চিত্রাঙ্গনা পর্ব ১৪
ইশরাত জাহান জেরিন
বৃষ্টির পানি আজ রক্তা*ক্ত। আকাশ নিজেই আজ শোকগ্রস্ত হয়ে ঝরছে। বিদীর্ণ ধরনীর বুকে লালচে জল জমে আছে। রাস্তায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু চিত্রা কিছুই টের পাচ্ছে না। তার শরীর নিথর, চোখের পাতা ভারী। র*ক্তের স্রোতে সবকিছুই যেন ধোঁয়াশা।গুলিটা তাকে ছুঁতে গিয়েও ছুঁতে পারেনি। বরং তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট ছেলেটার মাথা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। মস্তিষ্কের ছিটকে পড়া টুকরোগুলো চিত্রার শরীরে এখনো লেগে আছে। ভয় আর ধাক্কায় তার হাত থেকে ফুচকার প্লেট পড়ে গেছে কাঁদাজলে। হৃদপিণ্ডের গতি অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সমস্ত শরীর নিস্তেজ মাটিতে লুটিয়ে পড়তে নেয় চিত্রা। তবে ফারাজ পড়ার আগেই তাকে সামলে দেয়।
কয়েকটা মুহুর্তে কি থেকে কি হয়ে গেল? ফারাজের চোখে মুখে আতঙ্ক তবে র*ক্ত কিংবা গুলির শব্দে নয় বরং চিত্রার নেতিয়ে পড়া দেখে। কেমন যেন একটা অনুভব হচ্ছে তার। ওইযে গলায় মাছের কাটা বিঁধলে কিংবা শরীরের প্রতিটি অংশ ফালি ফালি করলে যেমন যন্ত্রণা হয় ঠিক তার চেয়েও বেশি । এক লহমার জন্য ফারাজ নিজেও থমকে যায়। একবার তাকায় বাচ্চা ছেলেটার লুটিয়ে পড়া র*ক্তাক্ত দেহের দিকে অন্যবার তার বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকা নিষ্পাপ প্রিয়তমার দিকে। গুলির শব্দে অভ্র দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে আসে। চারপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তবুও মানুষ অবিরাম ছুটছে। মানুষের তো বাঁচতে হলে ছুটতেই হবে। কিশোরগঞ্জে ইদানীং ছিনতাইকারী, সন্ত্রাস, ডাকাতি ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে। এর মূল কারণ কি এখানকার কাউন্সিলর জাতীয়তাবাদী বলে? ইশরে সামান্য ক্ষমতা পেতেই পালোয়ান সাহেবরা অরাজকতা শুরু করেছে? যদিও তাদের দিয়ে এসবই আশা করা যায়। দলের দোষ দিয়ে লাভ নেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফারাজ ভিজছে। চিত্রাকে সঙ্গে নিয়েই ভিজছে। রাগে তার কপালের শিরা অব্দি নীল হয়ে এসেছে।চোখে জমেছে দপদপে আগুন। অভ্র ছুটে আসে। সঙ্গে ফারাজের বাকি লোকজনও। সবাই তাকে ঘিরে রাখে, যে-কোনো মুহূর্তে আবারও গুলি চালাতে পারে সন্ত্রাসীরা।
“ভাই, জলদি উঠেন!ভাবীরে নিয়ে গাড়িতে যান ভাই! এখানকার পরিস্থিতি ভালো না। কালকে জেল থেকে সাবেক বিএনপি নেতা নাশিদ পালোয়ান পালিয়েছে। দেশের অবস্থা খুব খারাপ। ভাই, দেরি করবেন না!”
ফারাজ দাঁতে দাঁত চেপে একটা ঢোক গিলল। চোখের শিরাগুলো রক্তিম হয়ে উঠেছে। এক মুহূর্ত চুপ থেকে সে চিত্রাকে শক্ত করে কোলে তুলে নিলো।
“চিত্রাকে নিয়ে তুই হাসপাতালে যা।”
অভ্র দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল, “ভাই!”
“আমি যা বলছি, তাই কর।”
“কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আপনি কোথায় যাবেন? কাকে ধরবেন? আগে ভাবীকে সুস্থ হতে দিন, ভাই!”
“মেজাজ গরম করাস না।”ফারাজ অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,”আমি জানি এসব কার কাজ। খুব ভালো করেই জানি। তুই চিত্রাকে নিয়ে হাসপাতালে যা। চিত্রা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার আগেই আমি আমার কাজ সারবো। আমার কলিজার ওপর হাত দেওয়া? শালাদের কলিজা ছিঁড়ে এনে যদি কুত্তাকে না খাওয়াই তাহলে আমার আব্বা দুইটা।”
অভ্র একটা শুষ্ক ঢোক গিলে। এসব ঝামেলায় না গেলে কি হয় না? যেই কাজের জন্য দেশে আসা সেইটা শেষ করে চলে গেলেই তো হয়?শুধু শুধু শত্রু বাড়ানোর কি দরকার? ফারাজ অভ্রকে পাশ কাটিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তার লোকগুলো মাথার ওপর ছাতা ধরতে গেলে, ফারাজ হুংকার ছাড়ে,
” আরে বা*ল ছাতা সরাবি? নাকি ছাতা তোদের পেছ….ছাতা সরাহ।”
লোকগুলোর সাহস হয় না আর এগোনোর। ফারাজ চিত্রাকে গাড়িতে শুইয়ে দেয়। কালো বোরকা পড়া মেয়েটার মুখে এখনো নিকাব। ফারাজ হাত বাড়িয়ে নিকাব সরিয়ে দিয়ে অভ্রকে নির্দেশ দেয়,
“ফারিয়াকে একটা কল করে হাসপাতালে আসতে বল। আর শুন এসব খবর যেন বাড়ির কেউ এখনি না জানতে পারে।”
ফারাজ আরেকবার চিত্রার দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“ও আমার আমানত। আমি ফেরার আগ অব্দি ওকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তোর। যদি কোনো ভুল হয় রে তাহলে রাম দা দিয়ে তোর কল্লা কেটে স্পেশাল মুড়িঘন্ট বানাবো।”
অভ্র জবাব দেয় না। গাড়ি ছেড়ে দেয়। তবে যাওয়ার আগে মেয়েলী গলার একটা কান্নার শব্দ তার কানে ভেসে আসে। ওই বাচ্চাটার মা এসেছে বুঝি? লা*শের সামনে পড়ে হাহাকার করছে? সাহায্যের জন্য আকুতি করছে? আচ্ছা সন্তান হারানোর বেদনা সত্যিই খুব পিঁড়া দেয়?
চারটে লাশ পরপর সাজানো। নিথর, বিকৃত, নিঃশেষ। চারজনই সোহানের লোক। সোহান ধীরে ধীরে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আর গভীর দৃষ্টিতে লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। খু*নের ধরন দেখে বোঝাই যাচ্ছে, একেবারে পেশাদার কাজ। ছেলেগুলো একটা মাদ্রাসা ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধ*র্ষণ করেছিল। তারপর ভোরে হ*ত্যা করে জঙ্গলে লা*শ ফেলে দিয়ে যায়। কিন্তু আফসোস তাদের কর্কম গুলো মানুষের চক্ষুনজরে পড়ে যায়। বলদগুলো একটা কাজও যদি ঠিক করতে পারত! প্রতিটি লাশের হাতের আঙুল কাটা, নখ তোলা, কান ছেঁড়া। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার, ওদের “মূল্যবান” জিনিসটাও কেটে ফেলা হয়েছে। সোহান ধীরে ধীরে লুঙ্গির ভাঁজ ঠিক করল। মুখে তেতো হাসি ফুটল।
“চ্যাহ! শালাগুলারে একেবারে হিজড়া বানাইয়া উপরে পাঠাইলো! কামডা কি ভালা হইলো?”
সিফাত পাশেই দাঁড়িয়ে, চুপচাপ। তার মুখ গম্ভীর। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ভাই, সবাই জেনে গেছে যে ওরা আমাগো দলের লোক ছিল। তার ওপর ধ*র্ষণ আর খু*নের ব্যাপারটা হাইপ্রোফাইল। কেমনে হ্যান্ডেল করুম?”
সোহান গোঁফে আঙুল বুলিয়ে এক পা তুলে বসল। তার কালো চামড়ায় ঘামের চিকচিকে আভা। চোখে অদ্ভুত এক ঝলক। সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশে ভারী মেঘ। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু পেছন থেকে নদীর ঢেউয়ের শব্দ আসছে।
“জনগণ নাকি গণধোলাই দিছে?”
সিফাত মাথা নাড়ল, “হ ভাই, মেয়েগুলাও মারছে। জুতার বারি দিছে।”
“তাইলে হাতের আঙুল আর কান আর ওইডা কাটল কে? তাও আবার এমন কইরা?”সোহান লা*শগুলোর দিকে তাকিয়ে একবার ঠোঁট ভেজাল। এইভাবে শাস্তি দেওয়ার মতো ক্ষমতা ওই মাদ্রাসার মেয়েগুলোর কিংবা জনগনের থাকার কথা না। কারন সবাই জানে এরা কার লোক। কেউ রাগ-ক্ষোভ মিটাইছে নিশ্চিত। কিন্তু কে?”
সোহানের কালো চামড়া চকচক করছে। সে গোঁফে হাত বুলিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে আরো কিছুক্ষণ লা*শ চারটের দিকে তাকিয়ে রইল। সন্ধ্যা কেবল এখন। আকাশে বৃষ্টি নেই তবে মেঘ জমে আছে। সকলের মতে এই চারজনকে জনগণ ধরে গনধোলাই দিয়েছে। মাদ্রাসার মেয়েগুলোও সেখানেই ছিল। জুতার বারি দিয়েছে। তবে সোহানের কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না। মারধোরের ধরন দেখে মনে হয়েছে কেউ রাগ-ক্ষোভ মিটিয়েছে। কিন্তু কে?
“এখন লা*শগুলা তো উদ্ধার করতে পারছি তবে এগুলারে কি করমু?পুলিশ তো লা*শ খোঁজা শুরু কইরা দিছে।” সিফাত বলল।
” ট্রলারে মানুষ আছে না?”
“জে।”সিফাত কাঁধ ঝাঁকালো।
“চুরি-চাপাতি দিয়া পোলাপান গুলারে কাজে লাগাইয়া দে। লা*শগুলারে টুকরা টুকরা কইরা নদীর মাছগুলারে পেটভইরা খাওয়ানের ব্যবস্থা কর। লাশ হচ্ছে গিয়া প্রমান। লা*শ থাকলে প্রমান থাকবো,প্রমান থাকলে পুলিশ ঘাটাঘাটি করবো। গু যত লাড়বি তত গন্ধ ছুটবো। যা এখন। যেইতা কইছি ওইটা কর।”
সিফাত মাথা ঝাঁকালো। “বুঝছি ভাই।” একটু থেমে আবার বলল,
“ভাই, আরেকটা কথা। কাল রাতে যে চালান যাওয়ার কথা ছিল?ওইখানে ঝামেলা বাঁধছে। মাল দুইদিন পর তেনারা নিবো।”
সোহান ধীরস্থিরভাবে সিগারেট জ্বালাল। ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
“আচ্ছা সমস্যা নাই। টাকা পাইছি এখন মাল নেক বা না নেক আমার তাতে যায় আসে না। তো মাইয়াগুলার যত্ন নিতাছোত তো?”
“হ।”
“সাবধান থাকবি। মাইয়া মানুষ হইলো ঝামেলা। তার ওপর এতগুলা মাইয়া মানুষ। ওগো হদিস যেন ভুলেও কেউ না পায়।”
সিফাত মৃদু করে হু বলে থামল। একটু ইতস্তত করল। তারপর বলল,
“ভাই!”
“কইয়া লা।”
“কাল রাতে যে নতুন মাইয়াটারে আনছি, ওইটা কিন্তু এক্কেরে হিরা! চাইলে তৈয়ার কইরা রাতে আপনার কাছে পাঠাইতে পারি। আপনে তো ইদানীং অনেক চিন্তায় থাকেন।”
সোহান নদীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সিফাতের দিকে তাকাল।
“নাম কী ছ্যামড়ির?”
সিফাত একটু ভেবে বলল,
“নিলু… নিলুফা ওর নাম।”
চারপাশে মৃদু হলুদ আলো ছড়িয়ে আছে। বাতাসে শুকিয়ে যাওয়া র*ক্তের গন্ধ। মাটিতে পড়ে আছে একটা পুরুষ। চোখ বাঁধা। শরীরের বিভিন্ন অংশ নিখুঁতভাবে ছেঁটে নেওয়া হয়েছে। পুরোই দক্ষ কসাইয়ের কাজ লাগছে। তার চারপাশে আরও পাঁচটি নিথর দেহ পড়ে আছে।সামনের কাঠের চেয়ারে বসে থাকা ফারাজ পিস্তলট হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। তার চোখেমুখে অদ্ভুত দীপ্তি। মনে হচ্ছে মৃ*ত্যু তার জন্য নতুন কিছু নয় বরং একপ্রকার শিল্প। চারপাশে কালো পোশাকে ঢাকা কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের উপস্থিতি বাতাসের মতোই স্বাভাবিক তবে ভয়ানক। ফারাজ ধীরগতিতে উঠে দাঁড়াল। একঝলক চারপাশে তাকিয়ে ইশারা করতেই একজন এগিয়ে এসে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার চোখ থেকে কালো কাপড়টা সরিয়ে দিল। লোকটা এক পলক তাকাল ফারাজের দিকে। ভেতরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে। গলাটা ঢিলে হয়ে এসেছে। শরীর আরও বেশি কুঁকড়ে গেছে। ফারাজ হাঁটু গেড়ে বসে তার থুতনিতে ঠান্ডা ধাতব পিস্তলটা ঠেকাল। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বিদ্রূপাত্মক হাসি টেনে বলল,
“ট্রিগারটা তুমিই চালিয়েছ, তাই না জান্টুস?”
লোকটা থরথর করে কাঁপছে। ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু শব্দ বের হচ্ছে না। ভূমিকম্প হলে যেভাবে মাটি কাঁপে, ঠিক সেভাবেই কাঁপছে তার শরীর।
“ক… কথা বলো না কেন জন্টুমন্টু? তোমার সঙ্গে কি আমি এখানে বাসর সারতে এসেছি?তো লজ্জায় তোমার জবান অব্দি বাদরের পশ্চাৎদেশের মতো লাল হয়েছে কেন? মুখ থেকে স্বরবর্ণ- ব্যঞ্জনবর্ণ কিচ্ছু বের হচ্ছে না?বাট হুয়াই কাল্লু?”
“ভা..ভাই, কাউরে মারার উদ্দেশ্য আমার ছিল না…”
“তো? মাঝ রাস্তায় শাড়ি-চুড়ি পড়ে নার্গিস আপার গানে ডিসকো ডান্স দিয়ে জনগণের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল?”
লোকটা মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ভ…ভাই, ক্ষমা কইরা দেন। আর কোনোদিন ছিনতাই করমু না!”
“তোর নাম কি রে জলহস্তী?
লোকটা ঢোক গিলে বলল, হা..হারুন।”
ফারাজ লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখেমুখে প্রচণ্ড বিরক্তি। “আমি চিন্তা করি, তোদের এত সাহস দিলটা কে শা*লা?? দিনদুপুরে মেইনরোডে পিস্তল উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ানো? পাবলিকের গায়ে হাত তোলা? গুলি ছোড়া, ছিনতাই করা?বাহ বাহ তালিয়া।
ছিনতাইকারীর মুখ শুকিয়ে গেছে। চোখদুটো পানিতে ভেসে যাচ্ছে। গলার শব্দ কেঁপে উঠছে কান্নায়। পুরুষ মানুষ শব্দ করে কাঁদছে। লজ্জার বিষয় না? ফারাজের কাছে এসব ছিনতাইকারীরা কখনোই “পুরুষ সমাজের” অংশ ছিল না। ভীরু কাপুরুষদের দেখলেই তার গায়ে জ্বালা ধরে যায়। এমন লোকেরা শুধুই ভয় পায়, কিন্তু সেই ভয় তাদের বদলায় না।
“ভাই, ছাইড়া দেন!” লোকটি আবারও আকুতি জানায়, কণ্ঠে ভয় আর অনুনয়ের স্পষ্ট ছাপ।
“দয়া দেখাতে বলছো শালা? তুমি বোধ হয় জানো না দয়া নামক ছোটলোকি শব্দ ফারাজ তার অভিধান থেকে মায়ের গর্ভে থাকতেই কিক মেরে বের করে দিয়েছে।” ফারাজ থামল।
“এমন কইরেন না ভাই। আমার বাসায় বউ বাচ্চা আছে। আমি ছাড়া তাগোর কেউ নাই।”
বিরক্তিতে মুখ বাঁকায় ফারাজ, “ছ্যাহ! তুমি তো একেবারে বাচাল সোনা।তোতাপাখির মতো পটপট করা তোমার মতো কালো চামড়ার গরিলার মুখে একদম মানায় না।”
লোকটি চুপ করে যায়। ফারাজের চোখে কেমন এক যেন একটা অদ্ভুত উপহাস খেলা করছে।হয়ত তার সামনে বসে থাকা ব্যক্তিটি মানুষ নয়, এক ক্ষুদ্র, তুচ্ছ কিছু। ফারাজ উঠে দাঁড়ায়। প্যাকেট থেকে একটা ধারালো ছুড়ি বের করে লোকটার আঙ্গুলের দিকে তাকায়। এই আঙুল দিয়েই তো ট্রিগার প্লেস করেছিল। তাই না? দু’জন কালো পোশাকধারী ব্যক্তি হারুনকে শক্ত করে তুলে বসায়। চেপে ধরে তাকে। হাতের আঙুলগুলো শক্ত করে টেনে ধরে যেন নড়তে না পারে। তবে নড়ার ক্ষমতাই বা কোথায়? তার শরীরের প্রতিটি জয়েন্ট ইতোমধ্যেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সে এখন এখন কেবল নিস্তব্ধ, যন্ত্রণার ভারে অবশ তার দেহ। ফারাজ ঝু্ঁকল। কোনো সতর্কতা ছাড়াই এক ঝটকায় ছুরিটা চালিয়ে দিল। ছ্যাঁৎ! ডান হাতের তর্জনী মুহূর্তেই শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
গভীর কাটা অংশ থেকে গরম রক্ত গড়িয়ে পড়ে।গটগট শব্দে মেঝেতে ছড়িয়ে যায়। ভোঁতা, কর্কশ এক আর্তনাদ ঘরজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়। তারপর মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা। কিন্তু নিস্তব্ধতা স্থায়ী হয় না। পরপর কয়েকটি আর্তনাদ বদ্ধ কক্ষের লোমহর্ষক পরিস্থিতির জানান দেয়। প্রতিটি চিৎকার ক্রমে ম্লান হয়ে আসে। ব্যথার চূড়ান্ত পর্যায়ে অনুভূতিগুলো নিস্তেজ হয়ে আসছে। ফারাজের সামনে পড়ে আছে দশটি বিচ্ছিন্ন আঙুল। মেঝেতে জমে থাকা র*ক্তের কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারপাশ।ফারাজের শরীরের শার্ট টাও র*ক্তে ভিজে একাকার। মুখে র*ক্ত ছিটকে কি ভয়ানক দেখাচ্ছো তাকে। আগের থেকে বিরক্তভাব কিছুটা কমেছে,ফুটে উঠেছে এক শীতল, বিকৃত আনন্দ। হারুনের শরীর ধীরে ধীরে মাটিতে ঢলে পড়ে। তার গা থেকে শার্টটা কে যেন ছিঁড়ে খুলে ফেলে দিয়েছে, রক্তে ভেজা শরীর উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে হলুদাভ আলোর নিচে। ফারাজ এবার হাতের মুঠোয় তুলে নেয় বড় রামদাটা। চকচকে ফলাটা আলোয় ঝলসে ওঠে।
“কেন জানি আমার কলিজার প্রতি আলাদা একটা দূর্বলতা কাজ করে। তবে আজকে কেবল কলিজা না হৃদপিন্ডের প্রতিও কাজ করছে। দেখি মেপে তোর কলিজা আর হৃদপিন্ডের সাইজ কতখানি? শত হলেও তুই বড় সন্ত্রাসবাদী বলে কথা!”
ফারাজের কণ্ঠস্বর নিস্তরঙ্গ। কোনো উন্মত্ততা নেই। হারুনের গলায় পা রেখে জোরে চেপে ধরে ফারাজ। নরম কলাপসিবল হাড়গুলো চূর্ণ হওয়ার শব্দ হয়। তারপর বুকের ওপর কয়েকটা প্রচণ্ড লাথি বসিয়ে দেয়। হারুনের নিভু নিভু প্রাণ। চোখে-মুখে মৃ*ত্যুর ছায়া স্পষ্ট। শরীরে শক্তি পর্যন্ত নেই আর। এক মুহূর্ত দেরি না করেই ফারাজ হঠাৎ রামদাটা চালিয়ে দেয় হারুনের বুকে। শ্রাক! চামড়া বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসে লাল রঙের কাঁচা মাংস। হৃদপিণ্ডের কাছে পৌঁছনোর আগেই হারুনের ফুসফুস থেকে ফেটে বেরিয়ে আসে এক বিভৎস চিৎকার। পুরো ঘর কাঁপিয়ে দেওয়া একটা চাপা আর্তনাদ। কিন্তু ফারাজ থামে না। সে রামদাটা টেনে নামিয়ে আনে বুকের মাঝখান বরাবর। হাড়ের গুঁড়িয়ে যাওয়ার খটখটে শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়। তারপর তাজা উষ্ণ কলিজাটা তুলে আনে ফারাজ। র*ক্তে ভেজা কাঁপতে থাকা একটা অঙ্গ। যা এখনো জীবনের শেষ ছন্দ বাজিয়ে চলেছে। ফারাজের চোখে পৈশাচিক আনন্দ। হাতে ধরা র*ক্তমাখা কলিজার দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠল,
“হাহ! এত ছোট কলিজা নিয়ে সন্ত্রাসবাদী হতে এসেছিলি?”
জলজ্যান্ত মানুষটার বুক চিরে কলিজা বের করে আনার পরও ফারাজের মনে একচুল প্রশান্তিও আসছে না। এত সহজে হওয়া মৃ*ত্যুটা তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সে আরও কিছু চাইছিল… আরও অনেক কিছু। ফারাজকে আজ কোনো অংশে নরপিশাচের থেকে কম লাগছে না। তার র*ক্তমাখা হাত থেকে লাফাচ্ছে টাটকা কলিজাটা। আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ লালচে র*ক্তের ধারা। তবুও সে নির্বিকার। ফারাজ কলিজাটাকে নিস্পৃহ হাতে ছুড়ে ফেলে দেয় হারুনের রক্তাক্ত বুকের ওপর। তারপর আবারও রামদার ফলাটা চালিয়ে দেয় বুকের খাঁচায়। দু’হাতে মাংসের গহ্বর ফাঁক করে টেনে বের করে আনে হৃদপিণ্ডটা। ধুকপুক… ধুকপুক… হৃদপিণ্ডটা তখনো জীবিত। তাজা, গরম, লাল র*ক্তে থপথপ করছে। ফারাজ হৃদপিণ্ডটা হাতের তালুতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। কী অদ্ভুত প্রাণের স্পন্দন! এত ছোট, অথচ এত ক্ষমতাধর একটা বস্তু। যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে আবার সে বিনা মানুষের মৃ*ত্যু অনিবার্য। ফারাজ আবারও হাসল।
হঠাৎ হৃদপিণ্ডটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছেলেগুলোর দিকে তাকায় ফারাজ। কণ্ঠস্বর আগের মতোই শীতল। তবে তাতে চাপা নিষ্ঠুরতা মিশে আছে।যা ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে।
“হৃদপিণ্ডটা ভালো থাকলে ডোনেট করে দিবি। আর শরীরের বাকি অংশগুলা যেগুলো ঠিক আছে, সেগুলোও কাজে লাগাবি।” কিছুক্ষণ থেমে চোখ সরু করে পুনরায় বলল,
“আর এই জা*নোয়ারের দেহ এক হাজার একশ এক টুকরো করে রাস্তার অনাহারী কুকুরগুলারে খাইয়ে আসবি। যেন তার পাপের শেষ কণাটুকুও পচে-গলে কুকুরের পেটে মিশে যায়।”
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ১৩
ঘরজুড়ে তখন র*ক্তের ভারী গন্ধ। হারুনের নিথর শরীর মেঝেতে পড়ে আছে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে। চারপাশের দেয়ালে ছিটকে থাকা র*ক্তের ছোপগুলো ফারাজের নীরব উন্মত্ততার সাক্ষ্য বহন করছে। সে বুলিয়ে কপালের সামনে চলে আসা র*ক্তমাখা চুলগুলো ঠিক করে নেয়। মুখের ওপর ছিটকে পড়া র*ক্তের ডলাটুকু থুতু দিয়ে গিলে নেয় অনায়াসে। তার চোখে এখন আর কোনো বিরক্তি নেই। নেই কোনো ক্রোধ… আছে কেবল এক ধোঁয়াশাচ্ছন্ন বিকৃত প্রশান্তি। ঘরটা এখন শীতল হয়ে গেছে। পুরোই নিঃশব্দ। এতক্ষণ পর্যন্ত যে মৃ*ত্যু ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল কক্ষের কোণায় কোণায়, সে এখন ফারাজের মুখের সেই বাঁকা হাসির মধ্যে স্থায়ী বাসা বেঁধেছে। ফারাজ আরো একবার কলিজাটার দিকে তাকায়। ফিসফিস করে বলে, “কলিজাটা আজ আমি নিজ হাতে রান্না করব… তারপর… তারপর স্বাদ গ্রহণের পালা।”