চেকমেট পর্ব ৪৩
সারিকা হোসাইন
প্রায় আঠাশ ঘন্টার ক্লান্তিকর দীর্ঘ জার্নির পর সারফরাজ এর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় রূপকথা।সারফরাজ আর রূপকথা যখন গাড়ি থেকে নেমে মাটিতে পা রাখে তখন কেবল ভোরের সূচনা।ক্লান্ত চোখে রূপকথা চারপাশে একবার নজর বুলায়।
পাহাড় আর শৈলশ্রেণি বুকে জড়িয়ে রাখা সিয়েরা ফরেস্টের ভোরের সূচনা লগ্ন রূপকথার কাছে মনে হলো কোনো অদৃশ্য শিল্পী ধূসর ক্যানভাসে আলোর তুলিতে প্রথম ঝলক টেনে দিচ্ছে। সূর্যের অতি সূক্ষ্ম সোনালি রেখা দূরের পাইন চূড়াগুলোকে ছুঁয়ে ঝিকিমিকি করছে আর গাঢ় ছায়া আলোর লুকোচুরিতে বনের গভীরে জন্ম নিচ্ছে এক রহস্যময় আলো আঁধারির খেলা।
শেষ রাতের ঠান্ডা হাওয়ায় জমে থাকা শিশির পাতার ডগা থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে।নরম শব্দ টুপটাপ ছন্দ। অদূরে পাহাড়ি ঝর্নার ক্ষীণ গর্জন। কাছেই মরিচা রঙা কাঠঠোকরার একটা ঠক ঠক আওয়াজ। আর মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বাজপাখির ডানার ফাঁপা শোঁ শোঁ শব্দ।সব মিলিয়ে একটা গোপন সুর রচনা করছে এই ভোর। রূপকথার মনে হলো এই সুরের ভেতরেই জেগে ওঠে সিয়েরার সুবিশাল নিশ্ছিদ্র নিস্তব্ধতা।যেন বনই এক প্রাচীন দ্বাররক্ষক ।তারা ফিসফিস করে রূপকথার কানে কানে বলছে
“আজ থেকে নতুন এক গল্প শুরু হোক।নিঃসঙ্গ ,গম্ভীর,বেদনায় জীর্ণ হওয়া এক অসাধারণ মানবের ভালোবাসার গল্প।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ভোরের রূপে মুগ্ধ হয়ে রূপকথা আরেকটু সামনে এগিয়ে দাঁড়ায়।প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে নিজের চোখ বুজে লম্বা শ্বাস টানে।মাটির গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেকোয়িয়া আর সুগার পাইন এর গন্ধ মৃদু কুয়াশার সঙ্গে মিশে শ্বাসের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। আকাশ এখনো হালকা রক্তিম ।গভীর বেগুনি থেকে ধীরে ধীরে আড়চোখে লাজুক গোলাপি তারপর স্নিগ্ধ কমলা রঙে রূপ নিচ্ছে। সেই আলো প্রথমে স্পর্শ করছে উঁচু পাইন গাছের চূড়ার কাঁপা কাঁপা ডগাগুলো তারপর গড়িয়ে নামছে পাথুরে ঢাল বেয়ে ফার্নের পাতায় আর বুনো জুঁইয়ের সাদায়।শেষমেশ মাটির ওপর এক অনিন্দ্য মোহজাল এর ন্যায়।
সূর্য এখনো পুরোপুরি ওঠেনি, তবু পূর্ব দিগন্তে লাল-কমলা আলো ছড়িয়ে পড়েছে,
আর সেই আলো ভেদ করে দেখা যাচ্ছে সামনের সারফরাজের বাড়ি।
দূতলা বিশিষ্ট কাঠ আর কাঁচের নিমিত্তে এক নিঃশব্দ বিশালতার সাম্রাজ্য।
যেটা দেখতে যতটা সুন্দর,কিন্তু তার চেয়েও বেশি একাকী,প্রাণহীন।
গাড়ির ভেতর থেকে রূপকথার লাগেজ নামিয়ে ঘন কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে এলো সারফরাজ।প্রচন্ড শীতে দাঁতের কপাটে কপাটে বাড়ি খাচ্ছে।কিন্তু রূপকথা নির্বিকার।সারফরাজ দ্রুত পায়ে রূপকথার সামনে দাড়িয়ে নিজের গায়ের কালো লেদার জ্যাকেট রূপকথার গায়ে জড়িয়ে কাঁপা কন্ঠ স্বরে বলে উঠলো
“এই হাড্ডি গুলোতে শীত লাগে না?
সারফরাজ এর আকস্মিক গলায় সম্বিৎ ফিরে পেলো রূপকথা।সে চকচকে উচ্ছল চোখে সারফরাজ এর পানে তাকালো।এরপর চপল গলায় বললো
“এমন রাজ প্রাসাদ তুল্য সুন্দর ফরেস্ট হাউজে থাকো তুমি?আমি তো ভাবতেই পারিনি তোমার বাড়ি এতো মোহনীয় আর অপার সৌন্দর্যে আবৃত!
রূপকথার উত্তেজিত কথায় সারফরাজ অল্প হাসলো।এরপর এক ঝটকায় নিজের কোলে তুলে নিলো রূপকথাকে।লুইস আর ইয়ং কে ইশারা করতেই দুজনে দুপাশ থেকে সদর দরজা মেলে ধরলো।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ এর আগে সারফরাজ ফিসফিস করে বলে উঠলো
“প্রথমবারের মতো এই সিয়েরা ফরেস্ট,এই বাড়ি সত্যি করে ঘুম থেকে জাগলো।স্বাগতম মাই সুইট ম্যাডনেস।তোমাকে স্বাগতম ।তবে আমার বাড়িতে নয় আমার হৃদয়ে।কজ
“You are not just the queen of my kingdom…
You’re the queen of my heart’s empire too.”
সারফরাজ এর আবেশীত কথায় রূপকথা কিছু বলতে পারে না।সে শুধু সারফরাজ এর নীল চোখ জোড়ায় নজর স্থির রেখে সারফরাজ এর গলা জড়িয়ে থাকে।
রূপকথাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসায় সারফরাজ।এরপর ফায়ার প্লেসের আগুন জ্বালায়।বিশাল ড্রয়িং রুম,থাই কাঁচের বাইরের সৌন্দর্য আর সারফরাজ এর বৃহৎ সাম্রাজ্য সব মিলিয়ে অবাক থেকে অবাকতর করে তোলে রূপকথাকে।
রূপকথাকে বসিয়ে সারফরাজ দৌড়ে চলে যায় দূতলার কক্ষে।ফিরে আসে মিনিট দুয়ের মধ্যেই।লুইস আর ইয়ং লাগেজ গুলো নিয়ে উপরে চলে যায়।
সারফরাজ রূপকথার পায়ের সামনে হাটু মুড়ে বসে নরম তুলোর স্যান্ডেল পরিয়ে দেয় সযত্নে।স্যান্ডেল জোড়া একদম রূপকথার পায়ের মাপে।উষ্ণ স্যান্ডেল জোড়ার পানে তাকিয়ে রূপকথা শুধায়
“এখানে আরো কোনো মেয়ে মানুষ এসেছিলো কখনো?
সারফরাজ রূপকথার পা চেপে ধরে ঠান্ডা গলায় বলে উঠে
“এই বাড়ির দেয়াল পর্যন্ত কখনো কোনো নারী কন্ঠ শুনেনি।আজই প্রথম কোনো মেয়ে এই বাড়িতে পা রেখেছে।এই বাড়ি প্রাণ হীন রূপকথা।আমি চাই তোমার ছোঁয়ায়,তোমার গলার স্বরে, তোমার হাসিতে এই বাড়িতে প্রাণ আসুক।
বলেই উঠে দাঁড়ালো সারফরাজ।এরপর পকেট থেকে ফোন বের করে ডায়াল করলো কাঙ্খিত নম্বর।রিং হতেই ঘুম জড়ানো গলায় ফোন তুললো ওপাশের ব্যাক্তি।সারফরাজ তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ভারী গলায় নির্দেশ দিলো।
“ড্যাভিন….. ব্রিং এঞ্জেলো হেয়ার।
বলেই কল কাটলো।সারফরাজ কল কাটতেই রূপকথা অবাক গলায় শুধালো
“এঞ্জেলো কে?
“আমার ছেলে।
বলেই দুস্টু হেসে উঠে গেলো সারফরাজ।
সারফরাজ এর মুখে ছেলে সম্বোধন শুনে রূপকথার বুক মুচড়ে উঠলো।সে সারফরাজ কে অনুসরণ করে দৌড়ে উপরে উঠলো।এরপর পেছন থেকে সারফরাজ এর হাত চেপে ধরে ভয়ার্ত কম্পিত গলায় শুধালো
“তুমি বিবাহিত ছিলে?
সারফরাজ থমকে দাঁড়িয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে দাঁত চেপে বলে উঠলো
‘গাঁধী।
কিন্তু রূপকথা ছাড়বার পাত্রী নয়। অগত্যা সারফরাজ অল্প করে বললো
“এলেই দেখবে।
এরপর রূপকথাকে টেনে নিজের সামনে এনে এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে গালে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো
“ব্রেকফাস্ট সেরে ঘুমাও রূপকথা।অনেক লম্বা জার্নি হয়েছে।ঠিক ঠাক রেস্ট না নিলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তুমি।
বলেই রূপকথার কক্ষের দরজার সামনে রূপকথাকে এনে হাত নির্দেশ করলো সারফরাজ।
রূপকথা বৃহৎ কক্ষের প্রতিটি কোনায় নজর বুলালো।এরপর বিস্ফারিত নজরে শুধালো
“এটা আমার গেস্ট রুম?
সারফরাজ মাথা ঝাকিয়ে শীতল গলায় বললো
“মেয়েলি প্রয়োজনীয় সব পাবে ভেতরে।যদি আরো আগে জানতাম তুমি আসবে তবে সবকিছু আরও গোছালো থাকতো।চব্বিশ ঘন্টায় মানুষ মারফত যা পেরেছি ওটুকুই করেছি।কিন্তু তুমি টেনশন নিও না।আমি তোমার ঘর রাজ রানীর ন্যয় সাজিয়ে দেবো।তুমি আমার মেহমান নও রূপকথা।তুমি আমার রানী সাহেবা।আর আমি নিতান্ত ছোট নগন্য এক ভৃত্য তোমার।
বুকে এক হাত রেখে আরেক হাতে ঘর নির্দেশ করে মাথা নোয়ালো সারফরাজ।রূপকথা ধীর ছোট পায়ে কক্ষে প্রবেশ করলো।কক্ষের এক পাশে ছোট একটা বিছানা পাতা,পাশে একটা বেড সাইড টেবিল।তার উপর একটা টেবিল ল্যাম্প।ওপর পাশে কাঠের নান্দনিক ড্রেসিং টেবিল,বিশাল ইন্টেরিয়র মডার্ন উডেন কাপবোর্ড।প্রতিটি তাক ভর্তি মেয়েলি পোশাক,বিভিন্ন কসমেটিকস, জুতা আর স্টাইলিশ দামি দামি ব্যাগের সমাহার।ঘরের প্রতিটি কোনায় আভিজাত্যের ছাপ।বেলকনি ভর্তি ইনডোর লতানো,ঝোলানো নানান গাছ গাছালি।
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো রূপকথা।সব কিছু তার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে।শ্বাস টেনে রূপকথা ধপ করে নরম বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে ভাবতে লাগলো
“সারফরাজ কতো বড়লোক?
এরপর আবার উঠে বসলো।রূপকথার কক্ষ থেকে সিয়েরা ফরেস্ট এর উঁচু চূড়া আর তা থেকে গড়িয়ে পড়া ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে।রূপকথা দৌড়ে বেলকনিতে এলো।এরপর নয়নাভিরাম সেই সৌন্দর্য উপভোগ করে বলে উঠলো
“মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই সারফরাজ ব্যাটাকে বিয়ে করে এখানে এসে স্থান পোক্ত করতে হবে।নয়তো এমন দৃশ্য না দেখে থাকবো কি করে?
রূপকথা স্থির দৃষ্টিতে উপভোগ করতে লাগলো ঝর্ণার সৌন্দর্য।এমন সময় কুকুরের ঘেউ ঘেউ স্বর পাওয়া গেলো।কুকুরের শব্দে রূপকথার কান সজাগ হলো।সে শব্দ অনুসরণ করে বাইরে বেরিয়ে এলো।এরপর সিঁড়ি ধরে নীচে।এসেই দেখতে পেলো সারফরাজ এর কোলে ছোট একটা কুকুর।যেনো দীর্ঘদিন বাদে তার আপন কাউকে পেয়ে ভালোবাসায় গদগদ হয়েছে।রূপকথা দ্রুত পায়ে সারফরাজ এর সামনে দাঁড়ালো।সারফরাজ এঞ্জেলোকে আদরে ব্যস্ত।চোখ বুঝে এঞ্জেলো সেই আদর উপভোগ করছে।এমন সময় রূপকথার ঘ্রানে চোখ মেলে তাকায় এঞ্জেলো।আর অমনি কর্কশ গলায় ঘেউ ঘেউ ডেকে উঠে।পারলে সারফরাজ এর কোল থেকে নেমে রূপকথাকে কামড়ে ধরে।এঞ্জেলোর এমন আচরণে রূপকথা ঘাবড়ে গিয়ে সারফরাজ এর পেছনে দাঁড়িয়ে সারফরাজ এর শার্ট খামচে ধরে।সারফরাজ এঞ্জেলো কে শান্ত করতে করতে বলে উঠে
“হুশ এঞ্জেলো,ডোন্ট সাউট।শি ইজ আওয়ার কুইন।শী ডিজার্ভস রেসপেক্ট’স।নট বার্কিং।
অবুঝ প্রাণীটি মালিকের কথা কি বুঝলো কে জানে?সে তাৎক্ষণিক ঘেউ ঘেউ থামিয়ে মাথা নত করে সারফরাজ এর বুকে মিশে রইলো।নাদুস নুদুস লোমশ ছোট কুকুরটাকে ছুঁয়ে আদর করার ইচ্ছে জাগলো রূপকথার।সারফরাজ বোধ হয় তা খেয়াল করলো।ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে ধরে রূপকথাকে শুধালো
“কোলে নেবে?
“হু।
সারফরাজ সযত্নে রূপকথার হাতে তুলে দিলো এঞ্জেলোকে।রূপকথা আলতো হাতে ধরে তাকে আদর করলো।এরপর শুধালো
“ওকে দেশে নিয়ে যাওনি কেনো?
“হুট করে গিয়েছিলাম প্রস্তুতি ছাড়া।আর ও সব ওয়েদার এ নিজেকে সুট করাতে পারে না।অসুস্থ হয়ে যায়।এজন্য নিতে পারেনি।
রূপকথা এঞ্জেলোর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শুধালো
“ওকে কে দেখেছে এই কয়েক মাস?
সারফরাজ তাচ্ছিল্য হাসলো এই প্রশ্নে।এরপর হাঁটুতে ভর দিয়ে ঝুকে রূপকথার মুখের সামনে এসে ফিসফিস করে বলে উঠলো
“টাকার বিনিময়ে কাঠের পুতুল নাচে রূপকথা।শুধু কুকুর নয়।সিয়েরা ফরেস্ট এর অজগর পাহারা দিতে বললেও তারা দেবে।
অজগরের নাম শুনে বুক কেঁপে উঠলো রূপকথার।সে ফাঁকা ঢোক গিলে ভয়ার্ত কন্ঠে শুধালো
“এখানে অজগর আছে?
সারফরাজ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো
“শুধু অজগর নয় রূপকথা।তার চাইতেও ভয়ানক প্রাণী আছে।আস্তে আস্তে সব দেখবে।
রূপকথা চট করে বলে উঠল
“না না আমি এসব দেখতে চাই না।
“তা কি করে হয়?জঙ্গলে বাস করবে অথচ পশুপাখি দেখবে না?ওদের সাথে মিলেমিষেই তো তোমাকে থাকতে হবে রূপকথা!
এবার ভয়ে রূপকথার গলা শুকিয়ে উঠলো।সে বইয়ে পড়েছে এসব ভয়ানক অরণ্যে ভয়ানক সব প্রাণীর বসবাস।ঘরের আনাচে কানাচে কোথায় কোন সাপ খোপ লুকিয়ে আছে কে জানে?যদি ঘুমের ঘোরে কোন বিষাক্ত সাপ এসে কামড়ে দেয় তখন?
সারফরাজ এর বাড়ী ভ্রমনের এডভেঞ্চার অনুভূতি মুহূর্তেই ভয়ে রূপ নিলো রূপকথার।তার মুখের রঙ পাল্টে গেলো।সারফরাজ তা খেয়াল করে শুধালো
“ভয় পাচ্ছ?
রূপকথা মাথা ঝাঁকালো।
সারফরাজ অবাক গলায় বললো
“কেনো?
“যদি ঘরে কোনো বিষাক্ত প্রাণী ঢুকে যায়?আর আমায় কামড়ে দেয়?
রূপকথার বোকা কথায় ফিক করে হেসে দিলো সারফরাজ।এরপর ঠান্ডা গলায় বললো
“আমার হুকুম ছাড়া এই বাড়িতে বাইরের হাওয়া পর্যন্ত প্রবেশ করে না রূপকথা।এখানে শুধু আমার রাজত্ব চলে।আর কারোর না।এই অরণ্যের প্রতিটা প্রাণী জানে তাদের রাজা কতোটা নির্দয় আর নৃশংস।নিশ্চয় তারা সেই নিষ্ঠুর রাজার রানীকে বিরক্ত করার দুঃসাহস দেখাবে না।
সারফরাজ এর কথা গুলো কেমন ভয়ঙ্কর ঠেকলো রূপকথার কাছে।রূপকথা পলক হীন তাকিয়ে সারফরাজ এর কঠিন মুখটা দেখলো।দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করবার আগেই সারফরাজ ভারী গলায় আদেশ করলো
“ফ্রেস হয়ে ডাইনিং টেবিলে এসো।খাবার দিচ্ছি।
আর দাঁড়ালো না সারফরাজ।হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেলো।সারফরাজ এর আভিজাত্য ভরা চলন গভীর চোখে খেয়াল করলো রূপকথা।প্রতিটি পায়ের স্পর্শে সিঁড়ির ধাপ গুলো পর্যন্ত যেনো কেঁপে উঠছে।চোয়ালের কাঠিন্য আর চোখের স্থির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বলে দিচ্ছে মানুষটা আর দশটা সাধারণ পুরুষের মতো নয়।সে সকলের থেকে আলাদা।যে ভালোবাসার মানুষ ব্যতীত সকলের জন্য হিংস্র,ভয়ানক।
অল্প কিছু খাবার খেয়ে নিজ কক্ষে এসে কম্ফোর্টার জড়িয়ে আরাম করে শুয়ে গেলো রূপকথা।হঠাৎ বাবা মায়ের কথা মনে পড়তেই আবার উঠে বসলো।নিশ্চয় তারা চিন্তা করছে।একবার কল করা প্রয়োজন।নিজের চার্জ হীন ফোনটা ঝটপট ব্যাগ থেকে বের করলো রূপকথা।এরপর সেটা চার্জে লাগিয়ে ছুটলো সারফরাজ এর কক্ষে।
লম্বা জার্নি,কয়েকদিনের টানা পরিশ্রম আর নির্ঘুম রাত দিন কাটানোর কারনে শোয়া মাত্র তন্দ্রা এসে ভর করলো সারফরাজ এর চোখে।সে মাথার নিচে এক হাত আর বুকে আরেক হাত রেখে চোখ বুঝলো।
রূপকথা যখন সারফরাজ এর কক্ষে এলো তখন দেখতে পেলো সারফরাজ ঘুমুচ্ছে।রূপকথা তাকে ডেকে বিরক্ত করতে চাইলো না।চুপি চুপি নিঃশব্দে সে সারফরাজ এর বিছানার সামনে এসে দাড়ালো।আশে পাশে নজর বুলিয়ে বালিশের কাছটায় সারফরাজ এর ফোন নজরে এলো।ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হালকা ঝুকে ফোনের পানে হাত বাড়ালো রূপকথা।মুহূর্তেই শিকারি জন্তুর ন্যয় রূপকথার হাত চেপে ধরে বালিশের তলা থেকে গান বের করে রূপকথার কপালে তাক করলো সারফরাজ।সেই সাথে তীক্ষ্ণ কাট কাট ভয়ংকর দৃষ্টি পাতলো রূপকথার চোখে।
সারফরাজ এর এহেন কাণ্ডে ভয়ে কেঁদে দেবার জোগাড় হলো রূপকথার।সারফরাজ এর মস্তিষ্ক সজাগ হতেই গান ফেলে রূপকথাকে বুকে চেপে স্বস্তির শ্বাস টানলো ।এরপর ঘুম ঘুম স্বরে বলে উঠলো
“ডাকলে না কেনো?
রূপকথা ভয় মিশ্রিত গলায় বললো
“ঘু,ঘু ঘুমুচ্ছিলে ত ত তাই।
সারফরাজ লম্বা শ্বাস টেনে রূপকথার কপালে চুমু আকলো ।এরপর বললো
“কিছু লাগবে?
রূপকথা ধীর গলায় বললো
“বাড়িতে কল করবো।
সারফরাজ চোখ বুঝে রূপকথাকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বললো
“ওয়াইফাই কানেক্ট করে নাও।পাসওয়ার্ড এর জায়গায় তোমার নাম দিলেই হয়ে যাবে।
রূপকথা সারফরাজ এর থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে উঠলো
“ঠিক আছে ঘুমাও।আমি আসছি।
সারফরাজ শুনলো না তা।রূপকথাকে আরো শক্ত করে টেনে ধরে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করলো।এরপর পাশে শুইয়ে গায়ের কম্ফোর্টার দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো।
রূপকথার গলার ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে সারফরাজ বলে উঠলো
“আমি অনেক ক্লান্ত পরিশ্রান্ত রূপকথা।প্লিজ একটু ঘুমুতে দাও।প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।
রূপকথা নড়লো না।সারফরাজ এর প্রশস্ত বাহুতে ঘাপটি মেরে রইলো।সারফরাজ অল্প হেসে উত্তর করলো
“গুড গার্ল।
এরপর নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
রূপকথার যখন ঘুম ভাঙলো তখন আশেপাশের কোথাও সারফরাজ কে দেখা গেলো না।তন্দ্রা ভাব কাটিয়ে ফ্রেশ ঘুম দিয়ে উঠে বসলো রূপকথা।খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে।প্লেট ভর্তি ডাল, লেবু আর ঝাল ঝাল আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।সকালের অল্প স্প্যাগেটি আর স্যান্ডউইচ পেটের তলানিতে কখন বিলীন হয়েছে তার হিসেব আছে নাকি?
বিছানা থেকে নেমে উঠে দাঁড়ালো রূপকথা।গায়ে এখনো দুদিন আগের পোশাক।চেঞ্জ করা প্রয়োজন।ক্লান্ত পায়ে নিজের রুমে এলো রূপকথা।এরপর ঝটপট লাগেজ থেকে কাপড় বের করে
কাঁচের দরজা ঠেলে ওয়াশ রুমে ঢুকলো।
প্রকৃতির সান্নিধ্যে মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে করতে স্নান সেরে মাথায় টাওয়েল পেঁচিয়ে বেরিয়ে এলো রূপকথা।।
এরপর ড্রেসিং কেবিনেট এর সামনে দাঁড়িয়ে টুলে বসে চুল মুছে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিলো।এরপর মুখে হালকা পাতলা ক্রিম, প্রসাধনী মেখে চুল গুলো কাঁধের দুপাশে ফেলে হাত ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে এলো ড্রয়িং রুমে।
এসে দেখতে পেলো ওপেন কিচেনে আটঘাট বেঁধে গায়ে কিচেন এপ্রোন জড়িয়ে পারদর্শী শেফের ন্যয় কিছু রান্না করছে সারফরাজ।হাত মুখের এক্সপ্রেসনে মনে হচ্ছে রাঁধুনির হাত বড্ড পাঁকা।
দ্রুত পা চালিয়ে কিচেনের সাথে লাগোয়া উঁচু চেয়ার টেবিলটায় বসলো রূপকথা।এরপর ছোট বাচ্চার ন্যয় ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো
“খিদে পেয়েছে।খাবার দাও।
রূপকথার গলায় সামনে তাকালো সারফরাজ।লম্বা ঘুমের কারনে মেয়েটির চোখ মুখ ফুলে আছে।দেখতে গুলুমুলু লাগছে।রূপকথার স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে লক্ষ্যচ্যুত হলো সারফরাজ।মুহূর্তেই উত্তপ্ত তেল এসে লাগলো হাতে।সটকে দাঁড়িয়ে হাত ঝেড়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো সারফরাজ।হুড়মুড়িয়ে টেবিল থেকে নেমে দৌড়ে গেলো রূপকথা।চুলা বন্ধ করে সারফরাজ এর হাত বেসিনের কলে লাগিয়ে পানি ছেড়ে দিলো।এরপর ব্যস্ত গলায় বললো
চেকমেট পর্ব ৪২
“একটু সাবধানে কাজ করবে না?ইশ কতোখানি পুড়ে গেলো!
সারফরাজ ঘোর লাগানো গলায় বলে উঠলো
“এমন সৌন্দর্য দর্শনে আমি প্রতিদিন নিজেকে পোড়াতে চাই রূপকথা।এই সৌন্দর্য আমার পাপের দেয়াল ধ্বসে দেয় একটু একটু করে।পাপী পুরুষ থেকে আমি হই সাধু পুরুষ।পুড়ে পুড়ে যদি পাপ মুক্ত হওয়া যায় তবে ক্ষতি কোথায়?