চিত্রাঙ্গনা পর্ব ২৯
ইশরাত জাহান জেরিন
জমেলা ঝড়ের বেগে ফারাজের দিকে ধেয়ে আসে।বিক্ষিপ্ত আবেগে দুহাত প্রসারিত করে। ফারাজ মুহূর্তের ভেতর চিত্রার আড়ালে গিয়ে বলে ওঠল,
“এই মাতারি দূরে থাক। কাছে আসবি না। বউ বিনা কেউ কাছ এলে পেছন চুলকায়।”
চিত্রা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে একপাশে সরে দাঁড়ালো। কটাক্ষভরা কণ্ঠে বলল,
” আরো দরজা খুলে রোমান্স করুন। খুশী হয়েছি। এই যে মিস এই ধরুন আপনার হেন্ডুকে। হেন্ডুর কারেন্ট বেশি। একটু কমিয়ে দেন তো।”
ফারাজের কণ্ঠ শুকিয়ে আসে। সে সংযম ধরে রেখে চিত্রাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“শয়তানন্নি তুই আমার বউ নাকি দুশমন? স্বামীর যৌবন বুড়ির হাতে তুলে দেস। শরমভরম তো বাথরুমের পানির সঙ্গে গুলিয়ে খাইছিস খাটাশ ছ্যামড়ি।”
চিত্রার মুখ ভেংচি কাটে। সামনের থেকে সরে গিয়ে জমেলার জন্য পথ ছেড়ে দেয়। জায়গা পেয়ে বৃদ্ধা উচ্ছ্বসিতভাবে ফারাজের দিকে দৌড়ে আসে। অথচ পরমুহূর্তেই ফারাজের বজ্রকঠিন স্বরের ধমকে থমকে যায় সে।
“মাতারি তোর নাম জমেলা না রেখে ঝামেলা রাখা দরকার ছিল। দূরে থাক বুড়ি। আমার কারেন্ট লাড়া দিতে এলে একেবারে লড়ে যাবি বলে দিলাম। কথাখানা মাথা হোক আর যেখানেই হোক ঢুকিয়ে রাখ।”
“নায়াাাাাা কারেন্ট বেপ্পি এভাবে নো বলিং। ইউ আমার বালফেরেন্ড। মাই ফ্রেমিক। ইউ দূরে গুয়িং হলে মই তো ডাই হয়ে যামু। আর হুয়াই ইউ কল মি বুড়ি? আই এম ফাইভ বছরের বুটুফুল গাল। ইউর ফ্রেমিকা।”
ফারাজ ফুঁসতে থাকে। মুখের রেখায় স্পষ্ট বিরক্তি ফুটে ওঠে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
“ইশরে বুড়ির মারাত্মক কিরমি উঠেছে দেখি! আমারে বুড়ি কুদ্দুসের বাপ পাও নি। তোমার সঙ্গে দাঁড়ানো জোয়ানটাই তো লোড নিতে পারে না। ঘন্টা না যেতেই জ্বর চলে আসে আর তুমি কোন ছাগলের চকলেট ফ্লেবার?”
“ইউ যেই চুকুলেট ফেলেবার পুছুন্দ করো। মুই ওইডা।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জমেলা এবার ফারাজের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ফারাজ সজোরে এক ধাপ পেছনে সরে পুনরায় বলল,
“ধরার কাজ তো আমার। তুমি কেন ধরছো পাঁচ বছরের বিউটিফুল বুড়ি?”
ফারাজ এই বলে এক ঝটকায় নিজের শার্ট খুলে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে।
“অনেক বেশি দেখার কিরমি উঠছে তাই না? নে দেখ। কত দেখতে পারোস মাতারি দেখ। এই চিত্রাঙ্গনা তুমি রুম থেকে বের হও। আউট। বুড়ির কিরমি কতখানি তা আজকে দেখেই ছাড়বো।”
“ফারাজ…বেশি হয়ে যাচ্ছে না। কথায় কথায় জামাকাপড় খুলতে হবে কেন? না দেখালে ভালো লাগে না?”
ফারাজ ঘাড় কাত করে চিত্রার দিকে তাকিয়ে সজোরে একটা ধমক দিয়ে বলল, জাস্ট আউট।”
চিত্রা ধমকে কিছু আসে যায় না। সে গম্ভীর শ্বাস ফেলে। মুখে কুঞ্চিত ভ্রুর ছায়া। মনে ঘূর্ণিঝড়। আয় আল্লাহ! এই লোকের একটুও লজ্জা নেই? জমেলা দাদির যে মানসিক সমস্যা আছে, তা জানা সত্ত্বেও কি এমন নাটকীয়তা জরুরি ছিল? ফারাজ এবার নিজেই জমেলার দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু হঠাৎই বৃদ্ধা থমকে দাঁড়ায়, কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,
“আল্লাহ গো আমি এইখানে কেমনে আইলাম?”
ফারাজ ভ্রু উঁচিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,”কেন জানো না? তুমি তো নিজেই আমার কাছে কিরমি দূর করার জন্য নাচতে নাচতে চলে এসেছো ঝামেলা না মানে জমেলা চোনাপাখি।”
জমেলা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চিত্রা দ্রুত বিষয়টি সামাল দেওয়ার জন্য বলল,
“কিছু না দাদু। আপনি নিচে যান। আয়েশা আপনাকে খুঁজছে।”
জমেলা আর কিছু না বলে ধীর পায়ে দরজার দিকে এগোয়। দরজা বন্ধ হতেই ফারাজ বিদ্যুতবেগে ছিটকিনি এঁটে দেয়। তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে চিত্রার দিকে এগিয়ে আসে। তার চোখে শীতলতা।
“তোমাকে আউট বলেছিলাম শুনতে পাও নি?”
“আউটের বাংলা জানি না তাই দাঁড়িয়ে ছিলাম।” চিত্রা মুখ বাঁকিয়ে বলল।
“ওহ আচ্ছা?”
“জ্বী।”
“কাম।”
“এই বেডা কাছে ডাকো কেন? ইংরেজি শিখাবা নাকি? আমি ইংরেজি জানি। লাভ ইউ,হেইট ইউ, ফা*ক ইউ।”
ফারাজ বড় বড় চোখ করে চিত্রার দিকে তাকায়। তওবা করে করে বলে,
“আসতাগফিরুল্লাহ। এই জমজমের পানিটা কই রে? শালার আগুন সুন্দরীর আগুন বেড়ে গেছে দেখি। পানি ছিটিয়ে আগুন বন্ধ করতে হবে।”
তৃতীয় তলায় অবস্থিত অতিথিশালা। সচরাচর সেখানে পদচারণা ঘটে না। কেবল অতিথি এলে সাময়িক আনাগোনা হয়। এতদিন অভ্র নিচতলার কক্ষে অবস্থান করেছিল। যদিও সে কক্ষটি তার পছন্দসই ছিল না। অবশেষে, ফারাজকে অনুরোধ করে সে অতিথিশালার একটি কক্ষ উন্মুক্ত করিয়েছে। তদুপরি সে আর একাকী নেই। নতুন অতিথিরও আবির্ভাব ঘটেছে। যার জন্য পৃথক একটি কক্ষ বরাদ্দ করা হয়েছে। ফারাজ নিজ দায়িত্বে কক্ষসমূহ সুসজ্জিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে আয়েশা আর মিতালিকে পাঠিয়েছে তৃতীয় তলায়। কক্ষ দুটো পরিপাটি করার নির্দেশ দিয়েছে। অভ্র স্নান শেষে কক্ষে প্রবেশ করতেই নজর কারল আয়েশার ওপর। সে নিপুণ হাতে বিছানার চাদর টান টান করছে। প্রতিটি ভাঁজ নিখুঁতভাবে মেলাচ্ছে। নীরবে অবলোকন করল দৃশ্যটি। অভ্র এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল৷ তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে তা কাঁধে ঝুলালো। তারপর বলল,
“একটা ময়লাও যেন না পাই গুওয়ালী ।”
“দেখুন আমার সুন্দর একটা নাম আছে।”
“তাতে আমার কি? জলদি কাজ শেষ করো গুআফা।”
“ওমা! আপনি এত সুন্দর করে কথাও বলতে জানেন?”
“সুন্দর করে আরো অনেক কিছু করতে পারি। করবো?”
অভ্র ধীর পদক্ষেপে আয়েশার দিকে অগ্রসর হলে সে চমকে ওঠে। পলকেই তার সমস্ত অস্তিত্ব সংকুচিত হয়ে আসে। অনিশ্চয়তা ও শঙ্কার আবরণে আবৃত হয় চেতনা। অভ্রের নৈকট্য অনুভব করতেই সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চোখ মুদে নেয়। কিন্তু মুহূর্ত কয়েক অতিবাহিত হওয়ার পরও নিরবচ্ছিন্ন নিরবতা বিরাজমান। কোনো অপ্রত্যাশিত স্পর্শ অনুভূত হয় না। শ্বাসরুদ্ধ সময়ের অবসান ঘটিয়ে আয়েশা দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে চোখ মেলে তাকায়। অভ্র টি-শার্ট পড়ে বোতাম লাগাচ্ছে। কলার ঠিক করে চুলে হাত বুলিয়ে ঝাড়ু হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আয়েশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“শালার মেয়ে মানুষ যে কি পরিমান আবেগি। এই বোন তোদের এত আবেগ আসে কই থেকে? তুই কি ভাবছিস গুওয়ালী? আমি তোর দিকে এগিয়ে যাবো? তুই চোখ বন্ধ করবি তারপর আমি তোকে চুমু খাবো? আর তুই পরে চুমুকে ধ*র্ষন বানিয়ে আমাকে জোর করে বিয়ে করবি? মেয়ে তোর মাথায় গু ভরপুর। গুয়ের ব্যবসাটা কবে শুরু করবি?”
আয়েশা রাগে ঠোঁট উল্টায়। মন চাইছে নিজের মাথায় একটা বারি মেরে বাঙ্গির ঝোল বের করতে। আসলেই তো সে কেনো চোখ বন্ধ করেছিল? ছি লজ্জার বিষয়। কিন্তু নিজের সম্মান ধরে রাখতে হবে। এই যে জীবনে এত পকেটমেরেও তো কখনো সম্মান হারা হয় নি সে। আর শেষে কিনা এই মুখলেসের কাছে হার মানবে? উঁহু। আয়েশা গর্জে উঠে,
“শালা তুই কর ওই ভুংচুং ব্যবসা। রকবাজ কোথাকার।”
“গু ব্যবসায়ী কোথাকার।”
“তুই একটা শালা।”
“আর তুমি আমার শালী
তোমায় চড়াইতে মন চায় খালী।”
আয়েশা ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু বলতে উদ্যত হয়। কিন্তু তার উচ্চারণ পথ খুঁজে পাওয়ার আগেই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় বারান্দার দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক দীর্ঘকায় পুরুষ। প্রসারিত আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। পশ্চাৎদৃষ্ট থেকে মুখাবয়ব স্পষ্ট নয়। তবে সুঠাম দেহসৌষ্ঠব এবং দৃঢ় ভঙ্গি তার অস্তিত্বে অনন্য আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। অন্ধকার ছায়ায় ঢেকে থাকা শারীরিক কাঠামো দেখেই অনুমান করা যায় এই আগন্তুক সাধারণ কেউ নয়। কিন্তু কে এই ব্যক্তি? নতুন অতিথি?
কাজ সমাপ্তির পর আয়েশা কক্ষ ত্যাগ করতে নিলে অভ্র হঠাৎ পেছন থেকে তাকে ডাকে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আয়েশার চোখ পড়ে কক্ষের এক কোণে রাখা বাস্কেটের দিকে। সেখানে দুই জোড়া পোশাক অবিন্যস্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ছাই রঙের শার্টটি চিনতে আয়েশার বিলম্ব হয় না। অল্পক্ষণ আগেও সেটি অভ্রর দেহে শোভা পাচ্ছিল। কিন্তু কালো শার্টটি? সেটা কার? অভ্র কোনো ব্যাখ্যায় না গিয়েই নির্দেশ দেয়,
“কাপড়গুলো ধুয়ে দিস। আর গিয়ে খাবার সাজা, খুব ক্ষুধা পেয়েছে। ভাই আর ভাবি খেয়েছে?”
“রুমে খাবে।”
“ঠিক আছে, এখন যা।”
কোনো প্রশ্ন না করে আয়েশা নির্ধারিত কর্তব্যপথে এগোয়। তবে অন্তরের এক কোণে জমে থাকা কৌতূহল এত সহজে মিলিয়ে যায় না। নতুন মুখটি কে? উত্তর জানার তীব্র বাসনা একরাশ ধোঁয়ার মতো তার চিন্তাপথে ছড়ায়। অদেখার রহস্যের আবরণ আরও ঘন হয়ে আসে।
ঘড়ির কাটায় চারটা বাজে। ফারাজের উন্মুক্ত বক্ষের ওপর শায়িত চিত্রার আঙুল গুলো ক্লান্ত মিহি ভাবে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। একসময় যে স্পর্শে বিতৃষ্ণা জাগ্রত হতো। যে উপস্থিতি দহন তুলত অন্তরের অন্তঃস্থলে। আজ তার প্রতি নেই কোনো বিদ্বেষ। এখন আর কোনো তিক্ততা দংশন করে না চিত্তকে। বরং হৃদয়ের এক অনির্বচনীয় আকাঙ্ক্ষা জাগে এই পুরুষকে একান্ত করে পাওয়ার, ভালোবাসার সর্বান্তঃকরণে আত্মসমর্পণের। ভালোবাসা! এই বিস্মৃত শব্দ, অপাঙ্ক্তেয় অনুভূতি যার প্রতি চিত্রার কিছুদিন আগেও অনীহা, ঘৃণার পাহাড় জমেছিল আজ তা চিত্রার শিরায় শিরায় শিহরণ তুলছে। ফারাজের লোমশ বক্ষপট আজ তার কাছে অনন্ত আস্থার এক তপ্ত ভূমি। যেখানে তার অনির্ধারিত যন্ত্রণাগুলো গলিত হয়ে প্রবাহিত হতে চায়।
“আমাকে আপনি জাদু করেছেন এলাহী?”
“তোমাকে পাওয়ার লড়াইয়ে এই বান্দা খু*ন করতেও প্রস্তুত। তবুও যদি জাদুর মতো নিম্ন কৌশলে তোমাকে পাওয়া যায় তবে ওসবেও আমার আপত্তি নেই।”
“আমার জন্য ফারাজ এলাহী ছোটোলোকি কাজ করবে?”
“উঁহু। তোমার স্বামী করবে। তোমার অর্ধাঙ্গ করবে। ফারাজ এলাহী কেনো করবে?”
“তাহলে আপনি আমার কে হোন?”
“স্বামী।”
“আর ফারাজ এলাহী কে?”
“”অন্ধকার পৃথিবীর কলুষিত পুরুষ।”
চিত্রা স্থির হয়ে রইল। ফারাজকে সে বুঝতে চেয়েও ব্যর্থ। কী সেই অন্ধকার যার ভার সে নিজেই বহন করছে? কেনই বা নিজেকে কলুষিত বলে অভিহিত করছে? তার গড়ে তোলা অন্ধকার জগতের গল্পই বা কী? চিত্রা ফারাজের বুকে চাপা দেওয়া দেহ সরিয়ে নিতে উদ্যত হলে ফারাজ আরও দৃঢ়ভাবে তাকে কাছে টেনে নেয়।
“যেও না বিবিজান। বুকের বা পাশ খালি খালি লাগে।”
চিত্রা নিজেকে গুটিয়ে আরও গভীরভাবে লেপ্টে গেল ফারাজের প্রশস্ত বুকের উষ্ণতায়। কেন এত শান্তি লাগছে? ঈশ্বরের বিধান বড়ই রহস্যময়। অতীতে হয়তো হারাতে হয়েছিল অনেক কিছু শুধুমাত্র এ প্রাপ্তির জন্যই। যদি সোহাগের অভ্যুদয় না ঘটত তবে কি ফারাজের কাছে আসা সম্ভব হতো?
“তৃষ্ণা পেয়েছে। গলাটা কেমন জানি শুকিয়ে আসছে। ” নিচু স্বরে বলল ফারাজ।
চিত্রা চমকে উঠে দ্রুত ফারাজের বুক থেকে সরে বসল। ল্যাম্পের ম্লান আলোয় তার সুডৌল মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ছাড়ুন। পানি দিচ্ছি।”
“তৃষ্ণা মোর প্রিয়তমার আঁখি। আর তুমি কিনা জল দিয়ে নিবারন করবে বলছো?”
“ছাড়ুন তো।”
চিত্রা ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। টেবিলের ওপর রাখা পানির জগের দিকে চোখ গেল। জগটা খালি। কেবল তলানিতে কিছুটা জমে রয়েছে। সে ওড়নাটা ঠিক করে নিল। ফারাজ ধীরে উঠে বসল দৃষ্টি নিবদ্ধ করল চিত্রার দিকে। ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করল,
“কোথায় যাচ্ছো?”
“পানি নেই। রান্নাঘরে যাওয়াটা দরকার।”
“আমিও আসি? একা ভয় করবে না?”
“উঁহু এত সহজে ভয় পাওয়ার মতো মেয়ে আমি নই। আমি মিসেস ফারাজ এলাহী। বুঝতে পেরেছেন জনাব?”
“ ভয় পেয়েছি ম্যাডাম।”
চিত্রা মুচকি হেসে উঠে গেল। ফারাজ তার পানে খানিকক্ষণ চেয়ে বলল,
“সাবধানে যেও।”
“ইশরে মনে হয় একেবারে ছেড়ে চলে যাচ্ছি?”
“যাচ্ছোই তো।”
সমগ্র এলাহী বাড়ি গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। অচিরেই ফজরের আজান ধ্বনিত হবে। সূর্য উঁকি দেবে নতুন দিনের দিগন্তে। অথচ চিত্রার চোখে ঘুম নেই। প্রহরের পর প্রহর ফারাজের বক্ষে আশ্রয় নেওয়ার এ এক অদ্ভুত তৃপ্তি। যদি এভাবেই সমগ্র জীবন গলে গলে ঝরে যায় তবে আর কীই-বা চাওয়ার থাকতে পারে?
রান্নাঘরে যেতে যেতেই অনেকটা সময় পার করে ফেলে চিত্রা। এক হাতে তার পানির বোতল। অন্য হাতে এক বাটি পায়েস। নদী ভাবী আজই বানিয়েছেন। ফারাজের খুব পছন্দ মিষ্টিজাতীয় খাবার। যেকোনো মিষ্টি পেলেই সে এক নিমেষে খেয়ে ফেলে। কিন্তু ঝালের ব্যাপারে তার ধাত একেবারেই আলাদা। সামান্য ঝালও সে সহ্য করতে পারে না। এমনকি বাড়ির তরকারিতেও তার জন্য আলাদা করে ঝাল কমিয়ে দিতে হয়। চিত্রা এ নিয়ে বেশ হাসাহাসি করে। কে বোঝাবে ফারাজকে বাঙালির জীবন ঝাল ছাড়া ভাবাই যায় না! ফারাজের এই স্বাদবিভ্রাট চিত্রার কাছে বিস্ময় ঠেকে। চিত্রা নিজেই তো ভাতের সঙ্গে অনায়াসে তিন-চারটে কাঁচা মরিচ চিবিয়ে খেতে পারে! ফারাজ প্রথমদিকে তার এমন খাওয়া দেখে বিস্মিত হয়েছিল। এখনো মাঝে মাঝে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সিঁড়ির দু’ধাপ পার হতেই হঠাৎ ওপর থেকে একটা শব্দ এলো। কাঁচ ভাঙার শব্দ! কাঁচ ভাঙলে যেমন ঝনঝনে আওয়াজ হয় ঠিক তেমন। চিত্রার ভ্রু কুঁচকে আসে। কী পড়ল? কোথাও কিছু ভেঙে গেল নাকি? কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার বুকের ভেতর অজানা আশঙ্কায় ধক করে উঠল। আর দেরি না করে সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। এত বড় বাড়ির এতগুলো সিঁড়ি! ধ্যাত, বড়লোকদের জীবনও কেমন ঝামেলার! হাঁপাতে হাঁপাতে দরজার সামনে এসে চিত্রা থমকে দাঁড়াল। দরজাটা খোলা! চিত্রা নিশ্চিত যাওয়ার সময় সে দরজা লাগিয়েছিল। তাহলে খুলল কে? ফারাজ? সে ধীরে ধীরে পা টিপে ভেতরে ঢুকল। মেঝের দিকে চোখ যেতেই তার নিঃশ্বাস আটকে গেল। টেবিলের ওপর রাখা কাঁচের ফুলদানিটা পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে! চারদিকে কাচের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বারান্দার দরজাটাও খোলা। ঠান্ডা বাতাস ভেতরে ঢুকছে। জানালার পর্দা দুলছে। চিত্রা মৃদু কাঁপা গলায় ফারাজকে ডাকল, “ফারাজ?” কিন্তু কোনো সাড়া এল না।
ফ্লোরজুড়ে লাল ছোপ। তাজা র*ক্তের দীর্ঘ দাগ।র*ক্তাক্ত বস্তু টেনে নিয়ে গেলে যেমন হয়, ঠিক তেমনই ছাপ। চিত্রার চোখ সেই দাগ বেয়ে বারান্দার দিকে যায়। দৃষ্টি বারান্দায় আটকে যায় চিত্রার। বুকের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে দ্রুত ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়। কোথাও কেউ নেই। ফারাজও নেই। আতঙ্কের শীতল স্রোত মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে আসে। তার কাঁপতে থাকা হাত থেকে বোতল আর পায়েসের বাতিটা টেবিলের ওপর রাখে সে। তারপর আবারও র*ক্তের দিকে তাকায়। মাথাটা হালকা ঝিমঝিম করছে। সেই ঘন লৌহগন্ধী বাতাস তার গা গুলিয়ে তুলছে। এই র*ক্ত ফারাজের?চিত্রা ধীর পায়ে রক্তের ছাপ অনুসরণ করে এগিয়ে যায় বারান্দার দিকে। কানের পাশ বেয়ে ঘামের উষ্ণ স্রোত নেমে আসে তার। বুকের ভেতর দমচাপা উত্তেজনা। বারান্দায় পা রাখতেই তার শরীর শিউরে ওঠে। পায়ের নিচে তাজা রক্তের কাদামাটির মতো আঠালো স্পর্শ। চারপাশ অন্ধকার, তবু সামনের দৃশ্য বোঝা যাচ্ছে। বারান্দায় পড়ে আছে একটা নিথর, রক্তের স্রোতে ভেসে যাওয়া দেহ। কে পড়ে আছে? অন্ধকারে ঠিক স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তবে পুরুষালী গড়ন, চওড়া শরীর৷ এক মুহূর্তেই চিত্রার মনে বিদ্যুৎ চমকের মতো ভেসে উঠে ফারাজের মুখখানি। বুকের ভেতর ধুকপুক করে ওঠে। শুষ্ক কন্ঠে চিত্রার মুখ দিয়ে বেরোয়,
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ২৮
“ফারাজ!”
কোনো সাড়া নেই। চিত্রা এক পা এগিয়ে যেতে না যেতেই হঠাৎ ঠান্ডা ধাতব কিছু তার গলার কাছে ঠেকে। এক ঝটকায় পিঠ শক্ত একটা বুকের সঙ্গে ধাক্কা খায়। ভয়ে চিত্রার শ্বাস আটকে আসে। হাত-পা অনিয়ন্ত্রিত কাঁপতে থাকে। পেছন ফিরে দেখার আগেই কেউ একজন তার কাঁধের কাছে নিজের থুঁতনি রাখে। লোকটার নিঃশ্বাসের গরম ছোঁয়া অনুভব করে চিত্রা। তারপরই ফিসফিস শব্দে ভেসে আসে। গা শিউরে দেওয়া একটা স্বর।
“আগুন সুন্দরী!”