চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৮
ইশরাত জাহান জেরিন
“ধ্যাত! আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?” চিত্রা খানিক ভান করে বলল।
ফারাজ হেসে উঠল, “এই বউ! তোকে চিনব না তো পাশের বাড়ির ভাবীকে চিনব?”
“কি জানি! এমনভাবে বললেন রক্তের খেলা দেখাবেন। তাহলে দেখান দেখি, জলদি দেখান!”
ফারাজ হেসে বলল, “তুমি বউ বিছানায় এসো। শুধু খেলা নয়, সবই দেখাবো সঙ্গে খেলবোও।”
চিত্রার চোখে একটু ভয়, একটু কৌতূহল। ঠিক তখনই ফারাজ চিত্রার হাত ছাড়িয়ে নিচে মেঝেতে পড়ে যাওয়া ফোন খুঁজে। অন্ধকার ঘরে ফোনটা উল্টে পড়ে ছিল বলে আলো ছড়ায়নি, ফলে ঘরটা যেন এক অজানা রহস্যে ঢেকে ছিল। অবশেষে ফোন হাতে নিয়ে আলোর উৎসের দিকে তাকাতেই চমকে উঠল। একখানা প্লাস্টিকের ছুরি, যার ডগায় টেপে পেঁচানো কাটা চামচ!
“বাহ বউ! এতকড়া মাল দিয়ে আমাকে চান্দের বুড়ির সাথে ডেটে পাঠানোর ফন্দি এঁটেছ?”ফারাজের গলায় রসিকতা।
চিত্রা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “উঁহু, ছি! এসব কী বলছেন আপনি? আমি তো স্রেফ একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। আপনি ভয় পান নি কেনো?
“তা বলে এমন অন্ধকারে এসব করতে হবে? তোমার না বরাবরই অন্ধকারে ভয় লাগে?”
চিত্রা হেসে তার মুঠো থেকে একটা ছোট লাইটার বের করল। সামনে তুলে ধরে বলল, “প্রোটেকশন তো ছিল। এটা থাকতে ভয় কিসের?”
ফারাজ কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “হ্যাঁ! এসব থাকলে কিসের চিন্তা? তবে বউ, আর এমনভাবে ভয় দেখিও না। এমনিতেই ভয় পেয়ে কিডনি পেছন থেকে সামনে চলে। এসব মারামারি কাটাকাটি আমার একেবারেই অপছন্দ। আমি নিষ্পাপ, নিরীহ একটা মানুষ।”
চিত্রা চোখ টিপে বলল, “তেমন ভয় তো দেখালাম না মনে হয়।”
“তুমি তো দেখবেও না। অন্ধকারে কিছু দেখা যায়? এই বউয়ের ঘরের বউ দয়াকরে আর এসব চাং চুং ভুং ভাং আমার ওপর ট্রাই করবে না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তাহলে আপনি নিজে র*ক্তের খেলার কথা বললেন কেন?”
“তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যই তো! ভয় পেয়েছিলে?”
চিত্রার চোখ একটু নরম হলো। সে মাথা নেড়ে বলল, “পেয়েছিলাম।”
“কতটুকু?” ফারাজ জানতে চায়।
চিত্রা ধীরস্বরে বলল, “আপনি আমায় যতটা ভালোবাসেন, ঠিক ততটাই।”
ফারাজ একটু থেমে চোখ মেলে তাকিয়ে বলল, “হায় খোদা! তাহলে তো তুমি ভীষণ ভয় পেয়েছো। এসো বউ, বুকে এসো। ফু দিয়ে ভয় উড়িয়ে দিই।”
ফারাজ চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুঁজে ফেলল। চিত্রা অনুতপ্ত। তার ওমন ভালো স্বামীটার সঙ্গে এসব করা ঠিক হয় নি। ফারাজ খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকার পর হঠাৎ বাঁধন হালকা করে। চিত্রাকে বলে,”শালার কারেন্টের আব্বা মরলো নাকি?এই বালের কি হয়েছে?আর জেনারেটর আইপিএস দুটোই এই বাড়িতে আছে ওই বালগুলোরই বা কি হলো? আয়েশা কই? অভ্র কই? বাড়ির সব জলহস্তি গুলো কই?”
“আপনার নানির……” পুরো কথা শেষ করার আগেই ফারাজ চিত্রার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে তাকে পুরো দমে থামিয়ে দেয়।
নিশ্চল পড়ে আছে মিতালি। লঞ্চের ইঞ্জিন ঘরের এক কোণে। যেখানে আলো পৌঁছায় না, মানবতা দীর্ঘ দিন পা রাখেনি। শরীর তার নিজস্বতা হারিয়েছে। ব্যথা এখন আর কেবল অনুভব নয়—একটা স্থায়ী সঙ্গী হয়ে গিয়েছে। গোনা যায় না কতবার, কতভাবে, কতজনের হাতে সে ছিন্নভিন্ন হয়েছে কাল রাত থেকে আজ পর্যন্ত। প্রত্যেকটি মুহূর্ত যেন একেকটা মৃ*ত্যুর স্বাদ। ব্লে*ডের ক্ষতগুলো এখনও র*ক্তাক্ত। ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই তাতে ছুরির মতো নতুন আঘাত এসে বসে। যন্ত্রণা এতটাই প্রবল যে আর্তনাদও ক্লান্ত।চিৎকারেরও আর জোর নেই মিতালির গলায়। তার দেহ এখন কেবল যন্ত্রণার ক্যানভাস। যেখানে প্রতিটি দাগ একেকটা নির্লজ্জ গল্প বলে। তবু ইচ্ছে হয় শেষ হোক সব। নদীর শো শো শব্দ শুনে মনে হয়, যদি এক লাফে সব শেষ করা যেত! যদি এই ক্লেদাক্ত দেহটা ডুবে গিয়ে হারিয়ে যেত সেই গভীর জলের অন্ধকারে! কিন্তু বাস্তব এক নিষ্ঠুর কারাগার। হাত-পা শক্ত করে বাঁধা, আত্মহ*ত্যার সামান্য উপায়টুকুও নেই। মৃ*ত্যু পর্যন্ত তার থেকে দূরে সরে গেছে। সে জানে, ওরা আবার আসবে। আবার দখল নেবে তার শরীর, ভাঙবে তার আত্মা, কাঁচের মতো চূর্ণ করবে প্রতিবার। বারবার। শেষ না হওয়া যন্ত্রণার চক্রে বন্দী এক অসহায় অস্তিত্ব সে। নাম তার মিতালি।
ভাবনার সুতো ছিঁড়তে না ছিঁড়তেই ভেসে এলো ভারী জুতার শব্দ। একটা, দুইটা, তারপর আরও। মিতালির নিথর দেহ কেঁপে উঠে। অসহায় শরীরটার প্রতিটি রক্তকণা আতঙ্কে ঝাঁকুনি খায়। পেছন দিকে গা হিঁচড়ে সরতে চায় সে। কিন্তু বাঁধা পড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেবল অসহায় প্রতিরোধ করে উদ্ধার নয়। ইঞ্জিন ঘরের স্যাঁতসেঁতে বাতাস চিরে পাঁচ-ছয়জন পুরুষ ঢুকে পড়ে। তাদের মধ্যে দুজন নিঃশব্দে সামনে একটি চেয়ার রেখে দেয়। ঠিক মিতালির মুখোমুখি। সেই চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে এক পুরুষ। মিতালির চোখ মুহূর্তেই চিনে ফেলে তাকে। তার শরীরের পৈশাচিক ইতিহাসে এ পুরুষও একটি র*ক্তাক্ত অধ্যায়। আকবর কিছুটা পেছনে দাঁড়ায়, হাতদুটো পেছনে রাখা। নামমাত্র ভদ্রতার ভঙ্গিমা। তৎক্ষণাৎ সামনে বসা লোকটি বজ্রগর্জনে বলে ওঠে,
“গোলামের পুত! আমার মাথার পেছনে দাঁড়ায়া না থাইকা যা, আরেকটা চেয়ার দে! আমার ভাই জোহান বসবো।”
আকবর তড়াক করে সরে যায়। অল্প সময়ের মধ্যেই সে এনে দেয় আরেকটি চেয়ার। সেখানে এসে বসে জোহান। নিঃশব্দে, নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে। রাজন এবার গাঢ় দৃষ্টিতে মিতালির দিকে তাকায়। তার চাহনিতে জ্বলে ওঠে দম্ভ আর এক ধরনের বিকৃত তৃপ্তি। সে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চুপচাপ, যেমন ভাবে শিকারিরা পরখ করে আহত জন্তুকে। আকবর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বলে উঠল,
“ভাই! আপনি খালি বলেন, আমরা নটিরে জলে ভাসাই দিমু।”
রাজন মাথা নাড়ল ধীরে। ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
“সবকিছুর একটা সময় আছে। এই মাইয়া খোকনরে মারছে। ফারাজের আগুন সুন্দরীর চাদর হইছে। আমি ওরে এমনি এমনি ছাইড়া দিমু? না। ওরে বাঁচায়া রাখ। চিত্রারে দেখাইতে হইবো মাইয়া মানুষ যদি মুখ উঁচায়, তার পরিণতি কি হয়। যেদিন চিত্রা ফিরবো, সেদিন এই মাইয়ার লাশ ফেলবি ওর সামনে। নাটক সাজায়া। তার আগে যদি এই মাইয়া মরে তাইলে তোগোরেও ওর লগে মেঘনায় ভাসামু।”
সবাই থম মেরে যায়। এমনকি বাতাসও বুঝি থেমে শোনে রাজনের কথা। তখনই জোহান ঠান্ডা কণ্ঠে বলে ওঠে, “চিত্রাকে দেখানোর দরকার কেন? ওর তো এসবের সাথে কোনো সম্পর্কই নাই।”
রাজনের চোখদুটো অন্ধকারে চকচক করে ওঠে। গলায় বিষ মেশানো শব্দে সে বলে, “আজ নাই। কাল থাকবো না? চিত্রা জানে খোকন আমার লোক। কাল যদি ওর কানে কাহিনী যায়, সন্দেহ আমার ওপরই পড়বে। আর তাছাড়া, ফারাজ ওরে বিয়া করছে ক্যান? ওই তালুকদার বাড়ির রক্ত বইতেছে ওর শরীরে। এত পিরিত মারাইতাছে কেন?”
জোহান এবার একটু এগিয়ে বসে। স্বর গভীর হয়ে আসে, “ওই চিত্রারে আমি চাই ভাই। যে কোনো মূল্যে।”
রাজন এবার হাসে। একটা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেউ যেমন সুখ পায়, তেমন তৃপ্ত হাসি, “একটা মাইয়ার লাইগা ফারাজের বিপক্ষে যাইবি তুই?”
জোহান ঠান্ডা গলায় বলে,“শুধু ফারাজ না, দরকার হইলে পুরো দুনিয়ার বিপক্ষে যামু।”
ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে আসে। বাতাস ঘন হয়ে নামে বুকের ওপর। নদীর কলকল ধ্বনিও এঘরে ঢুকতে সাহস পায় না। দৃষ্টি এক হয়ে আটকে থাকে মাটিতে পড়ে থাকা মিতালির দিকে। একটা র*ক্তাক্ত দেহ, নিঃশ্বাস আর যন্ত্রণার মাঝখানে দোল খাচ্ছে। অথচ কোন শব্দ নেই তার। আকবর চেয়ে থাকে। চোখে নিঃশব্দ ভয়। একটা শুষ্ক ঢোক গিলে নেয় সে। চিত্রার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু চিত্রা নামটা শুনলেই তার মাথায় বাজে একটা ঘণ্টাধ্বনি। মূল কারন ফারাজ এলাহী। চিত্রা মানেই এখন ফারাজ। আর ফারাজ এলাহী মানেই অনিবার্য ধ্বংস। ভেবে পায় না আকবর। বিষয়টা এতটা জটিল হয়ে উঠল কীভাবে? কাহিনী তো সরল ছিল। মিতালিকে মেরে ফেললেই তো হতো। মুখ বন্ধ, ঝামেলা শেষ। কিন্তু রাজন ভাই প্রতিশোধের নামে র*ক্ত খেলা শুরু করল। আর মিতালি? এখনও কিছু বলেনি সে।
কণ্ঠস্বর নেই, ভাষা নেই। কেউ তাকে শোনার সুযোগই দেয়নি। তবু আকবর জানে, সত্য যত চেপে রাখা হোক এভাবে বাঁচিয়ে রাখলে সেটা একদিন মুখ ফুটে বেরোবে। তখন যে আগুন জ্বলবে, তাতে কেবল রাজনের পরিকল্পনা নয় আকবর নিজেও ছাই হয়ে যাবে। কারণ সে জানে খোকনকে সেই রাতে মিতালি মারে নি। বরং সে নিজেই খোকনকে খতম করে। ঠান্ডা মাথায় একেবারে নিজের জায়গা দখলের জন্য। রাজনের বিশ্বাসটাকেই সে ব্যবহার করেছে। খেলার নামে মূল চাল সে নিজেই দিয়েছে। আকবর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে থেকে দেখতে শান্ত, অথচ ভিতরে ভেঙে পড়া আতঙ্কের একটা পাথর বুকের ওপর চেপে বসে আছে। মনে মনে একটা কথাই ঘুরপাক খায় যদি রাজন জানতে পারে? যদি মিতালি বলে ফেলে? যদি ফারাজ এলাহী চিত্রাকে জড়ালে নিজেও এসবে প্রবেশ করে?সে জানে, যদি ফারাজ ঢোকে এই অন্ধকারে, তবে মৃ*ত্যুর প্রথম ডাকটা তার দিকেই যাবে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আবার ঢোক গিলে। কপাল বেয়ে ঘাম নেমে আসে জুলফি ঘেঁষে। চোখে কিছু পড়ে না, কানেও যেন কিছু আসে না। এখন তার দৃষ্টি, চিন্তা সবটাই ঘিরে আছে একটি নামকে নিয়ে। ❝ফারাজ এলাহী।❞
ফারাজের গায়ে এখন শুভ্র একখানা মসৃণ, স্নিগ্ধ পাঞ্জাবি। শেষ কবে পাঞ্জাবি পরেছিল সে? স্পষ্ট মনে পড়ে না। হয়তো বহু বছর আগে, কোনো উৎসবে, অথবা কোনো স্মৃতিমাখা বিকেলে। আজ সে আবার পরেছে। কার জন্য? চিত্রাঙ্গনার জন্য। তার বুক পাঁজরের হার থেকে সৃষ্টি অর্ধাঙ্গিনীর জন্য? এতটা ভালোবাসে ফারাজ তাকে?আজ-কাল ধ্যান বলতেও বউ ছাড়া মাথায় কিছু আসে না। স্নানশেষে বিছানায় পায়জামা-পাঞ্জাবি রাখাই ছিল। নিপুণভাবে গুছানো। কে রেখেছে? চিত্রা? নিশ্চয়ই। কিন্তু ঘরে তার দেখা নেই। দরজা বন্ধ, জানালার পর্দা অল্প হেলে আছে মেঘলা বাতাস ঢুকছে ভেতরে। সেই হাওয়ায় মোমবাতির শিখা কাঁপছে ক্ষীণভাবে। আলো যেন আর আলো নয় একটা গোটা মায়ার আবরণ। ঘর সাজানো এত নিখুঁত, এত নরম ছোঁয়ায়, যেন এ বাস্তব নয় স্বপ্নের নিভৃত গহ্বরে প্রবেশ করেছে সে। বিছানায় গোলাপচাপা রঙের চাদর, চারপাশে ছড়ানো সুবাসিত ধূপ।মেঝেতে ছড়িয়ে কিছু পাঁপড়ি, আর সেই ক্ষীণ আলোর ভেতর একটা স্বপ্নময় নীরবতা। তবু ফারাজ কোনো ব্যাখ্যা খোঁজে না। তার স্বভাবেই অনুপস্থিত কৌতূহল। সে শুধু অনুভব করে।
পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়াতে চড়াতেই তার দীর্ঘ, চওড়া বুক আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঠিক যেন কোনো পৌরাণিক চরিত্র বাস্তবের রূপ নিয়েছে। পেশিগুলো এতটাই ছাঁটা আর সুনির্মিত যে মনে হয়, প্রকৃতি নিজ হাতে তাকে গড়েছে এক অনবদ্য ধৈর্যে। তার চোয়াল দৃঢ়, কণ্ঠদেশ গভীর ও পুরুষালি। চোখ দুটো—ধূসরতায় ভরা অথচ অদ্ভুত একটি চুম্বকীয় টানে আটকে আছে দৃষ্টি। ফারাজ নড়লে মনে হয়, ছায়াও তার অনুগত হয়ে নড়ে ওঠে। সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নাটি সাধারণ৷ সেই একঘেয়ে আয়না। কিন্তু আজ সেই আয়নার মধ্যেও নতুন প্রাণ এসেছে। ফারাজের প্রতিফলিত অবয়ব এতটাই নির্মল, এতটাই অনবদ্য, স্বয়ং আয়নাও তাকে দেখে নিজের ধুলোমলিনতা ভুলে গেছে।
নুপুরের ক্ষীণ, তীক্ষ্ণ শব্দে ফারাজ হঠাৎই পিছন ফিরে তাকায়।
ঘরের নিভু নিভু মোমের আলোয় এক মুহূর্তের জন্য তার চোখ স্থির হয়ে যায়। মেরুন রঙের জরজেট শাড়িতে মোড়া চিত্রা যেন একটা অগ্নিকন্যা। শাড়ির পাতলা কাপড় তার শরীরের ওপর মেখে আছে শিশিরের মতো। ভেতরের প্রতিটি রেখা, প্রতিটি ভাঁজ যআলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মেতেছে। কোমরের ঠিক নিচে শাড়ির ভাঁজটা এতটাই নিখুঁতভাবে বসে আছে যে, ফারাজের চোখ সেখানে আটকে যায় অসহায়ভাবে। চিত্রার কটিদেশ ফর্সা, কোমল, অথচ জাদুকরী একটা উষ্ণতা ছড়ায় চারপাশে। মোমের আলো সেই স্থানে পড়তেই অনির্বচনীয় জ্যোতি ফুটে ওঠে। সে এগিয়ে আসে ধীরে, হাতে একখানা মোম, যার শিখা দুলছে হাওয়ার দোলায়। চিত্রা বারান্দার টাইগ্লাস খুলে দেয়। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি দমকা হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘরের মধ্যে। সেই বাতাস তীক্ষ্ণ কোনো অস্ত্র। চিত্রার শরীরের বাঁক ভেদ করে বয়ে যায়। তার খোলা চুল, শাড়ির আঁচল, আর হাতের মোম, সবকিছুই বাতাসে দুলে ওঠে এক অমোঘ ছন্দে। হুট করে মোম নিভে যায়। অথচ আলো যেন নিভে না। চিত্রার শরীর থেকে যেন জ্বলে ওঠে অন্য একটা দীপ্তি। ফারাজ তাকিয়ে থাকে। নিঃশব্দ, নিঃস্পন্দ। তার চোখে প্রশ্ন নেই, জিজ্ঞাসা নেই। আছে কেবল মোহ, একটা চিরচেনা তৃষ্ণা। এই আগুন সুন্দরীর রূপে মোজে গেছে সে। মোহগ্রস্ত নয়, বন্দি।
চিত্রা ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। মোমবাতির আবছা আলোয় তার ছায়া জমাট বাঁধা অনুভব। ফারাজ তার চেয়ে অনেক দীর্ঘ-লম্বা। চিত্রার উচ্চতা তার বুক অবধি। সে একটানা তাকিয়ে থাকে। এমন পুরুষের চোখে চোখ রাখলে হৃদয়ের ঝড় নিশ্চিত। আজ প্রথমবারের মতো সে নিজের স্বামীকে এমন শুভ্র, নির্মল পাঞ্জাবিতে দেখছে। লোকটা কতখানি আকর্ষণীয়। ফারাজ চিত্রার উপস্থিতিতে নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। চোখ স্থির হতে চায় না। চোখ একবার মেরুন শাড়ির মোহময় রেখায় ছুটে বেড়ায়, তো আবার রক্তিম ওষ্ঠের রহস্যে ডুবে যায়। হঠাৎ সে চিত্রাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। তার শিরাগুলো ফুটে থাকা হাত চিত্রার কোমর বেয়ে নেমে আসে নিঃশব্দে। চিত্রা ফারাজকে ছুঁতে পায়ের ভরসা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু সে পৌঁছাতে পারে না। ফারাজ তখন ডান হাত দিয়ে তাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। এক লহমায় তুলে আনে নিজের হৃদয়ের সমান উচ্চতায়। চিত্রা তার পাঞ্জাবির কলার শক্ত করে চেপে ধরে। আর কোনো শব্দের প্রয়োজন পড়ে না। সে নিঃশব্দেই ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। সমস্ত আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, আর ভালোবাসা ওই এক চুম্বনে ঢেলে দেয়। চিত্রার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে। সে ফারাজকে থামানোর চেষ্টা করে। গালে হাত রেখে আবছা আলোয় আকুতি ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি আমার কলঙ্ক হবেন?”
“কলঙ্ক কেনো?”
“জানেন না? নারীর গায়ে একবার লেগে যাওয়া কলঙ্ক কখনো মুছে না। থেকে যান না যেমনি থেকে যায় নারীর গায়ে লেপ্টে দেওয়া কলঙ্কগুলো।”
“কতকাল কলঙ্ক হয়ে তোমাতে মিশে থাকতে পারবো?
“আমৃত্যু । নারী মরলেও কলঙ্ক তার পিছু ছাড়ে না।আমি মরলেও আপনি আমার কলঙ্ক হয়ে আমার মধ্যিখানে বেঁচে থাকবেন।”
ফারাজ চুপ হয়ে রয়। চিত্রা আবারও বলে উঠে,
“ফারাজ!” কন্ঠে অনুনয়।
“হু।” নেশালো কন্ঠে জবাব দেয় ফারাজ।
“একটা জিনিস দেখানোর বাকি আছে।”
“আরও? এই রুপ দেখিয়ে কতবার যে ভেতর ভেতর মরেছো তাতে তৃপ্তি মেটেনি?”
“কি যে বলেন। আপনি আমার বেঁচে থাকার কারন। আপনাকে মারলে আমি বাঁচবো কেমন করে?”
সময় থমকে দাঁড়ায়। ফারাজের চোখে ছায়া নেমে আসে। বাঁধন আলগা হয়, দেহ নরম হয়। চিত্রা ধীরে তার হাত ধরে। তাকে টেনে নিয়ে আসে বিছানায়। একান্তে, নীরবতার মোড়কে আবৃত আশ্রয়ে। বাইরে ধমক দিয়ে উঠেছে বাতাস। জানালার পর্দা দুলে ওঠছে। যেন সাক্ষী দিচ্ছে এই প্রহরের। এক অদ্ভুত সুন্দর মুহূর্ত। যেখানে পাপ আর প্রেম একে অপরের মুখোমুখি। আকাশ এবার কাঁদবে ঠিকই, তবে যন্ত্রণার জন্য নয়। এই কান্না হবে প্রণয়ের জলে ভেসে যাওয়া দুই বিপরীত সত্তার মিলনের জন্য।
চিত্রা নিভু নিভু মোমের আলোয় টেবিলের ওপরে রাখা রেড ভেলভেট কেকটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে ফারাজের দিকে। হাওয়ায় দুলতে থাকা তার চুল, চোখে গভীর মায়া। ফারাজ স্তব্ধ চোখে চেয়ে থাকে তার দিকে। টেবিলের পাশটায় বসে চিত্রা চুপিসারে বলে ওঠে, “আজ আমাদের বিয়ের এক মাস। ভুলে গেলেন সোনাবর?”
এই সোনাবর ডাকটা ফারাজের অন্তর জুড়ে অনুরণন তোলে। সে থমকে যায়। কিছু বলার আগেই চিত্রা ছুরি দিয়ে কেক কেটে একটুকরো ফারাজের মুখে তুলে দেয়। ফারাজও তার জন্য তুলে নেয় আরেক টুকরো। কিন্তু চিত্রা আচমকা ফারাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ঠোঁটে চেপে ধরে এক আকুল চুমু।
চারপাশে ছড়িয়ে আছে অগণিত লাল গোলাপ। মেঝেতে, বিছানায় হাওয়ায় ওরা উড়ছে। ভালোবাসার প্রতীক হয়ে। সাদা বিছানার চাদরে গোলাপের পাপড়িগুলোর রক্তলাল দেখাচ্ছে। ফারাজ আলতো করে চিত্রার মুখ থেকে চুল সরিয়ে দেয়। তার চুলে মুখ ডুবিয়ে দেয়। মাদকতায় পূর্ণ হয়ে পড়ে তার সত্তা।
বাইরে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। জানালায় জলের ছিটেফোঁটা থামতে চায় না। কিন্তু ঘরের এই দুই মানুষের মন আজ নিঃসীম এক জগতে প্রবেশ করেছে। ফারাজ চিত্রার কাঁধে হাত রেখে তাকে ধীরে ধীরে শুইয়ে দেয় বিছানায়। হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে ঘরের সব মোমবাতি নিভিয়ে দেয়। ঘর ছেয়ে যায় কালো এক রহস্যে। চিত্রা আজ ভয় পায় না। না অন্ধকারে, না মেঘের গর্জনে। এ রাত ভালোবাসার রাত। শরীরের বাঁধন ছিঁড়ে আত্মা আজ একে অপরের দিকে ছুটে চলেছে। ফারাজ ঝুঁকে পড়ে তার ওপরে। চিত্রা দুহাত বাড়িয়ে দেয়। তাকে বুকে টেনে নেয় অনির্বচনীয় আকর্ষণে। গলা দিয়ে ভেসে আসে গান,
“এ হৃদয়ে জ্বলছে এক যাদুর মোমবাতি
তুমি আগুন হয়ে পুড়ছ আমায়
সারা দিবারাত্রি…”
শব্দগুলো ঘরের বাতাসে গলে যায়। চিত্রার দেহ কেঁপে ওঠে, নিশ্বাস ভারী হয়। আগুন আর জলের মতো তারা মিশে যেতে থাকে একে অপরের মাঝে। ফারাজের আকাঙ্ক্ষা ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠে।
চিত্রার নখের আঁচড়ে তার পিঠ জর্জরিত, রক্তিম ক্ষত সৃষ্টি করে। কিন্তু সেই ব্যথায়ও আনন্দ আছে।এক রকম মুক্তি, তৃষ্ণা মেটানোর উন্মাদনা জড়িয়ে আছে। ফারাজ থেমে যায় না। থামে না চিত্রা। তারা হারিয়ে যায় অন্ধকার এক যুদ্ধে। যেখানে ভালোবাসা, কামনা আর মোহ মিশে গিয়ে সৃষ্টি করছে এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। সময় থেমে যায়। শুধু নিঃশ্বাস আর হৃদয়ের ধুকপুক শব্দে ঘরটা গুঞ্জরিত হয়ে থাকে। চিত্রা ফারাজের গালে হাত বুলিয়ে কোমল গলায় বলে,
“আজকের রাত আপনার আমার। বলুন কী চাই আপনার?”
ফারাজ মৃদু হাসে। অন্ধকারে সেই হাসির ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে না সহজে। হয়তো তাতে ভালোবাসা, নয়তো নিছক প্রলয় মিশে আছে। সে চিত্রার ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। কানের কাছে মুখ এনে ধীরে ধীরে হিসহিসিয়ে বলে—
❝আমি তোমার মনের ভেতর
একবার ঘুরে আসতে চাই
আমায় কতটা ভালবাস
সে কথাটা জানতে চাই
ভালবাসার যত কথা
হৃদয় দিয়ে শুনতে চাই
তুমি শুধু আমার হবে
পৃথিবীকে বলতে চাই❞
সময় গড়ায়। বাড়তে থাকে ঝড়ের বেগ। সঙ্গে দেনাপাওনার গল্পগুলোও উত্তাল মৃত্তিকায় হারিয়ে যায়।
অভ্র ভেজা শার্টটা খুলে নির্বিকার ভঙ্গিতে বাস্কেটের দিকে ছুঁড়ে ফেলে। হাতের কাছে কোনো চার্জার লাইট না পেয়ে, ফোনের ফ্ল্যাশলাইটই চালু করেছে সে।ওয়াশরুমে ঢুকে প্যান্ট বদলে ট্রাউজার পরে ফিরে আসে অভ্র। বিছানার কিনারে, আয়েশা কুঁকড়ে শুয়ে আছে। আতঙ্ক আর অস্পষ্ট ক্লান্তিতে মিশে থাকা এক অবিন্যস্ত নীরবতা তার চারপাশে। অভ্র কঠিন, স্পষ্ট স্বরে তাকে বলেছে এখানে শুয়ে থাকতে। তার স্বর যেন আপত্তি কিংবা প্রশ্নের জন্য কোনো অবকাশ রাখে না। পাশে এসে বসে অভ্র।উদার, উদাম শরীর নিয়ে। ভেজা চুল কপালের উপর এলিয়ে আছে, সেখান থেকে টুপটুপ করে পানি ঝরে পড়ছে। লোমশ, ফর্সা বুক উন্মুক্ত, পেশিগুলো নিখুঁতভাবে আঁকা কোনো কাঠামোর মতো। চওড়া কাঁধ, দৃঢ় গড়ন। অভ্র তাকিয়ে থাকে আয়েশার দিকে। নিস্তব্ধ, অনড় ভাবে।আয়েশা তাকিয়ে আছে খোলা জানালার বাইরে। সে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না এতক্ষণ যাবৎ কেন সে এই পুরুষের ঘরে,তার বিছানায় কি করছে? কি অস্তিত্বকর! কি লজ্জা। তাকাতেও পারছে না আয়েশা। একবার জেদ করে উঠতে চায়৷ চেষ্টা করে, ব্যর্থ হয়। পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। মাথায় আসে অভ্রকে বলতে পারে কি না, তাকে কোলে করে তার নিজের রুমে পৌঁছে দিতে। কিন্তু কথাটা ঠোঁট পর্যন্ত গিয়েও আটকে যায়। লজ্জায়। দ্বিধায়। কিংবা অভ্রর কঠিন উপস্থিতির ভারে।
“পা দাও। দেখি, মলম লাগিয়ে দিই।”
অভ্র হাত বাড়াতেই, আয়েশা আঁতকে পা সরিয়ে নেয়।
“মাথা খারাপ নাকি তোমার? তুমি আমার পা ধরবে? দয়া করে এসব করে আমাকে লজ্জায় ফেলো না।”
অভ্র হালকা ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকায়,
“বাহ! চমৎকার ব্যবহার! সুন্দর ব্যবহার সুন্দরীদের বেশ মানায়।”
“আপনি… আমার কথা বললেন?”
“তাই মনে হলো বুঝি? আমি তো সুন্দরীদের কথা বলেছি। তুমি কি নিজেকে তাদের কাতারে ভাবো?”
আয়েশার মেজাজ গরম হয়ে ওঠে। কিছুটা আগে পর্যন্ত যে মানুষটাকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল, সে মুহূর্তেই পরিষ্কার হয়ে যায়। এই লোকটা ভালো হওয়ার অভিনয়টাও ঠিক করে করতে পারে না।
“আমি আমার রুমে যাবো। সামনে থেকে সরে দাঁড়াও।”
অভ্র নীরস মুখে বলে, “গিয়ে তো দেখো মেয়ে।”
“দেখাচ্ছি।”
আয়েশা উঠে দাঁড়াতে যায়, কিন্তু গতি পায় না। পা সেঁটে যায় যন্ত্রণায়। পড়ে যাওয়ার আগে অভ্র ধরে ফেলে। শক্ত হাতে আবার বিছানায় শুইয়ে দেয়।
“এত জিদ দেখাচ্ছিস কেন? অভ্রনীল সরকার তোকে সাহায্য করছে। তোর তো কপাল ভালো।”
“তোর মতো দরকার,আমার নাই কোনো দরকার।” কটাক্ষে মুখ ভেংচায় আয়েশা।
সে আবার জিদ করে উঠে দাঁড়াতে চায়। এবার অভ্র ধমকে ওঠে। চোখে কঠোরতা, কণ্ঠে চেপে রাখা আগুন। আয়েশার পা নিজের উরুর উপর রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “আমার সামনে জিদ চলবে না। যে জিদ তুমি দেখাচ্ছো, তা অভ্রর পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে থাকে।”
অভ্র ফোনটা রেখে। যত্নে আয়েশার পায়ে মলম লাগাতে শুরু করে। শক্ত আঙুলে মালিশ করে দেয় গভীর মনোযোগে।
“হাঁটুটাও তো বেশ ছিঁড়ে গেছে। ওখানে আমি স্পর্শ করতে পারবো না। নিজেই পরে মলম লাগিয়ে নিও। আর শোনো, আজকে আর কারেন্ট আসবে না। তোমার এখানে থাকাটাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। আমি ডিভানে শুয়ে পড়ছি। আশা করি, এতে কোনো আপত্তি নেই।”
আয়েশা কিছু বলতে চায়, কিন্তু গলা শুকিয়ে আসে। কথা আটকে যায় ঠোঁটে। ইদানীং কেনো জানি এই লোকটার প্রতি একরকম দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কেন? এই লোক পাহাড়ের মতো নির্দয়, অথচ ছায়ার মতো পাশে থাকে। মাটি হয়ে চাঁদ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখা পাপ। নিষিদ্ধ। কিন্তু মানুষকে কে বুঝাবে? তাদের যে নিষিদ্ধ জিনিসের ওপর আকর্ষন বেশি।
মধ্যরাত। আকাশ থেকে এখনও টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির নিরব বিরহ। চারপাশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন, কেবল মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকে অল্প সময়ের জন্য আলোকিত হয় ভিজে উঠোন। দরজায় প্রচন্ড করাঘাত করা হচ্ছে। রাশেদা তখন গভীর ঘুমে। বৃষ্টির ঠান্ডাভাব তাকে কুঁকড়ে রেখেছে উলের চাদরের নিচে। বাইরে কী হচ্ছে, সে কিছুই টের পাচ্ছে না। তার মেয়ে ও মেয়ের জামাই আজ সন্ধ্যেবেলা নিজ বাড়ি গেছে। রাশেদার স্বামী আবার দারোয়ান, আজ রাতেও নাইট ডিউটি। বাড়িতে একা রাশেদা।ধাক্কাধাক্কির আওয়াজটা যখন টানা হতে থাকে, তখন ধীরে ধীরে ঘুমচোখ খুলে যায় তার। বিরক্তভাব নিয়ে উঠে বসে। চোখ কচলায়, হাই তোলে। ছায়ার মতো ঘরের অন্ধকারে পা টেনে টেনে এগিয়ে আসে দরজার দিকে। বৃষ্টির একঘেয়ে শব্দে তার ধৈর্য কমে আসছে। সে ক্লান্ত কণ্ঠে দরজা খুলে বলে ওঠে,
“এরে ভাই, কেডা গো? এত রাইতে কি চাই তোমার?”
দরজা খুলতেই সে তার সামনে একজন লোককে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়। লোকটা লম্বা , সারা গায়ে গাঢ় কালো রেনকোট, মাথায় হুড তোলা। মুখ দেখা যাচ্ছে না। কেবল ভেজা কাপড় থেকে জল টপটপ করে পড়ছে। তার উপস্থিতি ঠাণ্ডা বাতাসে হাড়ে হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। সেই অচেনা মানুষটি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলে,
“আপনার একটা পার্সেল আইছে।”
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৭
রাশেদা একটু বিচলিত হয়। পার্সেল? কিসের পার্সেল? তাও এত রাইতে?
“কি? কি পার্সেল আনছো?”
“মৃ*ত্যু। মৃ*ত্যু আনছি। ম্যাডাম পার্সেলটা নিবেন না??