চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪১

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪১
ইশরাত জাহান জেরিন

নিঃশব্দে উচ্চারিত ‘বিদায়’ শব্দটি ছিল শুধু ফারাজের মনের একান্ত ভাষ্য। বাস্তবে আগুনের মতো ঝলসানো সেই সুন্দরী চিত্রাকে বিদায় জানানো তার সাধ্য নয়। যে আগুনে সে একবার জ্বলে উঠেছে, তা থেকে নিজেকে মুক্ত করা এখন তার পক্ষে অসম্ভব। সে পারবে না চিত্রাকে নিজ থেকে দূরে ঠেলে দিতে। তবু সে এই হাতের লেগে থাকা রক্ত চিত্রাকে কখনো স্পর্শ করতে দেবে না। সত্য যত যন্ত্রণাদায়কই হোক ফারাজ জানে, তা লুকাতে গেলে পাপ বাড়বে। আর পাপের ভার চিত্রাকে যদি একবিন্দুও দংশন করে, তবে তা হবে তার প্রেমের পরাজয়। ভালোবাসার মানুষকে রক্ষা করতে হলে, কখনো কখনো নিজের ভিতরের অন্ধকারকে খুন করতেই হয়। পাপহীন প্রেম এ কি আদৌ সম্ভব? যদি প্রেম এমন কিছু না হয় যা মানুষকে নিজের মন্দটুকু পুড়িয়ে ফেলতে বাধ্য করে, তবে সে প্রেমের দাবিই বা কোথায়?

বৃষ্টিতে ভেজার পর থেকেই চিত্রার শরীর খারাপ লাগছে। চোখগুলো মাথায় ব্যাথায় কেমন যেন লাল হয়ে আছে। চোখের মধ্যকার লাল শিরা গুলো টগবগ করছে। ফারাজ চিত্রাকে খাবার খাইয়ে একটা ঔষধ খাইয়ে দেয়। খানিকটা বিশ্রাম করলে ভালো লাগবে। বিছানায় শুইয়ে গায়ে চাদর টেনে দিয়ে পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। চুলে হাত বুলালে এই মেয়ে বিড়ালছানার মতো ঘুমিয়ে পড়ে। চিত্রার চোখ বন্ধ। ফারাজের ফোনে বার বার কল আসছে। ফোন তার সাইলেন্ট করা। ফোনের স্ক্রিনে বার বার একটা নাম জ্বলজ্বল করছে। ফারাজ সেই নাম দেখে এখন একটু বিরক্তবোধই করছে। বাধ্য হয়ে উঠে বারান্দায় যায়। কল রিসিভ করে জিজ্ঞেস করে,
“সমস্যা কি? বার বার এক কথা জিজ্ঞেস করিস কেন? বলেছি না সময় হলে আসবো। তোকে যেই দায়িত্ব দিয়ে আসছি তুই সেটার দিকে ফোকাস কর। আমারকে নিয়ে না ভাবলেও হবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অভ্র আর আয়েশা হাঁটছে ভেজা সড়ক ধরে। আকাশ কাঁদবে বলে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানিতে কেঁপে উঠছে আকাশের বুক। বাতাসে ভাসছে কাঁচা মাটির গন্ধ আর ধাতব আদুরে সোঁদা গন্ধ। তবুও তাদের পায়ে তাড়া নেই। হাঁটতে হাঁটতে কতদূর যে চলে এসেছে, তার ঠিক নেই। আশপাশে জনমানবহীন রাস্তা। হঠাৎ অভ্রর ফোনে কল আসে। সে আয়েশা কে বলে একটু সাইডে যায়। আয়েশা দাঁড়িয়ে থাকে। অপেক্ষা করতে করতে এক-দু’পা এগোয়। চোখে পড়ে রাস্তার ধারে একটি পুরনো কাঠবাদাম গাছ। বৃষ্টির ধাক্কায় গাছের নিচে নিশ্চয় অনেক বাদাম পড়ে আছে। বড়লোকদের এসবের দরকার নেই, তাদের দৃষ্টিতেও পড়ে না। আয়েশা এগিয়ে যায় গাছের দিকে, বাদাম কুড়িয়ে ওড়নায় পেঁচিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই অনুভব করে, কেউ তাকিয়ে আছে। রাস্তার উল্টো পাশে, দু’জন যুবক বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেটের ধোঁয়া পাক খেয়ে ভেসে যাচ্ছে বাতাসে। চোখদু’টো তাদের চকচক করছে, ঠোঁটে অশোভন হাসি।

“কিগো সুন্দরী, হারিয়ে গিয়েছো বুঝি?”
একজন বলে ওঠে। কণ্ঠে শুষ্ক ঠাট্টা।
“এমন ঝড়বৃষ্টির রাতে একা একা মেয়েমানুষের রাস্তায় বেরোনোটা কি ঠিক?”
আয়েশার মুখে ছায়া নামে। ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অভ্র কোথায়? একটু আগে তো এখানেই ছিল পাশেই তো ছিল… কই গেলো হঠাৎ?
তার আগেই ছেলেগুলো নড়েচড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে এক পা, এক পা করে এগিয়ে আসে। আয়েশা পিছাতে থাকে, হাতের ওড়না আঁকড়ে ধরে।
সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“কাছে আসবেন না কইলাম।”
দ্বিতীয় জন হাসে। বলে, “নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আমাদের আকর্ষণ বরাবরের মতোই গভীর, বেদনার মতোই লোভনীয়। কাছে না এসে কি করে থাকি বলো?”

রাতের বুক চিরে নিঃশ্বাস ফেলে ছুটছে নিশি। সরু সড়কের উপর তার পায়ের ধ্বনি যেন কোনো ব্যর্থ প্রতিধ্বনি হয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে অন্ধকারে। প্রাণটা হাতে নিয়ে দৌড়াতে হচ্ছে তাকে। বাঁচতে হবে যেভাবেই হোক। পায়ের জুতা কোথায় ছিটকে পড়েছে মনে নেই। চোখের কাজল গলে নেমে এসেছে গালের রেখা ধরে। যার জন্য ঘর ছেড়েছিল, সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে ভরসা করেছিল সেই মানুষটাই তাকে জ্যান্ত মেরেছে। সেই মুখটাই লেপ্টে দিয়েছে তার চোখে যত্নে আঁকা স্বপ্নের কাজল, নিষ্ঠুরতার হাতের আঁচড়ে। এখন সেই বিশ্বাসঘাতকতার ভারেই দগ্ধ হচ্ছে তার পায়ের পাতা। ছাল উঠে গিয়েছে, ফসকা পড়ছে। রক্ত মিশে যাচ্ছে কাদা-পানির সাথে। কিন্তু থামলে চলবে না। থামা মানেই শেষ। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে সে এসে পড়ে নিকলীর একটা এলাকায়। যেখানে ঘরবাড়ি আছে, আছে গলিঘুঁজির জাল। নিশি এক সরু গলিতে ঢুকে কিছুটা হাফ ছেড়ে আবার ছুটতে শুরু করে। তার দম নিতে দম নেই। একটা গলি থেকে আরেকটায় ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ কোনো এক জনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নেয় সে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে একটি শক্তপোক্ত হাত টেনে ধরে তাকে। পড়ে যাওয়া আটকে যায়। দেহটা থেমে যায়। কিন্তু নিশির চোখের ভিতরে বজ্রপাত হয়ে যায় যেন। সে ভয়ার্ত চোখে তাকায় সেই ছায়ামূর্তির দিকে। লোকটি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে স্বাভাবিক গলায় অনায়াসে বলে ওঠে,
“আস্তে এত তাড়া কিসের?”

বড় ক্যাবিন। সেন্ট্রাল এসি চলতেছে গুমোট নীরবতায়। কিন্তু ভেতরের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। শুধু মানুষের শরীর থেকে নয় আলোচনার বিষাক্ততা থেকেও। চামড়ার সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে রাজন, রোশান, জোহান আর সোহান পালোয়ান। সোহানের পাশে সিফাত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ঠাণ্ডা চোখে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছে। তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে আকব। মুখে থমথমে ভাব। সকলের হাতে আধভরা হুইস্কির গ্লাস।পাশে রাখা একটা ছোট কাঁচের কৌটো। তাতে সাদা, সূক্ষ্ম এক পাউডার। যা জোহান মুহূর্তে মুহূর্তে শুষে নিচ্ছে নাকে। চোখ বন্ধ করে একটা বিকৃত তৃপ্তিতে। বাতাসে ঘুরছে সিগারেট আর কোকেনের মিলিত বিষাক্ত গন্ধ। সোহান নিঃশ্বাস ছেড়ে ধোঁয়ার বলয় তৈরি করে বলে ওঠে,

“নতুন একটা প্রোজেক্ট হাতে আইছে। আবার মায়ানমার থেইক্কা।”
রাজন চোখ সরু করে। ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গ হেসে জিজ্ঞেস করে, “মাইয়া কয়টা লাগবো এবার?”
সোহান মাথা হেলিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে,
“একশোটা মাইয়া। তবে এবার যারে তারে দিয়া হইবো না। সুন্দর মাইয়া লাগবো। পছন্দসই মুখ। প্রিমিয়াম বুঝো? প্রিমিয়াম লাগবো?”
রোশান হো হো করে হেসে ওঠে, “এই এত মাইয়া দিয়া শালারা করেডা কি?”
সোহানের মুখে বিরক্তির ভাব, “ওটা আমাগো দেখার বিষয় না। আমাগো কাম হইলো মাল সাপ্লাই দেওয়া।”
এই মুহূর্তে রোশান আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “ফারাজের সঙ্গে দেখা হইছে তোমার?”
সোহান একবার ধোঁয়া ছেড়ে ঠাণ্ডাভাবে উত্তর দেয়,
“না। সময় হইতাছে না। ফারাজ নিজেও তো ব্যস্ত।”
রোশান খিকখিকিয়ে হেসে ওঠে, “হুম, এলাহী এখন বউ নিয়া সুখ করতাছে। করুক করুক আর তো কয়টা দিন।”
“ওরে কত কইরা বললাম আমাদের সঙ্গে যোগ হ। একসঙ্গে সব ভাইয়েরা মিল্লা কাজ করলে ধান্দা আরো বড় হইবো। জানোয়ারটা শুনে কথা? তার ওপর বিয়ে করছে তালুকদার বাড়ির মাইয়া। ঘরে আজরাইল আনছে নাকি আজরাইলের হাতে তুইলা দেওয়ার জন্য আনছে ওইটা সেই ভালো কইতে পারবো।” বলল রাজন।
সোহান সিগারেটটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে আঙুলের টোকায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ধোঁয়ার বৃত্ত ভেঙে আকাশে মিশে যেতে যেতে সে কেমন নিষ্পৃহ ভঙ্গিতে বলে, “চিত্রা দেখতে কেমন? ফারাজের সুখকে কোনোভাবে মায়ানমারে পাঠানো যায় না?”

জোহান তখনও আধা শোয়া ভঙ্গিতে বসে ছিল। কোকেনের নেশায় চোখটা একটু ভারী। কিন্তু চিত্রার নামটা শোনামাত্রই শরীরের প্রতিটি স্নায়ু টনটন করে উঠল। সে ধীরে মাথা তোলে। চোখে তীক্ষ্ণ জ্বলুনি। রাজন কিছু বলতে যাবে সেই সুযোগও দিল না সে।
জোহানের কণ্ঠ ছুরির ফলার মতো ঠান্ডা, স্পষ্ট, আর নির্মম, “মজা নিচ্ছেন? আগেই তো বলেছিলাম চিত্রাকে আমি এখনও স্পর্শ করিনি, এখনও অনুভব করা হয়নি। সেই রাতের কথা এত সহজে ভুলে গেলেন, সোহান ভাই? মাথায় ঢুকিয়ে নিন এই শহরে যদি কেউ চিত্রাকে নিজের করে নেয় তবে
সেটা কেবল আমি। চিত্রা আমার শরীরেও, মনে-প্রাণেও।”
সে এবার একটু ঝুঁকে আসে। চোখে আগুনের লাভা।” চিত্রার চিন্তা মাথা থেকে সরান। বেশি অশান্তি করবেন না। তা না হলে কিন্তু ঘটনা আপনাদের আব্বা ফারাজ এলাহীর কানে পৌঁছাতে সময় লাগবে না। জানেন তো ‘অশান্তি’ যে কীভাবে তার হাতে ‘দুই হাত’ বড় হয়ে ফিরে আসে?’

সুলেমান এলাহী বিছানায় আধশোয়া হয়ে বালিশে হেলান দিয়েছাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। বাতাসে পানপাতার ঘ্রাণ। রুমানা হাতে একজোড়া পানের খিলি গাঁথছে। স্বামীর জন্য পানের খিলি যত্নে সাজানো তার অভ্যেসের একাংশ। হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত হয়। মোহনা ঘরের মধ্যে ঢুকতেই রুমানার দৃষ্টি ওর দিকে ছুড়ে গিয়ে গেঁথে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নির্লিপ্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দেন, “নিরুরে বিয়ের জন্য রাজি করাইতে পারছো?”
“জ্বী। আম্মা। মাথা নিচু করে উত্তর দেয় মোহনা।
রুমানা শীতল গলায় বলে ওঠেন,“ভালো। যাও এখন। আর তুমি কিংবা নদী চিত্রের কাছে ঘেঁষবা না। তোমরা হইছিস বন্ধ্যা। তোদের ছোঁয়া যদি নতুন বউয়ের গায়ে লাগে, পরে সে যদি।”
তিনি বাক্য শেষ করেন না। কিন্তু যে শূন্যতা রেখে দেন তার ভার মোহনাকে থেমে দম নিতে বাধ্য করে। চোখ জলে ভরে ওঠে তার। তবু একটাও শব্দ উচ্চারণ না করে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
ঘরে নীরবতা নেমে আসে কিছু মুহূর্তের জন্য।

সুলেমান এলাহী ঠোঁটের কোণে পানের পিক জমাতে জমাতে বলেন, “তোমার এমন কথা বলা ঠিক হইল না। সে বন্ধ্যা? দোষ তো আমাগো পোলার। ও কী করছিল, ভুলে গেছো?”
রুমানার মুখ শক্ত হয়ে যায়। তিনি কোনো জবাব দেন না। তাঁর কাছে ছেলের দোষ মানে নিজের রক্তের প্রতি অবমাননা। পুরুষ মানুষের কোনো ভুল থাকতে পারে এই ধারণাই তাঁর কাছে অবান্তর। ❝পুরুষ মানুষের সঙ্গে দোষ শব্দটা যায় না,দোষ শব্দটা কেবল নারীর জন্য সৃষ্টি।❞
“পিয়াস কবে আসতেছে?” সুলেমান জিজ্ঞাসা করেন।
“কাল সকালে।”
“তুমি হঠাৎ করে নিরুরে পিয়াসের সঙ্গে বিয়েতে রাজি করাইতে উঠেপড়ে লাগলা ক্যান?”
রুমানার চোখে কিছুক্ষণ দূরের শূন্যতা খেলে যায়। তারপর শান্ত গলায় বলেন, “জানি না। শুধু চাই অন্তত একটা মেয়ে তো সুখী হোক। পাপীর হাতে পড়ে পাপের শরিক না হোক।”
সুলেমান একটু হেসে বলেন, “পাপের দুনিয়ায় থেকে পাপীর বিরুদ্ধে কথা বলতে বুক কাঁপে না?”

“নিজেই তো আমি পাপিষ্ঠা। পাপেই তো গড়া আমার শরীর। আমার আবার কিসের বুক কাঁপা?”
সুলেমান এবার ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গ মেখে বলেন, “তাই বইলা নিরুরে একটা ভালো ছেলের লগে বিয়া দিয়া তুমি কি চ্যালচ্যালাইয়া বেহেশতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেছো?”
রুমানা চুপ করে থাকেন। সুলেমান এবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে একটুখানি নরম সুরে বলেন, “ওরে তো আরো বড় পাপীর লগেই বিয়া দিতাম পারতাম। কিন্তু বউ আমি তোমারে ভালোবাসি।বউ হিসেবে তোমারও তো কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। তুমি মানুষ করছো নিরুরে। ওর ভালো-মন্দ ভাইবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায় তোমারই হওয়া উচিত। যাই হোক পিয়াস তো আসতেছেই কাল। কিছুদিন এখানে থাকুক, নিরুর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ুক। তারপর এই সপ্তাহের মধ্যেই সব ঠিকঠাক করে ফেলুম। তবে ভুল করতাছো তুমি নিরুর ভালা চাইতে গিয়া আরেকটা পোলারেও পাপের সঙ্গে জড়াইয়া ফেলতাছো।”

রুমানা আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই চাপিয়ে রাখা দরজা ঠেলে ভেতরে জমেলা দৌড়ে ঢুকে পড়ে। একচোট কেঁদে চেঁচিয়ে সুলেমানের লুঙ্গি টেনে ধরে বলে,
“মাই ইয়াং বেডা হুয়াই ইউ বসিং এই বুড়ির লগে? লুক আমি ইউর জন্য সাজছি। কামিং আওয়ার রুমে। আমি লাভিং পিরিত করিং ইউর সাথে। টুডে ইউ আমার লগে নেহি যাতহে তো আমিও নট ইউর লুঙ্গি ছাড়তাহে।”
সুলেমান এলাহী বিপাকে পড়ে যান। বউয়ের রাগান্বিত মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলেন,
“এই ছাড় আমার লুঙ্গি ছাড়। জুয়ান বেডা দেখলে মাথা ঠিক থাকে না? ছাড় কইলাম। তোর লাভিংয়ের মায়রে করি তুস তুস।”

“ভাবতেই পারিনি শরীরটা তোমার এমন হঠাৎ খারাপ করবে বউ।”
“আরে না, তেমন কিছু হয় নি। তবে পেটে কিন্তু মিছিল শুরু হয়েছে।”
“তারও ব্যবস্থা করেছি। বাইরে থেকে তোমার পছন্দের সব খাবার অর্ডার দিয়েছি। আজ তুমি খাবে, বিশ্রাম নেবে আবার খাবে, আবার শুয়ে রেস্ট করবে। তোমাকে খেতে দেখলে কেমন যেন আরাম আরাম লাগে। এমনিতে আমার আবার একটু গুলুমুলু মেয়ে বেশি পছন্দ।”
“তাহলে মানে দাঁড়াচ্ছে, আমি শুকনো তাই আমাকে অপছন্দ?”
“উফ! কোথায় বললাম আমি এমন কথা?মাইরি তোমার কি হেব্বি ডেঞ্জারাস চিন্তাধারা। মেয়ে মানুষ কইছে কারে।”
“কাল চলে যাচ্ছি… মনটা খারাপ হয়ে আছে। আবার একটু খুশিও লাগছে ওই বাড়ির সবাইকে অনেক মিস করছি।”
“ওহে ছোটলোক বউ, মাঝে মাঝে স্বামীকেও তো মিস করো বলতে পারো! নাকি সেই তালিকায় আমি নেই?”
চিত্রা মুখে ভেংচি কেটে বলল, “আপনাকেও মিস করি। তালিকা আপনার নাম থেকেই শুরু হয়েছে। তবে সেখানে গেলে তো আপনি আবারও ব্যস্ত হয়ে যাবেন। ঘরে আমার একা একা সময় কাটে না।”
“এখন থেকে কাটবে।”
“মানে?”

ফারাজ চিত্রার হাত ধরে তাকে আস্তে করে উঠে বসায়। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে তার চোখ বেঁধে দেয়।
“একটু অপেক্ষা করো, বিবিজান। তোমার জন্য একটা ছোট্ট সারপ্রাইজ আছে।”
চিত্রা নিঃশব্দে বসে থাকে। মনের মধ্যে একটু ভয়ও কাজ করে। সারপ্রাইজ শুনলেই তো অদ্ভুত কিছু এসে পড়ে। এইবার না আবার অজগর ধরিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণ পর ফারাজ তার চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে বলে,
“টানটানা!!”
চিত্রা অবাক হয়ে চেয়ে দেখে। একটা ছোট্ট খাঁচা। আর তার ভেতরে দুটো খুদে, তুলতুলে হেমস্টার।চোখজোড়া যেন আলোয় ভরে ওঠে চিত্রার।
“এই দুইজন এখন থেকে তোমার সঙ্গী। তবে সাবধান আমাকে বাদ দিয়ে ওদের বেশি ভালোবাসো না। তাহলে কিন্তু তোমার কপালে শনি আছে!”

ফারাজ খাঁচা খুলে হেমস্টার দুটো চিত্রার হাতে তুলে দিতেই চিত্রা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। ফারাজ কপালে হাত দিয়ে বলে, “ঠিক জায়গায় তো গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। তো এবেলায় এত গর্জন কোথ থেকে উৎপাদন করছো?”
“আহ্ থামুন তো! দেখুন না কতো কিউট! একদম পুঁচকে! কত্ত ছোট্টরে।”
“হায় হায়! বউয়ের দেখি ছোটখাটো জিনিস পছন্দ। ছ্যাহ ছোটলোকি কারবার।” ফারাজ বেডসাইড টেবিল থেকে একটা ফোনের বাক্স আর একটা খাম বের করে চিত্রার হাতে দেয়।
“তোমায় খুব মনে পড়ে কাজে গেলে। তাই তোমার জন্য নতুন ফোন এনেছি। এবার থেকে ভিডিও কলে প্রেম জমবে।”

চিত্রা চমকায়। আইফোন? এত বড়লোকি জিনিস ব্যবহার করবে সে? এখন যদি তার নিজেরও চুলকানি শুরু হয়? চিত্রা খামটা খুলে ভেতরে থাকা কাগজটা বের করে। একবার চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এটা কি?”
“তোমার কলেজের ভর্তির কাগজ। কাল থেকে তুমি আবার কলেজে যাবে।”
চিত্রা থমকে যায়। এরপর হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে।
ফারাজ বিস্মিত, “এই বউ, কী হলো তোমার?”
“ধ্যাত! সরেন আপনি! দূরে গিয়ে মরেন। আমি কলেজে যাবো না! আমাকে আপনি ওই নরকে ঠেলবেন না। আমি পড়তে চাই না। সংসার করতে চাই। আপনাকে ভালোবাসতে চাই, আপনার যত্ন নিতে চাই!”
“তোমার তো পড়ার শখ ছিল ?”
“শখ না! পাস করেছি টেনেটুনে! পড়া নয়, আমি প্রেম করবো আপনার সঙ্গে। ঠ্যাং ধরি আপনার আমায় মৃ*ত্যুর মুখে ঠেলবেন না।” বলেই চিত্রা আবারও এক চোট কান্নায় ফেটে পড়ে। ফারাজ কি বলবে কি করবে বুঝতে পারছে না। ঢোক গিলে বলে, “তার মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া এই আমি একটা ডাব্বামার্কা মেয়েকে বিয়ে করেছি?”

অভ্র কথা বলতে বলতে যে কখন, কোথায় চলে গিয়েছিল নিজেও টের পায়নি। ফিরে এসে দেখে, দু’টো ছেলে আয়েশার সামনে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাত-পা নাড়াচ্ছে। মুহূর্তেই অভ্রর মেজাজ তেতে ওঠে। সে দৌড়ে গিয়ে আয়েশার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“কি হয়েছে আয়েশা? এরা কী করছিল? তোকে কিছু বলেছে? বলে দে, আজ এদের পেছনে বোম পাঠাবো!”
তার কথা শেষ না হতেই, ছেলেদুটো হঠাৎ করে পিছিয়ে এসে অভ্রর পেছনে লুকাতে চায়। দু’হাত জোড় করে একদলীয় কণ্ঠে বলে, “ভাই! বাঁচান! প্লিজ এম্বুলেন্স ডেকে আনেন! এইটা মেয়ে না ভাই, কটকটি। একেবারে বজ্রাহত কিক দিয়ে শেষ করে দিছে! ভাই প্লিজ ৯৯৯-এ ফোন করেন। দুটোর ছেলের ভবিষ্যৎ ফিউজ হয়ে গেছে!”
অভ্র হতচকিত হয়ে আয়েশার দিকে তাকায়। এবার ভালো করে নজরে পড়ে। ওড়নাটা সে কোমরে শক্ত করে গিট দিয়ে বেঁধেছে।চোখে আগুন জ্বলছে। অন্যদিকে ছেলেদুটোর মুখে যন্ত্রণার ছাপ। নিজেদের গোপন জায়গা চেপে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
“আয়েশা… সত্যিই তুই ওদের মেরেছিস?”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪০ (২)

“হ্যাঁ! এক্কেবারে পাওয়ার পয়েন্টে শট মেরে ওদের ড্রিমলাইট নিভিয়ে দিয়েছি। সাহস তো দেখ আমাকে বিরক্ত করতে এসেছে! জানে না আমরা কিশোরগঞ্জের মেয়েরা একেকটা হাঁটুজলে রাখা ডিনামাইট!”
ছেলেগুলোর অবস্থা দেখে অভ্রর ভেতরের রাগ হালকা হয় বটে তবে মায়াও হয় না বরং আরো বিরক্তি জন্মায়। সে আয়েশার হাত ধরে টেনে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। যাবার সময় ছেলেদুটোর দিকে তাকিয়ে বলে, “থু! তোদের মত মানুষ বলার অযোগ্য জীবগুলোর মুখে। মরে যা ভাই! তোদের বেঁচে থাকা সমাজের লজ্জা। খালি ডিম, দুধ, বাদাম খেয়ে লাভ কী? যদি মেয়ে মানুষের কিক খেতে হয়?”
আয়েশা ভ্রু কুঁচকে অভ্রর দিকে তাকায়। বলে, “হইছে সরকার ভাই তোমার ওদেরকে খাওয়ার রুটিন বলতে হবে না। তোমার খবর বাসায় গিয়ে নিবো।”
অভ্র আবারও ঢোক গিলে। মনে মনে বলে, “আল্লাহ এভাবের মতো রক্ষা করো। কথা দিলাম ভন্ডামি ছেড়ে দিবো।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪২