চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৪

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৪
ইশরাত জাহান জেরিন

আবহাওয়া ভালো না। তবুওই এই আবহাওয়ার মধ্যে মাহাদী নিকলী এসেছে। মোহরকোনা বেরি বাঁধে সারি সারি ট্রলার, নৌকা বাঁধা। বৃষ্টির সময় হাওরে মানুষের আনাগোনা কম। বিশেষ করে করে রাতে। তবে এই সময়েও যেসব ট্রলার আছে তাদের দান্ডা শুরুই হয় রাত থেকে। মাহাদী বাইকে করে এসেছে। তার বাইকের পেছনে বাচ্চা মেয়ে দু’টোও ছিল। বেরি বাঁধে নামার পর মেয়ে দুটোকে খাবার কিনে হাতে ধরিয়ে বলে,
“কইছিলাম না তোমাগোরে মজার মজার খাওন খাওয়ামু?”
বড় মেয়েটা রুটিতে একটা কামড় বসিয়ে চিবোতে চিবোতে বলে, আপনে কইছিলেন আব্বার লগে দেখা করাইবেন?আর কত সময় লাগবো? আম্মায় তো মনে হয় বাড়িত চিন্তা করতাছে।”

মেয়েদুটোর পরিবারে মা ছাড়া কেউ নেই। বাবা ছিল তবে বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে। তবে বাবার বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা অবুজ শিশুদুটো জানে না। তারা রোজ বাবার ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনে। মা বলেছে বাবা দূরে থাকে। চাকরি করে। একদিন চাকরি শেষ হলে ফিরে আসবে। সেই কথা মনে গেঁথে মেয়ে দু’টো বাবার জন্য অপেক্ষা করে। ছোট মেয়েটা হওয়ার পরপরই লোকটা হঠাৎ গুম হয়ে গিয়েছে। মেয়েদুটোর মায়ের মতে তার স্বামী নিকাহ করেছে। নতুন বউ নিয়ে দূরে কোথাও থাকছে। বাপ সন্তান অস্বীকার করতে পারে কিন্তু মা তো আর পারে না। সে তো জন্ম দিয়েছে। বুকের দুধ খাইয়ে মানুষ করেছে।
“আরে তোমাগো বাপ ওই ট্রলারে আছে। এখুনি নিয়া যামু।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেয়েদুটোর মুখে অদ্ভুত উল্লাসের ছাপ ফুটে উঠল। একে অপরকে ধরে তারা খুশিতে নেচে উঠল।অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পর তারা বাবার সাথে দেখা করতে চলেছে। তাদের ছোট্ট হৃদয়ে ভিন্ন রকমের আনন্দ উথলিয়ে উঠেছিল। মাহাদী কিছুটা দূরে গিয়ে ফোন বের করে কথা বলে ফিরে আসে। ফিরতেই তার পিছন হতে হঠাৎ করে ট্রলার থেকে দুজন লোক বেরিয়ে এল। দুজন লম্বাটে, কালোমতো লোক। তাদের পরনে শার্ট আর লুঙ্গি। ঠোঁটের কোষ পানের রসে লাল হয়ে আছে। একজনের মুখে ভয়ঙ্কর পোড়া দাগ। অন্যজনের ডান হাতে এক বিশাল কাটা দাগ। যা উপরের অংশ থেকে নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত।
“ভাই ভেতরে ডাকে।” পোড়া দাগ ওয়ালা লোকটা কথাখানা বলতেই মাহাদী মেয়ে দু’টোকে নিজের কাছে ডাকে। দু’জনের দু-হাত ধরে বলে,
“বাবার লগে দেখা হইবো খুশী লাগতাছে না?”
“হ।”

মাহাদী মেয়ে দুটোকে নিয়ে ট্রলারের নিচের অংশে প্রবেশ করে। বিরাট ট্রলার। বসার ভালো জায়গা। সেখানে প্রবেশ করতেই কালো লুঙ্গি পড়া আরেকজন লোককে দেখতে পায়। মনোযোগ সহকারে মাদক সেবন করছে সে। সঙ্গে আরো কিছু মানুষ গোল হয়ে বসে আছে। মাহাদীর বুঝতে বাকি রইল না এখানে যে জুয়া খেলা হচ্ছে। পেছন থেকে আগের দু’জন লোকের মধ্যে হতে একজন বলে উঠে,
“ভাই চইলা আসছে।”
কালো লুঙ্গি পড়া লোকটার দৃষ্টি এতক্ষণে মাহাদীর ওপর পরে। সে এক ঝলক মেয়ে দুটোর দিকে তাকায়। তারপর আদেশ করে,
“জিনিস রাইখা মাল দিয়া বিদায় কর বাক্কি।”

মুহুর্তেই মেয়ে দু’টোকে মাহাদীর হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় টাকার বান্ডিল। মেয়ে দুটো আংকেল বলে চেঁচিয়ে উঠতেই মাহাদীর সামনেই বাক্কি নামক লোকটা ঝাঁঝালো চড় বসিয়ে দেয় গালে। মেয়ে দু’টো ভয়ে চুপ হয়ে যায়। মাহাদী একটা নিঃশ্বাস ফেলে। টাকার জন্য এ কি ধরনের পাপে জড়াচ্ছে সে? মেয়ে দু’টোকে বাবার আশা দিয়ে এই কোথায় এনে ফেলেছে? আল্লাহ কি এই অপরাধের ক্ষমা তাকে কখনো করবে? মেয়ে দু’টোকে বাক্কি সেখান থেকে টেনে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় কান্নাজড়িত মায়াবী চোখ দু’টো হয়তো বলছিল, “বাবাকে কি আর দেখা হবে না? মা যে বাসায় একা আছে। তাদের জন্য চিন্তা করছে। বাঁচাও আমাদের। আমরা না ফিরলে মাকে লাকড়ি কে কুড়িয়ে দিবে?পড়াশোনা করে মানুষের মত মানুষ হয়ে মায়ের অভাব কারা দূর করবে?”
মাহাদী হাতের বান্ডিলের দিকে একবার তাকায়। শিশুদুটোর র*ক্ত বেঁচে ভাত খাবে এই টাকায় সে? একটা ঢোক গিলে। কন্ঠমণিটা নিচে নামতে চাইছে নদ। গলাটা শুঁকিয়ে আসছে। সে কালো লুঙ্গি পড়া লোকটার দিকে আবারও টাকায়। এটাই কি সেই ভুঁইয়া তবে? কিন্তু ভুঁইয়াকে তো আজ অবধি কেউ দেখে নি। ভাবার আগেই লোকটা বলে উঠল,

“শুন ছোট মেয়েটা একেবারে ছোট হইয়া গেছে। তাও প্রথমবার দেখে ফুল টাকা দিলাম। ওই বয়সের বাচ্চাদের দ্বারা যেই দান্ডা চলত ওইটা কিছুদিনের জন্য আপাতত বন্ধ। পরে চালু হইলে জানামু নি। আর শুন যত জিনিস আইনা দিতে পারবি তত তোরই লাভ। রাতারাতি মালামাল হইয়া যাবি। তবে সাবধান যদি ধরা খাস আর ভুঁইয়ার নাম জড়াস তাইলে কিন্তু নজর তোর বাড়ির ওপরই গিয়াই পড়বো। এখন যাহ!”
মাহাদী নিচের দিকে চেয়ে মাথায় নাড়ায়। সে সালাম দিয়ে চলে যেতেই পেছন থেকে কানে কিছু কথা ভেসে আসে, “বড়টারে তৈরি কর কাস্টমারের লইগা। আর ছোটডা কামের না। ওর চোখ, কিডনি,লিভার খুইলা রাইখা দেহটারে হাওরের মাছেগো খাওয়াইয়া দে।”
মাহাদী আর পেছন ফিরল না। ট্রলার থেকে বেড়িয়ে এলো। বাইকে উঠে বসতেই টাকার কথা ভাবল। ভাবল মারিয়ার কথা। এই টাকা দিয়ে মারিয়ার জন্য সুন্দর একটা শাড়ি কিনে নিয়ে যাবে সে। আর কি কিনবে? সমস্যা নেই পথে ভাবা যাবে। এখন মাহাদী মারিয়াকে সব সুখ দিতে পারবে….. সব সুখ।

নিশ্ছিদ্র নির্জনতার আবরণে মোড়ানো বসুন্ধরার এ-ব্লকে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এলাহী মেনশন। একেবারে নিরিবিলি জায়গা। প্রশস্ত রাস্তার ধারে, সবুজে ঘেরা বাড়িটি। বাড়িটির চারপাশ গাছপালায় ঘেরা। সামনে বাগান। ফারাজ চিত্রাকে কোলে করে গাড়ি থেকে নামায়। তার সেইদিনের কথা মনে পড়ে যায়। বিয়ের রাতেও তো ঠিক এই ভাবেই ফারাজ চিত্রাকে কোলে করে এলাহী বাড়িতে প্রবেশ করেছিল। তবে পার্থক্য ছিল অনুভূতিতে। সেদিনের চিত্রা চোখে চোখ রেখে বহন করেছিল ঘৃণা আর অবজ্ঞা। আর আজকের চিত্রা ফারাজকে দেখছে গভীর, নিঃশর্ত ভালোবাসায় ভরা চোখে।
চিত্রাকে বিছানায় শুইয়ে দেয় ফারাজ। ঘুমন্ত মেয়েটার মুখটা নিস্পন্দ। বুকের ওঠানামা এতই ধীর যে না দেখলে বোঝাই যায় না সে এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বিছানার সাদা চাদরে তার গায়ের গরম গন্ধ মিশে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ফারাজ একবার তাকায় তার দিকে। তারপর ঘর ছেড়ে চলে যায় বাথরুমে। জার্নি করে গোসল না নিলে ঘুম আসবে না রাতে।

চিত্রার গায়ে তখনো সেই শাড়ি। ভেজা নয়, তবে ভ্রমণের ধুলা-মিশ্রিত, ভারী। ঘুমের মধ্যে মেয়েটা একটু নড়ে ওঠে। ফারাজ যখন ফিরে আসে তখন দেখে সে একপাশে গড়িয়ে পড়েছে, চুল এলোমেলো, কপালে এক বিন্দু ঘাম জমে আছে। ফারাজ এসিটা আরো বাড়িয়ে দেয়। সে তাড়াহুড়া করে না। চুপচাপ এসে বসে চিত্রার পাশে। দু’হাত বাড়িয়ে শাড়ির আঁচল খুলে নেয়। চিত্রার গায়ের কাপড়গুলো সরিয়ে রাখে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে। অস্বস্তি এড়াতে ওর জন্য একখানা হালকা, পাতলা নরম স্লিপ-ড্রেস বের করে আনে। চিকচিকে পিচ রঙের ড্রেস। একেবারে শরীরে বসে যায় নরম ভাবে। ফারাজ একবার থামে। এই গভীর ঘুমটা… এভাবে থাক না আরো কিছুক্ষণ। ওকে জাগাতে মন চাইছে না। কিন্তু তবুও,
“চিত্রা… চিত্রা, উঠো একটু,” ফারাজ নরম কণ্ঠে শুধায়।
মেয়েটা কুঁকড়ে যায় একটু। ঘাড় বেয়ে চুল গড়িয়ে পড়ে বালিশে। সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু ঘুমের কারনে মুখ থেকে শব্দ বেরোয় না।

“এসব নিয়ে ঘুমালে অস্বস্তিতে থাকবে তো? একটু বদলে নাও। তারপর আবার শুয়ে পড়ো। উঠো।” ফারাজ এবার ঘাড়ের নিচে হাত রাখে। একটু টেনে তোলে ওকে। চিত্রা উঠে বসে। চোখ অর্ধেক বন্ধ। ঘুম আর বাস্তবের মাঝে দুলছে সে। ফারাজ সাহায্য করে ওকে পোশাক বদলাতে। কাঁধে হালকা চাদর জড়িয়ে দেয়। তারপর ওকে বাথরুমে নিয়ে যায়। চিত্রা হালকা পানি দিয়ে মুখ ধোয়। আর কিছুই করে না। আয়নায় তাকালেও নিজের চোখের দিকে মনোযোগ নেই। পরে আবার বিছানায় ফিরে আসে দু’জন। চিত্রা এবার গা এলিয়ে দেয় ফারাজের বুকের ওপর। একেবারে নিচে,বুকের মাঝ বরাবর। চিত্রার আর্দ্র নিঃশ্বাস ফারাজের চামড়ায় গিয়ে ঠেকছে। ফারাজ চিত্রার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। এই মেয়েটার চুলে হাত পড়লেই সে এক মিনিটের ভেতর ঘুমিয়ে পড়ে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। শরীর ঢলে পড়ে ফারাজের ওপর।

ঘরটা তখন আর নিঃশব্দ নয়। বাইরের জানালায় হালকা বাতাসের দোলা। আর দূরে… কোথাও বিদ্যুৎ চমকালো। গম্ভীর, ভারি মেঘ আকাশে ডাকছে। ফারাজ চিত্রার দিকে তাকায়। এত সুন্দর লাগছে এই মেয়েটাকে। সে নিশ্বাস ছাড়ে। এই মেয়ে এমন রুপ নিশে পাশে থাকলে সে নিজেকে যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তা কি আগুন সুন্দরীর জানা নেই? তবুও সে হাত মুঠ করে নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করে “এখন নয়। মেয়েটা এখন ঘুমাচ্ছে। সে ক্লান্ত।” কিন্তু পারে না…. পারে না নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। সে ঘুমন্ত চিত্রাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দেয়। মেয়েটাকে নড়েচড়ে উঠতেই ফারাজ তার গানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে,
“আজ রাতটা শুধু আমাদের…”

চিত্রা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘরের আলো নিভে আছে, শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে আসা আলো তার মুখের ওপর পড়েছে। ফারাজ ঘুমন্ত চিত্রাকে বুকের ওপর থেকে আলতো জরে নামিয়ে লকার খুলে স্টেইনলেস স্টিলের কেসটা বের করে টেবিলের ওপর রেখে খুলে। ভিতরে সুচ, সিরিঞ্জ আর কাঁচের ছোট ফাইল। ফাইলে ড্রাগস ভর্তি। ঘোলাটে এক তরল। কাঁচের ছোট্ট ফাইলটা হাতে তুলে নেয় ফারাজ। শিশিটার ভেতরে যে তরলটা ঘুরছে সেটা কোনো সাধারণ ওষুধ নয়। এক ধরনের ঘুমের ফাঁদ। ঘোলাটে, হালকা ঘন, ধোঁয়াটে ধরণের স্লিপিং ড্রাগস। রঙটা ঠিক বোঝা যায় না। হালকা ধূসর আর কুহেলি সোনালি রঙের মাঝামাঝি। সূর্যের আলো না পড়লে বোঝাই যায় না তার প্রাণঘাতী অস্তিত্ব। ফারাক রাবারের মাথায় সূঁচ গুঁজে দিয়ে সাবধানে পিস্টন টানে। তরল উপরে উঠতে থাকে সিরিঞ্জে। স্বচ্ছ নয়, একটু ধোঁয়াটে, একটু বিষের মতো। ঠিক যতটুকু দরকার, ততটুকু ভরে ফারাজ পিস্টন থামিয়ে দেয়।
তারপর সূঁচটা ওপরের দিকে তুলে ধরে। হালকা টোকা দেয় আঙুল দিয়ে। যেন ভেতরের হাওয়া উঠিয়ে দেয়। চাপ দেয় পিস্টনে। একফোঁটা ড্রাগসের কণা বেরিয়ে আসে সুচের ডগা থেকে। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় সেটা মুহূর্তের জন্য চকচক করে ওঠে। তারপর অদৃশ্য। ফারাজ চিত্রার নরম কোমল বাহুর দিকে একবার তাকায়। বলে, “ক্ষমা করো আগুন সুন্দরী। এছাড়া আমার হাতে আর কোনো উপায় ছিল না।” ফারাজ নিঃশব্দে এগিয়ে আসে। তার চোখে স্থিরতা। তবে ঠোঁটে কোনো সংকোচ নেই।

ডান হাতে রাখা সুঁইটা সে আলতোভাবে তোলে। বাঁ হাতে চিত্রার বাহুটা উঁচিয়ে ধরে। চামড়ার নিচে নীল শিরাটা খুঁজে নেয় পাকা হাতের অভ্যস্ততায়। একবারও কাঁপে না তার আঙুল। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস নেয় সে। তারপর ধীরে ধীরে সুচ ঢুকিয়ে দেয় চিত্রার শিরায়। অল্প এক চিলতে সুঁইয়ের ঢুকেই নরম একটা চাপ দেওয়া। ড্রাগস ধীরে ধীরে মিশে যায় চিত্রার রক্তে। তার নিঃশ্বাস একবার থেমে গিয়ে আবার চলতে থাকে। যেন কিছু টের পায়নি সে। এই ড্রাগস কাজ করে ধীরে তবে নিশ্চিতভাবে। একবার শিরায় ঢুকে গেলে মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলোকে জড়িয়ে ফেলে নিঃশব্দে। শরীর প্রতিক্রিয়া দেখাতে চায়, কিন্তু পারে না। স্নায়ু অলস হয়ে পড়ে। মন ধীরে ধীরে আলো হারায়। চেতনার জগৎ থেকে সরু এক ধূসর করিডোরে চলে যায় মানুষ। যেখানে ঘুম আর নিস্তব্ধতা ছাড়া কিছু নেই। ফারাজ জানে, এই ড্রাগসে চিত্রা ঠিক কতক্ষণ ঘুমাবে। সে জানে কতটুকু প্রয়োগ করলে চিত্রা কথা মনে রাখবে না, আর কতটুকু দিলে সে গভীর স্বপ্নে আটকে থাকবে। সে প্রয়োজন মতোই দিয়েছে। কাজ শেষে ফারাজ চেয়ে থাকে মেয়েটার মুখের দিকে। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শুধু ঘুমন্ত এক নরম মুখ,নিরুপায়, নিঃসংশয়। সে ধীরে ধীরে সুঁইটা সরিয়ে নেয়। তুলো চেপে ধরে জায়গাটায়। নিজের কাজ শেষ করে গায়ে শার্ট জড়িয়ে অভ্রকে কল করে বলে,
“জলদি গাড়ি বের করো।”

নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে আচমকা নিজের নিঃশ্বাসের শব্দে জ্ঞান ফিরে মিতালির। চোখ মেলতেই বুঝতে পারল সে একটি অচেনা ঘরে।লঞ্চের ইঞ্জিন ঘর। বাতাস ভারি। তেল আর ধাতব গন্ধে ভরপুর। আলো কম। শুধুই একটি ক্ষীণ হলুদ বাল্ব টিমটিম করে জ্বলছে। নিজেকে দেখে মিতালি হতবাক। শরীর অর্ধনগ্ন। এক টুকরো কাপড়ও নেই ইজ্জত ঢাকার জন্য। লজ্জা ও আতঙ্ক একসাথে বুক চেপে বসে। কিন্তু তার চেয়েও ভয়াবহ ছিল শরীর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ক্ষতের নকশা। ব্লেড দিয়ে আঁকা অসংখ্য আঁকিবুঁকি। প্রতিটি দাগ জ্বলছে। ছ্যাঁকা দিচ্ছে যন্ত্রণার। চুল ছিল মিতালির গর্ব। কোমর ছোঁয়া কালো চুল। ঝলমলে আর ঘন। কিন্তু এখন মাথার একপাশ কাটা। নেড়া করে দেওয়া হয়েছে তাকে। কাঁচির ধার বা ব্লেডের খোঁচা এখনও স্পষ্ট মাথার ত্বকে। মিতালির কান্নার শব্দ নেই। হবেই বা কী করে? মুখ গোঁজানো কাপড়ের স্তরে শব্দ আত্মহারা হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখের সামনে একের পর এক চিত্র ভেসে উঠছে। মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ, ভাইয়ের বিস্ফারিত চোখ আর মৃত বাবার থমথমে নিস্তব্ধতা।

অন্ধকারে ঘেরা লঞ্চটা কোথায় যাচ্ছে মিতালি জানে না। শুধু জানে, কোথাও কোনো মুক্তি নেই। তার গা থেকে ঝরে পড়ছে ঘাম যেন শরীরজুড়ে আগুনের পরত। ইঞ্জিনের তাপ শরীরকে জ্বলন্ত করে তুলেছে। মস্তিষ্কের ভেতরটা থরথর করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে, এখনই মগজ গলে নাক-কান দিয়ে গড়িয়ে পড়বে। শরীরজুড়ে কাটা দাগগুলো ঘামের সংস্পর্শে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। প্রতিটা স্পর্শে যন্ত্রণার নতুন তরঙ্গ। কতবার এই নরখাদক শকুনগুলো তাকে ছিঁড়ে খেয়েছে মিতালির হিসেব নেই। এক একটা আঘাতে তার আত্মা একটু একটু করে থেতলে গেছে। হঠাৎ পায়ের শব্দ ধীর, ঠান্ডা, পরিচিত আতঙ্কে মোড়ানো। মিতালি থমকে যায়। নিঃশ্বাস আটকে রাখে। ওরা আবার আসছে। আবার নখর বসিয়ে র*ক্ত টেনে নেবে। মিতালি চোখ বন্ধ করে। এবার হয়তো সব শেষ। হয়তো এটাই শেষবার। তবে এরচেয়ে নদীর জলে ভেসে যাওয়া-ই ভালো।

শান্ত, নিশ্চুপ, চিরবিশ্রামের প্রয়োজন। শরীর, মন, আত্মার আর তো সহ্য হয় না। মিতালি আধবোজা দৃষ্টিতে সম্মুখপানে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হয় একটি জোড়া কালো পা। চামড়ার স্যান্ডেলে মোড়ানো। মুহূর্তেই তার দেহ নিস্পন্দ হয়ে আসে। যেন হাড়ের গাঁটে জমে ওঠা আতঙ্করা তাকে ঘিরে ধরছে। মিতালি সম্পূর্ণভাবে চোখ খুলে পরিস্থিতি অনুধাবন করার আগেই সেই অজ্ঞাত পরিধানে চেক লুঙ্গি পরিহিত পুরুষটি পাশবিক নির্দয়তায় চামড়ার স্যান্ডেল সমেত পা তুলে মিতালির মুখমণ্ডলে আঘাত হানে। মুখ থেঁতলে যায় বেদনার অমানবিক অভিঘাতে। মিতালি শ্বাস রুদ্ধ আর্তনাদে ফেটে পড়ে। কিন্তু তার চিৎকার গিলে নেয় নিকষ অন্ধকার। যখন সেই হিংস্র শক্তির উন্মত্ত প্রয়োগে একপাক্ষিক যুদ্ধ সমাপ্ত হয় তখন লোকটি পানের পিক ছুঁড়ে ফেলে মিতালির সম্মুখে বসে পড়ে। নির্মম ভঙ্গিতে মিতালির মুখ জোরপূর্বক চেপে ধরে উঁচু করে তোলে পরখ করে। খুঁটিয়ে দেখে এই মুখে এখনও কতটা প্রাণ অবশিষ্ট রয়েছে। লোকটি দাঁত পিষে বলল,

“দুনিয়ার জাহান্নাম এইডা। কেমন লাগতাছে এইখানে আইসা? মাঝে মাঝে কিছু জিনিস দেখা উচিত না। তোর ভাগ্য ভালা নিষিদ্ধ জিনিস দেখার পরেও এখনো চোখ দুইটা অক্ষত আছে। তুই মুখ খুললে তোর চিত্রা আপারও কিন্তু পরের বার এইখানেই আসতে হইতে পারে।”
আরও কিছু পায়ের ধ্বনি শ্রুতিগোচর হতেই আকবর সংবরণহীন উদ্বেগে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। সে খোকনের অনুগত সঙ্গী। সেই রাতের সমস্ত অন্ধকার গল্পের নীরব সাক্ষীও সে। ঠিক তখনই ইঞ্জিনরুমের দ্বারপথে আবির্ভূত হয় এক সুদেহী, সৌম্যদর্শন পুরুষের। যার উপস্থিতিতে শীতল ধাতব ঘরটিরও হঠাৎ রুদ্ধতায়
শ্বাস নিতে কষ্ট হয়ে যায়। তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা।

বাঙালি আভিজাত্যে মোড়া।পরিশীলিত রুচির নিদর্শনস্বরূপ। পেছনে তাঁর অনুগামী আরও কয়েকজন রয়েছে। তবে সমগ্র ঘরের দৃষ্টি এমনকি ভয়, সংকোচ ও রক্তাক্ততা ছাপিয়ে নজর কেবল কেন্দ্রীভূত হয় সেই ব্যক্তির দিকেই। মিতালির কর্ণদেশ দিয়ে র*ক্ত ঝরছে অবিরত। ধুলোমলিন চুলে জড়িয়ে গেছে সেই লালস্রোত। দৃষ্টি আধো ঝাপসা, শরীর প্রায় নিস্পন্দ। তবু অবশ মুখমণ্ডল তুলে চেষ্টা করে একটিবার চোখ রাখার সেই অচেনা অথচ চিরপরিচিত চোখদুটির দিকে তাকানোর। যেই মুহূর্তে তার দৃষ্টি সেই পুরুষের চোখের গভীরতাকে ছুঁয়ে যায় ঠিক তখনই যেন সমস্ত শরীরের স্নায়ুতন্ত্র থমকে যায় তার। সমস্ত অভ্যন্তরীণ হাহাকার স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় এক নিঃশব্দ বিস্ময়ে।
মিতালি নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে মনে মনে শুধায়,
“আপনি?”

ঘুম নেই চোখে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে নিহান। যেন রাতের ভার তার দেহে চেপে বসেছে। ঘরের নিস্তব্ধতা মাঝে মাঝে জানালার ফাঁক গলে আসা হাওয়ায় কাঁপছে পর্দা। কিন্তু তার মন স্থির নয়।
নিহান বইয়ের পাতায় কিংবা কারো বলা কথায় শুনেছিল, “ভালোবাসা মানুষকে খারাপ থেকে ভালোতে রূপান্তর করতে পারে।” কথাটা তার মনে গেঁথে আছে। তবে এই নিঃসঙ্গ রাতের নীরবতায় সে একটাই প্রশ্ন বারংবার করছে নিজেকে, “কই ভালোবাসার জন্য ভালো থেকে খারাপ হয়ে উঠার গল্প গুলো নিয়ে তো কেউ মেতে উঠে না?”
নিহান ঘুমন্ত ফারিয়ার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করে। আলতোভাবে তার গালে স্পর্শ রেখে মমতার পরশে চাদরটি আরও ভালো করে গায়ে জড়িয়ে দেয়। অতঃপর ধীরে ধীরে মশারির আবরণ সরিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে সে। গায়ে তার সাদামাটা সেন্ডো গেঞ্জি, পরনে একটি দাগকাটা লুঙ্গি।

নীরবতার সঙ্গে ঘরে আলোড়ন সৃষ্টি না করেই বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বাইরে প্রবল বর্ষার গর্জনে মাঝে মাঝে বিজলীর তীক্ষ্ণ আলো দিগন্ত ছিন্ন করে আকাশে দাগ কাটে যাচ্ছে। সেই বিভাবরীর মধ্যেই নিহান একটি সিগারেটে আগুন ধরায়। ধোঁয়ার ঘূর্ণি ছাড়তে ছাড়তে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দুর্বোধ্য আকর্ষণীয় সেই বিদ্যুৎছটায় মোড়ানো রাতের আকাশের দিকে। চিন্তার অতল গহ্বরে বহুক্ষণ ডুবে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে আনে সে। যেন সমস্ত উত্তাল বিক্ষোভকে ফারিয়ার শান্ত নিদ্রার মাঝে নিমগ্ন করে দিতে চায়। নিজের হৃদয়ের অব্যক্ত ক্লান্তি আর ব্যথা মিশিয়ে ফিসফিসিয়ে উচ্চারণ করে,

“তুমি কি জানো ফারিয়া… মানুষ নিজেকে কিভাবে হারায়?”
নিহান থেমে যায়। নিঃশ্বাস নিংড়ে মনে মনে পুনরায় ফারিয়াকে উদ্দেশ্য করে শুধিয়ে উঠে,
❝আমি লোভী। তোমার ভালোবাসার লোভ আমায় ধ্বংস করেছে,করুক। তবুও লোভ করব আমি,পাপ করব আমি। পাপ করে যদি তোমাকে পাওয়া যায়,তোমার ভালোবাসা পাওয়া যায় তবে আমি নিহান শেখ তাতেই খুশী।❞
নিহান হঠাৎ করেই রুমের নিস্তব্ধতা ছিন্ন করা মৃদু শব্দে দৃষ্টি মেলে অন্ধকার ঘরের দিকে তাকায়। বুঝতে পারে ফারিয়া সম্ভবত ওয়াশরুমে গেছে। একরাশ বিরক্তি আর মমতার মিশ্র অনুভব ছুঁয়ে যায় তার মনপ্রান্তে।
“ইশ! মেয়েটা একটিবার ডাকতে পারে না?এই অন্ধকারে হাঁটাহাঁটির অভ্যেস কবে যাবে তার?”মনেই বলে ওঠে নিহান।

ওয়াশরুম থেকে ফিরে ফারিয়া চোখে হাত ঘষতে ঘষতে খাটের ঠিক সামনে এসে থামে। চোখে ক্লান্তির ছাপ। “নিহান! তুমি কি বারান্দায় আছো? এত রাতে সেখানে কী করো?”
নিহান ধীর কণ্ঠে উত্তর দেয়। “কিছু না। তুমি ঘুমাও গিয়া।” ফারিয়া ফিরে যায় না। শব্দহীন পায়ে এগিয়ে আসে বারান্দার দিকে। পিছন থেকে ধরা দেয় নিঃশব্দে। বাহু জড়িয়ে ধরে প্রিয় মানুষের গন্ধের গহীন আবেশে ডুবে গিয়ে তার কণ্ঠে ফুটে ওঠে আকুলতা, “চলো না… রাত অনেক হয়েছে। চলো ঘুমাই।” নিহান কালো আকাশের দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে ধূমায়িত সিগারেটটি ছুঁড়ে ফেলে দেয় বারান্দার নিচে। তারপর ধীরে ধীরে ফারিয়াকে নিজের সামনে টেনে আনে। দু’হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে তার চিবুক ছুঁয়ে দৃঢ়, কোমল দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, “বল না ময়না …
ভালোবাসার ক্ষমতা কি প্রতিশোধের আগুনকে নিভিয়ে দিতে পারে?”

রাতভর পেটের যন্ত্রণায় একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছে আয়েশা। অভ্র তাকে শেষবার তেঁতুলের চাটনি খাইয়েছিল। সেই চাটনিই এখন তাকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। নির্গাত সরকারের বাচ্চাটা সেই চাটনিতে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল। যার পরিণতি পেটের দুর্বিষহ যন্ত্রণা। রাত থেকেই বাথরুমে ছুটোছুটি শুরু হয়েছে আয়েশা। এখনো থামার কোনো লক্ষণ নেই। শরীর প্রায় নিঃশেষিত। তবুও বার বার পেট মুচড়ে উঠছে। অভ্রকে গালাগাল করতে করতে সে আবারও বাথরুমের দিকে রওনা হয়। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। চারিদিকে ফরজের আজান ধ্বনিত হচ্ছে।

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৩

আয়েশা একেবারে বিধ্বস্ত। শেষবারের মতো বাথরুম থেকে বের হয়ে বিছানায় গিয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে। তখনই গাড়ির হর্নের শব্দ শোনা যায়। এক মুহূর্তের জন্য তার ভ্রু কুঁচকে ওঠে। শরীরের দুর্বলতা উপেক্ষা করে সে এক পা দুই পা করে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। পর্দা সরিয়ে সে যা দেখে, তাতে তার চোখ ছলকে ওঠে।বাড়ির সামনে দুটি মার্সেডিজ গাড়ি থেমেছে। প্রথম গাড়িটি থামতেই একজন লোক এসে দরজা খুলে দেয়। ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে ফারাজ এলাহী। আয়েশার কপালে ভাঁজ পড়ে যায়। গলার মধ্য থেকে উদ্বিগ্ন উচ্চারণ ভেসে আসে,
“উনি এই ভোরবেলা কোথা থেকে আসলো আবার?”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৫