চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৭
ইশরাত জাহান জেরিন
আকাশ ঢেকে আছে ধোঁয়াটে সীসার মতো ভারী মেঘের আড়ালে। ঝড় আসার আগে শহরটাকে ঢেকে দিচ্ছে এক অচেনা চাদরে। বাতাসে হালকা ঠান্ডা। রাস্তায় গাড়ির হর্ন আর মানুষের পায়ের ধ্বনি মিশে অস্থির কোলাহল তৈরি হয়েছে। এই শহর বিশ্রাম চেনে না। মানুষের ঢল, ট্রাফিকের জট, হেডলাইটের ঝলক, সবকিছুই জীবন্ত একটা অজগর হয়ে কিলবিল করে এগিয়ে চলে। ব্যস্ত মানুষের কিলবিল করতে থাকা শহরে “চায়ের আড্ডার” সামনে ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ফারাজ। চোখ তার বাইরের কোলাহল চেনে না, কিংবা সে চায় না চিনতে।
হঠাৎই একটা অচেনা মেয়ে এসে দাঁড়ায় ফারাজের পাশে। কুণ্ঠাহীন দৃষ্টিতে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে তার দিকে। যেন চোখ দিয়েই সে বলছে অনেক কিছু। ফারাজ কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও, মুখে কোনো ভাব প্রকাশ করে না। ভান করে যেন সে কিছুই দেখছে না। কিন্তু হঠাৎ মেয়েটি বলে ওঠে,
“আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আপনি আমার চা নিয়ে যান।”
ফারাজ অবাক হয়ে তাকায় মেয়েটার দিকে। তার হাতে দু’কাপ চা। একটু থেমে, কিছুটা দ্বিধা নিয়ে ফারাজ বলে,
“আচ্ছা, দেন।”
পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে যাবে, এমন সময় মেয়েটি বলে,
“চায়ের বদলে অন্য কিছু চাই।”
ফারাজের কপালে ভাঁজ পড়ে। “কি চাই?”
মেয়েটি এককথায় উত্তর দেয়, “নাম্বার।”
ফারাজ হাসে। “ওহ, আচ্ছা, ওয়েট।”
গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চিত্রা আর অভ্র ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ফারাজের দিকে। চিত্রার মুখে চাপা রাগ। চোখে জ্বলন্ত আগুনের ন্যায় জ্বলছে। সে নিজে এখানে দাঁড়িয়ে, অথচ তার সামনেই স্বামী অন্য মেয়েকে নাম্বার দিচ্ছে? ফারাজ নাম্বারটা দিয়ে মেয়েটার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ফারাজ ফাও খায় না। ফাও খেলে পেট খারাপ হয়।”
মেয়েটার মুখ অদ্ভুত রকম শান্ত। যেন বোঝার চেষ্টা করছে এই কথার অর্থ কী। ফারাজ চলে যাওয়ার আগেই মেয়েটি ফারাজের দেওয়া নাম্বারে তার সামনেই কল করে। মুহূর্তেই অভ্রর ফোন বেজে ওঠে।
অভ্র কল ধরতেই ওপাশ থেকে মেয়েটি হ্যালো বলে।চিত্রার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ, নির্বাক অভ্রর মুখটা শুকিয়ে যায়। কিছু বলার আগেই মেয়েটা তার দিকে তাকায়। কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফারাজ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,
“আরে রাস্তা ছাড়েন খালাম্মা। আমার আগুন সুন্দরী বউটা অপেক্ষা করছে। আর হ্যাঁ, চায়ের জন্য ধন্যবাদ আশা করবেন না বান্দরী। ওইটার দাম কিন্তু নগদেই পে করেছি।”
মেয়েটি রেগে বলে, “তাই বলে আরেকজনের নাম্বার দিবে তুমি?”
“নাম্বর চেয়েছ খালাম্মা কার নাম্বার চাই তাও তো বলো নি। তাই আমার মহামারী কুদ্দুসের বাপের ভাইরাস দূর করতে ওর নাম্বারটাই দিলাম। বাই দা ওয়ে মেয়ে তোর আব্বার বয়সী হই, বাপের দিকে নজর দিতে লজ্জা করে না?আবার তুমি মারাও?”
গুনগুন করতে করতে ফারাজ মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে চিত্রার দিকে এগিয়ে যায়। চিত্রার ঠোঁট কেঁপে ওঠে কিছু বলার জন্য, কিন্তু ফারাজের সেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে যেন সব কথা আটকে যায় গলায়।
অভ্র হতভম্ব। ফোনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বেচারা নিজের অস্তিত্বটাই ভুলে গেছে। মনে মনে শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খায় তার,
“এই ফারাজ এলাহী, তার প্রাইভেট নাম্বারটাকে সরকারি টয়লেট বানিয়ে দিল? ছ্যাহ! বালের জীবন একটা!”
গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে চিত্রা চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাবে ঠিক তখনই ফারাজ বলে উঠল,
“আস্তে, ঠোঁট পুড়ে যাবে তো! এদিকে দাও, ফু দিয়ে ঠান্ডা করে দিচ্ছি।”
চিত্রা হেসে বলল, “আমি নিজেই ফু দিতে পারি। আপনি যদি ফু দিতে গিয়ে জাদু করে ফেলেন?”
ফারাজ হাসে। চোখে একরকম দম্ভ ভাব। “জাদু করতে আমার ফুয়ের দরকারও হয় না আর মেয়ে পটানোর জন্য শার্টের বোতামও খুলতে হয় না। ফারাজ এলাহীর নাম শুনলেই মেয়েরা প্রেমের সাগরে ডুবে মরে।”
চিত্রা কোনো জবাব দেয় না। কারণ, ফারাজ ভুল কিছু বলেনি। একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা সে ভুলে নি। ফারাজ ধীরে ধীরে চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ায়। চিত্রা শহরের ব্যস্ততা মুগ্ধ চোখে দেখে। মনে মনে বলে, “এই শহর হাসে না, কাঁদেও না।
শুধু দেখে, কে কাকে হারায়, কে কাকে ঠকায়।
কি অদ্ভুত!তার চেয়ে আমাদের কিশোরগঞ্জে কত শান্তি।”
চায়ের কাপটা ডাস্টবিনে ফেলতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে একটা বাচ্চা মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। মলিন মুখে, মায়াভরা চোখে হাত বাড়িয়ে বলে,
“আপা, দুইদিন ধইরা পেটে কিছু যায় নাই… কয়ডা টাকা দেন।”
চিত্রার বুক কেঁপে ওঠে। মেয়েটার এক চোখ অন্ধ। তবুও সেই চোখে এক অপার কৌতূহল, এই দুনিয়াকে বুঝে নেওয়ার, ভালো কিছু পাওয়ার আশায় জ্বলতে থাকা শিখা। চিত্রার কাছে টাকা নেই। সে ফারাজের দিকে তাকায়। ফারাজ কোনো প্রশ্ন না করে মানিব্যাগ খুলে পাঁচ হাজার টাকা মেয়েটির হাতে দিয়ে বলে,
“কিছু খেয়ে নিও, ঠিক আছে?”
মেয়েটি থমকে যায়। এত টাকা? এ জীবনে কখনো ছুঁয়ে দেখেনি এতটা! চোখ থেকে পানি ঝরে পড়ে তার। কণ্ঠে কোনো শব্দ নেই। তবু যেন পৃথিবীর সব ‘ধন্যবাদ’ লুকিয়ে আছে তার দৃষ্টিতে। সে মনে মনে সুধায়,
“এই টাকা মায়ের হাতে দিমু। বলমু মাংস আনতে, পোলাও রান্ধতে। শুনছি বড়লোকেরা ওইসব খায়। মজার খাওন।”
চিত্রা ধীরে হাত রাখে মেয়েটার মাথায়। যেন দুনিয়ার সব আশীর্বাদ ছুঁয়ে যায় তার কপালে। ফারাজ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চিত্রার দিকে। এই মেয়েটার এত মায়া! পথের শিশুর জন্য এত দরদ!
নিজের সন্তান হলে সে কেমন করে ভালোবাসবে?
এই প্রশ্নটা কেমন যেন গেঁথে বসে তার হৃদয়ে।
ফারাজ ধীরে পেছন ঘুরে অভ্রর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,
“সামাদের চোখগুলো ঠিক ছিল তো?”
অভ্র মাথা হেঁট করে বলে, “হ্যাঁ, ভালো ছিল।”
“তাহলে একটা চোখ এই মেয়েটার জন্য ব্যবস্থা কর। আর এই মেয়ে এবং তার পরিবারের দায়িত্ব আজ থেকে আমি নিলাম। তুই তারও বন্দবস্ত কর।”
অভ্র নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। ফারাজ আর কিছু না বলে ফিরে যায় চিত্রার কাছে। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই আকাশ যেন তার আবেগ ধরে রাখতে না পেরে ঝরে পড়ে। মুষলধারে বৃষ্টি নামে। চারপাশে ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। কেউ খুঁজছে ছাউনি, কেউ ছুটছে বাড়ির দিকে। কিন্তু ফারাজের প্রয়োজন একটাই তা হচ্ছে চিত্রা। চিত্রারও হয়তো তাই—ফারাজ। বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে দিচ্ছে তাদের শরীর, কিন্তু তারা দাঁড়িয়ে থাকে স্থির। ফারাজের সাদা শার্ট ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। চিত্রার চুল থেকে টুপটাপ করে পানি পড়ছে। তবুও কোনো অস্বস্তি নেই। বরং সে বৃষ্টির জল ধীরে ধীরে চিত্রার শরীর ছুঁয়ে, ভিতর অব্দি কোনো অজানা অনুভবকে জাগিয়ে তুলছে। ফারাজের চোখে নেশা, অন্তরে কামুকতা।
অভ্র ছাতা হাতে নিয়ে এক পা এগিয়ে এসেও থেমে যায়। উঁহু এমন সময় বিরক্ত করলে অভিশাপ লাগবে। পরে যদি সেই অভিশাপের কারনে বিয়ে না হয়?বাপরে মহামারী হয়ে বেঁচে আছি সেটাই তো কষ্টকর। আবার মৃত্যু!
বৃষ্টির মাঝে ফারাজ চিত্রার হাত ধরে। চিত্রার কণ্ঠে দৃঢ়তা, “চলুন, বাড়িতে ফিরে যাই।”
ফারাজ চট করে প্রশ্ন করে, “ফিরে গেলে কি পাবো?”
“আপনার মন যা চাইছে, সেটাই।”
“সত্যি বলছো?”
“মনকে প্রশ্ন করুন। সত্য-মিথ্যার হিসেব ওর চেয়ে ভালো কেউ জানে না।”
চিত্রা চুপ করে যায়। বৃষ্টি, ভিজে চুল, কাঁপতে থাকা আঙুল… ফারাজ সেই হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে নিজের দিকে টেনে আনে। চারপাশের দৃষ্টি যেন থেমে থাকে ঠিক সেই মুহূর্তে। শহরের ব্যস্ততা, যানজট, হর্ন—সব থেমে গেছে কেবল এই দু’জনের চারপাশে। চিত্রা শ্বাস টেনে বলল, “এখানে নয়… গাড়িতে চলুন।”
ফারাজ চোখ ছোট করে হেসে বলে, “গাড়িতে? সত্যি তো?”
চিত্রা চোখ ঘুরিয়ে বলে, “নাউজুবিল্লাহ! আপনার মাথাটা একেবারে মাসুদ মার্কা। কেমন করে এমন ব্রেন নিয়ে মানুষদের মাঝে চলাফেরা করেন বলেন তো?”
ফারাজ ভিজে চুলে হাত বুলিয়ে হেসে ওঠে, “চলাফেরা করি না তো, প্রাইভেট জেটে উড়ে উড়ে যাই!”
চিত্রা মুখ ফুলিয়ে কিছু বলার আগেই ফারাজ চিত্রার হাত ধরে ফুটপাতের ওপর হাঁটা শুরু করে। তাদের গন্তব্য কোথায় তারা জানে না। শুধু জানে একসঙ্গে ভিজতে হবে,সারাটা জীবন এভাবেই একসঙ্গে হাত ধরে হাঁটতে হবে। ফারাজ চিত্রার পানে চেয়ে গান ধরে গলা উঁচিয়ে। “আকাশ মেঘে বৃষ্টি হয়ে
স্বপ্ন গুলো দেয় ভিজিয়ে। তুমিও কি আমার সাথে…
ভিজবে পথে হাত জড়িয়ে?”
এলাহী মেনশনে গাড়ি ঢুকতেই বৃষ্টিভেজা চিত্রা নিজেই দরজা খুলে নামল। গাড়ির শব্দ শুনে আয়েশা তাড়াহুড়া করে বাইরে বেরিয়ে এলো। ভেজা চিত্রাকে দেখে প্রথমে একটু থমকে গেলেও, পরক্ষণেই মুখটা লাল করে হালকা লজ্জায় পড়ে গেল। তার এমন অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়ায় পেছন থেকে অভ্র হেসে ফিসফিস করে বলল,
“গুওয়ালী কালা মাইন্ড ঠিক কর।”
তারপর চিত্রার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় যোগ করল, “ভাবী, আপনি ততক্ষণে কাজগুলো শেষ করে ফেলুন।”
চিত্রা মাথা নেড়ে চুপচাপ ভেতরে চলে গেল। চিত্রা চলে যেতেই আয়েশা এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর মাইন্ড কালা, তোর মন কালা, আর শালা তোর পেছনও কালা!”
“খুলে দেখিয়েছিলাম নাকি?”
“দেখ ওইসব দেখা লাগে না। এমনিতেই আন্দাজ করে ফেলি।”
“খুব অভিজ্ঞ আছে দেখছি অভিজ্ঞ আপা। তো ব্যাটা মানুষের পাছার কালার আন্দাজের উপকারিতা কি? মানে এসব করে কামান কি?”
“দেখ লাগতে আসিস না।”
” চেয়ে দেখ গুওয়ালী কে কার সীমানায় এসেছে। আর থাম বইন, ঝগড়ার মুডে নাই।” অভ্র বিরক্ত মুখে জবাব দেয়।
“কি হইছে, বক্কর আলী?” আয়েশা ঠোঁট বাঁকায়।
অভ্র রাগে মুখ ফুলিয়ে বলে, “আজাইরা। পাগল দাদির মেন্টাল নাতনি!”
আয়েশা এবার আর কথা না বাড়িয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু ঠিক সেই সময় আকাশ ফেড়ে এক বিকট শব্দে বিজলী চমকালো। আতঙ্কে আয়েশা পেছনে ফিরেই অভ্রর দিকে দৌড় দেয়। ততক্ষণে অভ্র সামনে থেকে সরে যায়।
আয়েশার তাল ঠিক না থাকায় সে অভ্রর গায়ে ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যায় । চিৎকার করে ওঠে সিমেন্ট ঢালাই করা পার্কিং লটে পড়লে তো গন্ডারের চামড়াও ছিলে যায়, আয়েশা তো সামান্য একটা মেয়ে! হাঁটু ছিলে বেরিয়ে এসেছে রক্ত। বাম পা-টাও মোচড় খেয়েছে। অভ্র প্রথমে পাত্তাই দেয় না, যাওয়ার জন্য ঘুরে পা বাড়ায়। কিন্তু এক মুহূর্তেই থমকে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে আয়েশার সামনে এসে দাঁড়ায় সে। হাতে থাকা ছাতাটি ফেলে দেয় একপাশে। তারপর নিজের ব্লেজারটা খুলে আয়েশার গায়ে জড়িয়ে দেয়। এক মুহূর্ত থেমে, কোনও কথা না বলে ঝট করে আয়েশাকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়।
“আরে…” আয়েশা অবাক হয়ে কিছু বলতে চায়।
“একদম চুপ!” অভ্রর আগুনের মতো উত্তপ্ত গলায় মুহুর্তেই আয়েশা থমকে যায়। অভ্রর মুখটা বদলে গিয়েছে। এমন রুপে আগে তো কখনও অভ্রকে দেখে নি সে। আয়েশা মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে,” আচ্ছা অভ্র তাকে এখন কোথাও নিয়ে যাবে? আশিকি মুভির মতো রুমে নিয়ে গিয়ে ছিনিমিনি খেলবে না তো?হায় আল্লাহ মিভ মি সাম হেলেপ।”
ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটার দোরগোড়ায়। ফারাজ সবেমাত্র বাড়িতে ঢুকেছে। দরজার চৌকাঠ পেরোতেই একটু থমকে দাঁড়ায়। বাড়িতে ঘোর অন্ধকার। কারেন্ট নেই? আইপিএসটা? সেটাই বা বন্দ কেন? বাড়ি নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ। ফারাজ একাই ফিরেছে। বজ্র এখনও বাইরে, ফিরতে একটু দেরি হবে। মনটা খচখচ করে ওঠে ফারাজের। আজ রাতে চিত্রার সঙ্গে তার একটু নিরালায় ব্যতিক্রম ভাবে কাটানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বউটাকে মাঝপথেই একা রেখে বেরোতে হলো। যদি না সামাদের ছেলে এত ঝামেলা পাকাত! শালা, যার বাপকে ফারাজ নিজের হাতে ডোনেশন দিয়েছে তার ছেলের এত তেল মানায় না। শালার মাথায় চর্বি জমেছিল। এখন তো সেই চর্বি গুলিয়ে শালাকে ফারাজ পানি খাইয়েছে। আসলে ব্যাটা জানে না,বাপেরও যে বাপ আছে।” ফারাজ মনে মনে গজগজ করে, “ব্যাটার তেল নিংড়ে ফেয়ার ক্রিম বানিয়ে নিজের গায়ে মেখে ছেড়ে দিবো।”
ফারাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীর পায়ে হলরুমে আসে। অন্ধকার ঘরটাও আজ অভিমানী হয়ে আছে। “ধ্যাত!” নিজেকে ধমক দেয় ফারাজ। আজকের রাতটা এমন হওয়ার কথা ছিল না। পরিকল্পনা ছিল চিত্রাকে আধার রাতের জ্যোৎস্না দেখাবে। তার চোখে চোখ রেখে কিছু না বলা কথা বলবে। অথচ এখন? কিছু করার আগেই খু*ন করে হাত র*ক্ত করে এসেছে সে? আচ্ছা চিত্রা কি কলিজা ভুনা করতে পারে? সে কি কখনও জানবে? তার স্বামীর খু*ন করলে কলিজা ভুনা খেতে ইচ্ছে করে?
ফারাজ থেমে যায়। অন্ধকারে চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নেয়। নিঃস্তব্ধতা এত ভারী যে মনে হচ্ছে বাড়িটার ভেতর শ্বাস নেওয়ার জন্যও অনুমতির প্রয়োজন। কিছু একটা গোলমাল তো আছেই। নিঃসন্দেহে। “অভ্র কোথায়?” হঠাৎ প্রশ্নটা মাথায় আসে। পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালায়। অভ্রকে কল দেয়। লাইন যাচ্ছে, কিন্তু কল ধরছে না। আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ফারাজ সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় দোতলায়। দোতলা থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের শব্দ পাচ্ছে ফারাজ। কিন্তু আদৌও কি ওটা রবীন্দ্র সঙ্গীত? বাইরে এখনও ঝরছে বৃষ্টি। জানালার কাচে অশরীরীর মতো আছড়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা জল। ফারাজ কিছুই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না। ঠিক তখনই চিত্রার মুখ মনে পড়ে যায়। চিত্রা তো অন্ধকার ভয় পায়… তাহলে এখন কোথায় সে? হঠাৎ উদ্বেগে তাড়িত হয়ে রুমে ঢুকে সে। ফ্লাশ লাইটের সাহায্যে পুরো রুমে চোখ বোলায়। চিত্রাকে ডাক দেয়। সারাশব্দ নেই। সে ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই পিঠে ঠেকে যায় একটা ঠান্ডা, সুচালো কিছু। চাকুর মতো। সেই সুক্ষ্ম চাকুর শান পিঠ বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসে কোমরের দিকে।
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৬
ফারাজের সঙ্গে খেলা? ফারাজের হাসি আসে।
চোখের পলকে, সে পেছনের হাতটা চেপে ধরে ফেলে। নিখুঁত কৌশলে চাকুটি কেড়ে নেয় নিজের আয়ত্তে। তারপর ক্ষিপ্রতায় সেই অজ্ঞাতকে ঘুরিয়ে এনে গলায় ঠেকিয়ে দেয় চাকুর শান। ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁই ছুঁই করে ফারাজের কণ্ঠ। গা কাঁপানো ঠান্ডা স্বরে ফিসফিস করে বলে, “আগুন সুন্দরী র*ক্তের খেলায় যেহেতু নেমেই গিয়েছো তাহলে খেলাটা তোমার র*ক্ত দিয়েই শুরু করি?”