চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৭
ইশরাত জাহান জেরিন
‘নাহিয়ান মানে?’
নাহিয়ান চিত্রার পাশে চেয়ার টেনে বসল। কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে একটা জায়গা। নাহিয়ান বলল, ‘ভাবী আমি আসলেই কোনো নিহান শেখ নই। আমি স্পেশাল ফোর্সের ইন্টেলিজেন্স অফিসার নাহিয়ান খান। খান বংশের ছেলে।’
চিত্রার কাছে সব কিছু ধোঁয়াশা লাগছে। নিহান ভাই কি পাগল হয়ে গেল নাকি? চিত্রা এবার এক ঘন্টার মতো নাহিয়ানের বলা প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল। নাহিয়ান খান বাড়ির ছেলে। সেই বাড়ির বড় ছেলে মাহিয়ান খান। বাবা মনিরুল খান।
দুইভাই যখন ছোট ছিল তখন বাবার ব্যবসা ধ্বসে পড়ে। অনেক ঋণ জমা হচ্ছিল। উপায় না পেয়ে এলাহীর সবচেয়ে বড় পাপী,নোংরা, আর জঘন্য মানুষটির কাছ থেকে বাধ্য হয়ে ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে টাকা সুদ হিসেবে নেয়। দিনকাল ভালোই চলছিল তবে মাঝে বাবাকে অনেক চিন্তিত দেখাতো। একদিন লোকজন নিয়ে ফরহাদ এলাহী বাড়িতে হাজির হন। মেয়াদ শেষ হবার পরও বাবা তাকে টাকা পরিশোধ করতে পারছিলেন না। আসলে যারা একবার ঋণগ্রস্ত হয় তাঁদের মাথা থেকে ঋণ আর সহজে নামে না। দিনকে দিন তা বেড়েই চলে। সেইরাতে বাবাকে চোখের সামনে হত্যা করা হয়। মাকে চোখের সামনে ধর্ষণ হতে দেখে দু’ভাই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিন্তু ঘটনাক্রমে খান বাড়ির কাজের লোক নজরুল কাকা নিজের জীবন বাজি লাগিয়ে দুই ভাইকে বাঁচায়। তাদেরকে তাদের মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মামারা সপরিবারে আমেরিকায় থাকতেন। অনেকটা কষ্টেই বেড়ে ওঠা দুই ভাইয়ের। এমন না যে মামা-মামী তাদেরকে ভালোবাসতেন না। তাদেরককে অত্যাচার করতেন। অভাব তাদের। খুব ভালো পরিবেশেই বেড়ে ওঠে। তবে ওই যে চোখের সামনে একটা বড় রকমের ঘটনা ঘটে গিয়েছে তার রেশ কখনো কাটেনি। নাহিয়ান বাবা-মায়ের বিষয়ে কখনো কথা বলেনি। তবে মাহিয়ান সবসময় বলত সে বড় হয়ে দেশে ফিরে প্রতিশোধ নিবে। তবে দেশে ফেরার পর জানতে পারল ফরহাদ এলাহী নাকি মারা গিয়েছে। কে মেরেছে জানা নেই।
তবে নিজের ছেলের হাতেই খুন হয়েছে। সেই ঘটনা জানার পর আস্তে আস্তে মাহিয়ান কেমন যেন হয়ে যায়। আসলে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরই তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। আবোল-তাবোল কথা বলত সারাক্ষণ। রাতে ঘুমের মধ্যে কথা বলত, কেঁদে উঠত। ফরহাদ এলাহীর কাছ থেকে বাবা-মায়ের প্রতিশোধ নিতে পারবে না এই ভেবে আরোও ভেঙে পড়ে। এক পর্যায়ে মানসিক চাপে পাগল হয়ে ঘরবন্দী হয়। মাহিয়ান আজও বেঁচে আছে। তবে এটাকে বেঁচে থাকা বলে না। নাহিয়ান সেই ক্ষোভেই আরও মন দিয়ে পড়াশোনা করে। ইন্টেলিজেন্স অফিসার হয়। দেশে আসে কেবল এই বাড়িতে ঢুকে সকলের জীবন জাহান্নাম বানাতে। তবে মাঝে ওইযে ভালোবাসা? ওই ভালোবাসার ফাঁদে পড়েই তো কিছুই করা হয়নি। নাহিয়ানের কাছে এখন সবার সবকিছুর প্রমাণ আছে। চাইলেই সবাইকে ধরিয়ে দিতে পারে। তবে এখন আর প্রয়োজন নেই।
কারণ সকলে নিজ নিজ হাতে তাদের ধ্বংস লিখেছে। এই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল এখন তাদের মৃত্যুর প্রহর গুনছে। নিজস্ব প্রতিশোধ নিতে এসেছিল অবশ্য নাহিয়ান ,তার ক্ষমতাও ছিল সবার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। নিজের জানের পরোয়া করে না সে। তবে তার কিছু হয়ে গেলে ফারিয়ার কি হবে? এই জাহান্নামে ফারিয়াকে ফেলে তো মরতে পারে না। কেবল ফারিয়া চায় বলেই নাহিয়ান জলদি তাকে নিয়ে বিদেশ চলে যাবে। মেয়েটাকে আর অসুস্থ জীবনে রাখতে পারবে না সে। কোনো মারামারি নেই,ঝামেলা নেই এমন একটা জায়গায় তাদের সংসার হবে। তবে বাকিরা নাহিয়ান খানকে না চিনলেও ফারিয়া চেনে। তাইতো প্রতি মুহূর্তে তার নাহিয়ানকে নিয়ে ভয় হয়। যদি ভাইয়েরা সব জেনে যায়? তখন তো তারা নাহিয়ানকে মেরে ফেলবে। কেবল এই একটা ভয়ে সে রোজ পুড়ছে, মরছে আবার জন্মাচ্ছে। চিত্রা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘সুলেমান এলাহীকে কে হত্যা করেছে জানেন?’
নাহিয়ান চিত্রার দিকে ভালো করে তাকায়। একটু মুচকি হেসে বলে, ‘জানব না কেন? আপনি শুনতে চান ভাবী? মজার বিষয় বলি? এলাহী বাড়িতে আগেও অনেক খুন হয়েছে। একটা সময় পর সব কমে এসেছে। তবে আপনি আসার পর আবার খুন শুরু হয়েছে। রহস্যময় নয় কি?’
চিত্রা একটা ঢোক গিলল। নাহিয়ান পুনরায় বলল,’ভাবী আপনি আর আমি এক জলের মাছ। তবে সাবধান। আমাদের ধরার জন্য কিন্তু অনেক জাল ফেলা হয়েছে। জাল থেকে বাঁচতে না পারলে শিকারির শিকার হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।’
চিত্রা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরল। তার শরীর এখনো থরথর করে কাঁপছে। কিসব শুনেছে সে? আসলেই কি সব সত্য? এলাহী বাড়ির মানুষগুলো আসলেই এত জঘন্য? এখন সব কেমন যেন লাগছে। এত খুন,রাত করে মাটি খুঁড়া, নোংরা পট্টিতে বাড়ির পুরুষদের আনাগোনা সবই তবে সত্য ছিল? চোখের দেখা সেইসব মিথ্যা নয়? তাহলে ফারাজ? রাত করে তার বাড়ির বাইরে যাওয়া। ভোরে ফেরা সেইসবও কি এমনি এমনি ছিল না? আচ্ছা ফারাজও কি তবে নারীদের এত জঘন্য ভাবে নিপীড়ন করে? তাদের পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়? পাপের টাকায় জীবন চালায়? মিথ্যার পাহাড় জমিয়ে চিত্রার সঙ্গে সংসার করছে? এটা কি সংসার? মাথা কাজ করছে না চিত্রার। ফারাজ পাপিষ্ঠ হলে তো চিত্রাকে কখনোই এত ভালোবাসত না।
আচ্ছা সব কিছু কোনো নাটক ছিল না তো? নাটক হলে চিত্রাকে বিয়ে করেছে কেন ফারাজ? চিত্রা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। বুঝতে পারছে না কি করবে। তবে মনে মনে এতটুকুই চাওয়া ফারাজ যেন এসবে না জড়ায়। চিত্রা ফারাজের জন্য সব করতে পারবে,কিন্তু ফারাজের ছলনা সহ্য করতে পারবে না। যদি পাপ করেও থাকে সে যেন খোদার কাছে ক্ষমা চেয়ে সব কিছু থেকে ফিরে আসে। চিত্রা ফারাজকে হারাতে চায় না। তারা বিদেশ চলে যাবে কিংবা অনেক দূরে কোথাও। তবুও…. তবুও যেন ফারাজ সব ছেড়ে দেয়। চিত্রার নিহানের কথা মনে পড়ল। উঁহুঁ নিহান বললেও ভুল হবে। নাহিয়ান খান। তার গোটা নাম থেকে শুরু করে বংশের পদবীও অদলবদল। এই এলাহী বাড়িতে তার প্রবেশ করা সবই ছিল পরিকল্পিত। তবে নাহিয়ান খান বাড়ির সকলের কথা বললেও ফারাজ এলাহীর কথা কিছুই বলেনি। আর না ওই ফরহাদ এলাহীর কথা। সময় হলে নাকি সেইসব চিত্রা নিজেই জানতে পারবে। তবে এবার চিত্রার ভয় হচ্ছে। বাড়ির মানুষগুলো খারাপ সেই জন্য নয়। বরং নাহিয়ান ইন্টেলিজেন্স অফিসার সেই ভেবে। এর মানে সে আরও অনেকের ব্যাপারে অনেক কিছু জানে।
ফারাজ বাসায় এসে সরাসরি গোসলে যায়। চিত্রা ফারাজের ফোনের সামনে বসে আছে। ফোনটা খুলে ভেতরে কি আছে দেখা হয়নি কখনো। তবে আজ ইচ্ছে করছে। ফারাজ রুমে আসতেই চিত্রাকে বলল,’তোমার পাসপোর্ট কিন্তু চলে আসবে। বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তো?’
চিত্রা ফারাজের দিকে তাকায়। সরু চোখে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কে বলুন তো?’
‘এমন প্রশ্ন কেন?’
‘না আজকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে তো তাই চিনতে পারছি না।’
‘মানে কি? আগে বুঝি অসুন্দর ছিলাম? দেখো চিত্রা আমার জন্মের দিন পুরো পৃথিবী আলোকিত হয়ে গিয়েছিল আমার রূপের ঝলকে। বাপরে বাপ নিজের প্রশংসা নিজে করতে আমি একটুও পছন্দ করি না। শুধু তুমি বললে দেখে একটু বললাম।’
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৬
ফারাজ আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চিত্রা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। কালো পুকুরটির দিকে তাকাতেই চোখের সামনে মিতালি, নিলুফা, মাহাদী, মরিয়ম আর মারিয়ার মুখটা ভেসে উঠে। সে একটা শ্বাস ছাড়ল। ফারাজ আয়নার সামনে দাঁড়াতেই অভ্রর ফোন এলো। অভ্র জানায় আয়েশা আর চিত্রার পাসপোর্টে কিছু সমস্যা হয়েছে। অনেক কিছুই মিলছে না। ফারাজ বিষয়টি পরে দেখবে বলে ফোন রেখে দেয়। তারপর বারান্দায় গিয়ে চিত্রাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘এবার বলোতো বউ তুমি কে?’