চিত্ত চিরে চৈত্রমাস পর্ব ২৫

চিত্ত চিরে চৈত্রমাস পর্ব ২৫
মম সাহা

তুমুল বৃষ্টির ছাঁটে বিরক্ত অহি। আর কিছু অপ্রয়োজনীয় মিথ্যে অজুহাতে বাহিরে এসে নওশাদের দেখা পাওয়ার পর হতভম্বও সে। লোকটার ফর্সা ফর্সা মুখ কেমন লাল হয়ে গিয়েছে! অনেকক্ষণ যাবত হয়তো ভিজছে! অহি দ্রুত গিয়ে নওশাদের মাথার উপর ছাতা ধরলো। বৃষ্টির অবাধ্যতায় কতখানি ভিজেও গেলো সে। বিরক্ত এবং অবাক কণ্ঠে সে প্রশ্ন করলো,
“আপনি এখানে কী করছেন!”
ঠান্ডায় নওশাদের নাক-মুখ বসে যাওয়ার উপক্রম। তবুও অনেক কষ্টে বললো,
“আপনাকে দেখতে এসেছি!”

“আপনি আমাকে দেখতে বনানী থেকে ধানমন্ডি এসেছেন! বনানী থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব জানেন তো?”
“আপনি বনানী থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব দেখছেন অথচ আমার ভালোবাসার গুরুত্ব দেখছেন না! এ কেমন অবিচার আপনার? দয়া করে নাহয় একটু দয়া করুন, আমায় নিয়ে ভাবুন, আমায় একটু নাহয় ভালোবাসুন।”
নওশাদের কণ্ঠে তুমুল আকুলতা। অহি বিরক্ত হলো। এমন পা* গলামো কিংবা বাচ্চামো তার কখনোই পছন্দ না। তবুও লোকটা এসব করছে!
অহিকে চুপ থাকতে দেখে কথা বললো নওশাদ। আকুতি করে বললো,
“আমার প্রতি কী আপনার একটুও মায়া হয় না?”
“না, হয়না।”
প্রশ্নের জবাবে অহির কাঠকাঠ উত্তর। নওশাদ তপ্ত শ্বাস ফেললো। ভারিক্কী গলায় বললো,
“তাহলে এখনি এখান থেকে যান। আমার ভালোবাসার প্রতি যার দয়া নেই, তার যেন আমার প্রতিও কোনো করুণা নাহয়।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নওশাদের কথার এই আকাশ-পাতাল পরিবর্তনে প্রায় থতমত খেয়ে গেলো অহি। স্তম্ভিত হয়ে বললো,
“কী করছেন? টিনএজারদের মতন আচরণ করবেন না।”
“ভালোবাসার আচরণের আবার পার্থক্য আছে নাকি? ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি গম্ভীর কিংবা টিনএজারও হতে রাজি।”
“আমার এসব পছন্দ না কিন্তু।”
“তাহলে চলুন, বিয়ে করি?”
নওশাদের হঠাৎ এমন প্রস্তাবে অহি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। কেমন হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো! অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“কী!”
“চলুন না, বিয়ে করে ফেলি।”

অহি গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলো। এই মুহূর্তে নওশাদ ফাজলামো করছে বলে তো মনে হয় না কিন্তু কথাটা যে সত্যি সত্যি বলছে তাও বিশ্বাস হচ্ছে না। বনানী থেকে এই রাতে ছুটে এসেছে কি কেবল এই কথাটা বলার জন্য? এত পা* গলাটে চিন্তা! অহি তপ্ত শ্বাস ফেললো, শীতল কণ্ঠে বললো,
“যেখান থেকে আসছেন, সেখানে ফিরে যান। এসব করে আমার মনে বিরক্তের সৃষ্টি করছেন, তাছাড়া আর কিছুই না।”
“কোথায় ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন! যেখান থেকে এসেছি সেখানে ফিরে যেতে হলেও আমার আপনাকে চাই।”
“আমাকে চান? কেনো চাইবেন? ভালো লাগে বলে?”
“না, ভালোবাসি বলে।”

নওশাদের সহজ স্বাভাবিক উত্তরে অহির তেজের ভাঁটা পড়লো। হাল ছেড়ে দেওয়া ভাবে বললো,
“আচ্ছা মানলাম ভালোবাসেন বলে। তা, ভালোবাসলেই কি পেতে হবে এমন কোনো কথা আছে? ইতিহাসে এমন কতই তো হয়েছে যে তুমুল ভালোবাসার পরও একজন আরেকজনকে পায় নি। তাহলে আপনারই কেন পেতে হবে?”
“ইতিহাসে বিচ্ছেদ ছিলো বলে আমিও অপ্রাপ্তি রাখবো তা ভাবছেন কেনো? বার বার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হবে তারও কোনো মানে নেই। ইতিহাস যারা রটেছে তারাও মানুষ। তারা নাহয় রটেছে অপ্রাপ্তির ইতিহাস, আমরা নাহয় রটবো প্রাপ্তিরটা।”
“আমায় পেয়ে কি আর এমন হবে বলুন? আমাকে এখন হয়তো ভালো লাগছে কিন্তু একসাথে সংসার করার পর আর নাও ভালো লাগতে পারে।”
“আপনাকে পেলে তেমন কিছুই হবে না। কেবল পাওয়া না পাওয়ার এই পৃথিবীতে, আপনাকে পেয়ে গেলে আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে।”

এমন একটা অনুভূতি মাখানো কথা শোনার পর আর কথা খুঁজে পেলো না অহি। বিরক্ত দেখাতে গিয়ে দেখলো কি আশ্চর্য! তার বিরক্ত লাগছে না। তবুও সে মিছে বিরক্তের ভাব ধরলো। নাক-মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো নিজের বিল্ডিং এ। নওশাদ পেছন থেকে চিল্লিয়ে বললো,
“আপনি বিয়ের জন্য রাজি না হলে আজই আমি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার জান দিয়ে দিবো।”
অহি গোপন হাসলে। মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,
“বৃষ্টিতে ভিজলে কেউ ম* রে না। ভিজতে থাকুন।”
“বৃষ্টিতে না ম* রলেও আপনার ঐ হাসিতে ঠিকই ম* রেছি।”
অহি আর পিছু ফিরলো না। চলে গেলো নিজের ফ্লাটে। নওশাদের কথাটা সে নেহাৎই হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো। ভাবলো নওশাদ হয়তো মজা করেই বলেছে। কিন্তু অপরদিকে নওশাদ নাছোড়বান্দা তা যে জানা নেই রমণীর।

মন খারাপের আকাশে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো অভিমানেরাও। চিত্রা বাহারের তীক্ষ্ণ কথা হজম করে চুপ করে ছিলো। কিন্তু তার চেয়েও বেশি তাকে চুপ করিয়েছে বাহারের আনা অন্য কারো জন্য নূপুর আর চিঠি। চিঠিটা পড়তে পারে নি তবে যতটুকুই দেখেছে মুগ্ধতা ভরা ছিলো। কারো জন্য খুব যত্নে লিখেছিলো চিঠিটা। বাহার চিত্রাকে ছাড়াও অন্যকারো কথা চিন্তা করছে ভাবলেই অষ্টাদশীর বক্ষ মাঝে তুমুল তোলপাড় শুরু হয়। প্রিয় মানুষের ক্ষেত্রে আমি একটু বেশিই স্বার্থপর হই। সব ভাগ করা মানুষটাও প্রিয় মানুষের ভাগ সহ্য করতে পারে না। কিন্তু বাহার ভাইকে তা জানিয়ে লাভ নাই। মানুষটা তো এমনই, অনুভূতি বুঝলেও প্রকাশ্যে তার মূল্য দেই নি কভু। অথচ সেই বাহার ভাইয়ের জন্যই অষ্টাদশীর এত হাহাকার!

ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পর ড্রয়িং রুমে ছোটোখাটো একটা আড্ডার আসর বসলো। কিন্তু চিত্রার মন বসলো না সেই আসরে। সে কাজের নাম দিয়ে উঠে চলে গেলো। তখনও প্রকৃতিতে ভরা বর্ষণ। বারান্দার ছোটো ছোটো শিকের জানালা গলিয়ে হাত ভিজাতে পারছে না বলে চিত্রার মন আরও খারাপ হলো। কেবল দেখেই যেতে হলো নিবিড়ে সেই বর্ষণ ধারা।
তন্মধ্যেই চিত্রা নিজের পেছনে কারো উপস্থিতি অনুভব করলো। মানুষটাকে দেখার আগেই মানুষটার গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ভালোবাসা যখন মানসিক শান্তি নাহয়ে মাথা ব্যাথার কারণ হয়, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় সে ভালোবাসার মানুষটি ভুল।”
চিত্রা কণ্ঠের মালিককে চিনলো কিন্তু এ মানুষ এমন কথা বলতে পারে ভেবেই তার অবাক লাগলো। অবাক কণ্ঠে বললো,

“দুলাভাই, আপনি!”
চিত্রার বিস্মিত মুখ দেখে হাসলো মাহতাব। পকেটে হাত গুঁজে হেলতে দুলতে চিত্রার সামনে এসে দাঁড়ালো। ছোটো একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“ভালোবাসার মানুষ ভুল হলে ভালোবাসা ফুল নাহয়ে কাঁটা হয়ে রবে কিন্তু শালীকা।”
চিত্রা কথা বললো না। দুলাভাই কিছু বুঝতে পারলো কিনা ভেবেই তার বুক কাঁপলো। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“কী বলছেন এসব?”
“তোমাদের বয়সই এমন যে এটা বলতে হচ্ছে। শোনো, কোনো সম্পর্ক যদি তোমায় ব্যাথা দেয়, তিল তিল করে মা* রে তবে তুমি বরং সে সম্পর্কটাই মে* রে ফেলো। মনে রেখো, ভুল কারণে নিজে মরার চেয়ে, ভুল কারণটার মৃত্যু হওয়া ভালো।”
চিত্রা কি বুঝলো কে জানে, কেবল অনবরত মাথা নাড়ালো। চিত্রাকে খুশি করতে হাস্যোজ্জ্বল মাহাতাব বলে উঠলো,
“চলে আজ রাতের রাস্তা ঘুরবো, বৃষ্টিতে ভিজে আইসক্রিম খাবো। যাবে?”
চিত্রা কতক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে গেলো। এতক্ষণের মন খারাপ টা তার হুট করেই ভালো হয়ে গেলো।

তখন প্রায় মধ্যরাত। চিত্রাদের ফ্লাটে কেবল অহি আর মুনিয়া বেগম রয়েছে। চিত্রা, চেরি, মাহতাব, তুহিন তো কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছে রাতের রাস্তা ঘুরার জন্য। বাহার ভাইও তার পরপর বেরিয়ে গিয়েছে। অহি, মুনিয়া বেগম নিজেদের মতন ঘুমিয়ে পড়লো।
রাত তিনটে, হুট করে সশব্দে বেজে উঠলো অহির ফোন। কড়া ঘুমটা হঠাৎই হালকা হয়ে এলো ফোনের শব্দে। অহি বিরক্ত হলো, চোখ-মুখ কুঁচকে ফোনটা রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে বাহার ভাইয়ের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আমায় ভালোবাসো অহি?”
অহির ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কে হুট করে এমন কথাটা কেমন ভোঁতা ভোঁতা অনুভূতির সৃষ্টি করলো। ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্ক জেগে উঠলো সেকেন্ডের মাঝেই, অহি চুপ থেকে রয়েসয়ে উত্তর দিলো,
“ভালোবাসতাম, এখন ভালোবাসা ছেড়ে দিয়েছি।”
উত্তর টা শুনে ফোনের অপর পাশের বাহার ভাই কি একটু হাসলো! হ্যাঁ হয়তো হাসলো। ক্ষীণ হেসে বললো,
“এটা তোমার জীবনের সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত। আরেকটা উত্তম সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলো তো ঝটফট।”
অহি ভ্রু কুঁচকালো, প্রশ্নাত্মক কণ্ঠে বললো,

“কী?”
“তোমাদের বাড়ির নিচে যে ছেলেটা বৃষ্টিতে ভিজেছে এই মাঝ রাত্তি অব্দি, তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফেলো। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তুমি অনবরত ছুটে চলা ঘড়ির কাটা, আমার মতন বেকার বাহারের জন্য থেমে থাকা তোমার মানায় না। আমরা তো বেকার মানুষ। আমরা হলাম অযত্নের কংক্রিট।
মানুষ ভাবে পাথর মন, দিলাম নাহয় একটু ভেঙে,
ক্রেংকিটের আড়ালেও হৃদয় নরম,মানুষ কি আর তা জানে?
একটা মৃত্যুর স্বাদ পেতে, বেকার মরে রোজ,,
তাই তো সমাজ নিয়ম করে আমাদের স্বপ্ন করছে ভোজ।
ফ্যানের সাথে কি যেন ঝু* লে, ডাকে মোরে মুক্তি হেথায়,
বাঁচবার সাধ বেকারেরও আছে, সে কথা কি সমাজে বিকায়?
যোগ্যতার সার্টিফিকেট তাচ্ছিল্যে ভাসে, অযোগ্যদের কাছে,
একটা চাকরি না পেলে, বেকারদের প্রেমও মিছে।

তোমাদের অবশ্য সে পিছুটান নেই, প্রেম মিছে হওয়ার ভয় নেই। মধ্যরাতে তোমার দোরে ভালোবাসা চাওয়া মানুষটাকে আজ নাহয় একটা কিছু বলেই দেও। মুক্তি নাহয় প্রেমের মৃ* ত্যু।”
অহি চুপ করে বাহার ভাইয়ের কথা শুনলো। অপর পাশ থেকে কল টা কাটতেই সে ওরনা টা জড়িয়ে সাবধানে ফ্লাটের দরজা আটকে নিচে নেমে গেলো। তখনও বৃষ্টি পড়ছে বিরতিহীন ভাবে।
বিল্ডিং ছেড়ে রাস্তায় নামতেই জুবুথুবু নওশাদকে চোখে পড়লো অহির। বেচারা শীতে কাঁপছে। অহি বেশ শক্তপোক্ত মুখ নিয়ে এগিয়ে গেলো নওশাদের কাছে। শক্ত কণ্ঠে বললো,
“আপনি না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে ভিজছেন? এসব করে আপনি কী বুঝাতে চাচ্ছেন?”
“আমায় বিয়ে করে নিলেই তো পারেন। বাঁচিয়ে নিন না আমায়।”
অহির মুখে তুমুল কাঠিন্যতা। কর্কশ কণ্ঠে বললো,
“আমার জন্য যে ছেলেটা মধ্যরাত অব্দি এমন পা* গলামো করতে পারে তাকে ফেরানোর সাধ্যি আমার নেই। এত রাতে কাজী অফিস খোলা থাকবে তো?”
নওশাদ ভেবেছিল এবারও বরাবরের মতন প্রত্যাখ্যান আসবে কিন্তু অহির কথায় সে হতভম্ব। নওশাদের হতভম্ব ভাব দেখে অহি ঠাট্টা করে বললো,
“বিয়ে কি করবেন না শহীদ হওয়ার ইচ্ছে এখনও আছে?”

তুমুল বর্ষণ মাথায় নিয়ে, অনাকাঙ্খিত ভাবে হয়ে গেলো নওশাদ আর অহির বিয়ে। বেশ সাদামাটা এবং অপ্রত্যাশিত ছিলো মধ্যরাতের সেই বিয়েটা। আর সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হলো, বাহার ভাই ছিল সে বিয়ের প্রধান সাক্ষী। নওশাদ যে এত দ্রুত সব ব্যবস্থা করতে পারবে তা অহির ধারণার বাহিরে ছিল কিন্তু তবুও সে নড়বড়ে অনুভূতি নিয়ে শক্ত করে সেই মানুষটার হাত ধরেছিল। যা হবে দেখা যাবে তার ভিতরে উপস্থিত। আর সবটা সম্পূর্ণ হওয়ার বড় ভূমিকা বাহার ভাইয়ের।
অহি কাজী অফিসে বাহার ভাইকে সব প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেসও করেছিল “বাহার ভাই, আপনি সিউর কীভাবে ছিলেন যে বিয়েটা আমি করতামই?”

বাহার তখন মুচকি হেসে বলেছিল,”মানুষ বরাবরই ভালোবাসার কাঙালি। যখন কেউ সেই ভালোবাসা উজাড় করে দেয় তখন খুব কম সংখ্যক মানুষই তা ফেরাতে পারে। ঘৃণা দেখেও চুপ থাকা যায় কিন্তু ভালোবাসা দেখলে তার বিপরীতে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। আর আমি তোমাকে প্রথমে কেনো জিজ্ঞেস করেছিলাম আমায় ভালোবাসো কিনা বলো তো? আমি তোমাকে কিঞ্চিৎ ভাঙার চেষ্টা করেছি যেন তুমি খুঁটি শক্ত করে ধরো। আর আমি সক্ষম।”
বাহারের কথায় চুপ রইলো অহি। ভালোবাসবে না করেও আরো একবার ভালোবাসলো বাহারকে। এ-ই শেষ। এরপর আর মানুষটাকে ভালোবাসা হবে না। আর মুগ্ধ হওয়া হবে না মানুষটার উপর। মনে একজন রেখে আরেকজনের সাথে ঘর করা যে পাপ। আর অহি সে পাপ কখনো করবে না। মনের মানুষকে নাহয় মন থেকে চিরতরে বিতারিত করবে।
এরপরেই খুব নীরব ভাবে হয়ে গেলো একপাক্ষিক ভালোবাসার বিচ্ছেদ, এবং আরেকটা একপাক্ষিক ভালোবাসার সন্ধি। প্রকৃতির নিয়মই এটা, কোথাও ভাঙবে সে আবার কোথাও জোড়া লাগবে।

সওদাগর বাড়িতে মুখ থমথমে ভাব। সেই বাড়ির সকল সদস্য চিত্রা, তুহিনও সহ আজ সে বাড়িতে এসেছে। নওশাদের বাবা-মাও এসেছে। বাড়ির সবচেয়ে ঠান্ডা মেয়ে এমন একটা কাজ করতে পারে তা যেন কারো বিশ্বাস হচ্ছে না। সবাই কেবল বিস্মিত নয়নে তাদের দেখে যাচ্ছে ঘন্টাখানেক যাবত।
প্রথম কথাটা আফজাল সওদাগরই বললেন। গম্ভীর কণ্ঠে সে অহির দিকে তাকিয়ে শুধালেন,
“তোমার যদি নওশাদকে এতই পছন্দ হয়েছে, আমাদের বললেই তো পারতে। আমরা তোমার পছন্দ কখনো অপূর্ণ রাখি নি।”
বড়চাচাকে বাড়ির বাচ্চারা বরাবরই বেশ পছন্দ করে। তাই এ মানুষটার কথার বিপরীতে অহি কোমল হয়েই বললো,
“আমার পছন্দের সব তোমরা পূরণ করেছো তা আমিও মানি। তাই বলে আমার ভালোবাসার সব পূরণ করবে তা তো না। সেই সংশয় থেকেই এমন কাজ করা।”
অহির উত্তরে আফজাল সওদাগর তপ্ত শ্বাস ফেললেন। কিন্তু পরের কথাটা উচ্চারণ করলেন অবনী বেগম। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললেন,

“তোমার ভালোবাসাও আমরা অপূর্ণ রাখতাম না।”
“ও তাই নাকি? সাইকোলজি পড়তে চেয়েছিলাম যেটা আমার ভালোবাসা ছিলো, তোমরা ভর্তি করিয়ে ছিলে বাংলায়। ছয়-সাত বছরের আমি আবদার করে ছিলাম তোমাদের সাথে থাকার, ঠাঁই হয়েছিল আমার হোস্টেলে। এভাবেই পূরণ করতে তাই না?”
মেয়ের তাচ্ছিল্য মাখা কণ্ঠে মাথা নত হয়ে আসে অবনী বেগমের। মেয়েকে সে যখন হোস্টেলে দেয় তখনও তার কাছে জীবনের মানে ভিন্ন ছিল। আজকের অবনীর আর তখনের অবনীর পার্থক্য অনেক। কিন্তু মানুষ তা আর জানলো কই?

“অহি, তোমার মায়ের সাথে এভাবে কথা বলছো কেন?”
নুরুল সওদাগরের গম্ভীর কণ্ঠে অহির তাচ্ছিল্য ভাব আর বিস্তৃতি লাভ করলো। খুব করে মানুষটাকেও দুটো কথা শুনাতে ইচ্ছে হলো কিন্তু সে শুনালো না। যতই হোক, নওশাদ এবং তার বাবা-মা সওদাগর বাড়ির মেহমান। তাদের সামনে এমন আচরণ শোভনীয় না।
নওশাদের বাবা-মা এতক্ষণ চুপই ছিলো। সওদাগর বাড়ির কথা কাটাকাটি থামার অপেক্ষায় ছিলেন হয়তো তারা। তাই তো সওদাগর বাড়ির মানুষদের কথা থামতেই মুখ খুললেন নওশাদের মা নওরিন। তুমুল আশ্চর্যের সাথে সে প্রশ্ন করলেন,
“নওশাদ, তুমি হুট করে এমন সিদ্ধান্ত কেনো নিলে?”
“হুট করে তো নেই নি, মা। তোমাদের তো জানিয়ে ছিলাম কিন্তু তোমরাই আমাকে কোনো পজিটিভ উত্তর দিতে পারো নি। তাই বাধ্য হলাম।”

“কেবল একবার জানিয়ে ছিলে। মানুষ দিনের পর দিন অপেক্ষা করে বাবা-মাকে মানায়। অধচ ইতিহাসে তুমিই একমাত্র ছেলে যে একবার মাত্র কথা কাটাকাটি করে বিয়ে করে ফেলছো। কী অদ্ভুত!”
“বিয়েই তো করবো মা, কোনো অপরাধ তো না। তো এত মানামানির কথা আসছে কোথা থেকে? আমি কিংবা অহি, দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক। তাই তোমাদের এমন অদ্ভুত আচরণ শোভা পাচ্ছে না।”
“দেখলে দেখলে, তোমার ছেলের কথা শুনলে? মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
নওরিন খাতুনের স্বামীর প্রতি অভিযোগ। ইলিয়াস খান মিনমিনে কণ্ঠে বললো,
“যা হয়েছে তা কি বদলাতে পারবে? এরচেয়ে মেনেই নেও।”
স্বামীর জবাবে হতাশ নওরিন। তিনি ভেবেছেন তার স্বামী হয়তো তার পক্ষ থেকে একটু হলেও কিছু বলবে। তা আর হলো কই! হতাশার শ্বাস ফেলে তিনি বললেন,

“এমন হুটহাট বিয়ে আমি মেনে নিতে পারছি না।”
“এখন করণীয়! আলাদা থাকবো?”
ছেলের ঝটপট উত্তরে ব্যাথিত দৃষ্টি নিয়ে তাকান নওরিন খাতুন। দশমাস দশদিন যে ছেলেকে গর্ভে ধারণ করলো, ছেলে ভূমিষ্ট হওয়ার পর এত গুলো বছর যে মা বুকে আগলে রাখলো, একটা মেয়ের জন্য সে মায়ের মুখের উপর এমন প্রশ্ন হয়তো একটা সন্তানই করতে পারে। কি আর করার? যুগ বদলের খেলায় এসব হয়তো স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে কিছুটা রাগ এই মেয়েটার উপরও বর্তাচ্ছে। কিছুটা সময় মৌণ থেকে নওরিন খাতুন তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন,

“আমার কখনোই পছন্দ ছিলো না অহি। কিন্তু আমার ছেলের আবার ওকেই পছন্দ। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমার পছন্দ অপছন্দে কিছু আটকাবে না। আমি না চাইলেও আমার ছেলে ওর সাথে সংসার করবে আমি জানি। আমার ছেলের হয়তো মায়ের প্রয়োজন নেই অথচ আমার কিন্তু ছেলের প্রয়োজন আছে। একান্তই আমার সেই স্বার্থে আমি বিয়েটা মেনে নিচ্ছি। তবে আমাদের বা আপনাদের পরিবারের একটা মান সম্মান আছে। সেই মান সম্মানের ভিত্তিতে আমি চাচ্ছি বিয়েটা আবার বড় করে দিতে।”

মায়ের কথায় নওশাদের মুখটা ছোটো হয়ে এলো। মা যে তার কষ্ট পেয়েছে তাও বুঝতে পারলো সে কিন্তু এমন জেদ না দেখালে হয়তো পরিস্থিতি ঘুরে যেতো। তাই এমন কঠিন হওয়া।
নওরিন খাতুনের স্পষ্ট কথার ধাঁচ অহির বেশ ভালো লাগলো। মানুষটা হয়তো উপর উপর শক্ত কিন্তু ভেতর ভেতর খুব কোমল। নওরিন খাতুনের প্রস্তাবে রাজি হলেন আফজাল সওদাগর। মহিলজ যে বেশ বুদ্ধিমতী তা আর বুঝতে বাকি রইলো না কারো।
বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো পঁচিশ দিন পরে। অহির মায়ের মতামতও নেওয়া হলো। বাড়িতে পরে গেলো আনন্দের ঢেউ। সব কিছুতে নিরেপক্ষ ভূমিকা পালন করলো রোজা সওদাগর এবং চাঁদনী। না আনন্দ হলেন না অন্য কিছু। ড্রয়িং রুমে উপস্থিত থাকার কড়া নির্দেশ দেওয়ায় তারা কেবল তা পালন করলো। এছাড়া কিছুই না। চিত্রা আর চেরি তো আনন্দে আত্মহারা কিন্তু চিত্রা চাইলেও সে আনন্দ দেখাতে পারছে না। এ বাড়িটা যে তাকে পর করেছে। পরের বাড়িতে শোক মানায় আনন্দ না।

অনেকদিন পর নিজের বাড়িতে পা রেখে সংশয়ে কাঁপছে চিত্রা। যে বাড়িতে একসময় বিনা বাঁধায় ছুটে বেড়িয়েছে, সে বাড়ির দেয়াল ছুঁতেও যেন আজ করছে ভয়। কেমন পর পর লাগছে সবটা!
বাড়ির সকলে যখন মিষ্টি ভাগাভাগি করতে ব্যস্ত চিত্রা এক ফাঁকে চলে গেলো চাঁদনী আপার কাছে। ছোটো থেকে এ অব্দি আপা তাকে কম আদর করে নি। আজ যদি আপা মুখ ফিরিয়ে থাকে তবে চিত্রার দায়িত্ব আপার কাছে ক্ষমা চাওয়া। যেমন ভাবনা তেমন কাজ।
চাঁদনী নিজের ঘরের কিছু জামাকাপড় গুছচ্ছিল। তন্মধ্যেই ঘরে দরজায় টোকার শব্দ, ক্ষীণ শব্দে চিত্রা বললো,
“আসবো?”
চাঁদনী একবার পলক ঝাপটিয়ে চিত্রার দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মনযোগ দিয়ে বললো,

“আয়।”
চিত্রা আসলো। ছোটো ছোটো পা ফেলে ঘরে থাকা চেয়ারটাতে বসলো। বুকে তখন তার তুমুল ঝড়। এত কাছের বড় আপার সাথে কথা বলতেই হাত-পা তার কাঁপছে। তবুও সে বললো,
“কেমন আছে, আপা?”
“যেমন চেয়েছিলি।”
বড় আপার কাঠ কাঠ উত্তরে মনে মনে হোঁচট খেলো চিত্রা। কণ্ঠধ্বনি বার বার জড়িয়ে এলো তবুও সে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আমি তো ভালোই চেয়েছিলাম আপা।”
“তাহলে আর কি, ভালোই আছি।”
চিত্রা আর কথা আগানোর শক্তি পেলো না। কত কথা সাজিয়ে এসেছিলো কিন্তু এখন সব অগোছালো হয়ে গেছে। ঘরে দু’জন মানবী চুপ হয়ে রইলো। কত কথা বলতে চেয়েও বলা হলো না। শেষমেশ চিত্রা মনের লুকিয়ে রাখা প্রশ্নটা করেই বসলো,

“আপা, দুলাভাইয়ের সাথে তোমার সব ঠিক আছে তো?”
চাঁদনীর হাত থেমে গেলো সাথে সাথে। কিন্তু উত্তরটা সাথে সাথে এলো না। এলো দুই তিন মিনিট পর। হৃদয় ছাড় খার করা উত্তর সেটা। চাঁদনী আপা অসহায় কণ্ঠে বললো,
“আমার মায়ের রাগ আমার উপর না মিটালেও পারতি।”
“আমি তোমায় ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে চাই নি বড়আপা।”
চিত্রার মাথা নত হয়ে এলো। বড় আপা তাচ্ছিল্য করে বললো,

“এত জোরে ধাক্কা কী মানুষ অনিচ্ছাকৃত দেয়? আমার তো জানা ছিলো না।”
বড় আপার কথায় চিত্রার চক্ষুদ্বয় বড় বড় হয়ে গেলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আমি তো ধাক্কা দেই নি তোমায়, কেবল হাত ঝারা দিয়ে ছিলাম।”
“থাক সেসব কথা। আমি তবুও দোয়া করি, তুই যেন তোর স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকিস।”
বড় আপার দোয়ার আড়ালে কী গোপন অভিশাপের ছোঁয়া ছিলো! চিত্রার মনে কেমন খচখচ করলো বড় আপার কথা। সে তো আপাকে ধাক্কা দেয় নি, তাহলে!
তন্মধ্যেই নিচ থেকে হৈচৈ ভেসে এলো। নুরুল সওদাগরের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে তুমুল ভাবে। চিত্রা এবং চাঁদনী অপেক্ষা না করেই ছুট লাগালো।

চিত্ত চিরে চৈত্রমাস পর্ব ২৪

বাহার ভাইয়ের ঘর ফাঁকা। তার অবহেলার বিছানা শূণ্য। পড়ার টেবিলে যত্নের বই গুলোও নেই। বাহার ভাইয়ের অস্তিত্ব চিলেকোঠার ঘরের কোথাও নেই। মূলত নুরুল সওদাগরের চেঁচামেচির কারণ এটা।
চিত্রা কেবল ফ্যালফ্যাল করে শূণ্য ঘরটায় তাকিয়ে রইলো। শূণ্য ঘরটার রঙ মেটে হওয়া দেয়ালে বড় বড় করে লিখা,
“স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার যার প্রতি অনীহা, মানুষ কীভাবে তাকে করবে দয়া!”
অবশেষে, অবশেষে বাহার ভাই নামক মানুষটা মায়া লাগিয়ে চলে গেলো! অবশেষে বাহার ভাই মানুষটা সত্যিই কঠিন হলো। অষ্টাদশী মানতে পারবে এই অনাকাঙ্খিত বিচ্ছেদ?

চিত্ত চিরে চৈত্রমাস পর্ব ২৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here