চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৯

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৯
ইশরাত জাহান জেরিন

অবাক করা এক সকাল। গা সজাগ করা হালকা শীত আর ভেজা হাওয়ার মধ্যে চিত্রা গোসল সেরে জলপাই রঙের শাড়িটা পরেই একদম অন্য রকম হয়ে উঠল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খানিকক্ষণ গভীর মনোযোগে দেখল সে। চোখে মুখে একটা প্রশান্তির ছোঁয়া। বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে ফারাজ। গায়ে চাদর। ঘরের ভেতর এসির ঠান্ডায় শরীর জমে গেলেও, ওর মুখখানা প্রশান্তির প্রতিমূর্তি। এই মানুষটা গরম একদমই সহ্য করতে পারে না। সামান্য গরমে এলার্জি হয় শরীরে। লাল হয়ে যায় ত্বক। আজ শান্তিতে ঘুমাচ্ছে ফারাজ। চিত্রার ওকে জাগাতে মন চাইছে না। ভালোবাসার মানুষ যখন ঘুমায়, তখন তা দেখেও শান্তি লাগে।

ঘরের অগোছালো দশার দিকে তাকিয়ে চিত্রা একটু বিরক্ত হলেও নিজের ভিতরের স্নিগ্ধ ভালোবাসায় আবারও নরম হয়ে যায়। কাল কিশোরগঞ্জ ফিরতে হবে। এই শহর, এই বৃষ্টি, এই রঙিন দিন পেছনে ফেলে যেতে হবে। এই শহর চিত্রাকে অনেক কিছু দিয়েছে। ভালোবাসা, অনুভব, আর এক নতুন জীবন। চিত্রা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সামনে বিস্তৃত বাগানটা চোখে পড়ে। হালকা ভেজা বাতাসে চুলগুলো ভিজে থাকে বলে তোয়ালে দিয়ে মুছে নেয় সে। কিন্তু পানি ঠিকই টুপটাপ ঝরে পড়ে। আবারও চুল পেঁচিয়ে তোয়ালে জড়ায়। নিচে বাগানে বজ্র ব্যায়াম শেষে চুপচাপ বসে আছে। প্রথমে চিত্রা তাকে খেয়াল না করলেও বজ্র কিন্তু উপর থেকে তাকানো চোখ এড়ায় না। খানিক চেয়ে থেকে হঠাৎই চোখ নামিয়ে নেয় বজ্র। সেই সময়ই চিত্রার নজর তাট ওপর পরে। চিত্রা তাকে ডাক দিতে যায় কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বের হওয়ার আগেই পেছন থেকে এক জোড়া হাত কোমরে এসে জড়ায়। পিঠে ওষ্ঠের ছোঁয়া ঠেকতেই চিত্রা শিহরণে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ফারাজ… কেউ দেখে ফেলবে,” কণ্ঠটা নরম। কিন্তু তাতে একটা স্নিগ্ধ সতর্কতা।
“যারা দেখবে, তাদের চোখ তুলে ডোনেশন করে দিবো,” ফারাজের গলায় দম্ভ ছেলেমানুষি।
“কি সব ভয়ানক কথা যে বলেন আপনি!”
“শুধুই কি কথা? ভয়ানক কাজগুলো কি সোহাইগ্গা এসে করে দিয়ে যায়?
“ধুর, সকাল সকাল একখান অশুভ নাম শুনালেন। মনটাই ভেঙে গেল।”
“আসো, একটা চুমু দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দেই।”
“বাপরে আপনার চুমুতে এত পাওয়ার?”
“বিবিজান! আমার চুমুর শক্তি ফ্যাবিকলের আঠার থেকেও বেশি। বিশ্বাস না হলে কাছে আসো। চুমু দিয়ে পরীক্ষা করে দেখো। এক চুমুতেই তোমার ভাঙা মন জোড়া লাগবে।”
চিত্রা হেসে ওঠে। চোখে খেলে যায় দুরন্ত হাসির রেখা। “মাইরি! এভাবে বলছেন, মনে হচ্ছে ফুতপাতের কোণে বসে চুমু দিয়ে ভাঙা মন সারানোর ব্যবসা করতেন আগে!”

“না করিনি। তবে বউ তুমি বললে শুরু করতে পারি। তোমাকে বিয়ে করার পর যাদের হৃদয় ভেঙেছে সার্ভিস তাদের দিয়েই শুরু করব!”
চিত্রা কিছু বলার আগেই ফারাজ তাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে শক্ত একটা চুমু দিয়ে সবটা বুলিয়ে দেয়। সকল শব্দ মুছে যায়, শুধু থাকে স্পর্শের ভাষা। বজ্র সেই দৃশ্য দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দুই হাত মুঠো করে ফেলে। কপালের শিরা ফুলে ওঠে। চোখের কোনায় জমানো আগুন গিলে ফেলে সে। বজ্র একটা ঢোক গিলে আওরায়, “যেই ফুলকে ধ্বংসের জন্য এত আয়োজন সেই ফুলের মালি কিন্তু আমি। ফুল ছেঁড়ার আগে মালির মুখোমুখি হওয়ার প্রবাদটা ভুলে গেলি?”

ঘুম ভাঙতেই অভ্র বুঝতে পারল সে নিজের বিছানায়। তবে এমন কিছু একটা দেখে যার ফলে তার শরীর কেঁপে ওঠে। মুখের সামনে দু’টো পা!
ভ্রু কুঁচকে চোখ কচলে তাকাতেই যেন চোখ দু’টো গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। এটা তো আয়েশার পা! অভ্র এক লাফে উঠে বসে।
“এই মেয়ে, ঠ্যাং তোলার জায়গার এত অভাব ছিল যে আমার মুখটাই পছন্দ হলো?”
আয়েশা চমকে উঠল চেঁচানোর শব্দে। এলোমেলো চুল আর ভ্যাবাচ্যাকা মুখ নিয়ে তাকাল অভ্রর দিকে। মাথা চুলকে কোনোভাবে স্মৃতি ঝাঁকিয়ে তোলার চেষ্টা করল। পরমুহূর্তেই মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল।
“এই আমি কি সারারাত… মানে… এই লোকটার মুখের কাছে পা রেখে ঘুমিয়েছিলাম?” আয়েশার মনে হঠাৎই আশঙ্কার ঢেউ। পায়ে গন্ধ ছিল নাকি? একটু শুঁকে দেখবো? না না, অভ্রর সামনে এসব ভাবাও পাপ। ছ্যাহ! এমন কাজের কথা লোকে জানলে তো তার সামাজিক আত্মহ*ত্যা নিশ্চিত!
নিজেকে যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়ে সে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, “এই সরকারি বেটা! এখানে কেমনে কি? খাটে কেন ইউ? বাজে কিছু করিসনি তো? ইউকে তো আমি চিনিই!”

অভ্র চোখ সরু করে তাকিয়ে বলল, “ভরসা তো আমারও তোকে নিয়ে নেই। ঘুমিয়ে পড়ার পর তুইই আমাকে দেখে লোভ সামলাতে পারিসনি। কোলে তুলে নিয়ে এসেছিস খাটে, নিজের পাশে! আসতাগফিরুল্লাহ!”
“আমি তোকে কোলে তুলব? আমারে কোন দিক থেকে তোর কুলি মনে হলো?”
“তুলেছিসই তো! আমি হাল্কা-পাতলা ছেলে বলে এসব করতে পারলি? আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম।তোর যৌবনে ঠ্যাডা পড়বে। আমার ইজ্জতের আর কোনো দাম থাকল না! এসব যদি আমার ভবিষ্যৎ বউ জেনে যায় তখন আমি তার সামনে কী করে মুখ দেখাবো শালী?”
আয়েশা ইতিমধ্যে টেবিল থেকে টিস্যু বক্স নিয়ে একটা টিস্যু নিয়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিলো। “হইছে, কাঁদিস না আর। চল বিয়ে করে, বাচ্চা পয়দা করি। শালা তোমার ইজ্জত তো বাঁচাতে হবে এখন।”
অভ্রর মন তখনও ধাক্কা খায়। মনোযোগ অন্যদিকে থাকার কারনে খেয়াল করে নি। টিস্যু দিয়ে নাক মুছে বলে, “কি বললি? আবার বল, ঠিকমতো শুনি নাই।”

“কিছু না… আসলে… লজ্জা লাগছে রে, অভ্র।”
“নিজেকে লজ্জাবতী ভাবছিস? তোদের মতো মেয়েরাই তো নিজেকে লজ্জাবতী ভেবে লজ্জাবতী গাছের মানহানি করে। এখন আর আমার মতো ভালো ছেলেদের সমাজে নিরাপত্তা কোথায়? তোকে আজ শালিসে তুলবো আমি!”
আয়েশা উঠে দাঁড়াল। ঠোঁট বাঁকিয়ে মুখ ভেংচালো। তার মন বলে উঠে, “এই সরকারকে এখনই তুলে বিয়ে করে ফেল আয়েশা। কমপক্ষে, বাচ্চাগুলো তো একেবারে অভ্রর মতো ফকফকা পয়দা হবে।
আয়েশা উঠে যেতে নিলে অভ্র পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরে। আয়েশার হৃদপিন্ড বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে পিটপিট করে অভ্রর দিকে তাকায়। এই মা অভ্রকি তাকে চুমু টুমু খেয়ে সকালের নাস্তা করিয়ে দিবে নাকি? আয়েশা মুখে হাত দিয়ে তাকাতেই অভ্র বলে উঠে, ” ডাব চুন্নী তুই আমার টিস্যুর বক্স রেখে তারপর যাহ্।”
আয়েশার নিজের হাতের দিকে তাকাতেই দেখে টিস্যুর বক্স। ছ্যাহ! বালের একটা কপাল। এমন সময় এইসব না হলে কি হতো না? এভাবে চললে তো শেষ পর্যন্ত পার্পেল কালারের জাদু করে এই চেংড়িমাছকে বশ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
“কিরে সিল মারা চুন্নি আমার টিস্যু রাখ।”

সকাল হতে না হতেই গোটা পাড়া সরগরম হয়ে উঠেছে। নিখোঁজ রাশেদা বেগমের খবরে এলোমেলো হয়ে গেছে আতিকুল সাহেবের জগৎ। কী করবেন, কোথায় যাবেন কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। মেয়ে আর জামাই মাত্র গতকালই নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল। খবর পেয়েই তড়িঘড়ি করে ফিরে এসেছে তারা। মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়েছে।মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, মায়ের নাম ধরে চিৎকার করছে। প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। জান্নাত আর মার্জিয়া সকাল থেকেই পাশে আছে। সোহাগ বেরিয়ে গিয়ে মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে এসেছে। তবে মাহাদী এখনো দেখা দেয়নি। সর্দি-জ্বর আর গলা বসে যাওয়ার কারণে সে বিছানায় শুয়ে আছে। মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে মারিয়া।

“কি কইরা ঠান্ডা লাগাইছেন?”মারিয়া উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করল।
“জানগো… শরীরটা ভালো না। কথা বলতেও মন চাইতাছে না,”ম্লান গলায় জবাব দিল মাহাদী।
“আপনার কাজকাম বুঝি না। রাতভর বাইরে থাকেন, দিনে থাকেন ঘরে। কী শুরু করছেন এসব?”
“কাজই তো করি, বউ। নাইট ডিউটি নিছি। আগের জায়গাতেই কাম করি, তবে এবার বেতনটা বেশি। তাই আগের শিফটটা ছাইড়া দিছি ।”
“বেতন দিয়ে কী হইবো?যদি শরীরটাই ভালো না থাকে আপনার? এই ডিউটি ছাড়েন, দরকার নাই আমার বেশি টাকা।”
মাহাদী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “না রে মারিয়া, ছাড়তে পারমু না। এই কাম… আমারে শিকরের মতো জড়াইয়া ফেলছে।”
তার কণ্ঠে ক্লান্তি । কথাটা যেন মাটি ফুঁড়ে বেরোনো শিকড়ের মতোই রহস্যময়। মারিয়া বোঝে না, বা বোঝার ভান করে না। সে নিচু গলায় স্বামীকে জানায়, “রাশেদা খালারে খুঁইজা পাওয়া যাইতাছে না।”
মাহাদী চোখ বন্ধ করেই উত্তর দেয়, “তাতে তোমার কী? হয়তো কোথাও গেছে… ফিইরা আসবো। দুনিয়ার কথা ভাইবা আয়ু ফুরানোর দরকার নাই। এদিকে আসো। তোমারে একটা চুমা দেই? কপালটা সামনের দিকে আনা তো।”
মারিয়া লজ্জা পায়। তার দিকে তাকিয়ে বলে, “ইশশ… আপনার না অসুখ?”

নিহান আজকে চলে যাবে। এই সত্যটা সকাল থেকেই ফারিয়ার মনে বিষাদের ছায়া ফেলেছে। কেন এমন হয়? কেন এই পুরুষটাকে সে সারাজীবন নিজের কাছে আগলে রাখতে পারে না? এমন তো কথা ছিল না তাদের! আজ রাতেই নিহান রওনা দেবে। আর তাই দুপুরের রান্নাটা ফারিয়া নিজ হাতে করেছে। নিহানের প্রিয় খাবার বিরিয়ানি। যত্ন করে, সময় নিয়ে, ভালোবাসার সবটুকু মিশিয়ে সে রেঁধেছে। সহায়তায় ছিল মোহনা আর নদী। রান্না শেষে মোহনা একটু বিরিয়ানি আলাদা করে রেখেছে। ফুল কালকে খেতে চেয়েছিল। মোহনার ফুলের প্রতি দুর্বলতা কাজ করে। ওর মায়াবী মুখ, শীতল দৃষ্টিতে কিছু একটার আকুতি আছে। সেই আকর্ষণে মোহনার বুক হু হু করে ওঠে। মোহনার বাচ্চা খুব পছন্দ। রোশানেরও ছিল! এখন আর নেই।

মোহনা বেশিক্ষণ ভাবে না। খাবার নিয়ে ফুলের ঘরে গিয়ে দিয়ে আসে। ফিরতি পথে হঠাৎ করেই দেখা হয়ে যায় জুনায়েদ এলাহীর সঙ্গে। মুহূর্তেই গা ছমছমে অনুভব। কিন্তু লোকটা কোনো কথা না বলেই মুখ ঘুরিয়ে তড়িঘড়ি করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। কী এমন হয়েছে? পাগলা কুকুর তাড়া করেছে নাকি? মোহনা ভাবার প্রয়োজন মনে করে না। এই বাড়ির পুরুষদের দৌড় কতদূর তার মোহনার জানা আছে।
ফুল কাল চলে যাবে। থাকতে চেয়েছিল এখানে। তীব্র এক নির্ভরতা নিয়ে বলেছিল, “থাকতে চাই, এখানে থাকলে শান্তি পাই।” কিন্তু মোহনা কঠিন হৃদয়ে ‘না’ বলেছে। এখানে থাকলে, আজ না হোক কাল, ও শকুনদের চোখে পড়বেই। বিশেষ করে রোশানের উপস্থিতি ফুলের জন্য বিপদজনক।
রোশান স্বামী হয়েও পুরুষত্বের খোলসে এক ভয়াল শিকারি। সে স্পর্শ করবে না, তবু শেষ করে দেবে। শুধু এই একটি কারণে -মোহনা ফুলকে ভালোবাসে। মোহনা জীবনে যে কজনকে ভালোবেসেছে একে একে সবাইকে কেড়ে নিয়েছে রোশান। হয়তো রোশান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মোহনাকে শূন্য করে ছাড়বে। প্রতিবাদের কোনো অধিকার নেই মোহনাদের। সমাজ, সংসার, সম্পর্ক—সব দোষ চাপায় মেয়েটার ঘাড়ে। মোহনার মতো মেয়েরা কেবল টিকে থাকে চুপচাপ থেকে । নিজেদের ভালোবাসাকে কফিনবন্দি করে জীবন্ত লাশ হয়ে বাঁচে।

ঢাকার এই এলাহী মেনশনে মানুষজন নেই। কাজের লোকও নেই তেমন। সকালে একজন লোক আসে প্রয়োজনীয় কাজ গুলো করে আবার চলে যায়। এমনকি রান্নার কাজে সহয়তার জন্যও কেউ নেই। তাতে চিত্রার কিছু আসে যায় না। তার সংসার, সামলানোর দায়িত্বটাও তো তারই। কেনো অন্য কেউ রান্না করবে? তার স্বামী কেনো আরেকজনের হাতের রান্না খাবে? উঁহু তার স্বামীর কেনো বিষয়ে কারো সঙ্গে ভাগ চলবে না। ভালোবাসার বিষয়ে চিত্রা বরাবরই হিংসুটে। ফারাজ বাহিরে গিয়েছে। সেই সুযোগে চিত্রা টুকটুক করে রান্না ঘরে চলে আসে। ফ্রিজ খুলে দেখে মাছ মাংসের অভাব নেই। ফারাজ ছোটো মাছ খায় না। তবে দেশীয় মাছের থেকে সি-ফুড তার বেশি পছন্দ। ফ্রিজে টোনা ফিশ ছিল৷ সেটাই বের করে ভিজিয়েছ চিত্রা। কালকের গরুর মাংসের কালা ভুনাও আছে। ওগুলো বের করে গরম করে নিলেই হবে। আর কি রান্না করা যায়? চিত্রার পেছনে আয়েশা দাঁড়িয়ে আছে। গাজর খেতে খেতে সে রাতের কথা ভাবছে।

“আয়েশা।”
“হ্যাঁ আপা।”
চিত্রা একটু হেসে বলে,”তোর কি খেতে মন চাইছে? বল আমাকে? আমি তোকে রান্না করে খাওয়াবো।”
আয়েশা বিনয়ী ভঙ্গিতে জবাব দেয়,”আপনি যা রান্না করবেন তাই খেয়ে নিবো। আমি বাছাবাছি করি না।”
“জমেলা দাদুর খোঁজ নিয়েছিস?”
“জ্বে।”
“এত সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে না। আমি তুই সমান বয়সী।”
“থাক গা। ভাই শুনলে নারাজ হবে।”
“ফারাজ কে ভাই বলে ডাকিস? কিছু বলে না?”
“সামনাসামনি দেখা হইলে অ-আ দিয়ে বুঝিয়ে দেই। সম্মোধন করি না। কিন্তু কেন গো আপা?”
চিত্রা হাসে। বলে, “আজকে আসলে ওকে একটু ভাইয়া বলে ডাকিস তো। তাহলেই বুঝবি।”
“আচ্ছা।”
‘মিতালির কোনো খবর আছে?”
“কল দিছিলাম ধরে নাই।”

চিত্রার চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ে। পরক্ষণেই সে নিজেকে সামলে বলে, “মেয়েটার জন্য চিন্তাও হচ্ছে। আর খারাপ ও লাগছে। আচ্ছা তোকে নিলুর কথা বলেছিলাম না? ওই যে মেয়েটা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল?ঢাকায় আসার আগের দিন ওর মা বাড়িতে এসেছিল। এলাহীদের বৈঠকখানায় গিয়েছিলও।”
“বৈঠকখানায় কারা ছিল?”
“ফারাজ, অভ্র আর বজ্র বাঁধে সবাই ছিল। নিলুর মা সেখানে প্রবেশ করার আগেও চিন্তিত ছিলেন ফেরার সময়ও। তবে ফেরার সময় হাতে একটা ব্যাগ ছিল। তিনি বার বার সেই ব্যাগের দিকে চাইছিলেন।”
“নিলুর কথা জিজ্ঞেস করেন নাই?”
“করেছি। বলল নিলুর নাকি বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারাও নাকি কিশোরগঞ্জ ছেড়ে গাজীপুর চলে যাবে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ছলছল নয়নে কিছু একটা বলতে চেয়েও বললেন না। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। একটু অদ্ভুত লেগেছে।”

আয়েশা কোনো জবাব দেয় না। কিছু একটা চিন্তা করছে সে। চিত্রা ফ্রিজ থেকে গলদা চিংড়িও বের করেছে। ভুনা করবে বলে। “আয়েশা পেঁয়াজ দে তো।” চিত্রা রাতের বাসনগুলো তখন মাজায় ব্যস্ত। এটা শেষ হলেই রান্নার জোগার শুরু করবে। আয়েশা কে চিত্রা আবারও বলে, “কিরে ভাই দে না।”
আয়েশার কোনো জবাব নেই। চিত্রা পেছনে ফিরে দেখে দাঁড়িয়ে আছে ছ’ফুট লম্বা, সুঠাম, আত্মবিশ্বাসী পুরুষ। পরিচিত সেই ভঙ্গিমা, অলঙ্ঘনীয় ব্যক্তিত্বের অনায়াস প্রদর্শন। চোখের চাহনিতে শাণিত তীক্ষ্ণা,লুকানো উত্তাপময়। চোয়ালে দৃঢ়তা, ঠোঁটে রুক্ষতা। চুলগুলো নিখুঁতভাবে জেল দিয়ে পেছনে আঁচড়ানো। এক হাতে রোলেক্সের ভারি ঘড়ি।
অন্য হাতটি যথারীতি নিজস্ব ভঙ্গিতে প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা। বুকের ওপর জড়ানো সাদা শার্টটা পরিপাটি আর নির্দোষ দেখালেও, তার ওপর চাপানো কালো ভ্যাস্টে ফুটে উঠেছে ক্ষমতার ঘনছায়া। ধীর পায়ে সে এগোয়। ধীরে ধীরে গা থেকে ব্লেজার খোলে। টাইয়ের গিঁট আলগা করে, হাতার বোতাম খুলে কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে নেয়। চিত্রার দৃষ্টি স্থির। তার চোখে আটকে আছে একটা স্পন্দন, একটা ব্যাকুলতা, যার নাম ফারাজ। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে ফারাজের দিকে। কি সুশোভিত লাগছে লাগে।

“আপনি কখন এলেন?”চিত্রার কণ্ঠে বিস্ময়।
“তুমি রান্না ঘরে কি করছো?”
“রান্না করতে এসেছি।”দৃঢ় জবাব চিত্রার।
“ছ্যাহ কি ছোটোলোকি বিষয়। তুমি কি আমার বাড়ির কামলা নাকি? এখন তোমার পিরিত করার বয়স, আমার প্রেমে ডুবে মরার বয়স আর তুমি কিনা বাসনের জলে হাত ডোবাচ্চো? ছোটলোক বউ!”ফারাজ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে।
“হ্যাঁ দুনিয়ার সব কিছুই তো আপনার চোখে ছোটলোকি বিষয়। এখন সরুন। এত সুর্দশন ব্যক্তিদের রান্না ঘরে মানায় না তো।”
“তাহলে চলো রুমে গিয়ে ইতিশপিটিশ করে পেট ভর্তি করি।”
“আপনার মুখে ভালো কথা জোগায় না বুঝি? আপনি রান্নাঘর থেকে চলে যান। আমি নিজের কাজ নিজে সামলে নিবো। আপনি প্রচুর বিরক্ত করছেন।”

“তোমার বিরক্তের গুষ্টির তুষ্টি।” বলেই ফারাজ চিত্রাকে সামনে পাশে সরিয়ে হাতে চাকু তুলে নেয়। একটা পেঁয়াজ নিয়ে বলে, “আজকে আমি রান্না করবো। তাও আবার ফারাজ স্পেশাল তেল দিয়ে। রান্না খেয়ে ফিদা হয়ে মরে গেলে কিন্তু কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় বিবিজান।”
চিত্রা কিছু বলে না, কেবল তাকিয়ে থাকে। ফারাজ পেঁয়াজ কাটতে শুরু করে। প্রথম পেঁয়াজের ফালি ছাঁটাই হতে না হতেই চোখের কোনে জল চিকচিক করে ওঠে। কিন্তু সে শক্ত মেরুদণ্ডে দাঁড়িয়ে থাকে, সেই জল এক বিন্দুও গড়ায় না। পেঁয়াজ হাতে নিয়ে সে বলে,
“বুঝলে বউ দেশী জিনিসের ঝাঁজ বেশি। তেমনি স্বাদে গন্ধেও দেশী জিনিসের তুলনা হয় না। তাই তো ঘুরে ফিরে দেশীতে আঁটকে গিয়েছি।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৩৮

চিত্রার কণ্ঠ শুষ্ক, “আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন?”
ফারাজ এক পলক তাকিয়ে বলে, “আরে পেঁয়াজের কথা বলছিলাম আর কি। বিদেশি পেঁয়াজের এমন ঝাঁজ নেই। ওরা শালা দুই নম্বর মাল।”
চিত্রা চোখ টিপে বলে,”পেঁয়াজ সম্পর্কে খুব অভিজ্ঞতা আছে দেখছি।”
ফারাজ এবার ছুরিটা থামায়, সরু চোখে তাকায়। ছুড়ির শাণটা চিত্রার গলার শিরা বরাবর স্পর্শ করে বলে,
“পেঁয়াজ আমদানি রপ্তানির ব্যবসায়ী যে।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪০