চেকমেট পর্ব ১৭

চেকমেট পর্ব ১৭
সারিকা হোসাইন

ঘড়ির কাটা অনবরত ঘুরতে ঘুরতে দিনের সমাপ্তি ঘটিয়ে গভীর রাতে গিয়ে ঠেকছে।চারপাশ নীরব নিস্তব্ধ।মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে।কাছে কুলে রাস্তার কুকুর গুলো ছুটোছুটি করে ঘেউ ঘেউ ডাকছে অবিরত।আকাশটা মেঘে ঢাকা।থেকে থেকে হাওয়ার দমকে মেঘ সরে চাঁদের ক্ষীণ আলো আবছা আলো ছড়াচ্ছে।হঠাৎ এলোমেলো বাতাসের উৎপাত শুরু হলো।সারি বাধা কংক্রিটের বিল্ডিংয়ে তা বাড়ি খেয়ে শো শো ধ্বনী তুলেছে।চারপাশ কেমন ছমছম ভুতুড়ে।এহেন ভৌতিক পরিবেশে সর্পিল পিচঢালা রাস্তা মাড়িয়ে নিজ বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হলো সারফরাজ।এরপর আরেকটু পা বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে গেটের কাছে দাঁড়ালো।বুক সম গেট ডিঙিয়ে বাড়ির খোদাই করা নাম খানা এখনো জলজল করছে।

“মায়াকুঞ্জ”
বির বির করে মায়া নামটা আওড়ালো সারফরাজ।কেমন সুক্ষ ব্যথা বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো।হৃদপিণ্ড টাও যেনো এফোড় ওফোড় হলো।সহসাই বুক চেপে ধরে চোখ বুজে ফেললো সারফরাজ।অদ্ভুত চোখ দুটো জলে সিক্ত হলো।সেগুলো গোপন না করে বাধন হারা করলো সারফরাজ।এরপর ভেজা গলায় বলে উঠলো
“মায়া মমতা ভালোবাসায় জড়াজড়ি করে আমরা এই ছোট বাড়িটায় দিন পাড় করতাম।তাই না আম্মু?আজ তুমি কোথায় আমি কোথায় আর তোমার কর্নেল সাহেব!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিজের মন্দ ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্য হাসলো সারফরাজ।বিধাতা সব দিয়েও কেড়ে নিয়েছে তার থেকে।টাকা পয়সা ক্ষমতা প্রতিপত্তি কোনো কিছুর অভাব নেই তার।অভাব শুধু আপন জনের।সারফরাজ আজ নিঃস্ব একাকী।
কষ্ট জর্জরিত ব্যথায় মুখ থুবড়ে মাটিতে পরতে চাইলো সারফরাজ।কিন্তু জং ধরা লোহার গেটে চেপে ধরে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করলো।এরপর কোনো মতে উঠে দাঁড়িয়ে গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো।আঙিনায় ছোট একটা লাইট জ্বলছে।তকতকে পরিপাটি বাড়িটির চারপাশে নজর বুলালে মনে হবে কেউ খুব করে যত্ন নেয়।সারফরাজ এর মায়ের হাতের লাগানো ফুল ফলের গাছ গুলো আজ মস্ত বড় হয়ে ফল ফুলে ঢলে আছে।চুলের যত্নের জন্য লাগানো মেহেদী গাছটা ফুলে ফুলে ভরে আছে।সেগুলো থেকে পাকা বেলের গন্ধ ছড়াচ্ছে।বাগানের এক কোনে পাতা ছোট স্টিলের দোলনা মরিচা ধরে অনাদরে পরে রয়েছে।দীর্ঘ বছর কেউ হয়তো বসেনি এখানে।মায়ের সাথে লাগানো সারফরাজ এর হাতের লিচু গাছটায় অসংখ্য লিচু ধরে গাছ নুয়ে যাবার উপক্রম।সেদিনের সেই ছোট লিচু গাছ আজ সারফরাজ এর চাইতেও বিশাল।

আবেগে আপ্লুত হয়ে চোখের জল মুছে প্রধান ফটকের সামনে এসে দাড়ালো।সারফরাজ মনে মনে ভাবলো হয়তো বাড়িটি কেউ দখল করে নিয়েছে।নয়তো প্রায় দু যুগ পরে এসে এমন অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফেরত পাওয়া মুখের কথা নয়।মনের ভাবনা ফেলে ক্লান্ত সারফরাজ দরজায় খটখট শব্দ করলো।এরপর অপেক্ষা করতে লাগলো দরজা খোলার।
মিনিট দুয়েক পর খুবই বৃদ্ধ এক লোক দরজা খুললো।মানুষটা বোধ হয় ভালো করে চোখে দেখে না।ঘরে কোনো আলো নেই।বাটন মোবাইল জ্বালিয়ে মানুষটা দরজা অব্দি এসেছে।দরজায় দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ কম্পিত গলায় বলল
“কে?
মানুষটির পানে তাকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো সারফরাজ।এরপর ফ্যাসফ্যাসে গলায় শুধালো
“কামাল চাচা কেমন আছো?তুমি বুড়ো হয়ে গেছো তাই না?
কামাল চাচা সম্বোধনে বৃদ্ধ হাত বাড়িয়ে সারফরাজ এর মাথা ছুলো।এরপর বাচ্চা শিশুর ন্যয় মুখ ভেঙে কেঁদে বললো

“সাফু নাকি?আমার সাফু বাবা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে?
সারফরাজ বৃদ্ধের হাত চেপে ধরতেই সারফরাজ এর বুকে হামলে পড়লো বৃদ্ধ কামাল।বয়সের ভারে শরীর টা কুঁজো হয়ে গেছে।চোখ দুটোও প্রায় দৃষ্টি শূন্য।পূর্বের নরম কন্ঠ আজ কম্পিত ভঙ্গুর।শ্বাস কষ্ট টাও খুব বেড়েছে আজকাল।একটু কাদঁতেই কাশি উঠে গেলো তার।সারফরাজ তাকে সামলে পিঠ চাপড়ে বলে উঠলো
“তোমাকে এই বাড়িতে পাবো কখনো ভাবিনি চাচা।
বৃদ্ধ কামাল সিক্ত গলায় অভিযোগ করে বলতে লাগলো
“সেই যে না বলে মাকে খুঁজতে বাড়ি ছাড়লে আর ফিরলে না।একদিন খবরে দেখলাম চট্রগ্রাম এর কোন কমিশনার কে গুলি করে পালিয়েছো।আমার ছেলেকে নিয়ে সেখানে গিয়েও খুঁজেছি তোমাকে বাবা।পাইনি।তোমরা সবাই নিষ্ঠুরের মতো এই বুড়োটাকে ফেলে চলে গেলে।যেই দায়িত্ব ভার দিয়ে গেছে তোমার বাবা তা ফেলে আমি কি আর যেতে পারি?বিশটি বছর ধরে খালি বাড়ি পাহারা দিয়ে যাচ্ছি।ছেলে মেয়েরা এসে প্রায় ই গালাগালি করে।বলে তোমরা সবাই মরে গিয়েছো।আমি নাকি মিথ্যে আশায় বাড়ি ধরে বসে আছি।এই দেখো আমার অপেক্ষা সফল হলো।আজ থেকে বিধাতা আমায় দায় মুক্ত করলো।ভেতরে এসো বাবা।
কথা গুলো বলে সারফরাজ কে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন বৃদ্ধ।অন্ধকার কক্ষ দেখে সারফরাজ শুধালো

“ইলেক্ট্রিসিটি নেই?
বৃদ্ধ মোম খুঁজতে খুঁজতে বলে উঠলো
“দীর্ঘদিন বিল না দেয়াতে লাইন কেটে দিয়েছিলো।আমার ছেলেকে বলে কইয়ে কিছু টাকা পরিশোধ করে ওই সামনের লাইট টা চালু রেখেছি শুধু।
বৃদ্ধ মোম জ্বালাতেই হলদেটে শিখায় পুরো ঘর আলোকিত হলো।সারফরাজ বসার ঘরটা নজর বুলালো একবার।সেই আগের মতোই ঝকঝকে পরিপাটি।পুরাতন জিনিস গুলো এখনো নতুনের মতোন।জায়গার জিনিস জায়গাতেই রয়েছে।নেই শুধু ঘরের মালিক আর মালকিন।
হাতের ব্যাগ সোফার পাশে রেখে সারফরাজ বলে উঠলো
“আব্বুর জন্য যেই টাকা গুলো আসতো ওগুলো বন্ধ করে দিয়েছে?
বৃদ্ধ অসহায়ের মতো উত্তর করলো

“পরিবারের সদস্য ছাড়া ওই টাকা তো আমি তুলতে পারিনি বাবা।
প্রবল অপরাধবোধ কাজ করলো সারফরাজ এর ভেতর।একটা বৃদ্ধ মানুষ এতগুলো বছর তাদের স্মৃতি আগলে রেখেছে আর তাকেই কি না এমন কঠিন জীবন যাপন করতে হচ্ছে।বৃদ্ধের শোচনীয় অবস্থা দেখে সারফরাজ ব্যথিত হলো সেই সাথে মাথা নিচু করে বলে উঠলো
“আমার এখন অনেক টাকা কামাল চাচা।তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না।টাকার চাদরে মুড়িয়ে দেবো তোমায়।
বৃদ্ধ হাত নাড়িয়ে তাৎক্ষণিক বলে উঠলো
“আমি ভালো আছি বাবা।যা আছি আলহামদুলিল্লাহ।
কথাটি বলেই বৃদ্ধ ইতস্তত করে বলে উঠলো
“আসলে বাবা ঘরে তো কোনো খাবার নেই।কি দিই তোমায় বলোতো?
মানুষটির আতিথেয়তা ভীষন মুগ্ধ করলো সারফরাজ কে।যদিও খিদেয় সারফরাজ এর পেটে ইঁদুর ছুটোছুটি করছে।তবুও মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো

“আমি খেয়ে এসেছি।আমি এখন ঘুমুতে যাবো।অনেক ধকল গিয়েছে।সকালে তোমার ছেলেকে বলে পুরো বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি দেবার ব্যবস্থা করবে।যা বকেয়া আছে সব পরিশোধ করবো আমি।
বৃদ্ধ মাথা নাড়তেই ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে নিজের কক্ষ অভিমুখে চলতে লাগলো সারফরাজ।হঠাৎ পেছন থেকে কামাল চাচা বলে উঠলেন
“হাত পাখা আছে দেবো?যদি গরম লাগে তো।
সারফরাজ হাত ইশারায় নিষেধ করে বললো
“আবহাওয়া যথেষ্ট ঠান্ডা ।তুমি ঘুমুতে যাও।সকালে বাকি কথা হবে।
কথাটি বলেই সারফরাজ নিজ কক্ষে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।নিজের ছোট বিছানা,বিছানার উপর ডাইনোসর পিলো, পরিচিত ঘ্রাণ সব মিলিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললো সারফরাজ।কামাল খুব সুন্দর করে প্রতিটি জিনিসের যত্ন নিয়েছে।গায়ের কাপড় শার্ট খুলে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো সারফরাজ।কিন্তু বিশাল দেহি শরীরটা এই ছোট বিছানায় সংকুলান হচ্ছে না।উপায় না দেখে অগত্যা বাবা মায়ের রুমে ঢুকে নরম বিছানায় বসলো সারফরাজ।এরপর কাবার্ড খুলে বের করে আনলো সাদাফ শাহজাইন এর জটনেভি গুছিয়ে রাখা এক লুঙ্গি।সেটা পরে নিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে গেলো সারফরাজ।এরপর মাথার পেছনে দুই হাত রেখে ছাদের উল্টো পিঠে তাকিয়ে বলে উঠলো

“তোমার চাইতেও বড় হয়ে গেছি আব্বু।দেখো তোমার লুঙ্গি আমার টাখনুর অনেক উপরে।
কথাটি বলেই চোখ বুজে ফেললো সারফরাজ।কঠিন হৃদয় টা আজ খালি দুমড়ে মুচড়ে উঠছে।চোখ দুটো যেনো উত্তাল সমুদ্র।অনবরত জল ঝড়িয়েই যাচ্ছে তো যাচ্ছে।
সারফরাজ আক্ষেপ মিশ্রিত কন্ঠে পুনরায় বলে উঠলো
“তুমি বলেছিলে একদিন আমি আকাশ ছুবো।তুমি নীচে দাঁড়িয়ে বাহবা দেবে।আমি আকাশ ঠিক ছুঁয়েছি।কিন্তু বাহবা দেবার তুমিটা নেই।এমন মিথ্যে প্রতিশ্রুতি কেনো দিয়েছিলে বলো তো?
নির্দয় নিষ্ঠুর হৃদয়হীন সারফরাজ আজ একাকী অন্ধকার ঘরে বালিশে মুখ গুঁজে গুঙিয়ে কেঁদে উঠলো।সেই কান্নার সাক্ষী হলো ঘরের জড় বস্তু।যারা কেবল নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো।না শান্তনার বাণী আওড়ালো না কোন আফসোস প্রকাশ করতে পারলো।

সকালে ব্রেক ফাস্টের পর নিজ কক্ষে আরাম করে শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে ন্যালি।আজ শিউলি আর আমজাদ বাসায় নেই।সকালের খাবার খেয়েই বেরিয়ে গেছে তারা।কোথায় নাকি জরুরি কাজ আছে তাদের।তারা বেরিয়ে যেতেই রূপকথা ন্যালির কক্ষে এলো গুটি গুটি পায়ে।এসেই আমতা আমতা করে বলে উঠলো
“রামপুরা যাবি?
আকস্মিক রামপুরার কথা শুনে হাতের ফোন রেখে ন্যালি বলে উঠলো
“ওখানে মরতে যাবো কেনো?
ন্যালির বিছানার কোনে বসতে বসতে রূপকথা বলে উঠলো
“তোকে বলেছিলাম না সারফরাজ দের বাড়ি যাবো?
ন্যালির ভোঁতা মস্তিষ্ক সজাগ হতেই বলে উঠলো
“ওহ মনে পড়েছে।তোর ছোট বেলার মনস্টার সেভিয়ার এর বাড়িতে।তা ওখানে কি কাজ তোর?
“তেমন কিছুনা।ওখানে ওর মায়ের সাথে দেখা করতে যাবো।
ন্যালি কিছুক্ষণ চুপ থেকে সময় দেখে নিলো।এরপর বললো
“আব্বু আম্মু যে বাইরে চলে গেলো।ফাঁকা বাড়ি ফেলে কেমনে যাবো?
রূপকথা মুখ ছোট করে বললো

“তুই আমাকে বল কিভাবে যেতে হয় আমি একাই যাবো।
ন্যালি কপাল কুঁচকে ধমকে বলে উঠে
“ধুর বেডি।ঢাকা শহর এটা।হারায় যাবি।আচ্ছা দাঁড়া আব্বুকে কল দিচ্ছি।
মুহূর্তেই আমজাদ হায়দার এর ফোনে কল দিলো ন্যালি।রিসিভ হতেই ন্যালি বলে উঠলো
“রূপকথা আর আমি আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায় যাবো।তোমাদের ফিরতে কি দেরি হবে?
আমজাদ হায়দার বললেন তারা এগারোটার মধ্যেই চলে আসবে।তারা যেতে চাইলে তালা দিয়ে চলে যাক।
সম্মতি পেতেই রূপকথা মলিন মুখ চকচকে হলো।ন্যালির মুখের উত্তরের প্রত্যাশা না করে দৌড়ে চলে গেলো নিজ কক্ষে তৈরি হবার জন্য।এরপর একটা লুজ ডেনিম প্যান্টের সাথে হাটু সমান লং শার্ট পরে নিলো।তার সাথে মিলিয়ে পরলো সেই জুতো জোড়া।আজই প্রথম কেনো জানি এই জুতো পড়তে ইচ্ছে হলো তার।পনিটেল স্টাইলে চুল বেঁধে চোখে অল্প কাজল আর নুড লিপস্টিক দিয়ে মুখে অল্প প্রেসড পাউডার দিয়ে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো।অধিক গরমে একটা পাতলা টপস আর স্কার্ট প্লাজও গায়ে চাপিয়ে ওড়না নিয়ে হেলেদুলে বেরিয়ে এলো ন্যালি।এরপর বলে উঠলো

“ঠিকানা বল।
রূপকথা একটা কাগজ এগিয়ে বলে উঠলো
“একশত পঁচিশ /সি,রামপুরা-ঢাকা”
বাসা থেকে বেরিয়ে একটা উবার বুক করলো ন্যালি।এরপর অপেক্ষা করতে লাগলো তার।মিনিট পনেরো গড়াতেই উবারের ড্রাইভার এলো।ন্যালি আর রূপকথা চেপে বসতেই উবার চলতে লাগলো তার গন্তব্যে।

খিদের যন্ত্রনায় ঘুম হলো না সারফরাজ এর।সকালের একটু পর পরই ঘুম ভেঙে গেলো।মোবাইলের স্ক্রিনে সময় বুলিয়ে এপাশ ওপাশ ফিরলো।হঠাৎ গায়ে কেমন সুড়সুড়ি লাগায় কোমরের নীচে হাত বুলালো।মুহূর্তেই চক্ষু চড়ক গাছ হলো।
“একি লুঙ্গি কোথায়?
নিজের ইজ্জতের এমন চটচটে চাটনি দেখে মাথা ঘুরে উঠলো সারফরাজ এর।দ্রুত হাতে লুঙ্গি ঠিক করতে করতে বলে উঠলো
“শালার কপাল যদি খুলত এমন লুঙ্গির মতো তাহলে বেশ হতো।
লুঙ্গি ঠিক করে পুনরায় ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে ডায়াল করলো অভিরূপ এর নম্বর।কিন্তু ফোন ঢুকলো না।নম্বর বন্ধ।আলতো হাতে ফোন ছুড়ে মেরে বাঁকা হাসলো সারফরাজ।এরপর বলে উঠলো
“পৃথিবীর বড় গিরগিটি আমি।আমার চাইতে কুটিল মানুষ আর একটাও নেই রে শাওয়ার নাতি।
হঠাৎ দরজায় নক হতেই বিছানা ছেড়ে লুঙ্গি ধরে নেমে এলো সারফরাজ।টেনে টুনে একবার লুঙ্গি পরখ করে দরজা খুলতেই বৃদ্ধ কামাল কে নজরে পরলো।মুখে অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে কামাল বলে উঠলেন
“আমার মেয়ে তোমার জন্য খাবার পাঠিয়েছে।এসো গরম গরম খাবে।

সারফরাজ মাথা নাড়িয়ে নিজ ঘরে ফিরে এলো।এরপর কাবার্ড থেকে দুটো বান্ডেল হাতে নিয়ে সুবহান গং এর স্টাইলে লুঙ্গির পাড় উঁচু করে ধরে নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে।নিচেই কামালের ছেলে নজরুল কে দেখা গেলো।সারফরাজ কে দেখে নজরুল প্রশস্ত হেসে বলে উঠলো
“সারফরাজ দেখছি ব্যাটা হয়ে গেছে।
নজরুলের কথায় সারফরাজ অল্প হাসলো।এরপর সেই বান্ডেল দুটো নজরুলের হাতে গুঁজে বলে উঠলো
“বাড়ির যা যা সমস্যা আছে তা ঠিক করাও আর নিজের মুদি দোকানটায় মাল তুলো নজরুল ভাই।কামাল চাচা বলেছে তোমার দিন ভালো যাচ্ছে না।তুমি আমার ভাই কম বন্ধু বেশি।তোমার সাথে কতো শত সময় কাটিয়েছি তা বলে শেষ করা যাবে না।তুমি ভালো নেই শুনে আমার মন ব্যাথিত হয়েছে।
নজরুল অতগুলো টাকা দেখে হা হয়ে গেলো বিস্ময়ে।এরপর অবাক চোখে বললো
“আলাদিনের চেরাগ পেয়েছো নাকি সাফু?
সারফরাজ মাথা নাড়িয়ে বললো
“তার চাইতেও বড় কিছু নজরুল ভাই।

কথাটি বলেই ফ্রেস হতে চলে গেলো সারফরাজ।ফিরলো মিনিট দশ পরে।নজরুল এখনো সেই স্থানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।কম করে হলেও দুটো বান্ডেল 4 লাখ টাকা আছে।এতো টাকা এক সাথে নজরুলের কাছে দুঃসপ্ন।আজকের যুগে এভাবে কেউ কাউকে এতো টাকা দেয় নাকি?
নজরুল দৌড়ে গিয়ে নিজের বাবার সামনে দুই হাতে বান্ডেল মেলে ধরে বলল
“দেখছো কি কারবার আব্বা?দুই হাত ভরে দিলো।
বৃদ্ধ কামাল তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো
“বাবা মায়ের হাত আরো বড় ছিল নজরুল।এই বাড়ির নুন খেয়ে আজ তোরা এতো বড়।
সারফরাজ ফিরতেই নজরুল আর কামাল ব্যতিব্যস্ত হলো খাবার সার্ভ করতে।গরুর মাংসের সাথে তেলতেলে পরোটা।ছোট বেলায় রি খাবার বেশ পছন্দের ছিল সারফরাজ এর।মায়া চেষ্টা করতো প্রায় সময় এটা সারফরাজ কে নাস্তা হিসেবে দিতে।ওই টুকুন বয়সে দুটো পরোটা খেতে পারতো সারফরাজ।মায়া হারিয়ে যাবার পর আর কোনোদিন এমন পরোটা পেটে পড়েনি।পরোটা দেখে চোখে জল জমলো সারফরাজ এর।সে ধরে আসা গলায় শুধালো

“আমার মায়ের চাইতে ভালো গোশত আর কেউ রাধতে পারে চাচা?
বৃদ্ধ যেনো নির্বাক হলো এহেন কঠিন প্রশ্নে।তড়িৎ মাথা নাড়িয়ে বললো
“না।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে সারফরাজ বললো
“বেশ কয়েকদিন থাকবো।রাতে গরমে ঘুম হয়নি।সব কিছু ঠিক করে দিও নজরুল ভাই।
ঝুটা প্লেট সরাতে সরাতে নজরুল বললো
“এক ঘন্টার মধ্যে সব ঠিক করে দিচ্ছি।তুমি রিল্যাক্স থাকো ছোট ভাই।

রাস্তার জ্যাম ঠেলে রোদ মাড়িয়ে সাড়ে এগারোটার দিকে এসে কাঙ্খিত গন্তব্যে থামলো রূপকথা দের উবার।বিল মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়ালো ন্যালি আর রূপকথা।ড্রাইভার চলে যেতেই পুরো বাড়ি পরখ করে ন্যালি বলে উঠলো
“এসব বড় লোকদের বাড়িতে খারুস টাইপের কেয়ারটেকার থাকে বুঝলি?জনমানব হীন এই বাড়িতে কি অপমান টাই না করতে বোধ হয় নিয়ে এলি আমাকে।
বলেই টিস্যু দিয়ে মুখ মুছলো ন্যালি।রূপকথা কপাল কুঁচকে ভঙ্গুর গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো
“সব জায়গায় তোর আবোল তাবোল কথা।ভেতরে চল তো।কেউ কিছু বললে বলবো আমি সারফরাজ এর বন্ধু।তখন দেখবি আর কিছু বলতে সাহস পাবে না।
দুজনে পা বাড়িয়ে আশেপাশে তাকিয়ে সম্মুখে এগুতেই আঙিনায় থাকা লিচু গাছের পাকা লিচু গুলো নজর কারলো দুজনের।ন্যালি চোখ পিট পিট করে বলে উঠলো
“এই লোভনীয় লিচু খেতে না পারলে আমার পেট গুড়গুড় করবে।
রূপকথা সায় দিলো ন্যালির কথায়।এরপর বললো

“গাছ তো উঁচু।কিভাবে পাড়বো?
“তুই গাছে উঠ।তোর পরনে প্যান্ট আছে।স্যালোয়ার কামিজ পরে গাছে উঠলে বিচ্ছিরি লাগবে।
অল্প বয়সী রূপকথা তাল মিলিয়ে গাছে উঠার উদ্যগ নিলো।কিন্তু পিচ্ছিল গাছে বার বার পা পিছলে যায়।এতে দুজনেই হেসে কুটি কুটি হলো।যেই কাজে এসেছে সেটা ভুলে লিচুতে ফোকাস দিলো।
এদিকে খাবার শেষ করে কেবলই ফ্যানের বাতাসে একটু চোখ বুজেছে সারফরাজ।কিন্তু হঠাৎ মেয়েলি হাসির শব্দে তার তন্দ্রাভাব কেটে গেলো।বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে হাসির উৎস সন্ধান করলো।জানালা দিয়ে অদুরের লিচু গাছে দুটো মেয়ের হৈ হুল্লোড় দেখে জানালা দিয়ে ধমকে উঠলো সারফরাজ

“এ্যই লিচু গাছে কে?
ইতোমধ্যে রূপকথা গাছের ডালে কেবলই উঠে বসেছে।আকস্মিক ভারী গলার প্রশ্নে ভয়ে তার পা কেঁপে উঠলো।কিন্তু ন্যালি রূপকথার গাছে উঠার দৃশ্য দেখে হেসেই যাচ্ছে।
বিরক্ত হয়ে খুঁজে খুঁজে একটা লাঠি নিয়ে লুঙ্গি উঁচু করে বেঁধে নেমে গেলো সারফরাজ।লম্বা পায়ে হাটতে হাটতে রূপকথা আর ন্যালির উদ্দেশ্য বলে উঠলো
“কিসের এতো হাসাহাসি?বজ্জাত মেয়ে মানুষ কোথাকার।আবার যদি হাসির শব্দ শুনেছি তবে ঠোঁট কে টে নেবো দাড়া।এমনি এমনি মেয়ে মানুষ দেখতে পারি না?কিছু হলেই হি হি হি।
এবার ভীত হলো ন্যালি।সাথে রূপকথাও।লুঙ্গি উঁচিয়ে লাঠি সমেত সারফরাজ কে তেড়ে আসতে দেখে ন্যালি চিৎকার করে বলে উঠলো

চেকমেট পর্ব ১৬

“ওই দেখ লাঠি নিয়ে কেয়ার টেকার আসছে।তাড়াতাড়ি নাম।পালাতে হবে।
ন্যালির চিৎকারে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নাজেহাল অবস্থা হলো রূপকথার।সারফরাজ যখন গাছের নিচে এসে দাড়ালো ঠিক তখনই মট মট করে ভেঙে গেলো লিচুর ডাল।ফস্কে গাছ থেকে পরে গেলো রূপকথা।লাঠি ফেলে সারফরাজ ধরে ফেলার আগেই ন্যালি চিৎকার করলো
“রূপকথা!

চেকমেট পর্ব ১৮