চেকমেট পর্ব ২৫

চেকমেট পর্ব ২৫
সারিকা হোসাইন

পিসফুল মেন্টাল হসপিটাল,ঢাকা
মেন্টাল হসপিটালের তিন তলার এক কোনে ছোট একটি কামরা।কক্ষ নং তিনশত পঁচিশ /এ।কোয়েদ খানার ন্যয় সবুজ রঙা ছোট কক্ষে খোলা জানালায় ফাঁকা দৃষ্টি মেলে বসে আছে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক প্রবীনা।কক্ষের টিমটিমে হলুদ আলোয় বয়স্ক মানুষটার ফ্যাকাসে হাড্ডিসার চেহারা বেশ করে নজরে লাগছে।মানুষটা কেমন নিষ্প্রাণ অনুভূতি হীন।জানালার থেকে ফাঁকা দৃষ্টি সরিয়ে বদ্ধ কক্ষের চারপাশে একবার নজর বুলালেন তিনি।সবুজ দেয়ালে জল দাগের উপস্থিতি চোখে লাগছে।মসৃন দেয়াল থেকে খসে যাচ্ছে চটচটে রঙ সমেত সিমেন্ট এর প্রলেপ।এলোমেলো অগোছালো কক্ষ আর চারপাশের ধুলার আস্তরণ।দেয়ালে থাকা ঘড়িতে নজর বুলায় সে।ঘড়ির কাটা কবে থেমে গিয়েছে তার হিসেব কেউ রাখেনি।অবশ্য পাগল মানুষের আবার সময় নিয়ে কিসের এতো মাতামাতি?
পুরো কক্ষ পরখ করে বিছানায় সযত্নে পরে থাকা ডাইনোসর এর আকৃতির ছোট খেলনার প্রতি নজর দিলো সে।চট করে উঠে গিয়ে সেই খেলনা বুকে জড়িয়ে বিড়বিড় করে বললো

“এটা রাজের।এটা কাউকে দেবো না আমি।রাজ কাঁদবে।
কথা গুলো বলে তুলো আর মখমলের তৈরি ডাইনোসর বুকে চেপে ধরলেন তিনি।এরপর উঠে গিয়ে মেঝেতে পায়চারি করতে করতে ডেকে উঠলেন
“সারফরাজ, ও বাবা!কোথায় তুই?ভাত খাবি না?খাবার যে ঠান্ডা হয়ে যায়।
ওপাশ থেকে বোধ হয় উত্তর আসে সারফরাজ ভাত খাবে না।মানুষটা ছেলের খাদ্য অনিহায় কপাল কুচকায়।সে কল্পনায় প্লেট ভর্তি ভাত নেয়।সাথে নেয় সারফরাজ এর পছন্দের ঝাল ঝাল গরুর মাংস।এরপর ছোটে ঘরময়।উদ্দেশ্য সারফরাজ কে পরম আদরে ভাত খাওয়ানো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত ডিউটি ডক্টর দাঁড়িয়ে সবটা অবলোকন করলেন।এই নাম অজানা মানুষটার জন্য তার খুব মায়া হলো।সিনিয়র ডক্টর দের থেকে তিনি কিছুক্ষন আগেই পেশেন্টের হিস্টোরি জেনেছেন।আরো জেনেছেন দীর্ঘ একুশটি বছর ধরে এই একই বদ্ধ কক্ষে তার দিন রাত কেটে যাচ্ছে।মাঝে মাঝে নাকি তার ছেলে এসে তার খোঁজ খবর নিয়ে যায়।কিন্তু ছেলেকে দেখলে আরো বেশি হাইপার হয়ে যান তিনি।তাই ছেলেটাও আর ঠিক মতো আসে না এখন।
“সাফু ভাত ঠান্ডা হয়ে যায় বাবা।ভাত না খেলে পাপা তোকে ঘুরতে নিয়ে যাবে না।
পাগল জ্ঞানহীন মানবীর এহেন দরদ পূর্ণ কথায় ডিউটি ডক্টর তপ্ত শ্বাস ফেলে ভেতরে ঢুকলো।এরপর তার সামনে এগিয়ে গিয়ে দুই বাহু চেপে ধরে নমনীয় গলায় বললো

“তোমার নাম কি মা?
আকস্মিক কারো কথার শব্দে নিজের জ্ঞানে ফিরলো সে।এরপর রুগ্ন ফ্যাকাসে মুখে ফাঁকা দৃষ্টি মেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন ডক্টর এর মুখপানে।মাথার চুলগুলো অল্প চুলকে ইতিউতি তাকিয়ে বলল
“মায়া!
ডিউটি লেডি ডক্টর মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে বললো
“সারফরাজ ভাত খেয়েছে?
মায়া মাথা নাড়িয়ে বললো
“এতো দুস্টু হয়েছে না,খেতেই চায় না।
মায়ার বোকা দৃষ্টি আর কল্পনায় সারফরাজ কে ভাত খাওয়ানোর দৃশ্য ডক্টর সোহানা কে ব্যথিত করলো।সে মায়ার সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠলো

“ছেলের প্রতি যখন এতই ভালোবাসা তখন সে এলে এমন পাগলামো করো কেনো?
ডক্টর এর প্রশ্নে ভাত খাওয়ার হাত থেমে গেল মায়ার।যেই চোখে সারফরাজ কে ঘিরে উদ্বিগ্ন আর ভালোবাসা খেলা করছিল নিমিষেই সেই চোখে ভীতি এসে ভর করলো।মুখটা কেমন পাণ্ডুবর্ণ হলো।হাত জোড়া কেঁপে উঠলো।মায়া বড় বড় চোখ করে সোহানার হাত চেপে ধরে বলে উঠলো
‘হুশ,কাউকে বলো না।ও আমার ছেলে নয়।ও একটা শয়তান।নির্দয় আর নিষ্ঠুর সে।
ভীতি যুক্ত মুখে মায়ার কাছ থেকে এমন কথা শুনে সোহানা বেশ অবাক হলো।তার কিছু বিষয়ে সন্দেহ ও হলো।তাই সে শুধালো
“ও তোমার খোঁজ খবর নেয়।তবুও ওকে শয়তান বলছো?
“ও আমার রাজ কে কষ্ট দিতে চায়।ও আমার কেউ না।ওকে দেখলে আমার ভয় লাগে।ও আসে আমাকে ভয় দেখাতে।আমি সত্যি বলছি।আমি ওর মা নই।
বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মায়া।এরপর কল্পনায় সারফরাজ কে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো

“সারফরাজ কে মেরে ফেলতে চায় ও।ইচ্ছে করেই ওরা দাদা নাতি মিলে আমাকে বন্দি করে রেখেছে।ওরা খুব খারাপ।খুব।আমাকে এখান থেকে বের হতে দাও।আমি আমার কর্নেল সাহেবের কাছে যাবো।সবাই অপেক্ষা করছে।আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।সারফরাজ এর স্কুল এর ঘন্টা পরে যাবে।স্কুলের অনেক কঠিন নিয়ম কানুন।ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কিনা।দেরি হলে গেট বন্ধ হয়ে যাবে।তোমার সাথে পরে কথা বলবো কেমন?
মায়ার এলোমেলো কথা আর কান্নায় সোহানা কেমন গোলকধাঁধায় পড়লো।মায়া সেই গোলকধাঁধা কাটিয়ে বললো
“আমার রাজের চোখ গুলো খুব সুন্দর বুঝলে? খুব সুন্দর।সমুদ্রের স্বচ্ছ জলের ন্যয়।ওই চোখে শুধু মায়া, দরদ আর ভালোবাসা।আর যে ছেলেটা এখানে আসে ওর চোখে কোনো ভালোবাসা নেই।সব কেমন ক্রুরতা আর রহস্য।হিংস্রতায় ভরা ওই ভয়ানক চোখ দুটো।
সোহানা মায়ার কথা একটাও ফেললো না।সব মনে গেঁথে রাখলো।পাগল মানেই যে সবসময় আবোল তাবোল বকে তা নয়।মায়ার চোখ মুখ ই বলে দিচ্ছে সে সত্যি বলছে।
সোহানা কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে শুধায়

“তোমার বাড়ির ঠিকানা বলো।
এবার চুপ হয়ে গেলো মায়া।সে খোলা জানালায় অসহায় দৃষ্টি মেলে বিড়বিড় করে বলে উঠলো
“আমার বাড়ি কোথায় কর্নেল সাহেব?
সোহানা যতটুকু বুঝলো এই মায়া কোনো আর্মি অফিসারের স্ত্রী।কিন্তু একজন অফিসারের স্ত্রী কিভাবে পাগল হয়ে এপর্যন্ত এলো তার কিচ্ছুটি সোহানার মাথায় ঢুকলো না ।এমন সময় একজন এসিস্ট্যান্ট এসে ডেকে উঠলো ডক্টর সোহানা কে
“ম্যাডাম উনার ছেলে এসেছেন উনাকে দেখতে।
কথাটি শুনেই মায়া সোহানার হাত খামচে ধরে কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে উঠলো
“প্লিজ ডোন্ট গো।হি ইজ নট মাই সান।হি ইজ অ্যা ডেভিল।
এবার সোহানার কাছে সবটা পরিস্কার হলো।মায়া যে কোনো সাধারণ পাগল নয় এটা চতুর সোহানা এক নিমিষেই বোঝে গেলো।তাই এসিস্ট্যান্ট কে আদেশ দিলো
“উনাকে নিয়ে এসো।
এসিস্ট্যান্ট কাচুমাচু করে বললো
“উনি একা দেখা করতে চান তার মায়ের সাথে।

এসিস্ট্যান্ট এর কথা শেষ হতে না হতেই হসপিটাল পরিচালক মাহিদ সারোয়ার এলেন এবং তার সাথে এলো প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার সুদর্শন এক যুবক।যুবকের গায়ের সাদা শার্ট আর কালো ফরমাল প্যান্ট অনন্য সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে।কিন্তু সেই সৌন্দর্য সোহানার চোখ ধাঁধালো না।চোখ দুটো আসলেই হিংস্র ঠেকলো।সোহানা এক পলক মায়ার মুখের দিকে তাকালো।কেমন ভয় আর অসহায়ত্ব এসে জেকে বসলো শুকনো মুখ জুড়ে।
হসপিটালের পরিচালক মাহিদ সারোয়ার শক্ত গলায় বলে উঠলো
“আপনি বাইরে আসুন ডক্টর।উনাদের মা ছেলেকে কথা বলতে দিন।
কিন্তু মায়া সোহানার হাত চেপে ধরে অসহায় গলায় বলে উঠলো
“প্লিজ ডোন্ট গো।

নিরুপায় সোহানা আমতা আমতা করে পরিচালক এর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
“স্যার পেশেন্ট আমাকে ছাড়তে চাইছে না।
মাহিদ সারোয়ার কিছু বলবার আগেই আগত ছেলেটি ভরাট গম্ভীর গলায় বলে উঠলো
“আপনি যেতে পারেন ডক্টর।আমি আমার মায়ের সাথে পার্সোনালি কিছু টাইম স্পেন্ড করতে চাই।আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন।
সোহানা বলার মতো কিছু খোঁজে পেলো না।সোহানা কক্ষ ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই মায়া কেঁদে চিৎকার করে বলে উঠলো
“ও আমার ছেলে নয়।ও শয়তান।ও আমার সারফরাজ কে মেরে ফেলতে চায়।এই হৃদয়হীন পশুর কাছে আমাকে একা ফেলে তোমরা কেউ যেও না ।
কিন্তু অসহায় মায়ার চিৎকার কারো হৃদয়ে মায়ার সৃষ্টি করলো না।নিরুপায় হয়ে সোহানা মাথা নিচু করে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলো।কিন্তু মস্তিষ্ক জুড়ে চলতে লাগলো নানাবিধ দুশ্চিন্তা।
সকলেই চলে যেতে যুবক তাচ্ছিল্য বাঁকা হেসে কক্ষে প্রবেশ করলো।যুবকের চোখের দিকে তাকিয়ে মায়া ভয়ে কুঁকড়ে গেলো।যুবক বাঁকা হেসে বলে উঠলো
“খুব ভয় লাগছে ফুপু?দেখলে পাগলের কথার কোনো দাম নেই এই নিষ্ঠুর ধরায়।তাই জতো নিশ্চপ থাকবে ততোই মঙ্গল।

কথাটি বলে মায়ার কাঁধে হাত রাখলো যুবক।মায়া আরেকটু ভয়ে সিটিয়ে নিভু গলায় বলল
“আমার সারফরাজ একদিন ঠিক নিতে আসবে আমাকে।ওই দিন তুই কোথায় পালাবি?
যুবক এই কথায় কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো।যেনো খুব মজার জোকস শুনলো সে।মায়া সে হাসি দেখে জড়সড় হয়ে হাটু ভাঁজ করে বসে অন্যত্র দৃষ্টি সরিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো
“সারফরাজ আসবে।হ্যা সারফরাজ আসবে।ওইদিন কারোর রক্ষা থাকবে না।চারপাশে আগুন জ্বলবে।কর্নেল সাহেবের সন্তান সে।আগুনের ন্যয় উত্তপ্ত রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে ওর শরীরে।সাহসী বাপের সন্তান ও।অন্যায়ের সাথে আপোষ কখনোই করবে না সে।
মায়ার বিড়বিড় শুনে ঝুকে যুবক হিসিসিয়ে বলে উঠলো
“তোমাকে দিয়েই তোমার ছেলেকে কব্জা করবো ফুপু।তোমার ছেলে হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছে তোমাকে।কিন্তু আমার হাত থেকে এতো সহজে নিস্তার মিলবে না তোমার।এই রুদ্ররাজ কে হারাতে হলে লাশের স্তুপ মাড়াতে হবে।সেই দম কি আছে তোমার ছেলের?
লাশের কথা শুনে ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো মায়া।সহসাই উত্তেজিত হয়ে টেবিলের উপর পড়ে থাকা স্টিলের বাটি চট করে হাতে নিয়ে আঘাত করতে চাইলো রুদ্রকে।কিন্তু ক্ষিপ্ত রুদ্র শক্ত হাতে চেপে ধরলো মায়ার হাত।এরপর রক্ত হীম দৃষ্টি নিয়ে মায়ার চোখে চোখ রেখে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো
“তোমার বাপ নিজে এই কারাবাস দিয়েছে তোমাকে।এখান থেকে তোমার মুক্তি নেই।আজীবন ধুকে ধুকে এই পাগলা গারদে পঁচে মরবে তুমি।আর তোমার ছেলেকে রাস্তার কুকুরের মতো মারবো আমি।বুঝলে?

মেঘের সারি আকাশ জুড়ে খেলা করছে।ভারী বাতাস এসে একবার সেই মেঘ মালা সরিয়ে নিচ্ছে।আবার কোথা থেকে যেনো মেঘ এসে চারপাশ অন্ধকার করে দিচ্ছে।নিজের রিডিং রুমের চেয়ারে বসে বসে আকাশের বাহারি খেলা দেখে চলেছে রূপকথা।
কিছুক্ষন পর নেলি এলো।হাতে ধোয়া উঠা কফি মগ।রূপকথার পানে কফি এগিয়ে বলে উঠলো
“সারাদিন এক বারো ঘর ছেড়ে বের হলিনা।কারন কি?এখনো ওই ছেলের কথা গুলো নিয়ে আপসেট হয়ে আছিস?
কফি মগ টেনে নিয়ে রূপকথা বলে উঠলো
“নাহ।এমনি ভালো লাগছে না।
নেলি কফিতে ছোট চুমুক দিয়ে বললো
“কাল থেকে ক্লাস শুরু।সেই প্রিপারেশন নে।যেহেতু মানুষটা চাচ্ছে না তোর সাথে সেরকম সম্পর্ক রাখতে সেখানে তুই জোর করে জেদ ধরে কিছু করিস না।নয়তো পরে পস্তাবি।
রূপকথা বাইরের পানে তাকিয়ে আনমনে জবাব দিলো

“ওর কাছে গেলে আমি আত্তিক প্রশান্তি পাই নেলি।মনটা বড্ড বেহায়া।কিচ্ছু শুনতে চায় না।ভেবেছিলাম এতগুলো বছর পর আমাকে দেখে খুশি হবে সারফরাজ।কিন্তু আমার ধারনা পুরোটাই ভুল।আমার উপস্থিতি তাকে বিরক্ত করে।
কথাগুলো বলে তাচ্ছিল্য হাসলো রূপকথা।নেলি বিষন্ন ভঙ্গিতে কফি মগে ট্যাপ ট্যাপ করতে করতে বললো
“ওর বর্তমান ভবিষৎ কিছুই জানিস না।না জেনে শুনে হুট করে এভাবে কোনো কিছু করা যায়?
“এতকিছু আমি জানতে চাই না নেলি।কবে কবে ওর জন্য আমার মনে ভালোবাসার সূত্রপাত হয়েছে আমি নিজেও জানিনা।এতদিন ভাবতাম ও জাস্ট আমার সেভিয়র।কিন্তু ওকে দেখার পর থেকে আমার মনে হচ্ছে ওকে না পেলে আমি বাঁচবো না।
বলেই মাথা নিচু করে ফেললো রূপকথা।বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে তার।না বলা কষ্ট গুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে রয়েছে যেনো।বিষিয়ে উঠা গলায় হাত বুলিয়ে ধীর লয়ে রূপকথা বললো
“ওর অবহেলা আমাকে মৃত্যু জন্ত্রনা দিচ্ছে নেলি।আমি বারোটি বছর ধরে ওর জন্য অপেক্ষা করছি।তার কোন মূল্যই দিলো না সে।বড় হয়ে বেশ নিষ্ঠুর হয়েছে সারফরাজ।

সারাটা দিন পরিচিত অপরিচিত সকল জায়গায় নিজ মাকে খুঁজে বেড়ালো সারফরাজ।অভিরূপ কে দিয়ে থানায় পর্যন্ত রিপোর্ট করালো।কোথাও কোনো হদিস পাওয়া গেলো না।সন্ধ্যার সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লো ঠিক তখন ক্লান্ত এলোমেলো ভঙ্গিতে বাড়ি ফিরে এলো সারফরাজ।ধীর পায়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে নিজ বেডরুমে এলো।গায়ের ঘামে ভেজা শার্ট মেঝেতে ছুড়ে মেরে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।এরপর মাথার পেছনে দুই হাত রেখে ছাদের উল্টো পিঠে সিক্ত নজর বুলিয়ে সারফরাজ বলে উঠলো
“তুমি কোথায় আম্মু?এবারও কি খালি হাতে ফিরতে হবে আমাকে?এতো জন্ত্রনা কেনো বিধাতা আমার কপালে লিখে রেখেছে?আমার জন্মই কি তবে পাপ?
নীলচে চোখ উপচে জল গড়াতে চায় সারফরাজ এর।কিন্তু সারফরাজ কঠিন শাষিয়ে তাদের রুখে দেয়।এরপর উঠে বসে বিছানা থেকে।সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে চলে যায় শাওয়ার নিতে।শীতল জল ধারা কি পারবে শরীর আর মনের সমস্ত ক্লান্তি,গ্লানি ধুয়ে মুছে দিতে?

রাত ন,টার দিকে অভিরূপ এলো।স্বেচ্ছায় আসেনি।সারফরাজ এর কল পেয়ে এসেছে।সঙ্গে এনেছে বিদেশি দামি ড্রিংকস।সারফরাজ চেয়েছে।যখন মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত থাকে তখন নিজেকে শান্ত করার জন্য এই এলকোহল কেই বেছে নেয় সারফরাজ।অভিরূপ যখন সারফরাজ এর কক্ষে এলো তখন খোলা আকাশে দৃষ্টি মেলে বারান্দার ডিভানে এক ধ্যানে বসে ছিল সারফরাজ।হাতের ড্রিংকস এর কাঁচের বোতল ছোট কর্নার টেবিলে রেখে গলা খাকরি দিলো অভি।অভির গলার স্বর নড়েচড়ে উঠলো সারফরাজ।এরপর হাত বাড়িয়ে বললো
“দে।
অভিরুপ বোতল এগিয়ে দিতেই দাঁত দিয়েই ছিপি খুলে ঢকঢক করে গলায় চালান করে চোখ মুখ কুঁচকে ডিভানে হেলান দিলো সারফরাজ।ঝাঁঝালো তিতকুটে স্বাদ মুখের সাথে এডজাস্ট হতেই পুনরায় চুমুক বসালো।অভিরূপ এহেন দৃশ্যে তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো
“আর কতোদিন?
“আজীবন।
চট করে নেশাক্ত গলায় উত্তর করলো সারফরাজ।এরপর পুনরায় বলে উঠলো

“আমার জন্মই আজন্মের পাপ অভী।লাইফ আমাকে নিয়ে কঠিন দচতুরঙ খেলছে।কখন কোথায় চেকমেট হচ্ছে আমি নিজেও জানিনা।আমি শুধু গুঁটির মতো ঘর বদল করে দৌড়ে চলেছি।
অভিরুপ এক দৃষ্টিতে সারফরাজ এর করুন মুখ খানা দেখলো।এরপর বললো
“রূপকথাকে জড়িয়ে নে জীবনে।ভালো থাকবি।মেয়েটা নিখাদ ভালোবাসে তোকে।ওর চোখ দেখে এমনটাই মনে হয়েছে আমার।
অভির কথায় তাচ্ছিল্য হাসলো সারফরাজ।এরপর ধরা গলায় বললো
“নিজে ভালো থাকার জন্য অন্যের ভালো থাকা কেড়ে নিতে বলছিস?এই টুকু ছোট বাচ্চা একটা মেয়ে।সুন্দর ভবিষৎ ওর।সেই ভবিষৎ নষ্ট করবার কোনো অধিকার নেই আমার।
অভিরূপ আর কিছু বললো না।নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো।এরপর চলে এলো ঘর ছেড়ে বাইরে।সারফরাজ একা সময় কাটাতে পছন্দ করে এমন দুঃখের মুহূর্তে।তার মতে একাকী নির্জনে দুঃখ বিলাস করা যায় গভীর করে।মাঝে মাঝে হৃদয় পোড়াতে খুব ভালো লাগে তার।

অভিরূপ চলে যেতেই আরো একটা বোতল ধরলো সারফরাজ।মুহূর্তেই দুটো বোতল সাবাড় করে একের পর এক সিগারেট ফুকলো।নিকোটিন এর ধোঁয়ায় ইচ্ছেমতো নিজেকে পুড়িয়ে ঢুলু ঢুলু শরীরে উঠে দাঁড়ালো।ঘড়িতে সময় কত তা জানা নেই সারফরাজ এর।ঝিঁঝিঁ পোকার হাঁক বুঝিয়ে দিচ্ছে এখন গভীর রাত।সারফরাজ সেসব তোয়াক্কা না করে গায়ে একটা শার্ট জড়িয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।এলোমেলো হাতে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ছুটলো অজানা কোথাও।
কোন পথ দিয়ে কিভাবে ড্রাইভ করে সারফরাজ চললো তার কোন জ্ঞান রইলো না।
এদিকে রূপকথার অক্ষিপটে এক ফোটা ঘুম ধরা দিলো না।অশান্ত হৃদয় নিয়ে খোলা বেলকনিতে এসে দাড়ালো।বাইরে হীম শীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে।বাতাসের তোড়ে গায়ে কাঁটা দিলো রূপকথার।দুই হাতে নিজেকে জড়িয়ে খোলা আকাশে ফের দৃষ্টি পাতলো রূপকথা।ভেতর থেকে কেমন আত্মচিৎকার ধেয়ে আসছে।কিন্তু গলা চিঁড়ে বেরুতে পারছে না।

হঠাৎ গাড়ির ব্রেক কষার শব্দে সামনে দৃষ্টি স্থির করলো রূপকথা।কালো রঙা রোলস রয়েস এসে থেমেছে আমজাদ হায়দার এর প্রকান্ড বাড়ির আঙিনায়।অল্প সময়ে পর সেই গাড়ি থেকে ঢুলতে ঢুলতে নামলো সারফরাজ।আবছা আলোয় তার মুখভাব বোঝা গেলো না।যখন গাড়ির হেড লাইটের সামনে এসে দাড়ালো সারফরাজ তখন তার কাতর মুখশ্রী নজরে এলো।
রূপকথা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সারফরাজ এর মনোভাব।গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বেলকনির দিকে তাকিয়ে বুক চাপড়ে ঘোর লাগানো গলায় সারফরাজ উচ্চ স্বরে ডেকে বলে উঠলো
“বুকের এই খানটায় খুব জন্ত্রনা হচ্ছে রূপকথা।বুক পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে।কলিজাতে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।একবার এই খানটায় মাথা রেখে আগুনটা নিভিয়ে দেবে?জ্বলুনি কমলেই চলে যাবো প্রমিস।
অধিক নেশায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সারফরাজ।এদিক সেদিক হেলে পরে যাচ্ছে সে।তবুও নিজেকে সামলে পুনরায় বলে উঠলো

চেকমেট পর্ব ২৪

“নেশাটা খুব ধরেছে।কিন্তু বুকের আগুন নেভাতে পারছে না।ডেট লেস এলকোহল।সব দোষ ওই অভিটার।ওকে শাস্তি দেবো পরে।আগে বলো রাখবে এই বুকে মাথা?জ্বলে যাচ্ছে পুরো বুক।খুব কষ্ট হচ্ছে।সহ্য করতে পারছি না।উপশম করবে আমার বুকের এই জন্ত্রনা?

চেকমেট পর্ব ২৬