চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৫ (৪)

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৫ (৪)
ইশরাত জাহান জেরিন

রাস্তায় থেকেই ফারাজ চিত্রাকে একটা কল করল। তৈরি হতে বলল। আজকে তারা ঘুরবে, হুঁ, তার আগুন-সুন্দরী ঘুরবে। শেষবারের মতো ঘুরতে যাওয়া যাকে বলে, তাই না? মাথার একপাশ জ্বলছে কবরের সেই ব্যক্তি, তার যন্ত্রণা, তার অসংখ্য আর্তনাদ আর তার চিৎকারের শব্দে। অন্যপাশ জ্বলছে প্রতিশোধের স্পৃহায়। রোজ ঠিকই বলেছে, এসব ভালোবাসা আজ থাকলে কাল থাকে না। চিত্রা সরে গেলে ফারাজকে কষ্ট করে ভালো হতে হবে না। এত সত্য লুকিয়ে বাঁচতে হবে না। এত প্রশ্নের মুখোমুখিও হওয়া লাগবে না। মেয়েটার অপ্রয়োজনীয় মোহে জড়াচ্ছে। আচ্ছা, চিত্রাকে মারার সময় সে যদি জিজ্ঞেস করে, “সেদিন আমার যখন মিজান চাচার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল, তখন বিয়ে করে আমাকে না বাঁচিয়ে মাথায় একটা গুলি করে মেরে ফেললেই তো গল্প শেষ হয়ে যেত। গল্পকে উপন্যাস বানানোর কী খুব প্রয়োজন ছিল, ফারাজ এলাহী?”

তখন ফারাজ চিত্রাকে কী জবাব দেবে? যে আসলেই সেসব করাটা অনেক দরকার ছিল? সে প্রিয় শত্রুকে তিলে তিলে মারতে ভালোবাসে বলেই এত কিছু করা? চিত্রাকে উজাড় করে দিয়ে কেড়ে নেবে বলেই এত সময় নেওয়া। ঠিক যেমন ভাবে কবরের ব্যক্তিটির সব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই। তবে ফারাজ কী করে বলবে? ওইদিন সে চিত্রাকে মারেনি, বরং মিজান সাহেবের হাত থেকে বাঁচিয়েছে কেবল নিজের হাতে ধুঁকিয়ে মারার জন্য?
ফারাজ বাড়িতে এসে দেখে, চিত্রা নীল রঙের একটা মসৃণ শাড়ি পরেছে। তার ধবধবে ফর্সা পেট শাড়ির ফাঁক দিয়ে ফারাজের চোখ পুড়িয়ে দিচ্ছে। ফারাজ চিত্রার সেই উপচে পড়া সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। আজ কতদিন পর তার চিত্রা সেজেছে, হাসছে। কবিরা যদি তার চিত্রাকে দেখত, তাহলে তারা তাদের কাব্যে ফুলের এত সুন্দর বর্ণনা দিতে পারত না। ফারাজ চিত্রাকে নীল গোলাপের সঙ্গে তুলনা করতে চায়, অথবা সেই পৌরণিক কল্পলোকের বিরল ব্লু স্পাইডার লিলির সঙ্গে। যার নীল-বেগুনি সরু পাঁপড়িগুলোর গঠন, দেখতে পাওয়া চিত্রার মতোই দুর্লভ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফারাজ গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আসে। গায়ে সে চিত্রার পছন্দ করা একেবারে হালকা বেবি স্কাই-ব্লু রঙের ফুলহাতা শার্ট আর সাদা রঙের একটা প্যান্ট পড়ে। বুকের দিকের দু’টো বোতাম বরাবরের মতো খোলা। ফারাজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল সেট করে। ফারাজের চুল নিয়ে অনেক মাথাব্যথা। শরীরের সকল কিছু থেকে চুল নিয়ে সে একটু বেশিই ভাবে। তার মতে মানুষের চুলই তার সৌন্দর্য বর্ধনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ফারাজ শার্টের হাতার বোতাম লাগিয়ে ডান হাতে রোলেক্সের ঘড়ি বাম হাতে চেইন ব্রেসলেট পড়ে। ফারাজ ম্যাচিং ব্লু সানগ্লাস চোখে পড়েছে। আচ্ছা সে কী কোনো ফ্যাশন শো তে যাচ্ছে? এত সাজগোছ কেনো? তাও আবার বউকে খুন করতে?
চিত্রা পুরো তৈরি হয়ে ফারাজের সামনে দাঁড়াতেই ফারাজ বলল,”কিছু একটা মিসিং লাগছে।”
চিত্রা চিন্তায় পড়ে গেল। কী মিসিং লাগছে? ফারাজ টিপের বক্স থেকে একটা নীল রঙের টিপ বের করে চিত্রার কপালে টিপ পড়িয়ে বলল,”এবার পারফেক্ট।”

চিত্রা আয়নায় নিজেকে দেখে মুচকি হেসে বলল, “কী বলুন, লাগছে না আমাকে পারফেক্ট মিসেস ফারাজ এলাহী?”
ফারাজ মেকি হাসল। বলল,”হ্যাঁ।” দমটা বন্ধ হয়ে আসছে তার। কী করে মারবে? আবার মারতেও যে হবে। এই প্রথম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ফারাজের এত ভাবতে হচ্ছে।

প্রথমে দুজনে হাসপাতালে যাবে মার্জিয়াকে দেখতে। আজকে ১৯ আগস্ট। চিত্রার পরিবারের সকলে এই দিনেই মারা গিয়েছে। প্রতিবছর এই দিনে চিত্রা তালুকদার বাড়িতে যায়। হাসপাতাল থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আজকে ফারাজ নিজ থেকেই চিত্রাকে ফুচকা খাইয়েছে। বাহিরের সকল খাবার খেতে নিয়ে মন মতো। চিত্রা একটু অবাক বটে। তবে তার চেয়েও বেশি খুশী। চিত্রার জরজেটের শাড়ি সামলাতে একটু কষ্ট হয়। আবার ভালোও লাগে। সে ফুকচা খাওয়া শেষ করে গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে। প্রতিবারের মতো ফারাজ সিটে বসেই চিত্রাকে বলে,” জানালার সঙ্গে হেলান দিয়ে পা দু’টো আমার উরুর ওপর রাখো। ওইসব না ছুঁলে গাড়ি চালানোর মুড আসে না।” চিত্রা একটু বাঁকা মুচকি হেসে পা দু’টো তুলে দেয়। তারপর হা করে ফারাজকে দেখতে থাকে। আয় আল্লাহ এই পুরুষ এত সুন্দর কেন? ফারাজ আজকে একটার পর একটা গল্প করছে। এমন ভাবে সে আগে কখনও এত কথা বলে নি। চিত্রা সেই কথা শোনার চেয়েও মনোযোগ দিয়ে দেখছে ফারাজের কণ্ঠনালি ওঠা-নামার দৃশ্য। চিত্রা আপ্লুত হয়। সে এগিয়ে এসে ফারাজের সেই কণ্ঠনালি ছুঁয়ে বলে,” আপনাকে হারালে চিত্রার সকল রঙ ফুরিয়ে যাবে। আপনাকে নিজের করে রাখার জন্য আপনার এই আগুন সুন্দরী আগুন হাতে নিয়েও খেলতে পারে।”
ফারাজ জবাব দেয় না। তবে খানিকবাদে বলে,”তুমি আমাদের বাড়ি আসার পর মোট চারটে খুন দেখেছে। ভয় লাগে না?”

“লাগে তো। তবে আপনি যখন রাতে পাশে থাকেন না তখন যেই ভয় লাগে তার থেকে কমই। জানেন ফারাজ সেদিন স্বপ্নে দেখলাম আমাকে মাথায় কেউ একজন গুলি করেছে। আপনি আমায় তখন বাঁচাতে আসেননি।”
“খুনির চেহেরা দেখেছিলে?”
“দেখার আগেই নিশ্বাস থমকে গিয়েছিল।”
চিত্রা পোড়া বাড়িতে অনেকক্ষণ সময় কাটায়। ফারাজ চিত্রাকে একা সময় কাটাতে দেয়। চিত্রা ভেতরে থাকাকালীন সে গাড়ির ভেতর থেকে পিস্তল বের করে হোলস্টারের রাখে। শার্টের কারনে পিস্তল ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ফারাজ সরাসরি চিত্রার কাছে চলে যায়। চিত্রা মোফাজ্জলের সঙ্গে কথা বলছিল। কী কথা ফারাজ জানে না। তবে এক মুহুর্তের জন্য ফারাজকে দেখে মোফাজ্জল চুপ করে যায়। তারপর বলে উঠে, “ফারাজ বাবারে নিয়া আইসো আইজকা?
ফারাজ ভ্রু কুঁচকায় তারপর বলে,” কেন আগে বুঝি অন্য কাউকে নিয়ে আসতো?”
লোকটি কিছু বলতে যাবে তার আগেই চিত্রা তার দিকে তাকায়। বলে,”আমরা একটু বাহিরে হাঁটাহাঁটি করি। আমার কোমর ব্যথা হয়ে গিয়েছে।”

বাহিরে এসে ফারাজ চিত্রাকে বলে,”চলো ঘোরাউত্রা নদীর ধারে যাই।”
চিত্রা একটু চমকে তাকায়,”বাসায় যাবো না?”
“ইচ্ছে তো করছে না। জানো বজ্রর বাড়িও বাজিতপুর। বাজিতপুরে ওদের পুরনো বাড়ি আছে। তবে কেউ সেখানে থাকে না। একেবারে জমিদার বাড়ির মতো।”
চিত্রা হালকা মাথা নাড়ে”হুম আমি জানি।”
“জানো মানে?”ফারাজ কৌতূহলী হয়ে তাকায়।
” মানে এখানে যে একটা জমিদার বাড়ি আছে তা জানি। অনেক আগে গিয়েছিলাম সেখানে। ওইটা কয়সার বাড়ি।”
“ওহ চিনো তাহলে?”ফারাজ অবাক হয়।
“হুম তবে আজকে জানলাম ওইটা বজ্র কায়সারের বাড়ি। সবাই ভূতের বাড়ি বলে চিনে। তাও আবার আমার নিজের এলাকায় ওই বাড়ি। চিনবো না মানে?”একটু চুপ থেকে চিত্রা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “চলেন, এখন বাসায় ফিরে যাই। আজকে কেন জানি কিছুই ভালো লাগছে না।”

ফারাজ চিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়। তারপর নিচু গলায় বলে,
“ভুলে যাও চিত্রা ওই বাড়ির কথা। আর কখনও… তোমার বাড়ি ফেরা হবে না।”
ফারাজ অন্ধকারের মাঝেই তালুকদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একটা বড়সড় নিশ্বাস ছেড়ে কোমরে গোঁজা পিস্তলের ওপর হাত রাখে। আজকের দিনে চিত্রার পরিবারের সবাই মারা গিয়েছে। চিত্রা কেন অন্য দিনে মরবে? এটা তো আনফেয়ার হয়ে যায়। আজকে দশ বছর পর তালুকদার বাড়ি আবার জ্বলবে। সেইদিন রাতে ফারাজের হাতেই তালুকদার বাড়ি জ্বলেছিল আজকে আবার জ্বলবে। চিত্রার মাধ্যমে তালুকদার বংশের ইতি ঘটবে। ফারাজ ভাবতে না ভাবতেই বৃষ্টি নেমে পড়ল। ফারাজ আকাশের দিকে চেয়ে একটু থতমত খেলো। হুট করে এমন বৃষ্টি? আকাশ তো পরিষ্কার ছিল? এখন আগুন লাগালেও তো জ্বলবে না। আর সময় পেল না। চিত্রা বৃষ্টি দেখে মহাখুশি। সে শাড়ি,গহনা কিছুর চিন্তা না করেই বৃষ্টিতে ভিজছে। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফারাজও ভিজে একাকার। এই তালুকদার বাড়ির সামনে এলে বৃষ্টি কেন বার বার তাদের ভিজিয়ে দেয়? বৃষ্টি কী কোনো শুভ লক্ষণ? তাদের জন্য পাঠানো খোদার কোনো রহমত!
ছাতা নিয়ে মোফাজ্জল এবং তার বৃদ্ধা স্ত্রী দৌড়ে এসে বলল,” আরে আপনারা এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে রাতবিরেতে বাড়ি যাইবেন কেমনে? আমাগো বাড়ি থাইকা যান। দক্ষিণের ঘরডা খালি আছে।”

চিত্রা নিষেধ করতে যাবে তার আগেই ফারাজ বলল,”আপনি সব ব্যবস্থা করুন। আমরা আসছি”
“কিন্তু আমাদের বাসায় যেতে সময় লাগবে না। আর আপনি এই জায়গায় থাকতে পারবেন? ওয়াশরুম সেই কোন মাথায়। রাতে সমস্যা হবে না?”
“হবে না।”
চিত্রা কথা না বলে মোফাজ্জলের বউয়ের পিছু নেওয়ার চেষ্টা করতেই ফারাজ পেছন থেকে চিত্রার হাত ধরে টেনে তাকে নিজের কাছে টেনে বলে,”আজকের রাতটা তোমার জীবনের আরেকটি স্পেশাল রাত হতে চলেছে।”
“এই দেখুন আমরা কিন্তু অন্যের বাড়িতে। আপনি কিন্তু এখানে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবেন না যেন।”
ফারাজ চিত্রাকে কাছে টেনে আনল। গলার কাছের গর্তমত জায়গাটায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল,

” সারা নিশি ভিজবো দুজন
চাদের.. ঝরা জলে….
সারা নিশি ভিজবো দুজন
চাদের… ঝরা জলে……
সবুজ সুখে করবো কুজন
নীল আকাশের তলে…
পাঁজর দিয়ে আগলে রবো
তোমায় সারা জীবন
ফারাজের ঠোঁট তখনও চিত্রার শিকলে বন্দী। তবে হাত চিত্রার গাল বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসে গলায়। ফারাজ মৃদু ভাবে চেপে ধরে গলাটা। আস্তে আস্তে হাতের চাপ বাড়তেই চিত্রার চোখে ব্যথায় পানি চলে আসে। বৃষ্টির পানিতে চোখের পানি আড়াল হয়ে গেছে। ফারাজ কী আর সেই অশ্রু দেখেছে? চিত্রার এবার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার পথে। সে আঁতিপাঁতি করতে থাকা চিত্রার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে চোখের দিকে নেশালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর বলে, ❝তোমার চোখ দুটো প্রেমের পোশাকে ছদ্মবেশী বিপর্যয়। যুদ্ধ না করেও আমি হেরে গেছি।❞রাস্তায় থেকেই ফারাজ চিত্রাকে একটা কল করল। তৈরি হতে বলল।

আজকে তারা ঘুরবে, হুঁ, তার আগুন-সুন্দরী ঘুরবে। শেষবারের মতো ঘুরতে যাওয়া যাকে বলে, তাই না? মাথার একপাশ জ্বলছে কবরের সেই ব্যক্তি, তার যন্ত্রণা, তার অসংখ্য আর্তনাদ আর তার চিৎকারের শব্দে। অন্যপাশ জ্বলছে প্রতিশোধের স্পৃহায়। রোজ ঠিকই বলেছে, এসব ভালোবাসা আজ থাকলে কাল থাকে না। চিত্রা সরে গেলে ফারাজকে কষ্ট করে ভালো হতে হবে না। এত সত্য লুকিয়ে বাঁচতে হবে না। এত প্রশ্নের মুখোমুখিও হওয়া লাগবে না। মেয়েটার অপ্রয়োজনীয় মোহে জড়াচ্ছে। আচ্ছা, চিত্রাকে মারার সময় সে যদি জিজ্ঞেস করে, “সেদিন আমার যখন মিজান চাচার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল, তখন বিয়ে করে আমাকে না বাঁচিয়ে মাথায় একটা গুলি করে মেরে ফেললেই তো গল্প শেষ হয়ে যেত। গল্পকে উপন্যাস বানানোর কী খুব প্রয়োজন ছিল, ফারাজ এলাহী?”

তখন ফারাজ চিত্রাকে কী জবাব দেবে? যে আসলেই সেসব করাটা অনেক দরকার ছিল? সে প্রিয় শত্রুকে তিলে তিলে মারতে ভালোবাসে বলেই এত কিছু করা? চিত্রাকে উজাড় করে দিয়ে কেড়ে নেবে বলেই এত সময় নেওয়া। ঠিক যেমন ভাবে কবরের ব্যক্তিটির সব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই। তবে ফারাজ কী করে বলবে? ওইদিন সে চিত্রাকে মারেনি, বরং মিজান সাহেবের হাত থেকে বাঁচিয়েছে কেবল নিজের হাতে ধুঁকিয়ে মারার জন্য?
ফারাজ বাড়িতে এসে দেখে, চিত্রা নীল রঙের একটা মসৃণ শাড়ি পরেছে। তার ধবধবে ফর্সা পেট শাড়ির ফাঁক দিয়ে ফারাজের চোখ পুড়িয়ে দিচ্ছে। ফারাজ চিত্রার সেই উপচে পড়া সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। আজ কতদিন পর তার চিত্রা সেজেছে, হাসছে। কবিরা যদি তার চিত্রাকে দেখত, তাহলে তারা তাদের কাব্যে ফুলের এত সুন্দর বর্ণনা দিতে পারত না। ফারাজ চিত্রাকে নীল গোলাপের সঙ্গে তুলনা করতে চায়, অথবা সেই পৌরণিক কল্পলোকের বিরল ব্লু স্পাইডার লিলির সঙ্গে। যার নীল-বেগুনি সরু পাঁপড়িগুলোর গঠন, দেখতে পাওয়া চিত্রার মতোই দুর্লভ।

ফারাজ গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আসে। গায়ে সে চিত্রার পছন্দ করা একেবারে হালকা বেবি স্কাই-ব্লু রঙের ফুলহাতা শার্ট আর সাদা রঙের একটা প্যান্ট পড়ে। বুকের দিকের দু’টো বোতাম বরাবরের মতো খোলা। ফারাজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল সেট করে। ফারাজের চুল নিয়ে অনেক মাথাব্যথা। শরীরের সকল কিছু থেকে চুল নিয়ে সে একটু বেশিই ভাবে। তার মতে মানুষের চুলই তার সৌন্দর্য বর্ধনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ফারাজ শার্টের হাতার বোতাম লাগিয়ে ডান হাতে রোলেক্সের ঘড়ি বাম হাতে চেইন ব্রেসলেট পড়ে। ফারাজ ম্যাচিং ব্লু সানগ্লাস চোখে পড়েছে। আচ্ছা সে কী কোনো ফ্যাশন শো তে যাচ্ছে? এত সাজগোছ কেনো? তাও আবার বউকে খুন করতে?
চিত্রা পুরো তৈরি হয়ে ফারাজের সামনে দাঁড়াতেই ফারাজ বলল,”কিছু একটা মিসিং লাগছে।”
চিত্রা চিন্তায় পড়ে গেল। কী মিসিং লাগছে? ফারাজ টিপের বক্স থেকে একটা নীল রঙের টিপ বের করে চিত্রার কপালে টিপ পড়িয়ে বলল,”এবার পারফেক্ট।”

চিত্রা আয়নায় নিজেকে দেখে মুচকি হেসে বলল, “কী বলুন, লাগছে না আমাকে পারফেক্ট মিসেস ফারাজ এলাহী?”
ফারাজ মেকি হাসল। বলল,”হ্যাঁ।” দমটা বন্ধ হয়ে আসছে তার। কী করে মারবে? আবার মারতেও যে হবে। এই প্রথম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ফারাজের এত ভাবতে হচ্ছে।

প্রথমে দুজনে হাসপাতালে যাবে মার্জিয়াকে দেখতে। আজকে ১৯ আগস্ট। চিত্রার পরিবারের সকলে এই দিনেই মারা গিয়েছে। প্রতিবছর এই দিনে চিত্রা তালুকদার বাড়িতে যায়। হাসপাতাল থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আজকে ফারাজ নিজ থেকেই চিত্রাকে ফুচকা খাইয়েছে। বাহিরের সকল খাবার খেতে নিয়ে মন মতো। চিত্রা একটু অবাক বটে। তবে তার চেয়েও বেশি খুশী। চিত্রার জরজেটের শাড়ি সামলাতে একটু কষ্ট হয়। আবার ভালোও লাগে। সে ফুকচা খাওয়া শেষ করে গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে। প্রতিবারের মতো ফারাজ সিটে বসেই চিত্রাকে বলে,” জানালার সঙ্গে হেলান দিয়ে পা দু’টো আমার উরুর ওপর রাখো।

ওইসব না ছুঁলে গাড়ি চালানোর মুড আসে না।” চিত্রা একটু বাঁকা মুচকি হেসে পা দু’টো তুলে দেয়। তারপর হা করে ফারাজকে দেখতে থাকে। আয় আল্লাহ এই পুরুষ এত সুন্দর কেন? ফারাজ আজকে একটার পর একটা গল্প করছে। এমন ভাবে সে আগে কখনও এত কথা বলে নি। চিত্রা সেই কথা শোনার চেয়েও মনোযোগ দিয়ে দেখছে ফারাজের কণ্ঠনালি ওঠা-নামার দৃশ্য। চিত্রা আপ্লুত হয়। সে এগিয়ে এসে ফারাজের সেই কণ্ঠনালি ছুঁয়ে বলে,” আপনাকে হারালে চিত্রার সকল রঙ ফুরিয়ে যাবে। আপনাকে নিজের করে রাখার জন্য আপনার এই আগুন সুন্দরী আগুন হাতে নিয়েও খেলতে পারে।”
ফারাজ জবাব দেয় না। তবে খানিকবাদে বলে,”তুমি আমাদের বাড়ি আসার পর মোট চারটে খুন দেখেছে। ভয় লাগে না?”

“লাগে তো। তবে আপনি যখন রাতে পাশে থাকেন না তখন যেই ভয় লাগে তার থেকে কমই। জানেন ফারাজ সেদিন স্বপ্নে দেখলাম আমাকে মাথায় কেউ একজন গুলি করেছে। আপনি আমায় তখন বাঁচাতে আসেননি।”
“খুনির চেহেরা দেখেছিলে?”
“দেখার আগেই নিশ্বাস থমকে গিয়েছিল।”
চিত্রা পোড়া বাড়িতে অনেকক্ষণ সময় কাটায়। ফারাজ চিত্রাকে একা সময় কাটাতে দেয়। চিত্রা ভেতরে থাকাকালীন সে গাড়ির ভেতর থেকে পিস্তল বের করে হোলস্টারের রাখে। শার্টের কারনে পিস্তল ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ফারাজ সরাসরি চিত্রার কাছে চলে যায়। চিত্রা মোফাজ্জলের সঙ্গে কথা বলছিল। কী কথা ফারাজ জানে না। তবে এক মুহুর্তের জন্য ফারাজকে দেখে মোফাজ্জল চুপ করে যায়। তারপর বলে উঠে, “ফারাজ বাবারে নিয়া আইসো আইজকা?
ফারাজ ভ্রু কুঁচকায় তারপর বলে,” কেন আগে বুঝি অন্য কাউকে নিয়ে আসতো?”
লোকটি কিছু বলতে যাবে তার আগেই চিত্রা তার দিকে তাকায়। বলে,”আমরা একটু বাহিরে হাঁটাহাঁটি করি। আমার কোমর ব্যথা হয়ে গিয়েছে।”

বাহিরে এসে ফারাজ চিত্রাকে বলে,”চলো ঘোরাউত্রা নদীর ধারে যাই।”
চিত্রা একটু চমকে তাকায়,”বাসায় যাবো না?”
“ইচ্ছে তো করছে না। জানো বজ্রর বাড়িও বাজিতপুর। বাজিতপুরে ওদের পুরনো বাড়ি আছে। তবে কেউ সেখানে থাকে না। একেবারে জমিদার বাড়ির মতো।”
চিত্রা হালকা মাথা নাড়ে”হুম আমি জানি।”
“জানো মানে?”ফারাজ কৌতূহলী হয়ে তাকায়।
” মানে এখানে যে একটা জমিদার বাড়ি আছে তা জানি। অনেক আগে গিয়েছিলাম সেখানে। ওইটা কয়সার বাড়ি।”
“ওহ চিনো তাহলে?”ফারাজ অবাক হয়।

“হুম তবে আজকে জানলাম ওইটা বজ্র কায়সারের বাড়ি। সবাই ভূতের বাড়ি বলে চিনে। তাও আবার আমার নিজের এলাকায় ওই বাড়ি। চিনবো না মানে?”একটু চুপ থেকে চিত্রা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “চলেন, এখন বাসায় ফিরে যাই। আজকে কেন জানি কিছুই ভালো লাগছে না।”
ফারাজ চিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়। তারপর নিচু গলায় বলে,
“ভুলে যাও চিত্রা ওই বাড়ির কথা। আর কখনও… তোমার বাড়ি ফেরা হবে না।”

ফারাজ অন্ধকারের মাঝেই তালুকদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একটা বড়সড় নিশ্বাস ছেড়ে কোমরে গোঁজা পিস্তলের ওপর হাত রাখে। আজকের দিনে চিত্রার পরিবারের সবাই মারা গিয়েছে। চিত্রা কেন অন্য দিনে মরবে? এটা তো আনফেয়ার হয়ে যায়। আজকে দশ বছর পর তালুকদার বাড়ি আবার জ্বলবে। সেইদিন রাতে ফারাজের হাতেই তালুকদার বাড়ি জ্বলেছিল আজকে আবার জ্বলবে। চিত্রার মাধ্যমে তালুকদার বংশের ইতি ঘটবে। ফারাজ ভাবতে না ভাবতেই বৃষ্টি নেমে পড়ল। ফারাজ আকাশের দিকে চেয়ে একটু থতমত খেলো। হুট করে এমন বৃষ্টি? আকাশ তো পরিষ্কার ছিল? এখন আগুন লাগালেও তো জ্বলবে না।

আর সময় পেল না। চিত্রা বৃষ্টি দেখে মহাখুশি। সে শাড়ি,গহনা কিছুর চিন্তা না করেই বৃষ্টিতে ভিজছে। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফারাজও ভিজে একাকার। এই তালুকদার বাড়ির সামনে এলে বৃষ্টি কেন বার বার তাদের ভিজিয়ে দেয়? বৃষ্টি কী কোনো শুভ লক্ষণ? তাদের জন্য পাঠানো খোদার কোনো রহমত!
ছাতা নিয়ে মোফাজ্জল এবং তার বৃদ্ধা স্ত্রী দৌড়ে এসে বলল,” আরে আপনারা এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে রাতবিরেতে বাড়ি যাইবেন কেমনে? আমাগো বাড়ি থাইকা যান। দক্ষিণের ঘরডা খালি আছে।”
চিত্রা নিষেধ করতে যাবে তার আগেই ফারাজ বলল,”আপনি সব ব্যবস্থা করুন। আমরা আসছি।”
“কিন্তু আমাদের বাসায় যেতে সময় লাগবে না। আর আপনি এই জায়গায় থাকতে পারবেন? ওয়াশরুম সেই কোন মাথায়। রাতে সমস্যা হবে না?”

“হবে না।”
চিত্রা কথা না বলে মোফাজ্জলের বউয়ের পিছু নেওয়ার চেষ্টা করতেই ফারাজ পেছন থেকে চিত্রার হাত ধরে টেনে তাকে নিজের কাছে টেনে বলে,”আজকের রাতটা তোমার জীবনের আরেকটি স্পেশাল রাত হতে চলেছে।”
“এই দেখুন আমরা কিন্তু অন্যের বাড়িতে। আপনি কিন্তু এখানে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবেন না যেন।”
ফারাজ চিত্রাকে কাছে টেনে আনল। গলার কাছের গর্তমত জায়গাটায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
” সারা নিশি ভিজবো দুজন
চাদের.. ঝরা জলে….
সারা নিশি ভিজবো দুজন
চাদের… ঝরা জলে……
সবুজ সুখে করবো কুজন
নীল আকাশের তলে…
পাঁজর দিয়ে আগলে রবো
তোমায় সারা জীবন

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৫ (৩)

ফারাজের ঠোঁট তখনও চিত্রার শিকলে বন্দী। তবে হাত চিত্রার গাল বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসে গলায়। ফারাজ মৃদু ভাবে চেপে ধরে গলাটা। আস্তে আস্তে হাতের চাপ বাড়তেই চিত্রার চোখে ব্যথায় পানি চলে আসে। বৃষ্টির পানিতে চোখের পানি আড়াল হয়ে গেছে। ফারাজ কী আর সেই অশ্রু দেখেছে? চিত্রার এবার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার পথে। সে আঁতিপাঁতি করতে থাকা চিত্রার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে চোখের দিকে নেশালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর বলে, ❝তোমার চোখ দুটো প্রেমের পোশাকে ছদ্মবেশী বিপর্যয়। যুদ্ধ না করেও আমি হেরে গেছি।❞

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৬