। নীতির ভেতর আত্মা কেঁপে উঠে। আশেপাশে সবাই তাকিয়ে আছে। নীতি পেছন ফিরে বলে-

-“ হ… হাত টা ছাড়ুন নীলয়।
নীলয় হাত টা ছাড়লো না৷ আগের তুলনায় চেপে ধরলো জোরে৷ ব্যথায় চোখ বন্ধ করলো নীতি। নীলয় এগিয়ে নীতির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে-
-“ এভয়ড করছিস আমায়? বলেছি না আই লাভ ইউ? কথা কানে যায় নি। শুনলাম ভার্সিটি ছেড়ে চলে যেতে চাইছিস? পারবি যেতে? এই নীলয় তোকে যেতে দিবে ভেবেছিস? তুই নীলয়ের না হলে তোর এমন অবস্থা করবো যে তুই অন্য কারোর ও হতে পারবি না।

নীতি মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো ছাড়া পাওয়ার জন্য। কিন্তু নীলয় তা হতে দিলো না। নীতির পড়নের ওড়নায় হাত দিতেই নীতি আর পারলো না। ডান হাত দিয়ে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো নীলয় এর গালে। নীলয় এর চোখ হিংস্র হয়ে জ্বলে উঠলো। নীতি বুকে ধাক্কা দিয়ে গেট থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে হোস্টেলের চলে গেলো।
নীলয় এর সাঙ্গোপাঙ্গ রা এগিয়ে এসে বলল-
-“ আপনি কিছু বললেন না ভাই? কত বড় সাহস আপনার গালে চড় মে’রেছে।
নীলয় গালো হাত দিয়ে রিকশার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ঘুঘু দেখেছে ঘুঘুর ফাঁদ দেখে নি। ভালো মতো বলেছি শুনলো না। এরপর ওর সাথে যা হবে ও কল্পনাও করতে পারবে না।

নীতি হোস্টেলে ফিরে কান্না করে দিলো। ছেলেটা কতটা অসভ্য হলে নীতির ওড়নাতে অব্দি হাত দেয়। নিজ শহর হলে এতক্ষণে জুতা দিয়ে পি’টিয়ে সোজা করে দিত। কিন্তু নিজ শহর না হওয়ায় তা পারছে না। নীতির রুম মেট হাবিবা নীতি কে কান্না করতে দেখে এগিয়ে আসলো। নীতির পিঠে হাত রেখে জিগ্যেস করলো-
-“ কাঁদছিস কেনো নীতি? কিছু হয়েছে আবার?
নীতি হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল-

গোধুলির শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ৩০

-“ ঐ বেয়াদব টা আজ আমার ওড়না ধরেছিল হাবিবা। আমি আর না পেরে থাপ্পড় মে’রে এসেছি।
হাবিবার বুক টা ছ্যাত করে উঠলো। এই ছেলে ভীষণ খারাপ। নীতির জন্য ভয় হচ্ছে। খারাপের সর্ব শেষেও যেতে পারে এই ছেলে। হাবিবা নীতি কে সাবধান করে দিলো। বলল আজ থেকে একা হোস্টেলের বাহিরে না যেতে। ভরসা নেই নীলয় কে নিয়ে।
নীতি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।

গোধুলির শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ৩২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here