চিত্রাঙ্গনা পর্ব ১৪ (৩)
ইশরাত জাহান জেরিন
“ভাবী গন আপনারা আমার বউকে খেলায় নিচ্ছেন না কেনো? থাক বউ আমরা দুজন একা খেলবো। আই মিন লুডু।”
চিত্রা বিরক্ত ভঙ্গিতে মুখ বাঁকালো। বড়দের সামনে কি করে কথা বলতে হয় জানা নেই। বিদেশে থেকে একেবারে লাগামহীন হয়ে গেছে। নিরু একপাশ থেকে ফারাজের দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ করল,
“শার্টটা তোমায় খুব নামিয়েছে ফারাজ ভাই।”
“প্রথমে ভাই তারপর চেটে-পুটে খাই? মেয়ে জাতিকে দিয়ে ভরসা নাই রে নিরু। এদের নজর বহুত খারাপ। তুই কিন্তু নজর ঠিক রাখিস। আমার আবার কাজিন রিলেটেডে পোষায় না। থ্রিলার পছন্দ, ওটা ছাড়া জমে না।”
নিরু বিরক্ত হয়ে মুখ ভেংচি কাটল। ফারাজ তা দেখে আবার যোগ করল,
“মুখটা বাঁকা হয়ে গেলে বিয়ে শাদি কেমন করে দিব? প্রতিবন্ধ বিয়ে দিতে গেলে তো অর্ধেক সম্পত্তি আবার জামাইয়ের নামে সদকা দিতে হয়।”
নিরু রাগ করে উঠে গেল। ফাঁকা স্থানে ফারাজ চিত্রাকে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার ফিরতে দেরি হবে। আড়তে যাচ্ছি। তুমি প্রিয়তমা আজকের রাতটা হ্যান্ডেল করো কোনোমতে। জানি আমাকে ছাড়া তোমার ঘুম আসবে না।”
চিত্রা সাদা রঙের একটা কামিজ পরহিত। বাড়ির অন্যসব বউরা শাড়ি পড়া কেমন যেন তার অস্বস্তি লাগছে। ফারাজ বিষয়টা লক্ষ করল। চিত্রাকে নিজের কাছে টেনে এনে হিসহিসিয়ে বলল,
“অস্বস্তির কিছু নেই প্রিয়তমা। তোমাকে সব কিছুতেই মানায়। ভাবছি তোমার কামিজ পড়ার বিধি চালু করব। শাড়ি পড়বে শুধু রাতে। একান্ত আমার জন্য।”
ফারাজ পোশাক বদলায় না। যেভাবে ছিল সেভাবেই বেড়িয়ে পড়ে। বাহিরে অভ্র তার জন্য অপেক্ষা করছে। তবে যাওয়ার আগে চিত্রাকে সে বলে যায়,
“বউ সাবধানে চাল দিও। মোহনা ভাবী কিন্তু একনাম্বারের খাইষ্টা। খালি বাটপারি করে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিলুফাকে দেখার জন্য কেমন যেন মনটা ব্যাকুল হচ্ছে সোহানের। যেইভাবে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ব্যাকুলতা কাজ করাটা কি স্বাভাবিক নয়?সিফাতকে সঙ্গে নিয়ে সোহান পালোয়ান ট্রলারের বন্দীশালায় গেল। একবার গিয়ে সব মেয়েদেরই এক নজরে দেখে নিলো সে। এই মেয়েগুলো মিয়ানমারে যাবে, যেখানে তাদের নানা কাজে লাগানো হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন কাজে, যা কোনোভাবেই সম্মানজনক নয়। সোহানের কাছে এসব কেবলই সমাজের বোঝা। তার নিজের একটা দর্শন আছে। সে মনে করে, এই মেয়েরা এমনিতেই বেঁচে থাকার মতো কোনো কারণ খুঁজে পায় না। এদের জন্য লড়াই করার কেউ নেই, সমাজেও এদের মূল্য নেই। তাই তাদের সরিয়ে ফেলা কিংবা অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া, এ যেন তার এক ধরনের সমাজ পরিশোধনের কাজ। আর তাই সে সবসময় নিম্নবর্গের মানুষদের নিশানা করে। সিফাত ইতোমধ্যে নিলুফার কাছে একটা ছেলেকে পাঠিয়েছে। তাকে তৈরি করার জন্য। অনেকক্ষণ কেটে গেছে, কিন্তু ছেলেটার কোনো খোঁজ নেই। অস্থির হয়ে উঠল সিফাত। বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে কল করার ঠিক আগেই দেখা গেল, ছেলেটা দৌড়ে তাদের দিকে ছুটে আসছে। ছেলেটার শ্বাস অস্থির, কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। ভয় আর দুশ্চিন্তায় থতমত খাওয়া কণ্ঠে বলল,
“মাইয়াটা ট্রলারে নাই। পালাইছে! মাইয়াটা পালাইছে!”
রাতের বৃষ্টি এখনো থেমে থেমে পড়ছে। বাতাস কেমন যেন স্থবির। এখানকার সবই ঠিক আছে তবে সমস্যা একটাই বাতাস বইতে দেরি তবে বিদ্যুৎ যেতে এক মুহুর্তও সময় লাগে না। চিত্রার ঘুম ভাঙতেই পাশ ফিরে ফারাজকে দেখল। উদাম শরীরে উপুড় হয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন। কোলবালিশটা যদি মানুষ হতো, তাহলে এতক্ষণে দম আটকে প্রাণ হারাতো। চিত্রা ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। ফরজের নামাজ পড়ে বারান্দায় গিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতেই চোখ পড়ল পুকুরের দিকে। বৃষ্টির পানিতে থইথই করছে চারপাশ। গাছপালার পাতায় পানি জমে টুপটাপ পড়ে যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য পুকুরের জলে কী যেন একটা নড়ল। চিত্রার ভ্রু কুঁচকে গেল। তার দৃষ্টি আরও মনোযোগী হলো। পানির ওপর কিছু একটা ভেসে আছে। একটা নয়, দুটো। তার নিশ্বাস ভারী হয়ে এল। সে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। মানুষ! হ্যাঁ, ওগুলো মানুষেরই শরীর! চিত্রার বুক কেঁপে উঠল। ধড়ফড়িয়ে ঘরের ভেতরে ফিরে এল সে।
“ফারাজ!” চিত্রার কণ্ঠে আতঙ্ক জড়ানো। ফারাজ কেবলই গভীর ঘুম থেকে জেগেছে। ভাঙা চোখে চিত্রার দিকে তাকাল।
“ফারাজ, নিচে… পুকুরে লাশ!” কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে থাকল ফারাজ। সে চিত্রার কথার অর্থ বুঝতে পারছে না। চিত্রার চোখ ছলছল করছে। ভয় আর হতবাক ভাব মিলেমিশে গেছে তার চেহারায়। ফারাজ নিঃশব্দে উঠে বসল। এক নিমেষেই ঘুম উড়ে গেছে তার। ভারী চোখে একবার চিত্রার কাঁপতে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে সে ধীর পায়ে বারান্দায় গেল। পুকুরের দিকে তাকিয়ে দেখল, সত্যিই দুটো নিথর শরীর ভেসে আছে পানিতে। তবে ফারাজের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। চিত্রা কাঁদতে কাঁদতে কিছু একটা বলছে। কিন্তু ফারাজ তা শুনছে না। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করল। নিঃশব্দে ধরিয়ে এক টান দিল। তারপর গায়ে একটা টি-শার্ট চাপিয়ে মোবাইল বের করল পকেট থেকে। কাকে যেন একটা কল দিল।
“নিচে নামছি।” শুধু এটুকুই বলল সে। তারপর কোনো শব্দ না করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করল। চিত্রা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার পেছন পেছন ছুটে গেল। অনুমতির অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।
পুলিশ এসেছে তদন্ত করতে। তবে কেইস সাংঘাতিক। মানুষ দু’টোকে নৃশংস ভাবে মা*রা হয়েছে। চোখ দুটো কোঠর থেকে তুলে আনা হয়েছে। ধারালো কিছু একটা দিয়ে যৌ*নাঙ্গ উপড়ে ফেলা হয়েছে। আর দু’জনেরই ঠোঁট দু’টো সেলাই করা। মনে হচ্ছে কেউ নিখুঁত ভাবে কাঁথায় সেলাই টেনেছে। লা*শের গলায় ফুলের কাটা।গোলাপ ফুলের কাটা। তবে শরীরে কারফেন্টানিল ড্রাগজ পুশ করা হয়েছে। মৃ*ত্যু খুব জলদি হওয়ার জন্য। ফুলের মধ্যেই এই বি*ষ দেওয়া হয়েছিল। যার গন্ধ শুঁকতে গিয়েই ম*রণ চলে এসেছে। বাড়ির মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল অথচ কেউ কিছু টের অব্দি পায় নি। খু*নি নিশ্চয়ই রাতের বৃষ্টিময় অন্ধকারকে কাজে লাগিয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে চিৎকারের শব্দ কারো কানে আসার কথা না। আর সবচেয়ে বড় কথা পুরোনো পুকুর পাড়ের দিকে কেউ যায় না। খু*নী সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছে। তবে অবাক করার বিষয় খুনীর সাহস কতখানি হলে এলাহীর বাড়িতে খু*ন করে লা*শ এলাহীদের পুকুরেই ভাসিয়ে দিতে পারে? তবে খু*নী আর যে কেউ হোক না কেন বাহিরের লোক না।
চিত্রা ফারাজের আড়ালে দাঁড়িয়ে লাশ দেখার সাহস দেখাতে চাইলেও। ফারাজ এক ঝটকায় তাকে টেনে বাড়ির ভেতর নিয়ে এল। রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বলল,
“এসব কাছ থেকে দেখার দরকার নেই তোমার। হুঁশ হারালে আবার হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হবে।”
কিন্তু চিত্রার ভেতরে আতঙ্ক চেপে বসেছে। কাল বাগানে যে কর্মী তাকে উত্তপ্ত করেছিল। আজ সে-ই লাশ হয়ে ভেসে উঠল! তার গলা শুকিয়ে এল। ধীরে ধীরে ফারাজের দিকে তাকাল। ফারাজ কিছু করেনি তো? গত রাতে ফারাজ কখন বাড়ি ফিরেছিল? সে জানে না। হাতে ব্যথা নিয়ে ঘুমাতে গিয়ে কখন গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গিয়েছিল বুঝতেই পারেনি। চিত্রা আরও একবার ফারাজের দিকে তাকাল। অদ্ভুত, অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে। ফারাজ তখনও কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ গ্লাসে মদ ঢেলে গিলছে, যেন সবকিছু স্বাভাবিক। চিত্রা ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। ফারাজের সামনে বসে সরাসরি চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
“খুনের পেছনে আপনার হাত আছে নাকি?”
দোতলা বাড়ি। চারপাশ ঘন গাছপালায় ঘেরা। নাম পালোয়ান মঞ্জিল। এই বাড়ির দুই উত্তরাধিকারী। সোহান পালোয়ান ও তার ছোটভাই সুমন পালোয়ান। সুমনের সংসার আছে, স্ত্রী মাহবুবা ও দুই সন্তান নিয়ে সে ব্যস্ত। কিন্তু একত্রিশ পেরোলেও সোহান এখনও বিয়ে করেনি। সে মায়ের প্রতি অসম্ভব ভক্ত। মায়ের সুখের জন্য সে সব করতে পারে, এমনকি পাপেও জড়াতে দ্বিধা করে না। তবে তার মায়ের কাছে তার অন্ধকার দিক সবসময়ই অজানা। জানলে মা কষ্ট পাবেন, আর সেই কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ানোর সাহস সোহানের নেই। আজ সকাল থেকেই তার মাথা ব্যথা করছে। গত রাত থেকে যা কিছুতেই কমছে না। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা নিলুর নিখোঁজ হওয়া । অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার বাড়িতেও খোঁজ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সে সেখানে যায়নি। নিলু তার দলের অনেক সদস্যের চেহারা দেখে ফেলেছে। যদি কোনো ঝামেলা বাঁধিয়ে বসে? মেয়েদের মন বোঝা কঠিন, তারা একটা ভাবে, আরেকটা করে। নিলুকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। ঝামেলা হওয়ার আগেই। আর ওপর দিয়ে হারুনকে সহ আরো কিছু লোককেও নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুনেছে তাদের মধ্যকার হারুনের ভুলবশত ট্রিগার চালানোর ফলে একটা বাচ্চা মারা গিয়েছে। সেটা নিয়েই ঝামেলা চলছে। এখন সেই ভয়েই কি সবাই একসঙ্গে উধাও হলো নাকি?
সুমনের স্ত্রী মাহবুবা গরম গরম কলিজা ভুনা আর গরুর তেলে ভাজা মোটা পরোটা সাজিয়ে রেখেছে টেবিলে। সোহানের মা অসুস্থ, তাই তার খাবার রুমেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেখভালের জন্য এক মহিলা আছেন। তিনিই মাকে খাইয়ে দেবেন। সোহান হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে বসতেই চোখ পড়ল কলিজা ভুনার দিকে। একটা অদ্ভুত মাতাল করা গন্ধ ভেসে আসছে। যেন খাবারের মধ্যে কিছু মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে পরোটা ছিঁড়ে কলিজা ভুনায় ডুবিয়ে মুখে পুরে দিল। স্বাদে তার চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর মাহবুবা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে সোহান আঙুল চেটেপুটে খাচ্ছে। এতটাই সুস্বাদু হয়েছে? সোহান থালায় তাকিয়ে দেখল। খাবার প্রায় শেষ। সে বিস্মিত গলায় বলল,
“মাহবুবা, আজকে তোমার রান্নার হাত এত ভালো হলো কেমনে? আর কলিজা ভুনা নাই?”
মাহবুবা অবাক হয়ে বলল,
“যতটুকু ছিল, ততটুকুই তো গরম করে দিলাম।”
সোহান ভ্রুকুটি করল।
“ছিল বলতে?”
মাহবুবা জবাব দিল,“কেন? রাইতে না আপনে একটা টিফিনবাক্স পাঠাইলেন?”
সোহানের মুখ কঠিন হয়ে গেল।
“আমি?”
“হ, একটা লোক আইছিল। বাক্স দিয়া কইল আপনে পাঠাইছেন। রাইতে তো আপনি আসেন নাই, তাই সকালে গরম কইরা দিলাম। ভালো কথা, টিফিনবাক্স যেই ব্যাগে দিয়া দেওয়া হইছিল, সেইখানে একটা কাগজও ছিল। আমি খুইল্লা দেখি নাই।”
সোহানের শরীরটা কেমন জানি শিউরে উঠল। কপালের ব্যথাটা হঠাৎ যেন বেড়ে গেল। সে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। মাহবুবা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল ব্যাগটা আনার জন্য। মাহবুবা ব্যাগটা এনে কাগজটা বের করে সোহানের দিকে বাড়িয়ে দিল। সোহান কাগজটা খুলে চোখ বুলাতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কাগজে ছোট্ট করে লেখা,
“হারুনের কলিজা ভুনাটা কেমন হয়েছে? খুব যত্ন করে রান্না করেছি। সাবধান করছি আমাকে ঘাঁটতে আসিস না। নিজেই ঘেঁটে যাবি। নিজের লোকেদেরকে সর্তক করবি। আরেকবার ভুল হলে বিরাট মাশুল গুনতে হবে কিন্তু। এবার শুধু ডেমো দেখালাম পরের পার তোর কলিজাটা ছিঁড়ে ভুনা করব।”
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ১৪ (২)
সোহানের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। গা গুলিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি বেসিনের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল। থুতু ফেলল। মানুষের কলিজা… এতক্ষণ ধরে উপভোগ করছিল সে? এত স্বাদ করে খাচ্ছিল?চিন্তাটা মস্তিষ্কে ধাক্কা দিতেই আরও একবার অস্বস্তিতে কুঁকড়ে ওঠল সে। গলার গভীরে একটা বমি বমি ভাব জমাট বাঁধে। হাতের আঙুলগুলো অবশ হয়ে আসছে। কোন হারামির কাজ এসব? কে হারুনকে মেরেছে?