চেকমেট পর্ব ৩৭

চেকমেট পর্ব ৩৭
সারিকা হোসাইন

আকাশ জুড়ে কালো মেঘের আধিপত্য, মনে হচ্ছে রাতে খুব করে বর্ষণ ঝরবে।থেকেই থেকেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।চারিধারে মানুষের কর্ম ব্যস্ততা বাড়লো খানিক।বৃষ্টি বাদলের আগে ঘরে ফেরা চাই।
নিজের অন্ধকার কক্ষে বসে বসে সমানে সামনে পিছনে দুলে চলেছে মায়া।আর বিড়বিড় করে কিছু বলছে।যা স্পষ্ট নয়।জানালা ডিঙিয়ে আসা বিদ্যুৎ চমকে মায়ার ফ্যাকাসে চোখ জোড়া নজরে এলো।কান্না করেছিলো বোধ হয়।চোখের জল শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে।কিন্তু এখন সব কিছু স্থির ,নিঃশব্দ।চোখের পলক ফেলতেও বোধ হয় ভুলে গেছে পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব এই প্রবীনা।

হঠাৎ কলের পুতুলের মতো উঠে দাঁড়ালো মায়া।অন্ধকার ঘরে হাতড়ে খুঁজে নিলো এক টুকরো ইটের ভাঙা অংশ ।সেটা দিয়ে ঘসঘস করে দেয়ালে কিছু লিখলো।
এরপর দেয়ালে হাত বুলিয়ে চুমু খেয়ে মাথা ঠুকে দাঁড়িয়ে রইলো।
সমস্ত পেশেন্ট কে শেষ বারের মতো নজর বুলাতে এলো সোহানা।তার ডিউটি শেষ।তাকেও বাড়ি ফিরতে হবে।কিন্তু মন কেমন সায় দিচ্ছে না।মনে হচ্ছে রাত টুকু এখানেই কাটাতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

টহল দিতে দিতে মায়ার কক্ষের সামনে এসে দাড়ালো সোহানা।কক্ষটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত।নিকষ আধারে ডুবানো কক্ষের পানে দৃষ্টি স্থির করে তপ্ত শ্বাস ফেললো সোহানা।এরপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালালো।পুরো কক্ষ জুড়ে দাগ টানা।দাগ গুলো পুরোনো।আবার কিছু নতুন।মায়া এখানে কতোদিন ধরে আছে তার হিসেব এটা।দেয়ালে ইটের খোয়া দিয়ে খুব সুন্দর করে হ্যপী বার্থডে সারফরাজ লিখেছে মায়া।লেখার ধরন দেখে মনে হচ্ছে পড়াশোনা জীবনে তুখোড় ছিলেন।কিন্তু জন্মদিন এর নিচের তারিখ দেখে ব্যথিত হলো সোহানা।একুশ বছর আগের দিন তারিখ লেখা।মায়া এখনো একুশ বছর আগের স্মৃতিতেই আটকে আছে।বর্তমান সময় সম্পর্কে তার বিন্দু মাত্র ধারণা নেই।

এদিকে আকস্মিক আলোক ছটায় কেঁপে উঠলো মায়া।সে দেয়াল আকড়ে চিৎকার করে বলে উঠলো
“খবরদার কেউ আসবে না আমার কাছে।কেউ না।আমি যাবোনা।আমি এখান থেকে কোত্থাও যাবো না।আজ আমার রাজের জন্মদিন।আমার ছেলে আমাকে ছাড়া কেক কাটবে না।খবর দার আর এক পা এগুলে আমি কাউকে ছাড়বো না।
বলতে বলতে আঘাত করার জন্য চারপাশে হিংস্র চোখে কিছু খুঁজতে লাগলো মায়া।সোহানা মায়ার হঠাৎ হাইপার হবার কারন টের পেলো না।সে দূরত্ব বজায় রেখে ডাকলো
“মায়া!
সোহানার কন্ঠ পেয়ে মায়া সামান্য স্থির হলো।কিন্তু দৃষ্টি এখনো চঞ্চল।চোখ মুখে দুর্দান্ত ভীতির ছাপ স্পষ্ট।
সোহানা এগিয়ে এসে নরম গলায় শুধালো

“কে তোমাকে নিয়ে যেতে চায় মায়া?এখানে তো কেউ নেই।
মায়া তাৎক্ষণিক সোহানার হাত চেপে ধরে কেঁদে বলে উঠলো
“আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো।বিশ্বাস করো আমি পাগল নই।আমাকে সারফরাজ এর কাছে নিয়ে চলো।আজ আমার ছেলের জন্মদিন।

সোহানা মায়াকে শান্ত হতে ইশারা করলো।এরপর বললো
“তুমি শান্ত হও।আমি নিয়ে যাবো তোমায়।কিন্তু চুপিচুপি।তুমি যদি এভাবে চিৎকার করো তাহলে সবাই জেনে যাবে।
সোহানার কথায় মায়া সামান্য ভরসা খুঁজে পেলো।সে শান্ত হলো।এরপর চারপাশে সতর্ক নজর বুলালো সুহানা।হসপিটালে ডিরেক্টর স্যার নেই আজ।লেডি নার্স গুলোও বৃষ্টির আভাস পেয়ে বাড়ি চলে গেছে।আছে দু একজন ডক্টর আর ওয়ার্ড বয়।কিন্তু এখন তারা নিজেদের রুম ছেড়ে বের হবে না।ডিরেক্টর স্যার না থাকলে কাজে ফাঁকি দেবার চূড়ান্ত সুযোগ কাজে লাগায় তারা।

সোহানা এতদিনের অনুসন্ধানে অনেক কিছু বুঝতে পেরেছে।মায়ার রিপোর্টস এ সেরকম মেন্টালি কোনো সিকনেস পাওয়া যায়নি।তাকে ইচ্ছে করে মানসিক শাস্তি দিতে এখানে ফেলে রাখা হয়েছে।মায়া আগে অন্য হসপিটালে ছিলো।বছর দুই আগে এখানে শিফট করা হয়েছে তাকে।মায়ার জবানবন্দি তেও উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।দীর্ঘ বছর কোনো এক অন্ধকার ঘরে তাকে আটক রাখা হয়েছিলো।সেখানে না ছিলো আলো বাতাস না ছিলো পর্যাপ্ত খাবার।মানুষের কথা পর্যন্ত মায়ার শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে প্রবেশ করেনি দীর্ঘ বছর।হয়তো এক যুগের ও বেশি সময়।এরপর হঠাৎ আলোর দেখা পায় মায়া।কিন্তু ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।ধীরে ধীরে মায়ার আচরণে এসেছে অস্থিরতা,অবুঝপনা।ভুলে গেছে সব কিছু।কোনো কিছুকেই এখন আর স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে না সে।সর্বদা এক ভয়ের রাজ্যে তার বসবাস।সব কিছু হারালেও স্মৃতিতে এখনো নিজের স্বামী সন্তানকে আগলে রেখেছেন।সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই পেরিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর।

সোহানা মায়ার হাত চেপে ধরে ধীর গলায় বলে উঠলো
“আমি তোমাকে মুক্তি দিবো মায়া।এজন্য আমার যা হয় হোক।আমি চাই তুমি তোমার সারফরাজ কে খোঁজে পাও।
মায়া মাথা ঝাকিয়ে বলে উঠলো
“দাও দাও মুক্তি দাও।আমাকে এই নরক থেকে বের করো।এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
সোহানা নিজের মনে মনে এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিলো।এরপর পুনরায় কক্ষ অন্ধকার করে ফিসফিস করে বলে উঠলো
“আমি যেখানে নিয়ে যাবো সেখানেই যাবে?
“হ্যা যাবো।
“চিৎকার করবে না তো?
“না।একদম না।
“ঠিক আছে চলো।

বাইরে তুমুল বৃষ্টি ধারা ঝরছে।বৃষ্টিকে মায়ার গুড লাক হিসেবে ধরে পা টিপে টিপে অন্ধকার মাড়িয়ে গেটে বেরিয়ে এলো সোহানা।যাবার আগে সারফরাজ এর ডাইনোসর ডল টা নিতে ভুললো না মায়া।সোহানা গেটে এসে বাইরে নজর বুলালো।দারোয়ান নেই।বাইরে ঘোর অমানিশার আধার।ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে।বিকট শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে।এই মুহূর্তে বাইরে বের হওয়া রিস্ক।কিন্তু সোহানা আজ প্রকৃতি দেখে ভয় পাচ্ছে না।তার মনে প্রানে মায়াকে মুক্তি দেবার চরম ইচ্ছে ঘুরপাক খাচ্ছে।যে করেই হোক মায়াকে সে তার ছেলের কাছে নিয়ে যাবেই যাবে।এজন্য যদি তার প্রাণ ও যায় তবে যাক।
মায়ার হাতের কব্জি চেপে ধরে সোহানা বলে উঠলো
“বৃষ্টি মাড়িয়ে দৌড়াতে পারবে?

মায়া মাথা ঝাঁকালো।সোহানা আর দেরি করলো না।শক্ত করে মায়াকে টেনে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো হসপিটালের গন্ডি ছেড়ে কংক্রিটের সর্পিল রাস্তায়।এরপর হারিয়ে গেলো বৃষ্টির জলে।
সোহানা বেরিয়ে যেতেই পরপর দুটো গাড়ি ঢুকলো হসপিটাল এর ভেতর।জেনারেটর এর কারসাজিতে মুহূর্তেই আলোকিত হলো চারপাশ।গাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে নামলেন ডিরেক্টর।পেছনের গাড়ি থেকে নামলো রুদ্ররাজ।
দুজনে ভেতরে চলতে চলতে নিজেদের বাক্য বিনিময় করলো
‘পেশেন্ট কে নিয়ে যতদ্রুত সম্ভব দেশ ছাড়ুন ডক্টর রুদ্র।একবার কোনো ভাবে ভেতরের খবর লিক হলে থানা পুলিশ সামলাতে হবে।বুঝতেই পারছেন কোনো সাধারণ কেস নয়।আর্মি অফিসার এর স্ত্রীকে এভাবে আটকে রাখার জন্য আমাদের পানিশমেন্ট কি হতে পারে তা অবশ্য আপনার অজানা নয়।
হাতের ব্রিফকেস ডিরেক্টর এর দিকে এগিয়ে বাঁকা হেসে রুদ্র বলে উঠলো

“আপনার ডিমান্ড এর চাইতেও বেশি আছে এখানে।ফুর্তি করুন,রিল্যাক্স করুন।সব সামলানোর দায়িত্ব আমার।আপনি শুধু তাকে আমার হাতে তুলে দিন।
ডিরেক্টর চারপাশে নজর বুলিয়ে কন্ঠ খাদে ফেলে বলে উঠলো
“আপনাকে দেখলেই রিয়াক্ট করবে।তার চেয়ে আপনি গাড়িতে অপেক্ষা করুন।আমি কাউকে দিয়ে বাইরে বের করে আনছি।
‘তাড়াতাড়ি করুন ডাইরেক্টর সাহেব।বৃষ্টি থামার আগেই আমি ফিরে যেতে চাই।উটকো ঝামেলা একদম পছন্দ নয় আমার।

ডিরেক্টর হাসতে হাসতে প্রস্থান নিলেন।গাড়িতে বসে সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটে চেপে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলো রুদ্র।এরপর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোয়া উড়িয়ে ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসির রেখা টেনে রুদ্র বলে উঠলো
“লাস্ট চেকমেট আমারই থাকলো সারফরাজ।খুব শীঘ্রই তোর পতন হতে চলেছে।চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছি তোকে।আমার চেকে বন্দি তোর দুর্বল দুই গুটি।এই চেক কাটাতে পারবি আদেও?উহু মোটেও না।চেকমেট ডিয়ার সারফরাজ।
বলেই শব্দ করে হো হো করে হেসে উঠলো রুদ্র।কিন্তু বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না সেই হাসি।ডিরেক্টর দৌড়ে এসে ভয়ার্ত গলায় জানালো
“সর্বনাশ হয়ে গেছে!ভেতরে মায়া চৌধুরী নেই ডক্টর রুদ্ররাজ।

রূপকথার উদ্যোগে কতো বছর পর সারফরাজ এর জন্মদিন পালন হলো তার হিসেব কষে কুলোতে পারলো না সারফরাজ।তার মা বাবা হারিয়ে যাবার সাথে সাথে তার সকল সুখ,আনন্দ,ভালোবাসা সব হারিয়ে গেছে।তার মরুভূমির ন্যয় শুষ্ক জীবনে রূপকথা এক পশলা বৃষ্টি।রূপকথা হীন তার অস্তিত্ব বিলীন।যেদিন হৃদয়ের গহীনে রূপকথার আনাগোনা বন্ধ হবে সেদিন সারফরাজ এর হৃদয় বিকল হবে।তাতে চলবে না রক্ত প্রবাহ,নির্গত হবে না শ্বাস।হৃদয়িক এবং দৈহিক দুই ভাবেই মৃত্যু হবে তার।

রাতের খাবার দাবার শেষ করে সব কিছু ধুয়ে মুছে সাফ করলো রূপকথা।এখন বৃষ্টি কিছুটা কমেছে।বাড়ি যাওয়া প্রয়োজন।হঠাৎ ই বিনা কারণে সারফরাজ এর মন ভার হলো।সব কিছু বিষাক্ত অর্থহীন ঠেকলো।সারফরাজ এর টলমলে চোখ দেখে রূপকথা আন্দাজ করলো সারফরাজ এর ভেতরের ঝড়।রূপকথা ভেবে ছিলো সারফরাজ তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।কিন্তু তার এহেন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে রূপকথা আর কথা বাড়ালো না।

কোনো মতে হেলে দুলে সারফরাজ নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।বুকে কেমন অসহনীয় জন্ত্রনা হচ্ছে।আকস্মিক এমন খারাপ লাগার হেতু খুঁজে পাচ্ছে না সারফরাজ।কখনো এমন অনুভূতি হয়নি তার।তার বাবার মৃত্যুর পর যখন তার মা হারিয়ে গেছিলো সেদিন এমন লেগেছিলো।কিন্তু সেদিনের চাইতে আজকের খারাপ লাগা হাজারগুন বেশি।বুক চাপড়ে মেয়েদের মতো কাঁদতে ইচ্ছে করছে।মায়ের অসহায় মুখশ্রী ভেবে ‘মা” বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো সারফরাজ।বাইরে থেকে সেই চিৎকার শুনলো সকলে।রূপকথার মন ভার হলো সারফরাজ এর ব্যথায়।একটা মানুষ এতো যন্ত্রণা নিয়ে কিভাবে বাঁচতে পারে?এদিকে রাত বাড়ছে তরতর করে।রেখা সুফিয়ান দুজনেই চিন্তাগ্রস্ত হবেন।তাছাড়া যতটুকু স্বাধীনতা সুফিয়ান তাকে দিয়েছে সেটাও কেড়ে নিবেন।চাইলেও রাত ভর সারফরাজ এর বাড়িতে থাকতে পারবে না রূপকথা।দৃষ্টি কটু দেখাবে।অভিরূপ নেলি থাকলে ভিন্ন কথা ছিলো।অভিরূপের বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় অভিরূপ হসপিটালে দৌড়াচ্ছে আর নেলি ইচ্ছে করেই আসেনি।এই মুহূর্তে অভিরূপ কে সাপোর্ট দেয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে সে।

রূপকথা দুতলায় সারফরাজ এর ঘরের পানে তাকিয়ে কম্পিত শ্বাস ফেললো।এরপর লুইস কে বলল
“ওকে সামলে নিয়েন।আপাতত নিজের মতো থাকুক।আই হ্যাভ টু গো নাও।
ইয়ং নিজে রূপকথাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চাইলো।কিন্তু হাত দিয়ে ইয়ং কে থামিয়ে দিলো রূপকথা।
“আমি একাই যেতে পারবো।তাছাড়া ঢাকার রাস্তায় এই রাত তেমন কোনো গভীর রাত নয়।আসছি।
বলেই বেরিয়ে এলো রূপকথা।তার মনে হচ্ছে সত্যি ই যদি এই মুহূর্তে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা বলে মায়া চৌধুরী কে সারফরাজ এর সামনে হাজির করতে পারতো তবে কতই না খুশি হতো সারফরাজ।সারফরাজ তাকে নতুন জীবন দিয়েছে,পরিবার দিয়েছে।অথচ রূপকথা?সে কিছুই দিতে পারলো না সারফরাজ কে।নিজেকে বড্ড অকাজের ঢেকি মনে হলো রূপকথার।

রূপকথা ভেবে ছিলো একটা উবার বুক করে চলে যাবে সে।কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে কোনো ড্রাইভার ই রাজি হলো না।কিছুক্ষন আগেই বৃষ্টি থেমে ছিলো।তাই রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলো রূপকথা।কিন্তু এখন ঝমঝমিয়ে আবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো।রূপকথা দৌড়ে গিয়ে একটা যাত্রী ছাউনির নীচে দাঁড়ালো।এরপর ফোন থেকে কল করলো সুফিয়ান চৌধুরীর নম্বর।নম্বর বন্ধ দেখাচ্চে।রূপকথার এবার ভয় হতে লাগলো।ইতোমধ্যে হেটে হেটে সারফরাজ এর বাড়ী ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে এসে গেছে সে।বৃষ্টির প্রবাহ আরো বাড়লো কয়েক গুন।রূপকথার ফোনের চার্জ লাল দাগে এসে স্থির হলো।সারা দিনের ব্যস্ততায় ফোনে চার্জ দেয়া হয়নি।রূপকথা উপায় না পেয়ে রেখার নম্বরে কল করলো।কিন্তু রিং ঢোকার আগেই বন্ধ হয়ে গেলো ফোন খানা।
এবার যেনো মাঝ সমুদ্রে পতিত হলো সে।রাস্তায় কোনো গাড়ি ঘোড়া,মানুষ কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছে না।সোডিয়াম লাইটের মৃদু আলো আর বিদ্যুৎ চমকে যতটুকু দৃশ্যমান হচ্ছে ততটুকু ধরেই হাটতে লাগলো রূপকথা।

মায়াকে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠলো সোহানা।ভেবে ছিলো রাস্তা থেকে ট্যাক্সি ধরে নিজের বড় বোনের বাড়িতে গিয়ে উঠবে।কারন হসপিটালে মায়াকে খুঁজে না পেলে সবাই তাকেই সন্দেহ করবে।মায়ার বিষয় নিয়ে একমাত্র সেই ই বেশি ঘাটাঘাটি করেছে।ডিরেক্টর একবার তাকে এটা নিয়ে বকাবকি ও করেছে।সোহানা এবার ঘাবড়ে গেলো।মায়ার শরীর দুর্বল।সেও এর হাটতে পারছে না।রাস্তার মধ্যখানে বসে পড়েছে সে।সোহানা দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে হাপাতে হাপাতে বলে উঠলো
“মায়া আর পারছো না?
সোহানার ক্লান্ত ভেজা মুখের পানে তাকিয়ে মায়া মাথা নাড়লো।

সোহানার বুক কেমন ধক করে কেঁপে উঠলো ।মনে হচ্ছে শেষ রক্ষা হলো না।ধরা পড়লে কি হবে তবে?
হঠাতই ঝড়ের বেগে ধেয়ে এলো কালো রঙের এক গাড়ি।সোহানা চিৎকার করার আগেই সেই গাড়ি থামলো একদম মায়ার কাছ বরাবর।সোহানা ভাবলো ভেতরের ভদ্রলোকের থেকে সাহায্য প্রার্থনা করবে।কিন্তু গাড়ির দরজা খোলে যখন রুদ্র নামলো তখন সোহানার শরীর ভার ছেড়ে দিলো।ত্রিশ বছর বয়সী সোহানা জরার ন্যয় রাস্তায় ধপ করে বসে গেলো।মুখে তৃপ্তির হাসি ঝুলিয়ে রুদ্র গিয়ে সোহানার সামনে দাঁড়ালো।এরপর হাটু মুড়ে বসে সোহানার গলা টিপে ধরে মুখে চু চু শব্দ করলো।সোহানার ভীত মুখ তাকে যেনো বেশ আনন্দ দিলো।
“ছে ছেড়ে দাও আমাদের।আমি জানি তুমি মায়ার ছেলে নও।আমি পুলিশে কমপ্লেইন করবো তোমার নামে।তুমি অন্যায় করছো।

সোহানার সাহস দেখে রুদ্রের এক ভ্রু বাঁকা হয়ে উপরে উঠে গেলো।কাছেই বিকট শব্দে বাজ পড়লো।তাতে রুদ্রের হিংস্র চোখ নজরে এলো সোহানার।ক্রুর চোখ দুটি দেখে পিলে চমকে কেঁপে উঠলো সোহানা।
রূপকথা হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টির মধ্যে মানুষের গলা শুনতে পেলো।তাতে মেয়েলি সুর শুনে সাহায্যের আশায় দৌড়ে এলো।নিকটে এসে উপস্থিত হতেই রুদ্রকে দেখে থমকে দাঁড়ালো সে।মায়া সোহানাকে রুদ্রের হাত থেকে ছড়ানোর জন্য এলোপাতাড়ি কিল চড় দিয়ে যাচ্ছে।তাতে বিরক্ত হয়ে মায়াকে সজোড়ে এক ধাক্কা মারলো রুদ্র।মায়া চটকে রূপকথার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো।সেই সাথে মৃদু আর্তনাদ করলো।
বিদ্যুৎ আলোয় মায়ার চেহারা দেখে কেঁদে ফেললো রূপকথা।মায়াকে জড়িয়ে রূপকথা বলে উঠলো
“আন্টি!আপনি এখানে?আপনি বেঁচে আছেন?

রূপকথার গলার স্বর পেয়ে পাশে তাকালো রুদ্র।এই মুহূর্তে রূপকথাকে দেখে তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবার আগেই বাছবিচার না করেই সোহানার বুকে শুট করে দিলো রুদ্র।ছলছল চোখে হাটু মুড়ে বসে গেলো সোহানা।রুদ্র তাচ্ছিল্য হেসে রূপকথার সামনে দাঁড়ালো।এরপর মায়ার চুলের মুঠি ধরে রূপকথার থেকে ছাড়িয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো।সোহানার রক্তাক্ত দেহ রূপকথার মস্তিষ্ক বোধ শূন্য করে দিলো।মায়া কেঁদে কেঁদে বলে উঠলো
“আমাকে সারফরাজ এর কাছে যেতে দাও।

রূপকথা কি করবে বুঝতে না পেরে রুদ্রের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে উঠলো
“সারফরাজ কষ্ট পাচ্ছে।উনাকে ছেড়ে দিন।আমার সাথে উনাকে যেতে দিন
রুদ্র রূপকথার কাকুতি মিনতি তে বেশ আনন্দ পেলো।রূপকথার বাহু ধরে টেনে উপরে দাঁড় করিয়ে রূপকথার গলা চেপে ধরলো রুদ্র।এরপর হিসহিস করে বলে উঠলো
“দুদিন আগেও খুব তেজ দেখেছিলাম।আর আজ সরাসরি পায়ে?বাহ হুয়াট অ্যা সিন ডার্লিং।
রূপকথা নীরবে কেঁদে বুক ভাসালো।তাতে একটুও মন গললো না রুদ্রের।বরং মাথায় এক শয়তানি ফন্দি চাপলো।এবার সারফরাজ কে বেশ করে জব্দ করতে পারবে সে।এক ঢিলে তিন পাখি মারার মতো ব্যপার ঘটলো ।
মায়াকে টেনে হিচড়ে গাড়িতে বসিয়ে দরজা লক করে দিয়ে রূপকথার সামনে এসে দাড়ালো।এরপর রূপকথার থুতনি চেপে ধরে বলে উঠলো

“ওই ডাক্তারণীর মতো হাল করবো আমি মায়া চৌধুরী কে।সারফরাজ এর জন্য আমিও কম সাফার করিনি।সমস্ত ঋণের হিসেব হবে সুদে আসলে।বকেয়া অনেক পরে গেছে ডিয়ার রূপকথা।
রূপকথা রুদ্রের হাত চেপে ধরে চোখ দিয়ে না বোঝালো।রুদ্র রূপকথার থুতনি আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলো
“সারফরাজ কে বলে দিবে আজকে রাতের ঘটনা?
ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলো রূপকথা।তার চোখ দিয়ে মোটা মোটা অশ্রুবিন্দু গড়াচ্ছে।রুদ্র রূপকথার কপালে কপাল ঠেকিয়ে ধীর গলায় বলে উঠলো

“যদি এর কিচ্ছুটি সারফরাজ এর কানে যায় তবে ওই যে মরার জন্য কাতরাচ্ছে ডাক্তার সাহেবা তার মতো হাল হবে মায়া চৌধুরীর।শুধু মায়া নয়।তোমার বাবা সুফিয়ান চৌধুরী কেও কেটে টুকরো টুকরো করবো আমি।এরপর তোমার ভালোবাসার প্রেমিক পুরুষ সারফরাজ।তাকেও জিন্দা দাফন করে দেবো।ঘূর্ণাক্ষরে কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না বুঝলে?

বলেই ধমকে উঠলো রুদ্র।রুদ্রের গর্জনে কেঁপে উঠলো রূপকথা।সে তাৎক্ষণিক মাথা নাড়িয়ে অস্পষ্ট বললো
“আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না।আপনি আন্টিকে আমার কাছে দিয়ে দিন।আমি সব চেপে যাবো।
রূপকথা বোকা মেয়ে মুহূর্তেই বুঝে গেলো চতুর রুদ্র।তাই সে রূপকথার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলো
“দেবো কিন্তু একটা শর্ত আছে।
“কি শর্ত?

চাতক পাখির ন্যয় অধীর হয়ে জানতে চাইলো রূপকথা।রুদ্ররাজ রূপকথার মুখের পানে তাকিয়ে প্রশস্ত হাসলো।এরপর বললো
“শর্ত না মানলে সারফরাজ এর কাছে ওর মায়ের বীভৎস লাশ পৌঁছাবে।আর এর জন্য দায়ী হবে শুধু মাত্র তুমি।মায়ের জন্য নিশ্চয়ই সারফরাজ ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো তড়পাচ্ছে তাই না?
মায়ার লাশ দেখে সারফরাজ এর কি হাল হবে সেটা ভেবেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো রূপকথা।এরপর ফট করে বলে উঠলো

“না না এমন করবেন না ।দয়া করুন।আপনার সমস্ত শর্তে আমি রাজি।
“তবে সারফরাজ কে ভুলে যাও।তাকে বলে দাও তুমি আর তাকে ভালো বসো না।
রুদ্রের মুখে এমন নিষ্ঠুর কথা শুনে রূপকথা প্রতিবাদ করে চিৎকার করে উঠলো।
রুদ্র তাচ্ছিল্য হেসে উত্তর করলো

“তাহলে মায়া চৌধুরী কে বাঁচিয়ে রেখে আমার কি লাভ?
“সারফরাজ আমার মুখ থেকে এ’কথা শোনার পর মরে যাবে।এতোটা নিষ্ঠুর হবেন না আমার উপর।আমার নিজের থেকেও সারফরাজ কে আমি বেশি ভালোবাসি।আমার প্রতিটি শ্বাস চলে সারফরাজ এর নামে।
রূপকথার উত্তরে ঠোঁট উল্টে রুদ্ররাজ বলে উঠলো
“তাহলে মায়া চৌধুরী মরে যাক।
বলেই বন্দুকে গুলি লোড করলো রুদ্র।এরপর এগিয়ে গেলো মায়ার পানে।
রূপকথা রুদ্রের হাত চেপে ধরে বলে উঠলো
“এতোটা নিষ্ঠুর হবেন না।উপর ওয়ালা সইবেন না।উনি মানসিক ভাবে অসুস্থ।
রুদ্র রূপকথার গালে সপাটে এক চড় বসিয়ে বলে উঠলো
“তোর কাছে জ্ঞানের বাণী শুনতে আসিনি।তুই রাজি কি না বল।
রূপকথা গালে হাত দিয়ে ডুকরে কেঁদে বলে উঠলো

“সারফরাজ এর হাতেই তোর মৃত্যু অনিবার্য বাস্টার্ড।যেদিন সারফরাজ সব জানতে পারবে সেদিন তোর রূহ পর্যন্ত পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।সেই দিন খুব শীঘ্রই আসতে চলেছে।আর যেই হাতে আমাকে আর সারফরাজ এর মাকে আঘাত করেছিস সেই হাত কে* টে তোর গলায় ঝুলিয়ে দেবে সারফরাজ।তুই ।মিলিয়ে নিজ নরকের কীট।
রুদ্র রূপকথার সাহসে দাঁতে দাঁত পিষে আরেক গালে শক্ত চড় বসিয়ে দিলো।চরের দাপটে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়লো রূপকথা।ধারালো পিচে হাত লেগে কেটেও গেলো খানিক।এদিকে সোহানার সাহায্য প্রার্থনার কাতরতা।

চেকমেট পর্ব ৩৬

সব মিলিয়ে নিরুপায় হয়ে গেলো রূপকথা।রুদ্র হাটু ভাঁজ করে রূপকথার সামনে বসে ধীর লয়ে বাঁকা হেসে বলে উঠলো
“মায়া চৌধুরীর প্রাণ এখন তোমার হাতে জানেমান ।যতদিন সারফরাজ কে দূরে রাখবে ততদিন মায়া চৌধুরী বাঁচবে।প্রেম লীলায় মজলেই মায়া চৌধুরী ফুঁস।নিজের দোষে ভালোবাসার মানুষকে যদি মা ছাড়া করতে চাও তবে আমার কি আর করার বলো?আহারে সারফরাজ ভাই আমার।এ জন্মে মায়ের মুখ তোর আর দেখা হলো না।ইশ কি কষ্ট!

চেকমেট পর্ব ৩৮