চেকমেট পর্ব ১৬

চেকমেট পর্ব ১৬
সারিকা হোসাইন

ঘড়িতে সকাল ন’টা বেজে ত্রিশ মিনিট।ঝকঝকে নীল আকাশ আর ফকফকে ধরণী।গত রাতে বোধ হয় সামান্য বৃষ্টি হয়েছে।গাছপালা,ফুল,ঘাস সবকিছু কেমন চকচকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।হালকা রোদের উত্তাপে মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে লাগছে বেশ করে।চারপাশে শীতল মৃদু বাতাস।রোদের তেজ খুবই মিয়ানো।
সুফিয়ান চৌধুরী আজ একটু দেরি করেই নিজ কার্যালয়ে এলেন।অফিসে ঢোকবার আগে মুহূর্তে লম্বা চওড়া কাউকে পিঠ মুড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা কপাল কুচকালেন।এরপর তেমন গুরুত্ব না দেখিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইলেন।কিন্তু পেছন থেকে কেউ ভরাট কন্ঠে ডেকে উঠলো

“স্যার!
পুরুষালি আভিজাত্য ভরা কন্ঠে সুফিয়ান চৌধুরী মুহূর্তেই পাথরের মত দাঁড়িয়ে পরলেন।যুবকের গলার ভারী স্বর সুফিয়ান চৌধুরীর হৃদয়ে কেমন ভীতির উদ্রেক করলো।তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে ফিরে তাকালেন কমিশনার।এরপর অপেক্ষারত যুবকের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন।সুফিয়ান চৌধুরীর এহেন ভীতির মানে বুঝলো না যুবক।বরং সে উচ্ছসিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো
“রূপকথা কেমন আছে?নিশ্চয় অনেক বড় হয়ে গেছে তাই না?
আশপাশে তাকিয়ে যুবকের হাট টেনে নিকটস্থ ক্যাফেটেরিয়ার দিকে অগ্রসর হলেন সুফিয়ান চৌধুরী।এরপর এক কর্ণারে আসন পেতে বসে যুবকের সিট নির্দেশ করে বলে উঠলেন
“বস।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নির্দেশ পেতেই অনুগত্যের ন্যয় বসলো যুবক।মুখে এখনো প্রশস্ত হাসি।সুফিয়ান কে দেখে ক্যাফেটেরিয়ার ওয়াইটার মেনু এগিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
“কি ওর্ডার করবেন স্যার?
এসি ওয়ালা ক্যাফেতে কেমন দরদর করে ঘামলেন সুফিয়ান।সামনে বসা যুবক চোখের কালো রোদ চশমা সযত্নে টেবিলের পাশে রেখে ভারী গলায় বললো
“স্যার কে কোল্ড কফি দাও।চিনি অবশ্যই কম দেবে।উনার সুগার ইস্যু আছে।
ওয়াইটার মাথা নাড়িয়ে চলে যেতেই অল্প খুক্ষুক করে কাশলেন সুফিয়ান চৌধুরী।এরপর একটা টিস্যু দিয়ে কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে বলে উঠলেন
“কবে এসেছিস?
“কিছুক্ষন আগে।
“কেনো?
এবার কিছুটা অপ্রস্তুত হলো যুবক।কিছুক্ষন নীরব থেকে বলে উঠলো
“মাকে খুঁজতে।

“তোর মা এখানে নেই সারফরাজ।আর এভাবে হর হামেশা আমার সাথে যদি তুই দেখা করতে আসিস তবে আমার পরিণতি কি হবে তা জানিস তো নাকি?
সুফিয়ান চৌধুরীর কথায় খানিক দমে গেলো সারফরাজ।মানুষটা নিজের জীবন উৎসর্গ করে তাকে বাঁচিয়েছিলো।এই সরল মানুষটাকে কখনো কলঙ্কিত করতে চায়না সারফরাজ।কিন্তু তবুও কেনো জানি বারবার তার কাছে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে একটু কথা বলতেও ইচ্ছে করে।কিন্তু কেনো?উত্তর খুজে পায় না সারফরাজ।
মাথা নিচু করে তপ্ত শ্বাস ফেলে একটা রঙিন বক্স সুফিয়ান চৌধুরীর দিকে এগিয়ে সারফরাজ শুধায়
“রূপকথার আমাকে মনে আছে?

সারফরাজ এর প্রশ্নে মুখ কালো করে ফেললেন সুফিয়ান।এরপর এদিক সেদিক তাকিয়ে বললেন
“তোকে কতবার বলবো সারফরাজ?ওই টুকুন বাচ্চা দুদিনের পরিচয়ে কাউকে মনে রাখতে পারে?কিছুদিন পরেই তোকে রূপকথা ভুলে গিয়েছে।তোর সাথে কাটানো একটা মুহূর্তও তার মনে নেই।কতো গুলো বছর ধরে একই প্রশ্ন আর একই উত্তর শুনে যাচ্ছি দিয়ে যাচ্ছি।তবুও তুই সেই একই প্রশ্নই করিস বার বার।
কথাটা কেমন যেনো তীরের ফলার মতো সারফরাজ এর হৃদয়ে বিধলো।চোখ দুটোও লাল হয়ে উঠলো।খচখচে জন্ত্রনা হচ্ছে তাতে।তবুও নিজেকে সামলে সারফরাজ বললো
“মন মানতে চায় না।আচ্ছা বাদ দিন সেসব।এখানে রূপকথার প্রিয় চকলেটস আছে।ওকে দিয়ে দিবেন প্লিজ।
সুফিয়ান অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন
“এসব এখন আর রূপকথা পছন্দ করে না।বুঝিস ই তো আজকাল কার মেয়ে ছেলে।স্বাস্থ্যের প্রতি ভীষন কনসার্ন।আবার যদি ফ্যাট বেড়ে যায়?ওই কি সব ডায়েট ফায়েট নিয়ে ব্যাস্ত থাকে সারাক্ষন বুঝলি?লো ক্যালরির খাবার খায় সে।
সুফিয়ান এর কথায় শুকনো হেসে বক্স টা কম্পিত হাতে গুটিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো সারফরাজ।এরপর বললো

“বছর দুই আগে যেই ডায়েরিটা দিয়েছিলাম সেটা রূপকথা পড়েছে?
সুফিয়ান যেনো আজ অগ্নি পরীক্ষা দিতে বসেছে।কেমন হাইপার টেনশন কাজ করছে মস্তিষ্ক জুড়ে।উচ্চস্বরে চিৎকার করে ধমকাতে ইচ্ছে করছে সব্বাইকে।তবুও দাঁতে দাঁত চেপে স্বাভাবিক গলায় বললেন
“ডায়েরি দিয়েছি।ভেতরের লিখা পড়ে আমাকে বলেছে,সারফরাজ নামক কাউকে তো চিনি না বাবা!
এবার বেশ করে ভেতর থেকে ভেঙে গেলো সারফরাজ।তবুও শক্ত থাকার ভান করে বলে উঠলো
“জুতো জুড়া লেগেছিলো পায়ে?
মনেমনে বেশ বিরক্ত হলেন এসব অবান্তর প্রশ্নে সুফিয়ান চৌধুরী।তারপরও জোর করে টেনে টেনে বললেন
“কখনো ছুঁয়েও দেখেনি।পছন্দ হয়নি নাকি তাই।
সুফিয়ান চৌধুরীর বলা প্রত্যেকটি কথা সারফরাজ এর হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে তুললো।কিন্তু লেস মাত্র মুখে ফুটিয়ে তুললো না সারফরাজ।শেষমেশ বহু ইতস্তত করে অপরাধীর ন্যয় বলে উঠলো
“একবার দেখা যাবে ওকে?
সুফিয়ান ফট করে বললো

“এখানে তো সে থাকেনা আর।ডাক্তারি পড়তে ঢাকায় চলে গেছে।অনেক মেধাবী বুঝলি।একদিন দেশের নামকরা ডাক্তার হবে।মানুষের জন্য খুব মায়া।
কথাগুলো বলে কিছুটা ধীর গলায় বললেন
“ত ত তোর মতো নির্দয় নয়।
সুফিয়ান চৌধুরীর শেষ কথায় সারফরাজ ব্যাথিত চোখে সুফিয়ান চৌধুরীর পানে একবার নজর বুলালো।দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতেই অন্যত্র চোখ সরিয়ে নিলেন সুফিয়ান।সারফরাজ কিছু বলার আগেই সুফিয়ান বললেন
“ভালো পথে ফিরে আয় সারফরাজ।তুই যেই পথের পথিক হয়েছিস সেই পথে কোনো সুখ নেই।শান্তি নেই।মানুষের জীবনের যে বড্ড দাম!
সারফরাজ বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না।শুধু অল্প করে বললো
“আমি ভালো আছি স্যার।
“তুই পাপ করছিস সারফরাজ।তুই ঘোর পাপী।
“কাউকে নিষ্পাপ রাখার জন্যই পাপী হয়েছিলাম আমি।

আর বসলো না সারফরাজ।বুকটা অসহনীয় ব্যাথায় জর্জরিত হচ্ছে ক্রমশ।চকলেট এর বক্স বুকে চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালো সারফরাজ।এরপর সুফিয়ান চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বললো
“একটা ফেরারি আসামিকে কে ই বা মনে রাখবে বলুন?আমিও না।ধ্যাত।
বলতে বলতে সারফরাজ এর গলা ধরে এলো।বাকি কথা আর শেষ করতে পারলো না সারফরাজ।শুধু বললো
“আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত।রূপকথা ডাক্তার হবে শুনে খুব খুশি হলাম।আমি ওর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আপনাকে আমানত স্বরূপ ওকে দিয়ে দিয়েছিলাম।সে ভালো আছে সুরক্ষিত আছে জেনে ভালো লাগছে।কিন্তু বিশ্বাস করুন মেয়েটিকে স্বেচ্ছায় দিতে মোটেও ইচ্ছে করেনি।আমি চাইলে জেল ভেঙে পালিয়ে যেতে পারতাম।কিন্তু আমার জন্য ফুটফুটে বাচ্চার ভবিষ্যত নষ্ট হোক তা চাইনি।আসছি।এটাই আমার শেষ বাংলাদেশ আসা।আমাদের আর দেখা হবে না স্যার।শেষ বার একটা অনুরোধ করতে চাই।রাখবেন?
সুফিয়ান অপরাধীর ন্যয় বললেন

“কি?
“রূপকথার একটা ছবি দেখতে পারি?
সুফিয়ান তড়িৎ ফোন ঘেঁটে ডিআইজি সাহেবের মেয়ের জন্মদিন এর একটা ছবি বের করে সারফরাজ এর সামনে মেলে ধরে বলে উঠলেন
“এই যে।
লম্বা সময় নিয়ে ছবিটি দেখে সারফরাজ ব্যাথিত গলায় বলল
“পুরো চেহারাই পাল্টে গেছে।ছোট বেলার সাথে কোনো মিল নেই।কিন্তু খুব সুন্দর হয়েছে।
ফোন সরিয়ে নিতেই এলোমেলো পায়ে বিদায় জানিয়ে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে এলো সারফরাজ।এরপর সেই ট্যাক্সির কাছে এসে ড্রাইভার এর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
“হোটেলে চলুন।

সারফরাজ এর যাবার পানে তাকিয়ে সুফিয়ান চৌধুরী বলে উঠলেন
“তুই আমাকে ক্ষমা করে দে সারফরাজ।এতগুলো মিথ্যে বলার জন্য আমি সত্যি ই লজ্জিত সেই সাথে মনের কাছে বিরাট অপরাধী।জানিস তো পৃথিবীর সবচাইতে স্বার্থপর, লোভী আর মিথ্যেবাদী বাবারা হয়?তোকে কি করে বলতাম তোর জন্য রূপকথার পাগলামি?আমি কিছুতেই রূপকথা আর তোর দেখা করাতে পারি না।রূপকথা তোকে ছাড়তে না চাইলে তখন কি হবে বলতো?কোনো ফেরারি দাগী খুনি কি একটা নিষ্পাপ মেয়ের জীবনে স্থান নিতে পারে?মেয়ের সুরক্ষায় আমি ঢাল হিসেবে নিজের বুক পেতে দিতে রাজি আছি।তার জন্য বিবেকের কাঠ গড়ায় যদি হাজার দাঁড়াতে হয় তবুও কোনো আপোষ করবো না আমি।

দুপুরের সূর্য যখন একদম তির্যক ভাবে কিরণ দিচ্ছে ঠিক সেই সময় নিজেদের ভর্তির সকল কাজকর্ম শেষ করে ডিএমসি মাঠ প্রাঙ্গনে এসে উপস্থিত হলো রূপকথা আর ন্যালি।রূপকথা ন্যালিকে বাসায় ফেরার তাগাদা দিতেই সে বলে উঠলো
“চল আমার সাথে।
“কোথায়?
অবাক হয়ে শুধায় রূপকথা।
ন্যালি দাঁত বের করে হেসে বলে উঠে
“হসপিটাল ক্যান্টিনে।শুনেছি এই ক্যান্টিনের ডিম খিচুড়ি খুব টেস্ট।লেটস ট্রাই।
ন্যালির আবদারে রূপকথা হাত ঝাড়ি দিয়ে বলে উঠলো
“এই গরমে এসব আবোল তাবোল খাবো না আমি।
ন্যালি ছাড়বার পাত্রী নয়।সে তার ক্রেভিংস এ অটল থেকে বলে উঠলো

“আরে গাঁধী ওখানে গেলে কিউট কিউট ডাক্তার দেখা যাবে।মন ভালো হয়ে যাবে এক নিমিষেই।তাড়াতাড়ি চল।তখন আর এতো গরম লাগবে না দেখিস।
ন্যালির লুচু মার্কা কথায় রূপকথা দাঁত চেপে বলে উঠলো
“খালি ছেলে মানুষের প্রতি এতো ইন্টারেস্ট কেনো?
“তবে কি মেয়ে মানুষের প্রতি থাকবে?
কথা বলতে বলতে দুজনেই ক্যান্টিনে পৌঁছে গেলো।রূপকথা কিছুই ওর্ডার করলো না শুধু একটা জুস ব্যাতিত।কিন্তু ন্যালি অনেক কিছু ওর্ডার করে কাঙ্খিত টেবিলে এসে বসলো।এরপর অপেক্ষা করতে লাগলো খাবারের আশায়।

কিছু সময় গড়াতেই একজন ছেলে এসে তাদের খাবার গুলো টেবিলে সার্ভ করলো।ধোয়া উঠা খিচুড়ি দেখেই চোখ বড় বড় করে হামলে পড়লো ন্যালি।রূপকথা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে জুসের স্ট্রো তে অল্প চুমুক দিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলো।এমন সময় হঠাৎই রূপকথার চোখ বিস্ফারিত হলো।সেই সাথে কাশতে কাশতে নাকে মুখে জুস উঠে গেলো।ন্যালি রূপকথার এহেন তামাশায় কপাল কুঁচকে শুধালো
“কি এমন হলো যে বিষম খেয়ে মরে যাচ্ছিস?
রূপকথা নিজের আঙ্গুলি নির্দেশ করতেই অপজিট বিল্ডিংয়ে নজর দিল ন্যালি।খুব সুন্দর্শন এক যুবক কিছু ডক্টর এর সাথে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে হেঁটে চলেছে।তার সাথে হ্সপিটাল এর ডিন এজাজ চৌধুরী কেও দেখা যাচ্ছে।যুবক কে দেখে ন্যালির চোখে যেনো সর্ষে ফুল ফুটলো।রূপকথা ন্যালির হাতে চিমটি কেটে বলে উঠলো

“ট্রেনে যেই অদ্ভুত ছেলেটার কথা বলেছিলাম এই সেই।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ন্যালি অবাক গলায় বলল
“এই বান্দা এখানে কি করছে?সে কি অসুস্থ?সে যদি প্যাশেন্ট হয় তবে আমি ডাক্তার হয়ে এখনই তার চিকিৎসা করাতে রাজি।
রূপকথা চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বললো
“মানুষটা দেখতে যেমন আসলে তেমন নয়।কেমন যেনো রহস্য মানব।
ন্যালি ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে উঠলো
“আরে বেহেনা সুদর্শন ছেলেরা রহস্যময় না হলে কেমিস্ট্রি ঠিক জমেনা।তারা যদি বাকি আম ছেলেদের মতো হয় তবে তো সব ঘেঁটে গেলো তাই না? রহস্যময় বলেই তো এরা আমাদের কাছে স্পেশাল।
রূপকথা সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বলে উঠলো
“কেমিস্ট্রি রসায়ন শেষ হলে তাড়াতাড়ি বাসায় চল।

হোটেলে সারাদিন কাটিয়ে সারফরাজ ঢাকায় যাবার জন্য ইমারজেন্সি ফ্লাইট টিকিট কাটলো।নিজের জন্ম ভিটায় দীর্ঘদিন যাওয়া হয়না।ওখানে বিশাল বড় বাড়ি আছে তাদের।বাবা মায়ের শেষ স্মৃতি আছে।সারফরাজ ভেবেছে বাড়ির সমস্ত স্মৃতি কুড়িয়ে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাবে চিরদিনের জন্য।এই নিষ্ঠুর মাতৃভূমিতে আর কোনো দিন ফিরবে না সে।
মনে মনে কথা গুলো ভেবে হোটেল রুমের নরম বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সারফরাজ।এরপর লাগেজে করে আনা দুটো ড্রেস ,জুতো,মেয়েলি ক্লিপ আর চকলেটস গুলো ডাস্ট বিনে ছুড়ে ফেলতে উদ্যাত হলো।কিন্তু কোনো এক মায়ার বাঁধনে ফেলতে অপারগ হলো।বুকে জমানো কষ্ট বুকে চেপেই সেই ব্যাগ পুনরায় গুছিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলো সারফরাজ।কিন্তু তার আগে একবার সুবহান গং এর হাবেলীর দর্শন করলে মন্দ হয়না।

পড়ন্ত বিকেলে সুবহান গং এর বিশাল বাড়িটির সামনে এসে দাড়ালো সারফরাজ।দম্ভ নিয়ে যেই প্রাসাদ তুল্য বাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকত তা আজ কেমন জীর্ণ আর ভঙ্গুর।যেই হাবেলীর গায়ে একটা পাখি পর্যন্ত বসতে ভয়ে পাখা ঝাপ্টাতো তাতে আজ ছত্রাক শেওলার বাস।তাচ্ছিল্য হেসে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে উঠোনে প্রবেশ করলো সারফরাজ।কোলাহল আর হুংকারে মুখরিত থাকা বাড়িটি এখন কেবল শুনশান নিস্তব্ধ।হঠাৎই ঝোপের ধারে কিছু নড়ে উঠলো।তাতে সামান্য ভীত হলো না সারফরাজ।ঠোঁটে একটা সিগারেট ঠেসে গুনগুন করতে করতে সিঁড়ি ধরলো।কেমন বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে।এটা নাকি তার নানা বাড়ি!আফসোস।নিকোটিন এর ঘন ধুঁয়া উড়িয়ে নিজের কক্ষে ঢোকার মনস্তাপ করলো সারফরাজ।কিন্তু এই বাড়ি ঘিরে রূপকথার স্মৃতি গুলো মস্তিষ্ক কেমন বিক্ষিপ্ত করে তুলছে।বারবার রূপকথার খিলখিলিয়ে উঠা হাসি,রূপকথার চিৎকার আর লুকোচুরির ছলে সারফরাজ এর নাম ধরে ডেকে উঠা সব কেমন হৃদয়ে নাড়া দিয়ে হাউমাউ করে কাদার উদ্রেক করতে চাইছে।শক্ত কঠিন পুরুষ সারফরাজ এর পাথর সম হৃদয় এবার খোলস ছেড়ে দগদগে ঘায়ে তাজা হলো।তাতে কেমন চুয়ে চুয়ে রক্তের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে।বুক চেপে ধরে গুমরে কেঁদে উঠলো সারফরাজ।কিসের এতো মায়া ওই বাচ্চার জন্য তার?
এক পা দু পা করে নিজ কক্ষে এসে ভাঙা বিছানায় ঠেস দিয়ে বসে পরলো সারফরাজ।এরপর চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলে উঠলো

“তোমার আর আমার দুজনের পথ ভিন্ন তাই না রূপকথা?অথচ এক সময় আমরা কতো আপন ছিলাম।একই পথে কতো হেঁটেছি দুজনে।আজ সব কিছু ধোঁয়াশা স্মৃতি।
ব্যাথিত গলায় কথা গুলো বলে পুরো ঘরে নজর বুলালো সারফরাজ।বিছানার পাশেই অযত্নে ভাঙা ট্রাংক খানা খোলা পরে আছে।উঠে হাটু মুড়ে বসে সেই ট্রাংক হাত বুলালো সারফরাজ।অসাবধানতা বসত মরিচা যুক্ত ভাঙা টিনে কেটে গেলো সারফরাজ এর আঙ্গুল।তাতে বিন্দুমাত্র ব্যাথা অনুভব করলো না সারফরাজ।ট্রাঙ্কের ভেতর এলোমেলো জিনিস দেখে অবাক হয়ে সারফরাজ মনে মনে বললো

চেকমেট পর্ব ১৫

“রিসেন্টলি কে এসেছে এখানে,?এখানে কি আদেও কারো আসার কথা?এলেও আমার ট্রাংক এ কেনো হাত দিয়েছে?
অজানা ভাবনায় পুরো ঘর জুড়ে কিছু পাবার আশায় শকুনি নজর বুলালো সারফরাজ।সেরকম কিছুই আশানুরূপ মিললো না।শুধু মসৃন দেয়ালে রঙের মুছে যাওয়া কালি ব্যাতিত।সেই রঙের সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে কিছু পড়ার চেষ্টা করলো সারফরাজ।কিন্তু আফসোস কেউ নিষ্ঠুর ভাবে সেই লেখা গুলো কালো রং দিয়ে মুছিয়ে দিয়েছে।

চেকমেট পর্ব ১৭