চেকমেট পর্ব ৪

চেকমেট পর্ব ৪
সারিকা হোসাইন

রাতের ঘন কালো আধাঁরের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে টকটকে লাল ঊষার আগমন ঘটেছে।পুব আকাশে কমলা রঙের আলো বিলাচ্ছে কোমল সূর্য।সুন্দর শীতল বাতাসে মোহাচ্ছন্ন চারিধার।ছোট নাইটিঙল পাখির ঝাঁক গাছের ঘন পাতার ঝোপে লুকিয়ে লুকিয়ে চিকন সুমিস্ট স্বরে ডেকে চলেছে অবিরত।কিন্তু সেই সুর বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না।কাকের ঝাঁক এসে কা কা শব্দে ভয়ানক করে তুললো চারপাশ।মুহূর্তেই সুন্দর সকাল কেমন ভয়ানক রূপ ধারণ করলো।
নিত্য দিনের ন্যায় আজো খুব ভোরে নিদ্রা ত্যাগ করে ছাদে উঠলেন সুবহান গং।সকালের কোমল রূপ উপভোগ করতে বেশ পছন্দ করেন তিনি।মন শরীর দুটোই ভালো থাকে এই মুহূর্তে।সিঁড়ি বেয়ে একপা দুপা করে এগিয়ে চলেছেন সুবহান।একহাতে সফেদ লুঙ্গির নিচের সোনালী পাড়ের অংশ ধরে রেখেছেন অন্য হাতে দাবার বোর্ড।আজকাল একা একা দাবা খেলা নেশায় পরিণত হয়েছে তার।এখানে তাকে হারানোর কেউ নেই।সে নিজেই উইনার।বিষয়টা মনে মনে বেশ পৈশাচিক আনন্দ দেয় তাকে।

ছাদে এসে দুই হাত উঁচিয়ে আরেকটু আড়মোড়া ভাঙলেন সুবহান।এরপর লম্বা শ্বাস টানলেন।ভোরের নির্মল মিষ্টি হাওয়া যেনো ভুর ভুর করে নাসারন্ধ্র দিয়ে হৃদয়ে প্রবেশ করলো।কেমন এক আত্মিক শান্তি অনুভূত হলো।
এরপর আয়েশ করে চেয়ারে বসে সামনে তাকাতেই দৃষ্টি বিস্ফারিত হলো।দাবার বোর্ড সরিয়ে তড়িৎ উঠে এগিয়ে গেলেন রেলিং এর নিকট।এরপর থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলেন নিজের হাতে লাগানো বহু সাধের বাবলা গাছের দিকে।প্রশস্ত গাছটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।উচ্চতায় যেনো আকাশ ছুঁইছুঁই।সেই বাবলা গাছের সর্পিল ডালে ঝুলছে নিজের আদরের একমাত্র ভাগিনা।বাতাসের দোলায় দড়ি খানা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলেছে।ডালটির ছাল উঠার নমুনায় মনে হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলছে এই লাশ।নির্লিপ্ত চোখে সেই লাশের পানে তাকিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলেন সুবহান।এরপর ধীরে ধীরে হাটতে লাগলেন সেই গাছ অভিমুখে।প্রতিটা কদমের সাথে সাথে সুবহান এর চোখ হলো অগ্নিবর্ণ আর চোয়াল হলো শক্ত।ভারী উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে বাঁকা গোঁফ গুলো নড়ে নড়ে উঠছে।পায়ের জুতার পিস্টনে মাটি গলে ধুলো হচ্ছে।কেঁপে উঠছে থুতনি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইতোমধ্যে হাবেলির অনেক মানুষ সেই গাছের নিচে এসে জমায়েত হয়েছে।উপস্থিত নেই শুধু সারফরাজ।যে নিজেই এমন ভয়ানক কান্ড ঘটিয়েছে তার এখানে উপস্থিত হওয়াটা কি বিশেষ জরুরি?
মাসুদের নিথর দেহের সামনে গিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সুবহান।সুন্দর গড়নের ফর্সা ছেলেটাকে কেমন ভয়ানক ঠেকছে।দেখেই পেট গুলিয়ে বমির উদ্রেক হচ্ছে।বেশ কয়েকজন নাক মুখ চেপে বমি আটকানোর চেষ্টা করেও বিফল হলো।
মাসুদের গায়ের চামড়া উপড়ে ফেলা হয়েছে।দগদগে মাংস আর চকচকে তেল দৃশ্যমান।কে*;টে নেওয়া হয়েছে বিশেষ অঙ্গ।শুধু তাই নয় জবরদস্তি মূলক তা এঁটে দেয়া হয়েছে তার মুখ গহ্বরে।হাত দুটোও বোধ হয় শক্তি প্রয়োগে ভে*-ঙে দেয়া হয়েছে।গায়ে কোনো কাপড়ের অস্তিত্ব নেই।গাছের নিচে অনাদরে পরে রয়েছে শুকনো মরিচের গুঁড়া আর লবন।মাসুদের মেলে রাখা বড় বড় ফ্যাকাসে চোখ দুটোতে ভয়ের আভাস স্পষ্ট।মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে যেনো পৃথিবীর সবচাইতে ভয়ানক কিছুর দর্শন করেছে ওই চোখ জোড়া।

মাসুদের এমন ভয়ানক রূপ দেখে কেউ আর কথা বলার অবস্থায় রইলো না।ভয়ে যেনো তাদের কলিজা শুকিয়ে উঠলো।কিন্তু সুবহান নির্বিকার।সে এখনো ঠাঁয় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে মাসুদের পানে।কয়েক মুহূর্ত এভাবে গড়াতেই এগিয়ে এলো সারফরাজ।সারফরাজ এর পায়ের শব্দ শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই মাথা নিচু করলেন সুবহান।নিজের ধেয়ে আসা কান্না গলাধঃকরণ করে চোখ তুলে সারফরাজ এর পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।এরপর শুধালেন
“চামড়া টাও তুলে নিলি?
প্রশস্ত হাসলো সারফরাজ।ভয়ানক ঠেকলো সেই হাসি।চোখ দুটো কেমন নির্দয়।এই টুকুন ছেলের নিশ্বাস টাও যেনো বিষাক্ত।সুবহান এর সামনে এগিয়ে এসে ভারী শীতল গলায় সারফরাজ বললো
“চামড়ার নীচে প্রচুর জন্ত্রনা দাদাজান।সেই যন্ত্রণায় মাসুদ ভাই ভুলে সিংহের খাঁচায় ঢুকে গেছিলো।কি করে ছাড়ি বলুন?বার বার বোঝানোর পর ও যদি কেউ অবুঝের মতো আচরণ করে তাহলে আমার আর কি করার?
আর কথা বাড়ালেন না সুবহান।নিজের চোখের সাহায্যে মনের ক্রোধ নিভৃতে জানালেন সারফরাজ কে।তা দেখে সারফরাজ স্মিত হাসলো।এসব চোখ রাঙানি সে গায়ে মাখে না।সে কোনো ভুল করেনি।নিজের আমানত রক্ষায় প্রয়োজনে এর চাইতেও ভয়ানক হয়ে উঠবে সে।এজন্য যদি মানুষের খাতা থেকে তার নাম বদলে পশুর খাতায় যায় তবে যাক না।ক্ষতি কোথায়?

রূপকথার ফর্সা কোমল গালটা কুচকুচে কালো জখমে ছেয়ে আছে।সকাল থেকেই ভয়ে সিটিয়ে আছে মেয়েটা।সেই যে সারফরাজ কে খামচে ধরে আছে কোনো ভাবেই ছাড়ছে না।থেকে থেকেই গালের টনটনে ব্যথায় কেঁদে উঠছে।কোনো ভাবেই আজ রূপকথাকে সামলাতে পারছে না সারফরাজ।মনে মনে সারফরাজ ভেবে নিয়েছে এখানে সে আর রূপকথাকে রাখবে না।কিন্ত এখানে না রাখলেও কার কাছে রাখবে ?নিজের চেনা জানা পরিচিত সেরকম কেউ নেই যার কাছে নিশ্চিন্তে রূপকথাকে রেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারবে সারফরাজ।এই মুহূর্তে সারফরাজ এর মনে হচ্ছে এই মেয়েটাকে না বাঁচালেই বুঝি ভালো হতো।বাবা মায়ের সাথে সেও আকাশে চলে যেতো।কোনো ঝামেলা রইতো না।

হঠাতই সারফরাজ খেয়াল করলো মেয়েটির শরীরের উত্তাপ অস্বাভাবিক।এবার যেনো আরেকটু বিপাকে পরলো সে।সাংঘাতিক জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।এতো এতো ঝামেলা কিভাবে সামাল দেবে সারফরাজ?
এধারে নিজের ঘরে রকিং চেয়ারে সমানে দুলে চলেছে সুবহান।কিছুই যেনো তার মন মতো হচ্ছে না।সারফরাজ কে নিয়ে তিনি যা যা ভেবে রেখেছেন সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।ওই ক্যাপ্টেন এর পরিবার তাকে একদম নিঃশেষ করে দিয়ে গেছে।এদিকে সারফরাজ আজ চরম ধৃষ্টতার পরীক্ষা দিয়েছে।হাতের মুঠো থেকে সহসাই যেনো এই সারফরাজ বেরিয়ে পড়তে চাইছে।কিন্তু সুবহান গং এ কিছুতেই হতে দিতে পারেন না।

সারফরাজ হীন তার সাম্রাজ্যের প্রতিটা ইট খসে খসে পরবে।যেকোনো মূল্যে সারফরাজ কে তার পক্ষে চাই।কিন্তু বাচ্চা মেয়েটির হঠাৎ অবতার সব কিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে।মুহূর্তেই রূপকথার উপর চরম আক্রোশ জন্মালো সুবহান গং এর।মেয়েটির উপর প্রবল জেদ আর ঘৃণা ফুটিয়ে ডেকে উঠলেন পশুতুল্য নির্দয় কাবির নামের ট্রাক ড্রাইভার কে।পশুর হৃদয়ে সামান্য দয়া মায়ার উপস্থিতি থাকলেও কাবিরের মধ্যে তার রেশ মাত্র নেই।হাজার কাকুতি মিনতি করেও ক্ষমা ভিক্ষে পাওয়া যায় না এই কাবিরের থেকে।অবশ্য এর ক্রেডিট সবটাই সুবহান এর।একদম ছোট বেলায় ধরে এনে মানুষ খুনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন এই ছেলেকে তিনি।খুন খারাবীর মধ্যে থাকতে থাকতে পাশানে পরিণত হয়েছে এই ছেলে।মানুষকে নৃশংস মৃত্যু দিতে বেশ পছন্দ করে কাবির।এক প্রকার মদের নেশার মতো খুনের নেশায় আসক্ত সে।

এদিকে দাদাজান এর ডাক পেয়ে দৌড়ে এলো ত্রিশ বছরের তাগড়া যুবক কবীর।সবেই খেতে বসেছিলো বোধ হয়।হাতের আঙুলে ভাত লেগে আছে।কাবির মাথা নত করে বুকে হাত ভাঁজ করে বললো
“বলুন দাদাজান।
কাবিরের হিংস্র চেহারার পানে একবার নজর বুলালো সুবহান।এরপর তেজী কন্ঠে ঠোঁট চেপে চেপে ক্রোধ সংবরন করতে না পেরে আদেশ করলেন
“ওই বাচ্চাটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দিয়ে আয়।এবং সেটা আজ রাতেই
সুবহান এর কথা শুনে কেঁপে উঠলো কাবির।মাথা সামান্য উঁচু করে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো
“কিন্তু দাদাজান সারফরাজ…

কাবির কে কথা শেষ করতে দিলেন না সুবহান।তার আগেই গলায় খানিক কাঠিন্য ঢেলে বললেন
“নিজের চ্যালা প্যালা দিয়ে ওকে শক্ত করে ধরে রাখবি।ওই বাচ্চা ওর রক্তের কেউ নয়।আবেগে গা ভাসিয়ে এমন বাহাদুরী দেখাচ্ছে।বাচ্চা মরে গেলে দেখবি আবার স্বাভাবিক হয়ে আমার গোলাম হয়ে রয়েছে।আর তাও যদি না পারিস তাহলে ওকে সহ শেষ করে দে।

কাবির যেনো ভুল শুনলো।সুবহান গং সারফরাজ কে শেষ করে দিতে বলছে এটা তার বিশ্বাস হলো না।এই হাবেলীতে একশত জনের উপর ছেলে পেলে আছে।তাদের মধ্যে সবার চাইতে সারফরাজকেই সুবহান সমীহ করে বেশি।শুধু কি তাই?নিজের নাতীর মতো করেই মানুষ করছেন এই সারফরাজ কে।হাবেলীতে কেউ সুবহান গং এর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না।অথচ সারফরাজ নিজের অধিকার আদায় করে নেয় চোখে চোখ রেখে।সারফরাজ ইচ্ছে পোষন করা মাত্রই সুবহান তাকে বিশেষ সুবিধা সহ লেখাপড়ার সুযোগ ও দিয়েছেন।এই হাবেলীতে একমাত্র সারফরাজ ই কলেজের গন্ডিতে পা রাখতে পেরেছে।অথচ সারফরাজ এর থেকে কম বয়সী ছেলে এখানে লেখাপড়া ফেলে চুরি ছিনতাই এ মশগুল হয়ে আছে। সুবহান গং তার খবর ও রাখেন না।আজকে সেই আদরের সারফরাজ কে শেষ করার হুকুম সুবহান গং নিজে দিচ্ছে কথাটা যেনো সপ্নের মতো ঠেকলো কাবিরের কাছে।কিন্তু কথা খানা তার মনে ধরলো।সারফরাজ তার দুই চোখের শত্রু।মোটেও সহ্য হয়না এই ছেলেকে তার।এতো দিন বাদে যেহেতু এমন সুবর্ণ সুযোগ এসেছে কাবির কিছুতেই তা হাতছাড়া করবে না।ওই মেয়েকে শেষ করার আগে সারফরাজ কে শেষ করবে সে।তার পর পিষে মারবে ওই ছোট বাচ্চাকে।মনে নানাবিধ ভাবনা ভেবে কাবির প্রত্যুত্তর করলো

“কথাটা ভেবে বলছেন তো দাদাজান?
চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে কপাল কুচকালেন সুবহান।এরপর রয়ে সয়ে গম্ভীর গলায় বললেন
“এক কথা একবার বলতেই পছন্দ করি আমি কাবির।নিজ স্বার্থে আদর দিয়ে যেমন মাথায় তুলেছি তেমনি মাথা থেকে পায়ে পিষতেও সময় নেবো না।তুই তোর কাজে যা।বাকিটা আমি দেখে নেবো।
কাবির সম্মতি জানিয়ে প্রস্থান করতে নিলেই সুবহান ধীর গলায় সতর্ক বাণী ছুঁড়লো
“বড় রাম দা টা ভালো করে ধার দিয়ে নিস।একবার ফস্কে গেলে কিন্তু তোর মৃত্যু অনিবার্য।
সুবহান এর কথায় ফিক করে হেসে দিলো কাবির।খুবই বিশ্ৰী ভয়ানক সেই হাসি।কিছু ক্ষণ হেসে সেই হাসি থামিয়ে কাবির বললো
“এই হাত থেকে আজ পর্যন্ত কেউ ফসকাতে পেরেছে দাদাজান?সতেরো বছর ধরে চলছে এই হাতের নির্দয়তা।জীবনে প্রথম খুন কবে করেছিলাম জানেন?
সুবহান উৎসুক হয়ে কাবিরের মাধুর্য হীন চেহারার পানে তাকিয়ে রইলো।শুকিয়ে উঠা আঙুলের ভাত চাটতে চাটতে কাবির বললো

“সাত বছর বয়সে দাদাজান।মানুষটার অপরাধ ছিল নগন্য।কিন্তু আমার ক্রোধ ছিলো অসামান্য।মৃত্যুর আগে অমন বাপের বয়সী মানুষটা বড় বড় চোখ করে আমাকে দেখছিলো।তার যেনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো এমন হাঁটুর বয়সী ছেলে তাকে নরক জন্ত্রনা তুল্য মৃত্যু দিচ্ছে।মৃত্যুর আগে আমাকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলো রাস্তার কুকুরের মতো মরন হবে আমার।ওই অভিশাপ আমি খন্ডাবো দাদাজান।এই কাবির কারো হাতে নিজেকে শেষ হতে দেখতে পারে না।দরকার পরলে নিজের জান নিজেই কোরবান দেবো দাদাজান।তবুও অন্যের হাতে নিজের জীবন কিছুতেই তুলে দেবো না।
কথা গুলো বলতে বলতে কাবিরের চোখ জ্বলে উঠলো।সুবহান দেখলেন ভয়ানক চোখ জোড়াতে কেমব অদ্ভুত দ্যুতি।রাক্ষসের মতো চোখ দুটো দেখলেই কলিজা কেঁপে উঠে।সেই চকচকে চোখের পানে তাকিয়ে সুবহান মনে মনে ভাবলেন
“তোকেও আমি নরক জন্ত্রনা দিয়ে মৃত্যু দেবো শুয়োর।সারফরাজ এর মৃত্যুর পর তুই যে আমার জম হয়ে ফিরে আসবি তা আমি ভালোই জানি।

মাসুদের লাশ দাফন হলো দুপুরের পরপর।কোনো ইমাম এলো না সেই লাশ দাফনে।এলো না বললে ভুল হবে।আনা হয়নি।শেষ গোসলটাও সেভাবে দেয়া হলো না।কোনো মতে গাছ থেকে নামিয়ে সাদা থানে ভরে মাটিচাপা দেয়া হলো।সুবহান গং এর হাবেলীতে আজ কোনো রান্না বান্না হলো না।রূপকথার জন্য বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে খাইয়ে দিলো সারফরাজ।জ্বরের মাত্রা ব্যাপক।মেয়েটি সেরকম কিছুই খেলো না।চোখ বুঝে ঘাড় ছেড়ে দিয়ে সারফরাজ এর গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা দিয়ে রাখলো।মেয়েটির এহেন অসহায় অবস্থায় মন ভার হলো সারফরাজ এর।

সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে আকাশ জুড়ে বিদ্যুতের খেলা চললো।সেই সাথে এলোমেলো দমকা হাওয়া।বিদ্যুতের ঝিলিক বিকট শব্দের উৎপত্তি করছে থেকে থেকে।মাগরিবের আজানের পরপর ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়লো রূপকথা ।সারফরাজ তাকে বিছানায় শুইয়ে একটা কাঁথা গায়ে দিয়ে খাটের কাছ ঘেষে মেঝেতে বসে রইলো।বাহিরে অঝোর বৃষ্টি ঝরছে।বৃষ্টির দমকে মনে হচ্ছে রাত ভর ঝরবে।সারাদিন সুবহান কে দেখা যায়নি।হয়তো ভাগ্নের মৃত্যু শোক পালন করছে একাকী।
বজ্রপাতের কাছে টিকতে না পেরে ইলেক্ট্রিসিটি বিদায় নিলো।
সারফরাজ একাকী অন্ধকার ঘরে নিজ চিন্তায় ডুব দিলো।মাসুদের প্রতি সুবহানের ভালোবাসা ছিলো অতুলনীয়।ভাগ্নের মৃত্যু যে এমনি এমনি সুবহান মানবে না তা সারফরাজ জানে।সুবহান অবশ্যই তাকে পাল্টা আঘাত করবে।কিন্তু আঘাত টা কি?
সারফরাজ এর ভাবনার ব্যাঘাত ঘটলো দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে।সজাগ কানে বিছানার নিচ থেকে নিঃশব্দে ভারী এক রড নিয়ে কোমরের পেছনে লুকালো সারফরাজ।এরপর লম্বা লম্বা পা ফেলে দরজা খুলে চৌকাঠে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়ালো।সামনে সারফরাজ এর বিশ্বস্ত সিদ্দিক দাঁড়ানো।তার চোখে মুখে ভয়।সিদ্দিকের মুখের ভয় কৃত্তিম নাকি সত্যি যাচাই করলো না সারফরাজ।সিদ্দিকের চোখে চোখ রেখে মাথা ঝাকিয়ে শুধালো
“কি চাই?
সিদ্দিক কিছুক্ষন আমতা আমতা করে বললো
“দাদাজান তোরে দাবা খেলার লাইগা ডাকে।
সিদ্দিকের কথায় কপাল কুচকালো সারফরাজ।এরপর ঘরে ঢুকে তালা চাবি এনে রূপকথার ঘর আটকে দিয়ে সিদ্দিক কে শুধালো
“কোথায় উনি?
সিদ্দিক বাইরের বড় উঠান নির্দেশ করে বললো

“ওই হানে।
সারফরাজ এর কাছে কেমন খটকা লাগলো।এমন ঝড় বৃষ্টিতে সুবহান তাকে দাবা খেলার জন্য বাইরে কেনো ডাকবে?হয়তো ভাগ্নের মৃত্যুতে উন্মাদ হয়ে উঠেছে এজন্য।সিদ্দিকের পিছু পিছু হাটতে লাগলো সারফরাজ।কিন্তু পা দুটো কেমন অসাড় লাগছে।শরীর ও শক্তিহীন।
সদর দরজা দিয়ে বের হতেই কাবির অমায়িক হেসে সারফরাজ এর সামনে দাঁড়ালো।সেই হাসিতে নজর বুলাতেই চোখ টিপলো কাবির।মুহূর্তেই দশ বারো জন ছেলে এসে ঘিরে ফেললো সারফরাজ কে।কোন কিছু বুঝে উঠবার আগেই টেনে হিচড়ে নিয়ে গেলো বাইরের বাবলা গাছের নিকট।
ছোটার জন্য ছটফট করলো সারফরাজ।কিন্তু কাবির ক্রুর হাসলো।হাতে থাকা রাম দা দিয়ে গাল চুলকাতে চুলকাতে বললো

“চিতা বাঘের থাবা থেকে কখনো শিকারী পালাতে দেখেছিস?
সারফরাজ বুঝলো কঠিন ষড়যন্ত্রে ফেঁসে গিয়েছে সে।আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো তার।নিজের ভয়ানক পরিণতি তে ক্রোধে চোয়াল শক্ত হলো সারফরাজ এর।রক্তবর্ণ ভয়ানক চক্ষু নিয়ে সিদ্দিকের পানে একবার তাকালো সারফরাজ।সিদ্দিক মুহূর্তেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো।
কাবির আর সময় অপচয় করতে চাইলো না।দাবার চালের মতো সারফরাজ কখন কি খেলা দেখাবে কে জানে?তাই ছেলে দের কঠিন স্বরে হুঁশিয়ারি করলো
“শালাকে আরো শক্ত করে চেপে ধর।ওর গরম রক্তে গোসল করবো আমি।
কথাটি বলেই কাবির দা উচালো।সারফরাজ এর চোখে মুখে মৃত্যু ভয় দেখা গেলো না।বিদ্যুতের আলোক তরঙ্গে তার ভয়ানক চোখ জোড়া আরো অদ্ভুত ভয়ানক দেখালো। কাবির এমন রূপে তাচ্ছিল্য হেসে বললো
“মা*-গীর ছাওয়াল মরন দেইখ্যা ডর লাগে না তোর?
সারফরাজ নির্লিপ্ত তাকিয়ে কাবিরের উচ্ছাস দেখলো।
কবির পুনরায় দাঁত কেলিয়ে নাটকীয় স্বরে বলে উঠলো
“তোকে আজ বড্ড নিরুপায় লাগছে।আমার বেশ মায়া হচ্ছে তোর জন্য।তোকে আমি দু মিনিট সময় দেবো দৌড়ে পালানোর ।যদি বাঁচতে পারিস তবে তুই উইনার।তুই বাচলে আমি নিজে আমার জান তুলে দেব তোর হাতে।আর যদি আমার হাতে ধরা পরিস তাহলে তোর মুন্ডু থাকবে আমার পায়ের নিচে।রাজি?
কাবিরের প্রশ্নে মাথা ঝাঁকালো সারফরাজ।তা দেখে কাবির হাত তালি দিয়ে বলে উঠলো
“তার আগে একটু খাতির করবো তোকে।

কথাটি বলেই পাশের এক ছেলের থেকে একটা হকি নিয়ে সারফরাজ এর পায়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করলো।কাবিরের আঘাতে সামান্য আউচ্ পর্যন্ত করলো না সারফরাজ।এটা দেখে কাবির আরো ক্ষিপ্ত হলো।যতক্ষন সারফরাজ মাটিতে হাটু মুড়ে না বসলো ততক্ষণ পেটালো।ব্যাথায় সইতে না পেরে কাদা মাটিতে নুইয়ে পড়লো সারফরাজ।এবার কাবিরের ঠোঁটে হাসি ফুটলো।সে তার ছেলেদের উদ্দেশ্যে গলা উঁচু করে বললো
“ওর হাত ছেড়ে দে।মরার আগে একটু লুকচুপি খেলবো ওর সাথে।
কবিরের নির্দেশে সারফরাজ এর হাত ছেড়ে দিলো ছেলে গুলো।হাত ছাড়া পেতেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো সারফরাজ।এরপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়াতো লাগলো ।এটা দেখে হো হো করে হেসে উঠলো কাবির।কিন্তু কাবিরের দৃষ্টি সীমা থেকে না পালিয়ে মুহূর্তেই ধেয়ে আসলো সারফরাজ।পায়ের আঘাত ভুলে পিঠের পেছন থেকে লুকিয়ে রাখা রড বের করে ঝাঁপিয়ে পরলো সকলের উপর।সারফরাজ এর আকস্মিক আক্রমনে দিশেহারা হলো সবাই।তারা পাল্টা আক্রমণ করতে চাইলো।কিন্তু ধূর্ত সারফরাজ এর সাথে পেরে উঠলো না।

।মুহূর্তেই সারফরাজ এর শরীর জুড়ে যেনো অসুরের শক্তি ভর করলো।সারফরাজ এর হাতের মার খেয়ে চিৎকার করে উঠলো ছেলে গুলো।বৃষ্টির ঝুমঝুম ধারা উপেক্ষা করে সেই চিৎকার হাবেলীর ভেতর পৌছালো না।ধারালো রডের বাড়ি কার কোথায় গিয়ে লাগলো সারফরাজ তা খেয়াল করলো না।কাবির দ্বিগুণ হিংস্র হয়ে দাঁত মুখ খিচে দা নিয়ে দৌড়ে এলো।কিন্তু সারফরাজ এর সামনে টিকতে পারলো না।দায়ের পোচ লেগে সারফরাজ এর হাতের তালু হা হয়ে গেলো।কোনো ভ্রূক্ষেপ করলো না সারফরাজ।এক ঝটকায় সেই দা কাবিরের থেকে টেনে নিয়ে কোনো কিছু বাছবিচার না করে কোপ বসালো কাবিরের ধরে।ধারালো দায়ের কোপে ধর থেকে নিমিষেই খসে পড়লো মাথা।ধীরে ধীরে নিজের জ্ঞান খুইয়ে ফেললো সারফরাজ।মাথায় যেনো খুনের নেশা চাপলো।কাবিরের চাইতে হাজার গুণ নির্দয় হয়ে প্রত্যেকটা ছেলেকে কু*-পিয়ে আগাছার মতো মাটিতে ফেলে দিলো সারফরাজ।এতগুলো মানুষের রক্ত সুবহান গং এর হাবেলীর উঠোন রাঙিয়ে তুললো।চারপাশে আরেকবার নজর বুলিয়ে অদূরে দাঁড়ানো ভীত সিদ্দিক কে নজরে পরলো।ক্লান্ত শরীরে দায়ে ভর দিয়ে এলোমেলো পায়ে সিদ্দিকের সামনে এসে দাড়ালো সারফরাজ।এরপর ঠান্ডা গলায় শুধালো

“এতবড় প্রতারণা কিভাবে করলি সিদ্দিক?
ভয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো সিদ্দিক।হুড়মুড়িয়ে সারফরাজ এর পায়ে পরে ডুকরে কেঁদে বলে উঠলো
“মাফ কৈরা দে বন্ধু।ভুল কইরা ফালাইছি।
সিদ্দিকের কান্নায় হো হো করে উন্মাদের ন্যয় হাসলো সারফরাজ।এরপর বললো
“তোর বেঈমানি তে কতগুলো মানুষের প্রাণ গেলো দেখ!তোকে মাফ করলে আমার যে ঘোর পাপ হবে সিদ্দিক।তার চেয়ে ভালো তুই মৃত্যুর জন্য তৈরি হ।
নিজের প্রানের শঙ্কায় কেঁদে সারফরাজ এর পায়ে মাথা নোয়ালো সিদ্দিক।কিন্তু সামান্য হৃদয় টললো না সারফরাজ এর।সিদ্দিক এর কান্না আগুন জ্বালিয়ে দিলো সারফরাজ এর শরীরে।সিদ্দিক কে লাথি দিয়ে দূরে ফেলে সারফরাজ হিংস্র কন্ঠে বলে উঠলো

চেকমেট পর্ব ৩

“কলেমা পড় সিদ্দিক।ওরা আল্লাহর নাম মুখে নেবার সময় পায়নি।তুই আমার বন্ধু।সেই দায় ভার থেকে তোকে এইটুকু ক্ষমা আমি করতেই পারি।কঠিন মৃত্যু দেবো না তোকে আমি।এতো দ্রুত মারবো তোকে তুই নিজেও জানবী না যে দুনিয়া থেকে তোর বিদায় হয়েছে।

চেকমেট পর্ব ৫