চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৬

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৬
ইশরাত জাহান জেরিন

চিত্রার সামনে বজ্র বসে আছে। সে একেবারে নীরব। চিত্রাও চুপচাপ। কিছু বলছে না। ইদানীং চিত্রার রক্তচাপ ঠিকঠাক থাকছে না। এ নিয়ে ফারাজ অনেক চিন্তিত। তাই আবারও বজ্রকে ডাকা হয়েছে তার প্রেসার মাপতে। বজ্র রুমে আসার পরই কাঁচের বাটিতে রাখা স্ট্রোবেরি গুলোর দিকে তার নজর যায়। সে তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করে, “এমা এসব কি?”
ফারাজ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, “তোমার নাকের ঘি। খাইবা নি?”
বজ্রর এহেন কথায় নাক মুখ কুঁচকে আসে। কথা না বাড়িয়ে সে চিত্রার প্রেসার মাপায় মন দেয়। ফারাজ একেবারে বজ্রর গা ঘেঁষে বসে আছে। যেন সে নিজেই ডাক্তার। বারবার নির্দেশ দিচ্ছে “এইভাবে কর, না না, ওইভাবে কর।” বজ্র বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলছে না।
“আরে বজ্রপাত, এতক্ষণ লাগে প্রেসার মাপতে?”
ফারাজের প্রশ্নে বজ্র মাথা তুলে তাকায়।“ভাই, গায়ের ওপর থেকে একটুও সরবি? আগে আমাকে কাজটা করতে দে।”

“কর, তবে সাবধানে। বেশি ছোঁয়াছুঁয়ি করিস না। কখন আবার কোন ভাইরাস ছড়ায়।”
বজ্র ধৈর্য ধরে চিত্রার প্রেসার মাপে। রিপোর্ট ঠিক আছে। তবে খাবারদাবারে একটু নজর দিতে হবে। সে চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভাবীর দুধ-ডিম বেশি খাওয়া দরকার। শরীরটা একটু দুর্বল।”
ফারাজ এক মুহূর্তও চুপ থাকতে পারে না। “ওকে ওকে, তোর কাজ শেষ?শেষ হলে এবার রাস্তা মাপ।”
বজ্র অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। চিত্রা লজ্জায় মাথা নিচু করে। এমন করে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে? এ লোককে কি কোনো নিয়মে ঠিক করা সম্ভব?
“ভাইয়া, আপনি কিছু মনে করবেন না,” চিত্রা ধীরে বলে, “আপনি জানেন তো উনি একটু… এমনই।”
বজ্রের মুখে মৃদু এক হাসি খেলে যায়। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই ফারাজ তির্যক চোখে তাকায়।
“দাঁত কেলানো বন্ধ কর ভাই। বত্রিশটা দাঁত একার তোর নেই।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন

বজ্রর মুখ মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে যায়। ফারাজ এবার চিত্রার দিকে ঘুরে তাকায়। “ বউ শোনো, এই বজ্রকে ‘ভাই’ ডাকো তুমি কোন আক্কেলে? আজ থেকে ওকে চাচা ডাকবে।” একটু থেমে আবার বলে, “না না, চাচাও না। আজকাল চাচাদের সঙ্গেও মোহাব্বত হয়। তুমি বজ্রকে আব্বা ডাকবে। দুনিয়ার সব পুরুষকেই আব্বার চোখে দেখবে।”
চিত্রা বিস্মিত, বিরক্ত। “কেনো? এই নিয়ম শুধু আমার জন্যই কেনো? আপনি ফারাজ বাচ্চাদের মতো কথা বলছেন।”
ফারাজ গম্ভীর হয়ে বলে, “আমার চোখে সব নারী হলো মায়ের মতো। শুধু তুমি বউয়ের মতো। তাই তোমাকেও হতে হবে আমার মতো। আমাদের চোখে পৃথিবীর সব নারী-পুরুষ আমাদের বাচ্চার মতো।”
বজ্র একটা কথাও না বলে উঠে দাঁড়ায়। এখানে বসে অপমান সহ্য করার আর ইচ্ছে নেই তার। সে চলে যেতে উদ্যত হলেই চিত্রা তাকে থামাতে যায়। তখনই ফারাজ তার হাত চেপে ধরে।

“শালায়, তোমার হাত ধরে প্রেসার মাপছে। জানো এই দৃশ্য যে আমি কলিজা হাতে নিয়ে দেখেছি?”
চিত্রার ধৈর্য ফুরায়, “তো কি সে আমার ঠ্যাং ধরে প্রেসার মাপবে?”
“এই বউ, ধরাধরির কথা বাদ দাও। কেমন যেন শুনতে লাগে। চলো ওয়াশরুমে, তোমার হাত ধুয়ে দেই।”
“আবার? কী হয়েছে?”
“হ্যান্ডওয়াশ, শ্যাম্পু সব দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করবো হাতটা। ওই বজ্রপাতের নোংরা হাতের স্পর্শ তোমার গায়ে লেগেছে। ইচ্ছে তো করছে হাতটাই কেটে ফেলি।”
চিত্রা এবার ঠান্ডা কণ্ঠে বলে, “আপনার মোসলমানির সময়ও কত মানুষ কত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কতবার স্পর্শ করেছে। আমারও তো সেইসব ভেবে কাটাকাটি করতে মন চায়। কই তবুও তো মুখ খুলি নি?”
ফারাজ থতমত খায়। হকচকিয়ে বলে, “যা বউ আস্তাগফিরুল্লাহ।”

আয়েশা লজ্জায় অভ্রর দিকে তাকাতে পারছে না। একদিকে ভুল বোঝাবুঝি, অন্যদিকে অসতর্কতায় সোজা গিয়ে পড়েছে অভ্রর গায়ে। পরিস্থিতি এমনই বিব্রতকর যে, চোখ তুলে তাকানোই মুশকিল। ল্যাপটপের মধ্যে যে ভিডিও দেখছিল লোকটা। তাতে মেয়ের গলা শুনে আয়েশা না হয় একটু ভুলই ভেবেছিল। বেশি কিছু তো আর নয়। কিন্তু যা ভাবায়, তা হলো—অভ্র কেন এত স্বাভাবিক এত মৃদুভাবে কথা বলছে? সে তো চাইলেই রাগ দেখাতে পারত তার গায়ের ওপর পরার জন্য। নিশ্চয়ই কিছু একটা গড়বড় আছে… ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।
বিষয় পাল্টাতে আয়েশা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
“এই বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই কেন? মানে, ওই বাড়িতে তো অনেকেই ছিল, রান্নাবান্না আর গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করত।”
অভ্র কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

“ফারাজ ভাই এই বাড়িতে বাইরের কাউকে এলাউ করেন না। তোমাকে যে গাড়িতে করে এখানে আনা হয়েছে সেটাই তোমার সাত কপাল ।”
“কিন্তু কপাল তো আমার একটাই!” আয়েশা মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার পরিবারে কে কে আছে?” এই প্রশ্নে অভ্র থমকে গেল। একটু চিন্তা করে, গলার স্বর নিচু করে বলল,
“পরিবার? সেটা আবার কেমন জিনিস?”
একটা অন্যমনস্ক হাসি ঝরল তার ঠোঁটের কোণে। আয়েশা অভ্রর সেই হাসির দিকে তাকায়। মনে মনে সুধায়, কে বলেছে শুধু নারীর সৌন্দর্য অপূর্ব? কখনো কখনো পুরুষের এক চিলতে হাসিও বিস্ময়ে ভরিয়ে দিতে পারে হৃদয়। হঠাৎ আয়েশা কপট রাগে বলল,
“আজ এত শান্ত ভালো মানুষ হয়ে গেছো যে? অথচ গতকাল সারা রাত আমি শুধু বদনা নিয়ে ছোটাছুটি করলাম! চাটনির মধ্যে কী মিশিয়েছিলে বলো তো?”
অভ্র হাসতে হাসতে জবাব দিল,

“কয় প্যাকেট খেয়েছিলে মনে আছে?”
আয়েশা গুনে গুনে বলল, “সাত প্যাকেট।”
“বেঁচে গেছো, এটাই অনেক! এমন খাই-খাই মেয়ে আমি জীবনেও দেখি নাই!” — অভ্র নাটকীয়ভাবে চোখ বড় বড় করল।
“খোঁটা দিয়ো না চান্দু!” — আয়েশা মুখ ফুলিয়ে বলল।
“ওয়েট গুওয়ালী! এই এত শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছো কীভাবে? মুখে ঘি-চিনি লাগিয়েছো নাকি?”
অভ্র এক পা সামনে এগোতেই, আয়েশা সতর্ক হয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল। তবু কিছু বলার আগেই অভ্রর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়ে সে ফোন হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়াল। আয়েশা তার পেছনে তাকিয়ে একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনকে বলল,
“এই শালার জ্বালায় আর একটুখানি ঝাকানাকা হইতে পারুম না মনে হয়! সবসময় মূর্খ বানাইবার চেষ্টা করে শালা! এইটার সঙ্গে ভালো করে কথা বললেও কেমন করে। একবার তো গুয়ের শাক খাওয়াইছি পরেরবার এটারে ড্রিনের শরবত খাওয়ামু।” বলেই মুখ ভেংচিয়ে, কোমর দুলিয়ে জায়গা ছেড়ে উঠে চলে যায় আয়েশা।

চিত্রাকে নিজের কাছে এনে বসায় ফারাজ। ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “হাতে ব্যথা বলেই তো আজ চুলগুলো ঠিক করে আঁচড়াতে পারোনি, তাই না?”
চিত্রা ধীরে মাথা নাড়ে।
“হুম।”
ফারাজ ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। কপালে একটা আলতো চুমু এঁকে ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি তুলে নেয়।
“আমি তো আছি বিবিজান। আমি থাকতে তোমার এত কষ্ট করার কী দরকার?”
চিত্রার কোমর ছুঁই ছুঁই করে নামা ঘন, কালো চুলে চিরুনি চালায় সে। চুলে জট বেঁধে গেলে সাবধানে খুলে দেয়। মাঝে মাঝে ব্যথার জায়গাগুলোতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় ভালোবাসার পরশ। চিত্রা চোখ বন্ধ করে অনুভব করে সে মুহূর্তগুলো। কখনও ভাবেনি, কোনো পুরুষ তার প্রতি এমন নিঃস্বার্থ যত্নশীল হতে পারে। এতটা ভালোবাসতে পারে। ক’জন পুরুষ আছে বউকে কাজ করতে দেয় না? এই তো দুপুরেও নিজ হাতে কি একটা যেন রান্না করে খাইয়ে দিয়েছে তাকে। এই লোকের রান্নার হাত ভালো! চুল আচড়ানো শেষ হলে ফারাজ তাকে আলতো করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে। চিত্রা চোখ বুঁজে ফেলে। ফারাজের বুকটা চিরচেনা আশ্রয়। ওখানে মাথা রাখলেই যেন দুনিয়ার সব যন্ত্রণাগুলো দূরে সরে যায়। আর শান্তির ভারে ঘুম নেমে আসে চোখে।

“বিবিজান,” ফারাজ নিচু স্বরে ডাকে।
“হু,” চিত্রা জবাব দেয় তার ঘুমজড়ানো কণ্ঠে।
” বাইরে যাবো।”
“কোনো কাজ আছে?” চিত্রা ধীরে জানতে চায়।
“হ্যাঁ, আছে।”
চিত্রার মুখটা একটু বিষণ্ন হয়ে আসে। সেই মুখ দেখে ফারাজ মুচকি হাসে, “তোমাকেও নিয়ে যাবো সঙ্গে করে। তৈরি হও, আমরা ঘুরতে যাচ্ছি।”
চিত্রা ফারাজের দিকে অবিশ্বাসভরা চোখে তাকায়। খুশিতে মুখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে। “সত্যি?” সে শিশুর মতো চমকে জিজ্ঞেস করে।
“না, মিথ্যে!”
চিত্রার মুখটা মুহূর্তেই শুকিয়ে যায়। অভিমানী চোখে তাকাতেই ফারাজ তার চিবুক ছুঁয়ে আলতো স্বরে বলে,
“আরে, আবুলের নাতনি! তিন সত্যি।”

ভোরের আলো ফোটার কিছু আগেই বাড়ি ফিরেছে রাজন আর জোহান। সারারাত দুই ভাই কোথায় ছিল, কেউ জানে না। সেই যে বেরিয়েছিল, আর ফেরেনি। রাজন ফিরে ঠান্ডা পানিতে গোসল করে নেয়। তারপর কিছু না খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ে। যেন ঘুম নয় ঘুমের ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে কোনো গাঢ় ক্লান্তি। রাজনের আগেও তিনজন স্ত্রী ছিল। কেউই স্থায়ী হয়নি। তিনজনই নাকি মারা গেছে। কথাটা বাইরে যত সহজে বলা হয়, নদীর কাছে তা অস্বাভাবিক লাগে। বিশ্বাস করতে মন চায় না তার। সে জানে তার স্বামী মানুষ না। মাঝে মাঝে তার মনে হয় রাজন কোনো হিংস্র জানোয়ার। যে ঘর করছে কিন্তু সংসার বোঝে না। নদী নামাজ পড়ে, আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করে।একটা সন্তান চায় সে। একটি পুত্র সন্তান যাকে ঘিরে গড়ে উঠবে তার নিজের একটা ছোট্ট জগত। যদি সেই ছেলের সুবাদেই তার ভাগ্য খুলে যায়, তাহলে ক্ষতি কী? নদীও তো চায় তার স্বামী তাকে ভালোবাসুক। খুব করে ভালোবাসুক। না, অত্যাধিক কিছু নয়। কেবল একজন স্ত্রীর যতখানি ভালোবাসা প্রাপ্য, সে কেবল সেইটুকুই চায়। কিন্তু সে জানে যদি ছেলে সন্তান না হয়, তাহলে হয়তো কখনোই সেই ভালোবাসার জায়গাটুকু পাবে না। হয়তো চিরকাল সে একজন ‘অযোগ্য’ রয়ে যাবে রাজনের চোখে, সমাজের চোখে, নিজের চোখে।

বিকেল হয়ে গেছে। নদীর পেটে কিছু পড়েনি আজ। খেতে মন চায় না। রাজন এখনও ঘুমিয়ে। উঠতে পারে, আবার না-ও পারে। তবে সে উঠলেই বা কী? আজ তো তার বাড়িতে টাকা পাঠানোর কথা। হয়তো ঘুম থেকে উঠলে পাঠাবে। এসব ভেবে আর কী হবে? নদী জানে টাকার লেনদেন দিয়ে পাপের ঋণ মেটানো যায় না। পাপ কখনো মুছে যায় না।

ওটা গায়ে রয়ে যায়, একরাশ কলঙ্ক হয়ে। নুড়িটার রাতে জ্বর এসেছিল। সারারাত কেঁদে কেটেছে তার। দুপুরে একটু ঘুম এসেছে। অথচ সেই ঘুমের মধ্যেও যেন ব্যথা লুকিয়ে আছে। একটা নিষ্পাপ শিশুর নিঃশব্দ আর্তি। রাজন কখনও তার দিকে ফিরে তাকায়নি। কখনও ‘বাবা’ হয়ে ওঠেনি সে। স্নেহ তো দূরের কথা, দায়িত্বের ছায়াটুকুও সে মেলেনি নুড়ির ভাগ্যে। অথচ দেখো না ফারাজ আর রোশান… ওরা নুড়িকে নিয়ে পাগল। একটুখানি কাশি হলেও অস্থির হয়ে পড়ে। নদীর বুকটা হু হু করে ওঠে। কপালটাই বুঝি পোড়া মেয়েটার। এমন এক নিষ্পাপ শিশুর ঠাঁই হওয়া উচিত ছিল না রাজনের মতো হিংস্র এক পুরুষের ঘরে। ওর জায়গা হওয়া উচিত ছিল ফারাজের কোলে। সেই ঘরে যেখানে ভালোবাসা যেমন প্রবল, তেমনি সুরক্ষাও নিশ্চিত। হ্যাঁ, ফারাজ নিখুঁত নয়। সে নিজেও পাপে মোড়া। তবু সে জানে কীভাবে আপনজনের জন্য লড়তে হয়। তার নিজের বলতে যা কিছু, তা বাঁচানোর জন্য পুরো দুনিয়াকে সে উল্টে দিতে পারে। নিজের বলতে যদি কেউ একবার জায়গা পায় তার মনে, তবে সেইজন্য সে নিঃশ্বাস পর্যন্ত বাজি রাখতে পারে। নদী চুপচাপ নুড়ির পাশেই বসে থাকে। তার হাতের তালুতে নুড়ির ছোট্ট আঙুল রাখা। নীরবে সুধায়, “মারে দাবি রাখিস না তুই।”

বিকেলের নরম আলোয় ঘরের প্রতিটি কোণায় মেখে আছে সোনালি ছায়া। জানালার পর্দা হেলে দুলছে। বাহিরে মন ছুঁয়ে যাওয়া এক টুকরো বাতাস। প্রকৃতির সবচেয়ে কোমল উপহার। এমন বাতাসের সামনে আধুনিক পৃথিবীর সব কৃত্রিমতা বড়ই তুচ্ছ লাগে।
ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিত্রা। পেছনে ফারাজ। চিত্রার কাঁধে শাড়ির আঁচল ঝুলছে। ফারাজ কপাল কুঁচকে মন দিয়ে তাকে সাজাতে ব্যস্ত। এই নিয়ে চতুর্থবার। কখনও আঁচল পড়ে যাচ্ছে, কখনও পিন ঠিকমতো বসছে না তবু ফারাজ দমছে না। এমন মনোযোগে যেন শাড়ি নয়, কোনো প্রিয় শিল্পকর্ম সাজিয়ে তুলছে সে। চিত্রা আয়নায় ফারাজের মুখ দেখে একটু হেসে ফেলল। ফারাজ তখন বলে ওঠল,
“এই বউ, এই শাড়িটা ভালো না রে! বারবার খুলে যাচ্ছে।”
চিত্রা একচুল হেসে, ঠোঁটে রক্তজবার মতো দুষ্টু ভঙ্গি এনে বলে, “আপনি ঠিকমতো পড়াতে না পারলে তো শাড়ি কেন, সবই খুলে যাবে!”

ফারাজ এবার এক দমে থেমে তার দিকে তাকায়। চোখেমুখে মিশ্র অনুভূতি। সে ধীরে চিত্রার চুল সরিয়ে দেয় এক পাশে। মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলে,
“এই বিবিজান শাড়ি পরা লাগবে না। তোমাকে সবভাবেই আমার ভালো লাগে। কিছু পরলেও আর না পরলেও।
“হয়েছে ছাড়ুন। আসলে পরাতে পারছেন না তো তাই কত কথা আরো বলবেন।”
শেষবারের চেষ্টায় কষ্ট করে হলেও ফারাজ শাড়িটা ঠিকঠাক চিত্রার গায়ে পরিয়ে দেয়। নিঃশ্বাস ফেলে তাকায়। তারপর চুপচাপ বসে পড়ে চিত্রার পায়ের কাছে। নিচু হয়ে চিত্রার উরুর ওপর তার দুটো পা তুলে নেয় নিজের হাতে। আলতা ছুঁইয়ে দেয় নরম পায়ে। আদর করে এক জোড়া সোনার নূপুর পরিয়ে দেয়। চিত্রা তাকিয়ে থাকে। একদৃষ্টিতে। তার চোখে বিস্ময়। এই মানুষটা যাকে সে ঘৃণা করত। যে ছিল একরোখা, সেও আজ এতটা কোমল ? ফারাজ এবার চিত্রার হাতে মেহেদির টিউব তুলে নেয়। ধীরে ধীরে ভালোবাসা দিয়ে আঁকে। নকশাটা তেমন নিখুঁত না। এবড়ো খেবড়ো। তবুও চিত্রার চোখ সরে না। যখন ফারাজ তার তালুতে নিজের নামটা লিখে দেয় তখন চিত্রা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,

“এবার কি ভালোবাসা দিয়ে মেরে ফেলবেন আমায়?”
ফারাজ কিছু বলে না। শুধু একটুখানি হাসে। সেই হাসিতে কোনো পুরুষালী ঔদ্ধত্য নেই। শুধু আছে একরাশ মায়া, ভালোবাসা।
বিকেলটা মেঘলা, হালকা নরম বাতাস বইছে। আকাশে রোদের বদলে ছায়া। কিন্তু সেই ছায়া মন ভার করা নয় বরং এক ধরনের স্নিগ্ধ প্রশান্তি নিয়ে এসেছে চারপাশে। চিত্রা আর ফারাজ রিকশায় বের হয়। গাড়ি নয়, কারণ চিত্রা গাড়িতে উঠলে বমি করে। ফারাজ জানে, এই বউটা বিলাসিতার চেয়ে
সাধারণতাই বেশি ভালোবাসে। হুড তোলা রিকশা ধীরে ধীরে চলতে থাকে এ ব্লক থেকে আই ব্লক ওয়ালটন বাড়ির দিকে। চিত্রা ফারাজের পাশের সিটে বসে আছে। ফারাজ তার হাতে চিত্রার হাতটাকে শক্ত করে জড়িয়ে আছে। শাড়ির আঁচল বাতাসে হালকা দুলছে। নূপুরের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে রিকশার টুংটাং টিনে। ফারাজ একবার তাকিয়ে দেখে পাশে বসা মেয়েটাকে। চোখে তার আনন্দ, ঠোঁটে একটা প্রশান্ত হাসি। “এর চেয়ে বেশি কিছু কি চাই?” ফারাজের মন বলে, না! আর কিছুই চাই না। এই মুহূর্তটাই যদি চিরকাল থাকে, সেটাই যথেষ্ট।

সন্ধ্যার স্নিগ্ধ আবহে আকাশে জমে উঠেছে মেঘের ভেলা। হালকা বাতাস বইছে চারপাশে। দিনের শেষে ক্লান্ত শহরটাকে একটু মেঘ ছুঁয়ে শান্ত করতে চাইছে। যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফারাজ আর চিত্রা। ব্যস্ত সড়কের হুলস্থুল ভেদ করে দু’জন আলাদা একটা জগতে প্রবেশ করেছে। যেই জগতে সবকিছু পেরিয়ে কেবল চিত্রা আর ফারাজের বসবাস। ভেতরে ঢুকতেই ফারাজ একটা আইসক্রিম কিনে দেয় চিত্রার হাতে। চিত্রা অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। এই মানুষটা না চাইতেই সব বুঝে যায় কি করে? সময় যত গড়াচ্ছে। প্রতিনিয়তই তাকে চমকে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে বিরক্ত করে, আর ঠিক পরক্ষণেই মনের মতো কিছু করে বসে মন জয় করে নেয়। চিত্রা আইক্রিমের দামের ট্যাগটা দেখে হঠাৎ হেসে উঠে বলে,
“আরে! এই সামান্য একটা আইসক্রিমের এত দাম? ঢাকা শহর মানেই তো দেখি ডাকাতি! এই ঘুনে ধরা শহর টাকায় খায়।”

ফারাজ একপলক চিত্রার দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। সে চিত্রার কাঁধে হাত রেখে বলে,
“তোমার মুখের হাসি কাছে কোটি টাকার জিনিসও নেহাৎ সস্তা ঠেকে।”
চিত্রা কিছু বলে না, চোখ নামিয়ে হাসে। সন্ধ্যার আলোয় তার মুখে অদ্ভুত কোমলতা ছড়িয়ে পড়ে। যেমনটা হয় কখনো ভিজে মাটির গন্ধে, কখনো প্রথম প্রেমের ছোঁয়ায়। এই শহর, এই মেঘলা সন্ধ্যা, আর এই ভালোবাসা সব মিলিয়ে মুহূর্তটা ঠিক ছবির মতো হয়ে দাঁড়ায়।
শপিং শেষ হলে ফারাজের মাথায় বাজ পড়ে। এত ব্যাগ, এত জিনিসপত্র! প্রথমে ভাবল সব নিজেই টেনে নিয়ে যাবে, কিন্তু পরক্ষণেই উপলব্ধি করল এই কাজ তার একার নয়। শেষে নিরুপায় হয়ে ফোন করে ডাকল অভ্রকে। যখন অভ্র এসে দেখে যমুনার মলের সামনে ফারাজ দাঁড়িয়ে আছে। দুই হাতে গাদা গাদা ব্যাগ, মুখে অস্থির বিরক্তি আর পাশে দাঁড়িয়ে মিষ্টি মুখে চিত্রা। সে থমকে যায়। চেনা মানুষ অচেনা আচরণ করলে যেমন হয়, ঠিক তেমন।
এটাই ফারাজ? সেই স্বার্থপর, একরোখা, নিজের জগতে ডুবে থাকা লোকটা? নাকি এখন যা দেখছে সবই একটা ধোঁকা? ফারাজ নিজেকে ফাঁকি দিচ্ছে, নাকি তাদের সবাইকে?

“আরে এই বাল কুদ্দুসের বাপ ধর ভাই! আমার হাত ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। গাড়ি নিয়ে যমুনার পকেট গেটের সামনে এসে দাঁড়া।” —ফারাজ বিরক্ত গলায় বলল।
“আপনি কই যাবেন আবার?” অভ্র অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
“লুমান্স করতে চুনোপুঁটি। তুই সিঙ্গেল জ্বলে পুড়ে মর।”
ফারাজ চিত্রার হাত টেনে ধরে পকেট গেটের দিকে হাঁটা শুরু করে। চিত্রা অভ্রকেও তাদের সঙ্গে আসার জন্য বলতে এগোতে গেলে ফারাজ হালকা টান দিয়ে চিত্রাকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলে ওঠে,
“ছ্যাহ বউ! ওই ব্যাটা সিঙ্গেল। সিঙ্গেল মানুষ হলো পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা মহামারীর মতো। ওদের সংস্পর্শে গেলে তুমিও দেখবে জুটিহীনা বিধবা হয়ে গিয়েছো। ওদের কাছে যেও না। আসো আসো বউ স্বামীর বুকে আসো।”
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা “চায়ের আড্ডায়” এখনো ভিড় জমে আছে। চায়ের কাপে ভাসছে ধোঁয়া। সেই ভিড় ঠেলে ফারাজ চিত্রার জন্য চা আনতে গেছে।এটা ভাবতেই যেন আশ্চর্য লাগে। চিত্রা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। অভ্র পাশে। আকাশ এখনো গুমোট। যেকোনো মুহূর্তে আবার নামতে পারে বৃষ্টি। চিত্রার চোখ আটকে থাকে ফারাজের দিকে। দোকানের ভিড়ে ব্যস্ত সে ভিড় মাড়িয়ে বউয়ের জন্য চা আনতে। সে দৃষ্টি সরায় না।চিত্রার ঠোঁট কাঁপে। মুখ থমথমে। সে আস্তে অভ্রকে জিজ্ঞেস করে,

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৫

“যা আনতে বলেছিলাম আনা হয়েছে?”
“জ্বী।” অভ্র মাথা নাড়ে।
“সব তৈরি তো?”
“হ্যাঁ ।”
এক মুহূর্ত থেমে চিত্রা আবার বলে, “আর ছুড়িটা?”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৭