চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৩
ইশরাত জাহান জেরিন
সকাল সকাল ফারাজের হাত ধরে এলাহী বাড়িতে প্রবেশ করে চিত্রা। চিত্রা ক্লান্ত জার্নি করে। ঢাকা থেকে ফিরেছে। নদী, ফারিয়া ও বাকিরা চিত্রাকে দেখে ছুটে আসে। কেবল নিরু ছাড়া। সে তো রুম থেকেই বের হয়নি। আজই পিয়াস ভাই আসবেন। তারপর? তারপর আর কী? নতুন পথচলা শুরু।
যারা নিরুকে ভালো থাকতে দেয়নি, যারা তার ভেতরটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে শেষ করে দিয়েছে তাদের সঙ্গে এই দুনিয়ার হিসেবের খাতা আজ বন্ধ হয়ে যাবে। তবে হাশরের ময়দানে আবার দেখা হবে। সেদিন খোলা হবে আসল হিসেবের খাতা। সেই দিনের প্রতীক্ষায় নিরু। এই জীবনটা সে কাটিয়ে দেবে না-পাওয়ার আক্ষেপে, নিজের অস্তিত্বকে মৃত করে রেখে। মোহনা ফারাজের হাতের দিকে তাকায়। কী সুন্দর করে নিজের বাম পাঁজর থেকে সৃষ্ট নারীর হাতটা আগলে রেখেছে সে। মোহনা একটা নিশ্বাস ফেলে। এসব দেখলে হয়ত নিরুও এমনই একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলত। তাদের উভয়ের হৃদয় চোখ বন্ধ করে বলত, “পরের জন্মে চিত্রাঙ্গনা হয়ে জন্মাবো। তখন তো ফারাজ এলাহী আপনাকে আমার প্রেমে পড়তেই হবে।”
নদী আর ফারিয়া চিত্রার সঙ্গে তার রুম পর্যন্ত যায়। কত কথা জমা হয়ে আছে! দু’তিন দিনের
জমা সব কথা আজ বলে ফেলতেই হবে। ফারাজ এসেই ছোট্ট নুড়িকে কোলে তুলে কিছুক্ষণ হইচই করেছে। বাচ্চা মেয়েটাকে ও চোখে হারায়। আর নুড়িও ফারাজকে দেখলেই খুশিতে দিশেহারা হয়ে পড়ে। চিত্রা সবার সঙ্গে দেখা করে। তার চোখ এদিক-ওদিক ঘুরে কারও খোঁজ করে।
মিতালি কোথায়? সে কি এখনও ফিরে আসেনি?
রাতে ফারাজের দেওয়া ফোন থেকে আয়েশার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে সবার আগে মিতালিকেই ফোন করেছিল চিত্রা। সিম বন্ধ। মেয়েটার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এবার সত্যি একটু চিন্তায় পড়ে যায় চিত্রা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পিয়াস মির্জার আসার খবরে গোটা এলাহী বাড়িতে উৎসবের আমেজ। সবাই আনন্দে ব্যস্ত। কেবল নিরু ছাড়া। তার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে ফারাজের স্মৃতিতে। রুমানা সারাদিন নিরুর পাশে থাকছেন। একা রাখতে ভয় পান। যদি ফারাজের শোকে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে নিরু? কিন্তু এমনভাবে হেরে গেলে হবে না। সুখী হয়ে, হাসিমুখে বেঁচে থেকেই জিতে দেখাতে হবে তাদের, যারা সব কিছু কেড়ে নিয়েছে।
“এই মোহনা, দরজার দিকে খেয়াল রাখবা। পিয়াস যেকোনো মুহূর্তে চলে আসতে পারে,” রুমানার কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা।
মোহনা তখন রান্নাঘরে। হাত ভেজা মসলা গন্ধে। ডাক শুনে দ্রুত বেরিয়ে আসে। আজও তার গায়ে হালকা রঙের পাতলা শাড়ি, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। মোহনাকে উপেক্ষা করা যায় না। এই নারী নিঃসন্দেহে অসাধারণ সুন্দর। মোহনা দরজার দিকে পা বাড়াতেই বেজে ওঠে কলিং বেল। বাড়ির কাজের লোক দরজা খুলতেই মোহনার চোখেমুখে আনন্দের ঝলক খেলে যায়। পিয়াস এসেছে। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস মাত্র এক মুহূর্তেই মুছে যায় মুখ থেকে। মুখটা কঠিন হয়ে ওঠে। পিয়াসের ঠিক পেছন থেকে বেরিয়ে আসে এক অচেনা মেয়ে।
এই মেয়ে কে? তাকে তো আগে কখনো দেখেনি।
কে এই অচেনা আগন্তুক? তার পরিচয়ই বা কী?
সারাটা দিন চিত্রার শরীর ভালো কাটে নি। অজানা ক্লান্তি জড়িয়ে ছিল তার দেহে-মনে। ফারাজও বাসায় নেই। কী যেন হয়েছে লোকটার। চিত্রা খেয়াল করছে বাড়িতে ফেরার পর থেকেই ও কেমন যেন দূরে দূরে থাকছে। হয়তো কাজের চাপে… হয়তো মন অন্য কোথাও। তবুও, বুকের ভেতর কেমন একটা অস্বস্তি বাসা বাঁধে। নদী খাবার এনে রেখে গেছে। কিন্তু চিত্রার মুখে রুচি নেই। আসার পর থেকেই বারবার বমি হচ্ছে। খাবারের কথা ভাবলেই বমি ভাব চেপে ধরে। মাথাটা ধরে আছে, ব্যথায় চৌচির। নদী খাবারটা রেখে গিয়েছিল ভেবে, “পরে হয়তো খাবে চিত্রা।” তবুও ওর মনে দুশ্চিন্তা কাজ করে। একটা ছোট মেয়ে সবকিছু ছেড়ে স্বামীর ঘরে এসেছে।
মামার বাড়িতে যে খুব সুখে ছিল তেমন কিছু না।
এলাহী বাড়ির অবস্থা ভালো, চিত্রার ভাগ্যও সহায় হয়েছে ফারাজকে পেয়েছে। আর ফারাজ তো একপ্রকার বউপাগল! সব দুঃখ-কষ্ট পেরিয়ে, যদি চিত্রা ফারাজকে আগলে রাখতে পারে, যদি ফারাজকে ধরে রাখতে পারে তবে আজীবন সুখে থাকবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। আবার নাও তো হতে পারে। চিত্রার ভালো থাকা, মন্দ থাকা ফারাজের হাতের মুঠোয় বন্দি।
বিকেলের দিকে নদী আবার এসে বসে পাশে। মাঝে রুমানা এসে চিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছে কিছুক্ষণ। আয়েশা ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়েছে কপালে। গা, হাত-পা মুছে দিয়েছে যত্ন করে। সব শেষে, সবাই চলে যাওয়ার পর নদী নিজ হাতে চিত্রাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে তবেই ফিরে। আয়েশা চিত্রার পাশ থেকে নড়ে নি। নিঃশব্দে বসে থেকেছে, না খেয়ে পাশে বসে পাহারা দিয়েছে। ফিরার সময় গাড়িতে অভ্রর পাশে বসতে তার ভীষণ লজ্জা করেছিল।বজ্র ছিল সামনের সিটে। অভ্র তাই আয়েশার পাশেই বসেছে। প্রেমিক হয়ে কি আর নিজের প্রেমিকার পাশে অন্য পুরুষকে বসিয়ে দেওয়া যায়? গাড়ির ঝাঁকুনিতে কখনও বা তাঁদের আঙ্গুল আঙ্গুল স্পর্শ করে গায়ে কাঁপুনি ধরিয়েছে দিয়েছে। লজ্জায় হয়তো ভেতর ভেতর অভ্রটারও হৃদয়ের বেগ নিয়ন্ত্রণ হারা হয়েছে।আয়েশার হয়ত মুখটা রক্তিম হয়ে উঠেছে। তবে আশ্চর্য লাগে। যে অভ্রকে নিয়ে এতকাল অবিরাম ঝগড়া করত, আজ তার চোখে চোখ রাখতেও সংকোচবোধ করছে আয়েশা। বুকের গভীরে এখন কেবলই সৃষ্টি হচ্ছে নাম না জানা অচেনা কাঁপুনি।
এই ভালোবাসারা এমন হয় কেন?
বাড়ির ভেতর তুমুল হাঙ্গামা বেঁধে গেছে। সন্ধ্যা নামার আগেই এলাহী পরিবারের সকল পুরুষ জড়ো হয়েছে বৈঠকখানায়। নারীরাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। পরিবেশে থমথমে উত্তেজনা। রুমানা ভাবতেও পারেনি পিয়াস এভাবে হুট করে আরেকজন মেয়েকে সঙ্গে করে এ বাড়িতে নিয়ে আসবে। সবার সামনে, নির্লজ্জ নির্ভয়ে। নিরু এক কোণায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। যেম সে নিজের অস্তিত্বটাকেই লুকিয়ে রাখতে চাইছে। তার কপালে খোদা কী লিখে রেখেছেন সে নিজেও জানে না। একটা মানুষের কপাল এত খারাপ কি করে হতে পারে? পিয়াসের পাশে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে রুমানা রাগে ক্ষোভে পুড়ে যাওয়া চোখে তাকিয়ে আছে। চাহনিতে স্পষ্ট অবজ্ঞা। রুমানা ঠান্ডা গলায় বলে ওঠেন, “এই মেয়ে, তোমার নাম কী?”
মেয়েটি আতঙ্কে কাঁপতে থেকে চোখে তাকায়। অস্পষ্ট কণ্ঠে ভেঙে ভেঙে জবাব দেয়, “নি…নিদ্রিতা নিশি।”
ঠিক তখনই পিয়াস গর্জে ওঠে। কণ্ঠে রোষ, “আমার স্ত্রীকে এভাবে জেরা করার অধিকার কারও নেই। কথা বলার থাকলে, আমার সঙ্গে বলুন। এমন জায়গায় আমি এক মুহূর্তও থাকবো না যেখানে আমার বৈধ স্ত্রীর সম্মান নেই। সেই জায়গায় পিয়াস মির্জা নিঃশ্বাস নিতেও ঘৃণা বোধ করে।”
বাড়ির বাতাস হঠাৎ জমে উঠেছে বিস্ময়ে। এমন কথা,এমন দৃঢ়তা ছোটবেলা থেকেই পিয়াসের স্বভাবে ছিল। কিন্তু তাই বলে একটা অচেনা মেয়ের পক্ষ নিয়ে মামীর মুখের উপর এভাবে কথা বলা? সবাই স্তব্ধ। পিয়াসের পরিবারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই তো তার বিয়ে নিরুর সঙ্গে ঠিক হয়েছিল। তখন তো সে একবারও বলেনি যে, সে অন্য কারো প্রেমে পড়েছে। প্রেমিকাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। যদি এসব আগে জানত, রুমানা তাহলে কি কখনও পিয়াসের সঙ্গে নিরুর বিয়েতে সম্মতি দিত? ঘরে উপস্থিত রাজন ও রোশান। তাদের মুখেও চাপা দ্বিধা। কারণ তারাও যে এই বিয়েতে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট ছিল তা নয়। তবে আজকের এই কাহিনী রাজনের ভাবনায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিল। মনে মনে সে ঠিক করে ফেলেছে এই সুযোগে নিরুর বিয়েটা সে সোহান পালোয়ানের সঙ্গে ঠিক করবে। এতে শুধু একজোড়া হাত মেলাবে না, মজবুত হবে ব্যবসায়িক সম্পর্কও। তাই দ্বিধাহীনভাবে সে পিয়াসের পক্ষ নিয়েই কথা বলে উঠল। সুযোগকে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
ঘরের এক কোণে নিরবে দাঁড়িয়ে আছে জোহান। সবার আড়ালে থেকে তার দৃষ্টি অন্যদিকে। চিত্রার দিকে। তার চাহনি বিদ্ধ, অন্ধকারে ভেজা। লুকিয়ে লুকিয়ে সে আঁটছে পরিকল্পনা। চিত্রাকে কলঙ্কিত করতে হবে, অপমানিত করতে হবে। এটাই একমাত্র পথ তাকে পাওয়ার। কারণ যতটা ফারাজ তার পবিত্র স্ত্রীকে ভালোবাসে, অপবিত্র হলে ততটাই ঘৃণা করবে। জোহান দূর থেকে চিত্রার শরীরে কু-নজর বুলিয়ে চলেছে। কোন কোন জায়গা থেকে মাংস উঠিয়ে নিবে সেই ভেবে খুশী হচ্ছে। কল্পনায় অন্ধ তার কামনার আঁচড়। তবে সেই কু-চাহনির পথ রুদ্ধ হয়। হঠাৎই চিত্রার সামনে এসে দাঁড়ায় ফারাজ এলাহী। তার দীর্ঘ ছায়া চিত্রাকে আড়াল করে দেয়। বিরক্তিতে জোহানের কপাল কুঁচকে ওঠে। মনে মনে খিস্তায় ভরে ওঠে তার ভাবনা, “সিনারি ঠিক মতো দেখতে না দিয়েই পর্দা টানলি ভাই?”
পিয়াসের বাড়িতে খবর পৌঁছতেই বিস্ফোরণ ঘটে। ছেলের আকস্মিক বিয়ের খবরে আকাশ ভেঙে পড়ে তার বাবা-মায়ের মাথায়। পিয়াসের বাবা তখন সিঙ্গাপুরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সঙ্গে গিয়েছেন তার মা-ও। পরিকল্পনা ছিল সপ্তাহখানেকের মধ্যেই কাজ সেরে দেশে ফিরবেন। কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত খবরে তারা ভেঙে পড়েন। মনের ঝড় যতই তীব্র হোক দায়িত্বের গাঁথুনি ভেঙে ফেরা সম্ভব নয়। কাজ শেষ না করে পিয়াসের বাবা ফিরতে পারবেন না। মা-ও একা আসতে সাহস পাচ্ছেন না। তবুও, দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে সবাই পিয়াসের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। যেহেতু তারা এসেই পড়েছে তাই সিদ্ধান্ত হয় নিশি ও পিয়াস অন্তত সপ্তাহখানেক এ বাড়িতেই থাকবে। পরিবেশ স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্য কোথাও যাওয়াটা যুক্তিসঙ্গত নয়। তবে রুমানার রাগ এখনো দগদগে। বিশ্বাসভঙ্গের জ্বালা কি এত সহজে মুছে যায়? পিয়াস শুধু তার স্বপ্নটাই নয়, ভেঙে দিয়েছে নিরুর মতো নিষ্পাপ মেয়ের মনটাও। রুমানা ভাবছে, কী বলবে নিরুকে সে? কী করে তাকে সান্ত্বনা দেবে?
আলোচনা শেষ হলে সবাই ধীরে ধীরে যার যার ঘরে ফিরে যায়। পিয়াসের জন্য আগেই একটি ঘর বরাদ্দ ছিল। সে সবার চোখের সামনেই নিশির হাত ধরে উপরে উঠে যায়। দৃশ্যটা রুমানার চোখে মৌন বিদ্রোহ। তবে ফারাজ পুরোপুরি ভাবে পিয়াসের সঙ্গেই ছিল যদিও পিয়াসের চাহুনি দেখে মনে হচ্ছে সে ফারাজকে কিছু একটা বলতে চায়।
নিশি স্তব্ধ। এই পিয়াস মির্জাকে সে ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। তাকে যত দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে। একটা অচেনা মেয়ের জন্য তার এমন এক তরফা যুদ্ধ? পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জবাব দেওয়া?
ইশ্… তার জন্যই কারো বিয়ে ভেঙে গেল! নিরুর মুখ মনে পড়তেই নিশির গলা বুজে আসে। যেন নিজের অজান্তেই কারো জীবনে অন্ধকার ঢেলে দিয়েছে। সে কি ভুল করেছে? অন্যায় করে ফেলেছে?
চিত্রা চেয়ার টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। স্বামীর দিকে হেলে ফারাজের গলায় বাঁধা টাইটি খুলে দিচ্ছে। এমন সময় ফারাজ হেসে জিজ্ঞেস করে,
“ভাবীর কাছ থেকে শুনলাম তোমার নাকি বমি বমি ভাব?”
চিত্রা চোখ না তুলেই জবাব দেয়, “ছিল। এখন নেই। তেঁতুল খেয়ে একদম চাঙ্গা হয়ে গেছি।”
ফারাজ চোখ বড় বড় করে বলে,”কি বলো! ধন্যবাদ, বউ, ধন্যবাদ। আমি জানি তুমি এখন ঠিক কী বলবে ‘বাবা হতে চলেছো ফারাজ!’ তাই না? কিছু বলার আগেই আমি বুঝে গেছি। আহা! এত্তটুকু ভালোবাসা যে স্বামী থেকে সরাসরি ‘বাবা’ পদে প্রমোশন করানোর জন্য। বাবা হবো জানতাম, কিন্তু এত জলদি হবে এটা কল্পনাতেও ছিল না!”
চিত্রা এবার বিরক্ত মুখে বলে, “এই যে বড়লোকের ছাওয়াল মাথায় কী কিরমি হয়েছে নাকি? নাকি রাস্তা থেকে ভেজাল পানি খেয়ে এসেছেন?”
ফারাজ গম্ভীর ভঙ্গিতে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, “ছ্যাহ বউ তুমি আমাকে কী বলছো এসব? আমি পিওর হেলদি। সুস্থ সবল পুরুষ মানুষ! এখন তো আমার অনেক কাজ। বাচ্চার নাম ঠিক করতে হবে, তারপর আবার ডায়াপার স্টক করতে মার্কেটে যেতে হবে!”
চিত্রা গম্ভীর মুখে জবাব দেয়, “এই জন্যই তো আপনাকে আমি দারাজ এলাচী বলে! আমার জার্নির কারণে একটু বমি ভাব করেছিল। তার চেয়ে বেশি কিছু না। আপনার দেখছি মরার আগে ওপরে যাওয়ার শখ। ছ্যাহ! ছোটলোক স্বামীকোথাকার।”
ফারাজ কপালে হাত দিয়ে কষ্টে বলে, “ইমোশনাল ড্যামেজ করলি রে আবুলের নাতনি!”
চিত্রা দাঁত কিটমিট করে বলে,
“আপনার ড্যামেজের মাকি-সাকি নাকি।”
সারাদিন অভ্র আয়েশার সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। কথা তো নয়ই। অনেক কষ্টে একপ্রকার অনুনয় করে আয়েশাকে রাতে বাগানে আসতে বলেছে। আয়েশা চুপিচুপি, চোরের মতো এসে দাঁড়ায় বাগানের মাঝখানে। হঠাৎই চোখে পড়ে দোলনাটা আপনাআপনি দুলছে।
“এমা! কেউ থাকলে একটা কথা, কিন্তু যদি ভূত হয়?” মনেই ভাবতে না ভাবতেই আয়েশা দোয়া পড়তে পড়তে এগোয় দোলনার দিকে।
ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা শক্তপোক্ত হাত তাকে টেনে নেয়। বুকের মধ্যে চেপে ধরে। ঠোঁটের ওপর রাখে হাত। ভয় পেয়ে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে প্রায় চিৎকার করতে যাচ্ছিল আয়েশা, তখনই সেই চেনা কণ্ঠটা বলে ওঠে,
“আরে ঘরনী! কেঁচোর মতো কাঁকড়াঝাঁক করছো যে! আরেকটু হলেই তো আমার ভবিষ্যৎ ফিউজ করে দিতে!”
অভ্রর মুখ চিনে একটু শান্ত হয় আয়েশা। মুখটা ছেড়ে দিতেই সে বলে ওঠে, “আরে কী যে বলো! তোমার ভবিষ্যৎ মানেই তো আমার সম্বল। ফিউজের কথা বললে পাপ লাগবে। পাপের চিপায় পড়ে আমিই না আবার অক্কে চলে যাই।”
অভ্র হেসে বলে, “বসো।”
“কই?”
“আমার মাথায়।”
“কি?! ইশ! আমার লজ্জা করে!”
“আরে বেডি, দোলনায় বসো।”
“কেন?”
“তোকে দোলনা থেকে ধাক্কা দিয়ে উগান্ডায় পাঠাবো। বস জলদি!”
অভ্রর হঠাৎ ধমকে বড় বড় চোখ করে তাকায় আয়েশা। সদ্য হওয়া প্রেমিকের এত রাগ?শেষমেশ আয়েশা দোলনায় বসে। অভ্র তাকে হালকা করে দোলাতে থাকে।
“ও ঘরনী!”
“আমার নাম গ…”
আয়েশাকে থামিয়ে অভ্র বলে, “না, আজ থেকে তুমি শুধুই আমার ঘরনী!”
আয়েশা মুচকি হাসে।
“তাহলে তোমার ঘরনী তোমার জন্য একটা কবিতা লিখেছে। শুনবে?”
“শোনাও।”
“ইতল বিতল ব্যাঙের ছাতা
ছাতার ওপরে আমার মাথা,
মাথা গেল ভাইসা,
আমি গেছি কুদ্দুসের বাপের ফাঁদে ফাইসা।”
কবিতা শুনে অভ্রর মাথা ঘুরে যায়। কিছু বলার আগেই হাওয়ায় ভেসে আসে অদ্ভুত একটা গলা,
“কালুর বাপ আই মিসিং ইউ।
লগে অলছো ফাসিং ইউর লাভিংয়ে…”
নিশুতি রাত। হাওয়ার গতি বেড়েই চলেছে। নিস্তব্ধ আকাশের নিচে ছায়াঘেরা আঁধারে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যেরা মেতে উঠেছে মেঘে-মেঘে আলো-আঁধারির খেলায়। ঘূর্ণি পাক খাচ্ছে হাওয়া।তালুকদার বাড়ির পোড়া দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক সুশোভিত পুরুষ। অন্ধকারের মধ্যেও তার সাদা শার্ট পতপত করে উড়ছে। ঠিক তার চুলের মতোই। কিন্তু উড়ন্ত চুল কিংবা জামা নয় যা ভয়ংকর, তা হলো তার চোখ। সেই চাহনি আঁধারকেও কাঁপিয়ে দিতে পারে।
সে চুপচাপ তাকিয়ে আছে পোড়া তালুকদার বাড়ির দিকে। কি ভাবছে তা কেউ জানে না। কিন্তু সে জানে, সেই রাতে যদি সাতাশটি দেহের সঙ্গে আরেকটি ছোট্ট নিষ্পাপ দেহও নিস্তেজ হয়ে যেত তাহলে আজকের এই বিষাক্ত প্রেম ও ক্রোধের সন্ধিক্ষণে তার আত্মা এমন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থাকত না।
সে মনে মনে বলে ওঠে, “আমিও তোমায় ততটাই ভালোবাসি, যতটা তীব্র ছলনায় ডুবে আছে তোমার প্রেমিক। তবুও এই পৃথিবী আমাকেই খলনায়ক ভাবে,ভাববেই। তোমার ভালোবাসা কি এতোই নগণ্য ছিল, যে আমার ভাগ্যে জুট্ল না? জুটলে হয়ত আমিই হতাম তোমার অর্ধাঙ্গ।”
ঠিক তখনই অন্ধকার চিরে হারিকেন হাতে চলে আসে মোফাজ্জল। মুরগির খোপগুলো ঠিক আছে কিনা দেখতে বেড়িয়েছিল। কিন্তু কি ভেবে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ পড়ে যায় সেই রহস্যময় পুরুষের ওপর। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪২
“বাবা, তুমি কেডা?”
লোকটা সামান্য চুপ থেকে ধীর স্বরে উত্তর দেয়,
“কায়সার… বজ্র কায়সার।”
মোফাজ্জলের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। চোখ বিস্ফারিত। কণ্ঠ শুকিয়ে আসে,
“কা…কায়সার?”