চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৭

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৭
ইশরাত জাহান জেরিন

“আমি এই কাইল্লা বেডারে বিয়ে করমু না। মরে গেলেও না।”
“আরে কি ধরনের কথাবার্তা? কালা মানুষের মন ভালা হয়। জানিস না?”
“তাহলে তুমি বিয়ে করে ফেলো। বড়আব্বা তো বুড়াই হয়ে গেছে।”
রুমানা চোখ রাঙাতেই নিরু চিপসে যায়। নিরুকে জোর করে সাজানো হয়েছে। একটু পর পর জোহান রুমে উঁকি ঝুঁকি মেরে হাঁক তুলছে,”হয়েছে?আর কত সময় লাগবে? বালের আটা-ময়দা মাখন লাগে? থোমায় এত কিছু মাইরা বাল ফালাইবো?”

রুমানা একটু পর পর জোহানকে রুম থেকে বের করে। গালাগাল করে। চেঁচিয়ে বলে,”বাড়ির মধ্যে সব হইল এক একটা নাহালত। জানোয়ার মানুষ করছি। মুখের কি ছিঁড়ি একএকজনের।”
চিত্রা রান্নাঘরে হাতেনাতে এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। গরমের কারনে গোসল করেছিল সে। সেই তো আবার ঘেমে একাকার। ফারাজ ঠিকই বলেছে রান্নাঘর আর বাথরুমেও এসি লাগানো উচিত। এত ছোটলোকিপনা আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
“চিত্রা ওই কাঁচের বাটিটা দাও তো। মাংস ঢালি।”
চিত্রা এগিয়ে দিতেই মোহনা তাতে মাংস পরিবেশন করে।
“ভাবী আমি নিয়ে যাব?যাই না প্লিজ। ওই কাইল্লা জামাই দেখার শখ হচ্ছে।”
“তুমি জানলে কেমনে জামাই কালো না সাদা?”
“নিরুর ঘরের সামনে উঁকি মেরেছিল আয়েশা। নিরু নাকি ওইসব বলছিল। সব জেনে আমারও জামাই দেখার শখ হচ্ছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“নিজের ফর্সা স্বামী থাকতে পরের হবু বরকে দেখার এত শখ?” মোহনা কাজ থামিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“সেটা তো আমিও বলি নিজের ওমন সুন্দর স্বামী রেখে পরের বরের ওপর নজর দেওয়াটা কি ঠিক? যাই হোক আমার ভাসুর সাহেবও কিন্তু মাশাআল্লাহ।চিত্রার দৃষ্টি স্থির। সে বাঁকা হেসে জবাব দিল।
“কি বুঝাতে চাইছ?”মোহনা তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে পুনরায়।
“যা বুঝে গায়ে তীরের মতো খোঁচা বিঁধেছে আপনার আপাতত তাই বুঝাতে চেয়েছি।”চিত্রা নিজের চুলগুলো কানপেছনে সরিয়ে নিল।
“কথা শিখেছ দেখছি। মরার খুব শখ?এই বাড়ির মাছেদের চুপচাপ লুকিয়ে মুখ বুজে থাকতে হয়। বলা তো যায় না কথার কারনে কোনো বিড়ালের নজরে পড়ে যাও।” মোহনা ভ্রু কুঁচকে বলল।
চিত্রা হেসে ফেলল। বলল “মাছের খবর জানি নাগো ভাবী। তবে বাড়ির সবচেয়ে ভয়ানক আর হিংস্র বুনো বিড়ালটা কিন্তু আমারই পোষা।” বলেই বাটি হাতে গুনগুন করে চিত্রা বাহিরে চলে গেল।
সোফার ঘরে বাড়ির সব পুরুষমানুষ বসে আছে। সোহান পালোয়ানও তাদের মধ্যে। চিত্রা ডাইনিং টেবিলে তরকারির বাটি রাখার অজুহাতে বসার ঘরের দিকে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করে। খানিকটা রীরের আভাস দেখা যাচ্ছে চেহারা নয়।
হঠাৎ রুমানা এসে বলল, “মিষ্টি আনো বউ, খুশির খবর আছে।”

চিত্রা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কি খবর?”
রুমানা ফিসফিস করে বলল,“নিরুর বিয়া আজই হইতেছে। তাড়াতাড়ি গিয়া ওরে নিয়া আসতে হইব।”
চিত্রা তড়াক করে রান্নাঘর থেকে মিষ্টির বাটি এনে রুমানার সামনে ধরতেই রুমানা আবার বলল,
“সবাই কাজে ব্যস্ত বউ, তুমি নিজেই মেহমানদের সামনে গিয়া মিষ্টিটা দিয়া আসো না।”
চিত্রা একটু থমকে বলল, “আমি? এতো পুরুষ মানুষ বসে আছে… উনি জানলে তো বকবেন।”
রুমানা হেসে বলল, “ফারাজের কথা কও? ওরে না জানাইলেই তো হইব। যাও যাও, একটু শরীর চালাও।”
রুমানার কথার অবাধ্য হওয়ার সাধ্য নেই চিত্রার। সে মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে নেয়। যদিও সকাল থেকে তার গায়ে ছিল কামিজ কিন্তু রুমানা একগাদা কথা শুনিয়ে দিয়ে বলেছে, “বাড়ির বউরা শাড়ি পরে। এসব কামিজ-টামিজ এ বাড়ির জন্য নয়।”

ইশশ… ফারাজ পাশে থাকলে, আজ এতটা শুনতে হতো না। কেন জানি চিত্রার মনে হয় ফারাজকে বাড়ির সবাই খুব মানে, ভয় পায়। যেন তার কথাই শেষ কথা। বাধ্য হয়েই হোক, অথবা অন্য কোনো অজানা কারণে। কিন্তু কারন কি তা চিত্রা আজও জানে না। ফারাজকে ঘিরে এত ভয়, এত মেনে চলার আসল কারণটা কী? ওদিকে বসার ঘরে সোহান, রাজন আর রোশানের সঙ্গে কথা বলছে। বিয়ে করতে এসেছে অথচ পরিবারের কেউকে আনেও নি। এমন ভাবে কেউ মেয়ে দেখতে আসে? আর এখানে তো মেয়েকে দেখার আগেই বিয়ে পাকা করা হয়েছে কি অদ্ভুত। মনে হচ্ছে পারিবারিক বিয়ে নয় ব্যবসায়িক বিয়ে হচ্ছে।
সেদিন রাজন যখন নিরুর জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসে, সোহান খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। তারপর হঠাৎই রাজি হয়ে যায়। রাজন তো অবাক! কারণ, বিয়ের নাম শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে সোহান। সে বারবার বলে”যারে তারে বিয়ে করুম না। যে প্রথম দেখাতেই মন কাইড়্যা লইব, তারেই চাই সোহান পালোয়ানের!”
চিত্রা মিষ্টির বাটি হাতে নিয়ে বসারঘরে ঢোকে, তখনও সোহান দেখতে পায় নি তাকে।তবে ঠিক সেই মুহূর্তে রাজন বলে ওঠে,

“আরে চিত্রা! তোমার কষ্ট করার দরকার কী ছিল?”
চোখের কোনায় চিত্রার চূড়ান্ত লজ্জা জমে ওঠে।
আর তখনই… সোহানের গভীর কালো চোখ থমকে যায় চিত্রার দিকে!এ যেন অমাবস্যা রাতে পূর্ণিমার অপ্রত্যাশিত আগমন। এক মুহূর্তে স্থির হয়ে যায় সোহানের অন্তর। বুকের ভেতর থরথর করে কিছু একটা। চোখ দিয়ে জ্বলে উঠে এক ঝলসানো আকুলতা।সোহান মনে মনে বলে ওঠে,”সরুপা আগুন সুন্দরী একনজরের লাগিয়া দেখা দিয়া আমারে ধ্বংস না করলেও পারতা।”

চিত্রা সোহানের দিকে মিষ্টির বাটি এগিয়ে দিচ্ছিল। ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা শক্তপোক্ত হাত হঠাৎ করে তার বাহু চেপে ধরে টেনে নেয়। আকস্মিক টান সামলাতে না পেরে সে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় একটা প্রশস্ত, উষ্ণ বুকের ওপর।
ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মাথা তুলে চেয়ে দেখে সেই উষ্ণ বুকের অধিকারী আগ থেকেই তাকিয়েই আছে তার দিকে। দু’চোখে আগুন জ্বলছে। ক্ষিপ্ত তার চাহুনি। গভীর সেই দৃষ্টি চিত্রার বুক কাঁপিয়ে দেয়।তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, “ফ… ফারাজ!”
বসার ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই চোখের মালিক হঠাৎই গর্জে ওঠে।”আয়েশা!”
শব্দ ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আয়েশা দৌড়ে আসে।তার ঢোক গেলারও সময় নেই,”তোর ভাবীকে সঙ্গে রুমে নিয়ে যা। এখনই।”
চিত্রা কাঁপা কণ্ঠে কিছু একটদ বলার চেষ্টা করে, “কিন্তু ফারাজ …”
“রুমে যাও, চিত্রা।”দাঁত চেপে ফিসফিসে গর্জনে জবাব দেয় ফারাজ।
চিত্রা কিছু না বলে নীরবে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। মাথা নিচু। মনে তোলপাড়। ফারাজ হঠাৎ এমন রাগে ফেটে পড়ল কেন? কিছুই বুঝতে পারছে না। গর্জনের শব্দে চমকে উঠে নিশি। দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে। কিন্তু পিয়াস এক মুহূর্তের জন্যও তাকে নিচে নামতে দেয় না। আজ শুক্রবার। জুমার নামাজ শেষ করে একটু আগে সে ঘরে ফিরেছে। এখনো গায়ের পাঞ্জাবিটা খোলার ফুরসত হয়নি এরই মাঝে নিচে আবার কী অশান্তি শুরু হয়ে গেল? পিয়াস স্ত্রীর হাত ধরে বলে, “ভেতরে যাও।”

নিচে তখন ভয়ানক নিস্তব্ধতা। রুমানা, সুলেমান এলাহী যারা সাধারণত মুখ ফুটেই কথা বলেন, আজ তারা চুপ। দাঁতে দাঁত চেপে নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন।যেন ফারাজের রোষের ভারে পিষ্ট হয়ে গেছেন।সোহান চুপচাপ তাকিয়ে আছে ফারাজের দিকে। তার চোখে বিন্দুমাত্র বিচলন নেই। ঠাণ্ডা, স্থির, গভীর সেই দৃষ্টি।
“আমার বউকে রাস্তাঘাটের মেয়ে মনে হয়?”
ফারাজের কণ্ঠ ঘরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। “কে পাঠিয়েছে ওকে এত মানুষের সামনে? নিজের ইচ্ছায় আসার মতো মেয়ে তো চিত্রা নয়।”

মোহনা আর নদী তখন রান্নাঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে আছে গলা গিলছে,মোহনার চোখ স্থির থাকলেও নদীটা ভয়ে আকুপাকু করছে। ফারুরে উপরে পাঠানো হয়েছিল নিরুকে আনতে।সে এখনো ফেরেনি।রুমানা নিঃশ্বাস আটকে চুপ করে আছে। চোখেমুখে ভয়।রাজন দাঁড়িয়ে উঠে বিরক্ত স্বরে বলে,
“তুই ঠিক আছিস তো? তামাশা লাগাইছিস ক্যান? এইসব কাজ বাড়ির বউরা না করলে কি আমরা মরদরা করবো?”
“করাই উচিত। কারণ আপনারা তো কেউ আবাট পুরুষ নন। সব হাতে চুরি পরা কাপুরুষ।”
ফারাজের চোখ রক্তজ্বলে জ্বলজ্বল করে উঠে,”আসল পুরুষ কখনও চরিত্রহীন হয় না।”
রাজনের কণ্ঠ চড়ায়, “তুই ওই মেয়ের জন্য সবার বিরুদ্ধে যাইতাছিস? পস্তাবি ফারাজ!”
ফারাজ ঠাণ্ডা গলায় তীব্র ছেদে বলে,
“পস্তাবো কি না ওটা সময় বলে দেবে।”
থামে সে। হঠাৎ গর্জে ওঠে। ” আমি কিন্তু কথা রিপিট করতে পছন্দ করি না। উত্তর এখনও পাই নি কিন্তু আমার বউকে এখানে পাঠিয়েছে কে?”

রুমানার কপাল বেয়ে ঘামের রেখা নেমে এলো । কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে, তবুও কাঁপা গলায় মিনমিন করে বলে ওঠে,
“বাবা… আমি সত্যিই বুঝতে পারি নাই।”
ফারাজ ধীর ভঙ্গিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় মায়ের দিকে। সেই দৃষ্টিতেই শরীরের সব স্নায়ু গলতে থাকে রুমানার। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।নিস্তব্ধতার ভেতর ফারাজের কপালের শিরা আর ঘাড়ের রগগুলো ফুলে উঠেছে। ক্রোধ তার রক্তের ধারায় পিষে ফেলছে সব সংবেদন। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে সোহানের পাশে গিয়ে বসে। নিস্পৃহ ভঙ্গিতে এক টুকরো মিষ্টি মুখে দেয়, আঙুলে চেটে নেয় চিবিয়ে। তারপর দু’ পা আলগা করে পায়ের ওপর পা তোলে। ঠান্ডা গলায় বলে,

“ডিয়ার মা… আপনি সর্বদাই কেন বুঝতে পারেন না ? কোন পদ্ধতিতে আপনাকে বুঝালে আপনি বুঝবেন?
রুমানা কাঁপতে থাকা ঠোঁটে কিছু বলতে যায়, ফারাজ ততক্ষণে ঠান্ডা হিম কণ্ঠে আবার বলে ওঠে,
“বোঝোন না, তবুও এত ফালপাড়ি? বয়সের সঙ্গে মাথার মগজ খেয়ে ফেলেছেন নাকি? আশা করি ফারাজ এলাহী মানুষ খুনের বিবরণ আপনার অজানা নয়? চলন্ত বন্দুকের সামনে ঘুরছেন আপনারা সবাই। চলন্ত বন্দুকের সামনে বাঁচা কিন্তু মুশকিল । তা জানেন তো? ক’দিন পর মরবেন। কবরে ফেলে আসা হবে। তাই সময় আছেন ভালো হন৷ কারন ফারাজ ছাড় দেয় তবে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়।”
হুট করে জোহান উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বলে, “বউকে এত ভালোবাসা ঠিক না। নজর লেগে যেতে পারে।”
এক মুহূর্তেই ফারাজের চেহারা পালটে যায়। সে দাঁড়িয়ে পড়ে, চোখ রাঙিয়ে এক ঝটকায় জোহানের গলা চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বলে,
“জানোয়ার… তোর নজরের গুষ্টি”…… থেমে যায় ফারাজ। ফের দাঁত পিষে বলে উঠে, তুই মিতালিকে খুন করেছিস, আমি জানি। তবুও চুপ আছি। জানিস কেন? কারণ তোর মৃত্যুর খবর শুনলেও আমার বউটা জিজ্ঞেস করবে ‘জোহান ভাই কোথায়?’ বউয়ের চোখে তোদের ভালো রাখছি, ভালো থাক। তা না হলে… মিতালির থেকেও ভয়ানক মৃত্যু তোদের কপালে লিখা ছিল। সাবধান হ।”

রাজন চুপসে যায় ফারাজের কথায়। এমনকি সেখানে উপস্থিত বাড়ির বউরাও বিস্মিত। আগেই তারা বুঝেছিল, ওই মেয়ের খুন এমনি এমনি হয়নি। নিশ্চয়ই কিছু দেখে ফেলেছিল, নয়তো ফাঁসানো হয়েছিল কোনো কিছুর জন্য। সোহান পালোয়ান তখনও চুপচাপ। সে জানে, ফারাজ কেন এতটা ক্ষিপ্ত। কারণ, ফারাজ কখনও চাইনি আলো-আঁধারির সাক্ষাৎ হোক। অথচ আজ তা হয়েই গেল। এখন তো পালা আলোকে আঁধারের গ্রাস করার। রাজনের বুকের ভেতর কেমন যেন করতে থাকে। তার মানে কি সেদিন আকরাম আর ফারুককেও খুন করেছিল ফারাজ? শুধুমাত্র নিজের স্ত্রীর জন্য ভাইয়ের সঙ্গে বিরোধ? এসব করে লাভই বা কী? রোশান একপাশে চুপ করে বসে আছে। এসব নিয়ে তার কিছু যায় আসে না। তবে, ফারাজকে যে সে সহ্য করতে পারে তাও না। কিন্তু কখনও কখনও সহ্য করতেই হয়।

সুলেমান এলাহীও থম মেরে বসে আছে। বারবার ফোন আসছে জুনায়েদ এলাহীর। পৌরসভায় সম্মেলন আছে। উপস্থিত থাকা জরুরি। কিন্তু সুলেমানের এখন সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। আল্লাহ ভালো জানে বাড়িতে আবার কোন কাহিনী শুরু হবে? সুলেমান চায় ছেলেরা মিলেমিশে থাকুক৷ একসঙ্গে মিলে খারাপ কাজ করলেও যেন একসঙ্গেই করে। তারা কেউ যেন নিজেদের মধ্যে খুনে লিপ্ত না হয়। কিন্তু পরিস্থিতি হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
“আমাগো পাপ নিয়া নাড়াচাড়া করলে কিন্তু তোর গুলাও বাহির হইব, ফারাজ,” গলা নিচু করে বলে রাজন বলে উঠল। “তুইও ভালা থাক, আমাগোরেও থাকতে দে। নিজের মানুষরে ক্ষতি কইরা লাভ কী? আমরাও চাই তুই অন্তত একটা সুন্দর সংসার কর, বউটারে লইয়া সুখে থাক। এই আপোষ-দ্বন্দ্ব বাদ দে।”
ফারাজ ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয়, “সেটাই তো চাই। তবে একটা কথা মনে রাখবেন আমি মরলে আপনাদের নিয়েই মরব। একা মরতে ভালো লাগে না। উপর নিয়ে একসঙ্গে গল্পসপ্ল করব, চা-পানি খাব। ভাবছি ভাবীদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবে। চা-পানির ব্যবস্থার জন্য লোক তো লাগবেই।”

“মজা করতাছি না।”চোখ কুঁচকে কেউ রাজন।
“আমিও না। ফারাজের সোজাসাপটা জবাব।
রোশান মাঝ থেকে বলে উঠল,”নিরুর বিয়াটা পাকা হইছে সোহানের লগে। আর ঝামেলা করিস না। তুইও একটু থাম, ফারাজ।”

ফারাজ হালকা হেসে উঠে দাঁড়ায়। সোহানের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতেই বলে, “শুভ কামনা। আমাদের অভিনেত্রী আপারে গলায় ঝুলাইবার জন্য। এত খুশির খবর মনে হয় আমার জন্মের আগেও আমি পাই নি।” সে বাঁকা হেসে পুনরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সোহানের চোখে। বলে,” যাই হোক সোহান ভাই, রুমে যাই। বউটারে একা রাখলে জয়েন্টে ব্যথা করে। এখনো তো আবার বাচ্চার বাপ হওয়া বাকি।” আঙ্গুল কপালে ঠেকিয়ে সালাম ঠুকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দোতালা থেকে আসা ফারিহার চিৎকারে থমকে যায়। ফারিহা উপর থেকে চিৎকার করে বলে,”হায় আল্লাহ! নিরুরে কোথাও পাওয়া যাইতাছে না!”

চিত্রা বারান্দায় উদাস মনে বসে আছে। আকাশের দিকে চেয়ে আছে সে। নিরুকে এখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে।
সে জানে, নিরু ফারাজকে ভালোবাসে।
তবুও তো সব ভালোবাসা যদি পূর্ণতা পেয়ে যেত, তবে অপূর্ণতার গল্পগুলোর কি হতো?
“মন খারাপ কেন?”
চিত্রা পিছনে তাকায় না। দরকারও পড়ে না। সে জানে ফারাজই এসেছে। সে আকাশের দিকে তাকিয়েই বলে,”এই বাড়িতে কিছু একটা চলছে, ফারাজ।”
ফারাজের কপালে ভাঁজ পড়ে।
“কেন? কী হয়েছে?”
“আমরা ঢাকায় যাওয়ার আগের দিন, মিতালি আমাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। ওইদিন যদি তার কথা শুনতাম, তাহলে হয়তো সে আজ বেঁচে থাকত।”
ফারাজ একটু বিরক্ত হয়,”আবার সেইসব কথা শুরু করেছো?”
চিত্রা থেমে না থেকে বলে, “আপনি খুঁজে বের করুন না কারা এসব করছে।”
“আমি? এসব তো পুলিশের কাজ।”
“তাহলে চলুন থানায়। ওকে খুন করা হয়েছিল, অথচ আত্মহত্যা বলে চালিয়ে মামলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
ফারাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সময় দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সে চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে।
বারান্দার বাইরে শনশন করে বাতাস বইছে।
আকাশটাও মুখ গোমড়া করে আছে।আজও কি তবে মন-আকাশে ঝরবে বৃষ্টি?

সুলেমান এলাহীর চোখে ঘুম নেই। গভীর রাতে বারান্দার দিকের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।মুখে বিরক্তির ছাপ। রুমানার ওপর রাগে তেতে আছেন তিনি। কেন যে চিত্রাকে দিয়ে এমন কাজ করানো লাগল! এসব না হলে হয়তো আজ এই বাড়িতে এত তামাশা জমত না। রাজন লুঙ্গি ঠিক করে বাবার পাশে এসে দাঁড়ায় । রুমের মধ্যে মায়ের সঙ্গে রোশান বসে আছে। রাজন বাবাকে রুমে এনে বসায়। সবাই গোল হয়ে বসে। রাজনের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কি কান্ড ঘটে গেল? ভেবেছিল সোহানের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কে তৈরি হলে ব্যবসায়িক সম্পর্কটাও বাড়বে। বিয়ের জন্য রাজিও হয়েছিল। বাড়িতে চলে এসেছে। কিন্তু কি লজ্জাজনক পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে ফিরে যেতে হলো। ভাগ্যিস বিয়ের বিষয়ে বাড়িতে কোনো কথা বলে নি। তাহলে পরিবারের মানুষ এলাহী বাড়ি সম্পর্কে কি ভাবত? নদী এসে কাপগুলোতে চা ঢেলে দেয়। কিছু বলতে চাইছে কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। চাহনিতে কিছু একটা বলতে চাইলেও সে শব্দ খুঁজে পায় না। রোশান এবার খেয়াল করে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

“কিছু বলবেন ভাবী?”
নদী হোঁচট খাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করে,
“নিরুর… কোনো খবর?”
রাজনের মুখ সঙ্গে সঙ্গে কুঁচকে ওঠে। ঘৃণা গিলে ফেলা দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকায়,
“ওই শালীর ঘরের শালী ঘরে যা তুই!”
নদী কেঁপে ওঠে। রাজন এবার চিৎকার করে উঠে,”নডির এত সাহস! এই বাড়ি থেইকা পালায় কেমনে? তাও জানালার কাঠ কাইটা? এসব দিনে করা হয় নাই। রাতেই সাজানো হইছে। তার চেয়ে বড় কথা বাড়ির পেছন দিয়া পালাইছে। দুপুরের সময় ওইপেছন দিকে কোনো মানুষও যায় না। ফারাজরে আগেই বলছিলাম ক্যামেরা লাগা। না তা কেন লাগাবে? তবে নিরু একা পালায় নাই। ওরে সাহায্য করছে কেউ না কেউ।কিন্তু পালাইয়া যাইব কই? ওরে ধরতে পারলে কসম খোদার, জবাই কইরা ফেলমু!”
একটু থেমে নদীর দিকে হাত তুলে ইঙ্গিত করে বলে,
“বাঁজার ঘরের বাঁজা ঘরে যা! তোরে দেখলেই গায়ে বিষ ধরে আমার।”

নদী আঁচলে মুখ ঢেকে চোখের জল ফেলে চুপচাপ চলে যায়। মনে প্রশ্ন জাগে তার, স্বামীরা কি এভাবেই স্ত্রীদের অন্যের সামনে অপমান করতে পারে? নারী বলেই কি সহ্য করতে হয় সব? পুরুষের দোষে গৌরব, নারীর দোষে কলঙ্ক কেন? পুরুষ করলে গুনগান নারী করলেই বদনাম?খোদা সব যদি তোরই সৃষ্টি হয় তবে এত ভেদাভেদ কেন?
নদী চলে যাওয়ার পর রোশান এসে দাঁড়ায় রাজনের সামনে। গলা নিচু করে বলে,
“ভাই, আকরাম আর ফারুকরে ফারাজই খুন করছে মনে হয়। তাইলে সে আমাগোরেও ছাড়বে না। কিছু না কিছু করতেই হইব।”
রাজন ধীরে মাথা নাড়ে। “আমি মনে করি, ওগো বিদেশ চইলা যাওয়াতেই উচিত। কয়দিন পর দেখমু তাগো জামাই-বউয়ের পরিতের চোটে আমাদের গোপন গুমর ফাঁস হবে। শালা ফারাজ নিজেও মরবে, আমাগোরেও মাইরা ছাড়বে।”
রোশান শ্বাস ছাড়ে। বলে,”চিত্রা যেন কিছু না জানে। ও জানলে তার আবদারেই হয়তো ফারাজ আমাগোরে খাইবো।”
রাজন চুপ থেকে শীতল কণ্ঠে জবাব দেয়,”কিন্তু যদি ফারাজ আমাদের মাইরা ফেলার আগেই তার মৃত্যু হয়?”

“চিত্রারে আমার লাগবো। বিয়া করমু ওরে।”
সোহান ধীরে সিগারেট জ্বালায় ধোঁয়া ছেড়ে বলে।
“আপনার মাথা ঠিক আছে? চিত্রার বিষয়ে কোনো ভাগাভাগি হবে না। আমি সহ্য করব না।”
সোহান ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে বলে,” আমি তো চাই তুই জ্বলে পুড়ে মর। যাই হোক ওরে কিন্তু আমি অনেক আগেই কিন্না রাখছি।”
জোহান চমকে ওঠে। “মানে?”
“মানে ফারাজ চিত্রার বিয়ের দিন মিজান সাহেবের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হইছিল। সে নতুন মেয়ে এনে দিবে। মেয়ে নাকি অনেক সুন্দরী। অগ্রিম টাকা ছাড়া মিজান কাজ করে না। তাই পুরো টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়ে আসল না।”

“কেন?”
“কারণ, সেই মেয়েটারেই তোর ভাই বিয়ে করে মাঝ রাতে এই বাড়ির বউ কইরা আনছে।”
জোহান এবার সত্যিই থমকে যায়। “চিত্রারে তোর ভাই বিয়ে করছে কেন জানোস?” সোহান ফের বলে উঠল।
“জানি না। তবে উদ্দেশ্য ছাড়া চিত্রা তালুকদারকে বিয়ে নি তা জানি।”
“কী রকম উদ্দেশ্য?”
“এইসব জানলে তো আমি ফারাজ এলাহীই হয়ে যেতাম! যাই হোক চিত্রা হলো তালুকদার বাড়ির মেয়ে। দশ বছর আগে সেই রাতে পুরো তালুকদার পরিবার সবাই মারা যায়। শুধু বেঁচে থাকে বংশের একমাত্র মেয়ে চিত্রা। আর যেই দিন ওরে ওকে আপনার হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল সেই দিনই, কোনো রকম আগাম বার্তা ছাড়া আমার ভাই বিদেশ থেকে ফিরে হুট করে ওকেই বিয়ে করে মাঝ রাতে বাড়ি আনে। অদ্ভুত না?”
“এসবের উত্তর খোঁজার চেষ্টা কেউ করে নাই?”সোহান সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে বলে।
“বালের ঠেকা?”বলেই জোহান ফলের ঝুড়ি থেকে ছুরিটা তুলে নেয়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে।বলে,
“কতদিন রক্ত খাই না ভাই। আপনি কখনও রক্ত খাইছেন?”
“আমি তো খুনি। কত রক্ত মুখে ছিটে পড়ে। কতবার যে স্বাদ নেওয়া হইছে। তবে স্বাদের না।”
জোহান হাসে। “লাগবেই বা কেমনে? আপনি তো ব্যাটা মানুষ মারেন। মেয়ে মানুষের রক্তের স্বাদ একবার মুখে লাগলে বুঝতেন এই জোহান কেন মেয়েমানুষ খুন করতে এত ভালোবাসে।”
সোহান তাকায় তার দিকে। “কয়টা খুন করছিস?”
“উনত্রিশটা।”
জোহান ছুরির ফলা আঙুলে ছোঁয়ায়। রক্তের এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে। বলে, “চিত্রারে মারলে ত্রিশটা পূর্ণ হবে।”

“এই ঘোড়ার ডিমের বাড়িতে পিরিত করার মতো একটা জায়গায়ও নাই। আমি আর লুকিয়ে লুকিয়ে পিরিত করতে পারতাম না রে!” বলেই আয়েশা ঠোঁট উল্টে অভ্রর মাথায় ঘুরিয়ে একটা মৃদু চড় বসিয়ে দেয়।
“আহ্! লাগছে তো!” অভ্র কাতর গলায় বলে।
“ছ্যাঃ বেডা, চুপ কর! পঁচা কথা কইস না। চল এখনই যাই কাজী অফিসে। তোকে ভরসা করা যায় না। যদি আবার অনয় কাউকে পেয়ে পালাইয়া যাস?”
“আগে চলো, একটু প্রেম করে আসি।”
“কোথায় করবি?”
“উপরে।”
“শালা! আমার তো এখনও বিয়েই হয় নাই। বিয়ের আগেই উপরে পাঠাতে চাস? আমি মরলে কুদ্দুসরে কে জন্ম দিবে? তোর নানি?”

“ঘরনী! অন্তত আমার নানির ইজ্জতেরে নিয়া ছিনিমিনি খেলিস না প্লিজ।”
অভ্র আয়েশার হাত ধরে চোরের মতো সিঁড়ি বেয়ে ছাদে ওঠে। ছাদে তখন দখিনা হাওয়া। অভ্র খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আয়েশার হাত জড়িয়ে ধরে। আয়েশা হঠাৎ হেসে ওঠে, “এই শালা! আমার হাতে কাতুকুতু লাগে।”
“ধন্যবাদ, আমার মুডটা তামা তামা করার জন্য।”
“সরি সরি আবার ধর। এবার হাসমু না।”
অভ্র এবার দুহাত দিয়ে আয়েশাকে ছুঁয়ে দেখে। চোয়ালে হাত রাখে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবেগে বলে ওঠে, “একটা চুমু খাই তোকে?”
চিত্রার মন ভালো নেই। এই বাড়িতে যেন একটার পর একটা অশান্তি লেগেই আছে। ঘুম তার চোখ ছেড়ে বহু দূরে পালিয়েছে।

“ঘুম আসছে না, বিবিজান?” পাশে থেকে জিজ্ঞেস করল ফারাজ।
“না।” সংক্ষেপে উত্তর দেয় চিত্রা।
চিত্রা শুয়ে থাকা অবস্থায় উঠে বসে। খাঁচার দিকে তাকিয়ে হেমস্টার গুলোকে দেখে বলে,”ওদের এখনও নাম দেওয়া হয়নি।”
“ওদের নিয়ে ভাবছো কেন? তুমি বরং আমার ভবিষ্যৎ গেডা-গেডির নাম নিয়ে ভাবো।”
“সময় হলে ভাবব। আমি তো এখনও বাচ্চা।”
“কি বলো? এখনও বড় হওনি?”
“না।”
“ছ্যাহ! কী ছোটলোকি ব্যাপার হয়ে গেল। সময়ের অভাবে এখন তোমাকে জোর করে বড় বানাতে হবে।”
“কীভাবে বড় বানাবেন?”
“খাইয়ে খাইয়ে।”
“কী খাওয়াবেন?”
“ভালোবাসা।”

“ওসব ছোটলোকি খাবার আমি খাই না।”
“ভালো জিনিস কেন খাবে বউ। তুমি তো আমার মাথাই খেয়েই কুল পাচ্ছ না।”
“ঠিকই বলেছেন, ভালো কিছু তো খাওয়াই হয় না আমার। খাই শুধু অখাদ্য, মানে আপনার মাথা।”
“আবুলের নাতনির!!!”
রাতটা আজ ভীষন ঠান্ডা। দখিনা হাওয়া বারংবার চুপিসারে কারও কান ঘেঁষে কিছু বলে চলে যাচ্ছে। ছাদে পা রাখতেই ফারাজ থমকে দাঁড়ায়। বাতিগুলো নিভে আছে। চারপাশ কি ভীষণ অন্ধকারের নিমজ্জিত। গা ছমছম করা একটা অনুভূতি চিত্রার বুক চেপে ধরে।
“ভয় করছে বিবিজান?”
“আপনি পাশে থাকলে আমার কেন জানি একদমই ভয় করে না। একটা কথা বলব?”
“বলো।”
“মৃত্যুর পর আমাকে দাফন পর যখন সবাই চলে যাবে। তখন আপনি খানিকটা সময় না হয় আমার সাহস হয়ে কবরের পাশে বসবেন। অন্তত প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার আগে,জবাবদিহির আগে। ”
“এসব শুনতে চাই না চিত্রা। তোমাকে ছাড়া এক মুহুর্ত বাঁচার ইচ্ছে নেই আমার। তুমিহীনা এক মুহুর্ত বেঁচে থাকার কথা চিন্তার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয়।”

পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়। নিরবতা কাটাতে চিত্রা ফারাজের হাত ধরে। সে সিঁড়ির ধাপে মৃদু শব্দে বলে ওঠে, “ফারাজ, আমি না… কারও গলার আওয়াজ পাচ্ছি। মেয়েলী হাসির শব্দ। আপনি শুনতে পাচ্ছেন না?”
ফারাজ মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। সে কান পেতে শোনে। হ্যাঁ, সত্যিই… ছাদের শেষ কোণ থেকে মেয়েলি হাসির চাপা শব্দ ভেসে আসছে। অন্ধকারে কে হাসছে এত রাত করে?
“এই বউ, ছাদে মনে হয় কোনো ডাইনী আছে। জলদি বাসায় চলো।” ফারাজ আধাভয়ে বলে উঠে।
চিত্রা চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,”কেন? ভূতে ভয় পান আপনি?”
“ভূতের তো হ্যান্ডসামদের ওপর বেশি নজর থাকে, জানো না? নজর লেগে যেতে পারে। তাই যেতে বলছি।”
চিত্রা ভ্রু কুঁচকে হাসে। “এখানে হ্যান্ডসাম কে?”
ফারাজ একমুহূর্ত থেমে যায়। উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ। চিত্রা হেসে বলে,”উফফ, সরি! আপনার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম।”

ছাদে এখন শুধু বাতাসের শব্দ। দূরের গাছের পাতায় হালকা সাঁ সাঁ করে বাতাস খেলা করছে। চিত্রা এগিয়ে যায় ছাদের শেষ দিকে। পেছন ফিরে ফারাজকে না দেখে হিসহিসিয়ে বলে,”আসছেন না কেন? আমি নিশ্চিত বাড়িতে চোর ঢুকেছে। আমার সঙ্গে চলুন, চোর ধরতে হবে!”
শাড়ির আঁচল কোমরে গিট দেয় চিত্রা। এখন তাকে দেখাচ্ছে একেবারে বাঘিনীর মতো। ফারাজ একটু হেসে বলে,”চিত্রা, তুমি চোর ধরতে যাচ্ছো? তাও আমাকে একা ফেলে? যেও না। চোরকে নিয়ে বিশ্বাস নেই। যদি চাকু চালিয়ে দেয়?”
চিত্রা তখন তার হাতটা ধরে শক্ত করে।

“আপনি চোরকেও ভয় পান? এত ভালো মানুষ আপনি? দুনিয়ায় তো দেখছি আপনার মতো আর কেউ নেই।”
ফারাজ চিত্রার কথা শুনে মনে মনে একটু হেসে ফেলে। সে তো আর জানে না তার স্বামীর এই হাত দু’টো কত খুন করেছে! কত রক্ত, কত যন্ত্রণার সাক্ষী সে! চোর? ওদের সামনে চোর কিছুই না।ফারাজ আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বলে মনে মনে বলে ওঠে,”ওহে আসমান-জমিনের মালিক… তোমার এই দুনিয়ায় কিছু পেতে হলে এত অভিনয় কেন করতে হয়? আমি যে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি… অভিনয় করতে করতে সত্যিকারের অভিনেতা হয়ে যাচ্ছি। অথচ মঞ্চের পর্দা নামে না, থামেও না…”
চিত্রার ডান হাতে মোবাইল। ফারাজ বলে,”তুমি চোরের কাছাকাছি গেলেই আমি ফ্ল্যাশ অন করব।” চিত্রা ‘হুম’ বলে বাঁ হাতে বাঁশের লাঠি তুলে নেয়। কাজে গিয়েই বসাবে এক বারি। আজকে একেবারে চোরের বেল বারি দিয়ে ভেঙে শরবত করবে।

চুপি চুপি পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায় ছাদের শেষ কোণের দিকে। আঁধারে কাউকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু দুইটা অবয়ব যেন জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে। চিত্রা লাঠি উঁচু করে। ঠিক তখনই ফারাজ ফ্ল্যাশ অন করে দেয়।আলোর ঝলকানিতে মুহূর্তেই চিত্রা ও ফারাজ দু’জনেরই চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম! কারন চোখের সামনে খালি চোরই না,বরং চুন্নীও দাঁড়িয়ে আছে। তাও আবার একেবারে কাছাকাছি। একটুর জন্য চুমুতে ব্রেক কষে গিয়েছে তাদের। চিত্রা কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে কিছু বলার আগেই ফারাজ বলে উঠে,

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৬

“কিগো আমার মাইয়ার জামাই, কুদ্দুসকে জন্ম না দেওয়া দামড়া শেষেও তুমিও তলে তলে ঠেলাগাড়ি চালাচ্ছো। বাহ বাহ ওয়েট একটা চু চ্যাড পোস্ট করতে হবে দেখছি।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৮