চেকমেট পর্ব ৪৯
সারিকা হোসাইন
সন্ধ্যার পর থেকেই সিয়েরা ফরেস্টে শীতের প্রকোপ নামলো বাকি দিন গুলোর চাইতে কঠিন রূপে।ফায়ার প্লেসের মৃদু আগুন আজ শরীর কে উষ্ণ করতে পারছে না।শরীর কেমন কেঁপে কেঁপে শিউরে কাঁটা দিয়ে উঠছে।শো শো শব্দে বাইরে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে।আকাশের উজ্জ্বল চাঁদটা আজ মেঘ আর ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া এসেছে পর্যন্ত এমন আবহাওয়া দেখেনি রূপকথা।রূপকথার মন বললো আজ রাতে বোধ হয় বৃষ্টি হবে।কিন্তু রূপকথাকে ভুল প্রমান করে নিমিষেই আকাশ থেকে টুপটাপ শব্দে ঝরতে আরম্ভ করলো সাদা তুষার।
খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে তুলোর মতো বরফ কণার ঝড়ে পড়ার দৃশ্য দেখে অভিভূত হলো রূপকথা।তার চঞ্চল মন নেচে উঠলো বরফের সংস্পর্শে যাবার জন্য।ইচ্ছে করলো বরফ নিজ হাতে ছুঁয়ে দিতে।যেই ভাবনা সেই কাজ।সমস্ত ভয় ,ভীতি ভুলে সকলের অলক্ষ্যে চুপিচুপি রূপকথা বাড়ির ইয়ার্ডে বেরিয়ে এলো।ইতোমধ্যে গাছপালা আর মাটির উপর জমে উঠছে নরম বরফের আস্তর। রূপকথা ঠোঁটের কোণে প্রশস্ত হাসির রেখা টেনে চারপাশে বিস্ফারিত নজর বুলালো।চারপাশ কেমন নিঝুম নিস্তব্ধ।নিশাচর প্রাণী গুলোর শ্বাস ধ্বনী পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।শুধু তুষার পড়ার মৃদু শব্দে ভরে আছে বনভূমি।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বাইরে বেরুতেই রূপকথা বুঝলো শীতের মাত্রা যথেষ্ট।গায়ের ভারী ওভার কোট এই শীত নিরাময় করতে পারছে না।শীতে দাঁতের বাড়ি উঠলো।বাতাসের তোড়ে এখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টসাধ্য হলো।তবুও রূপকথা ঘরে ঢুকলো না।রূপকথা মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো। এরপর আনন্দে দু’হাত ছড়িয়ে দিল।ঘন তুষারকণা এসে পড়তে লাগল তার চুলে, মুখে, কোটের উপর। ঠান্ডা বাতাসে নিঃশ্বাস ধোঁয়ার মতো ভেসে যাচ্ছে বাতাসে।হাত মোজা হীন হাত গুলো বরফ আর বাতাসের সংস্পর্শে শক্ত হয়ে নীল হয়ে উঠলো।রূপকথা মাটি থেকে বরফ খামচে সেগুলো দিয়ে বল বানালো এরপর তা ছুড়ে মারতে লাগলো এদিক সেদিক।
সারফরাজ আজ বাড়িতে নেই।কোথায় গিয়েছে রূপকথা জানেনা।সারফরাজ এর অনুপস্থিতি প্রথমবারের মতো রূপকথার কাছে আনন্দের ঠেকলো।সে থাকলে নিশ্চিত ধরে বেঁধে তাকে ঘরে নিয়ে দরজা আটকে দিতো।আর বড় বড় ভাষণ শুনাতো ঠান্ডা জ্বর নিয়ে।রূপকথার এবার অদ্ভুত এক ইচ্ছে জাগলো।বরফের স্বাদ কেমন তা চেখে দেখার।রূপকথা হাটু ভেঙে বরফের উপর বসলো।এরপর আঙুলের ডগা দিয়ে অল্প বরফ নিয়ে মুখে দিলো।স্বাদ পানির মতো।রূপকথার ইচ্ছে হলো কয়েক খাবলা বরফ খেতে।সে মনের ইচ্ছেকে প্রাধান্য নিয়ে অল্প বরফ মুখে নিয়ে আইসক্রিম এর মতো খেতে লাগলো।রূপকথার আনন্দ যখন চরম পর্যায়ে এমন সময় সারফরাজ এর গাড়ি এসে থামলো বাড়ির প্রকান্ড গেটের কাছে।লুইস দৌড়ে এসে গাড়ির দরজা খোলে দিতেই ছাতা নিয়ে এগিয়ে এলো ইয়ং।সারফরাজ গাড়ি থেকে নামতেই ড্যাভিন গাড়ি নিয়ে চলে গেলো পার্কিং লটে।গাড়ি থেকে নেমেই রূপকথাকে দেখে সারফরাজ এর চোখ কপালে উঠলো।সে ছাতা ফেলে দৌড়ে রূপকথার কাছে গিয়ে ধমকে বলে উঠলো
“কি করছো এসব?নিউমোনিয়া বাধাতে চাইছো নাকি?
সারফরাজ এর ধমকে বরফ খাওয়ায় বাধা পড়লো রূপকথার।সে নিচ থেকে পিটপিট চোখে উপরে তাকালো।সারফরাজ খেয়াল করলো রূপকথার চুল,ভ্রু আর চোখের পাপড়ি বরফে সাদা হয়ে উঠেছে।মেয়েটি সাংঘাতিক অসুস্থতায় ভুগবে বুঝতে পেরে সারফরাজ হাত বাড়িয়ে দিলো রূপকথাকে মাটি থেকে তুলতে।
রূপকথা সারফরাজ এর হাত স্পর্শ করতেই সারফরাজ চমকে উঠলো।হাত দুটো বরফের চাইতেও ঠান্ডা।হ্যাচকা টানে রূপকথাকে দাঁড় করিয়ে কোলে তুলে নিলো সারফরাজ।এরপর হনহন করে ডায়িং রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো।
রূপকথার গায়ের ভেজা কোট গা থেকে খোলে একটা ভারী উলের সুয়েটার পরিয়ে দিলো সারফরাজ।
এরপর তাকে টেনে হিচড়ে ফায়ার প্লেসের একদম কাছ ঘেঁষে দাড় করিয়ে হাত ছেকতে লাগলো।রূপকথার মনে হলো হাত দুটি কেমন অনুভূতি হীন শক্ত হয়ে রয়েছে।আর সেগুলোতে চিনচিনে ব্যথা করছে।কিন্তু ভয়ে সারফরাজ কে বলতে পারলো না।টাওয়েল দিয়ে রূপকথার মাথা পরম যত্নে মুছিয়ে মাফলার দিয়ে গলা পেঁচিয়ে দিলো সারফরাজ।সহসাই ফচ করে এক হাঁচি দিয়ে বসলো রূপকথা।সারফরাজ করুন হেসে কপাল চাপড়ালো।পরপর কয়েক দফা হাঁচির পর কাশি শুরু হলো রূপকথার।রূপকথার শরীর একটু উষ্ণ হতেই সারফরাজ কোনো বাক্য ব্যয় হীন রূপকথাকে তার কক্ষে নিয়ে গিয়ে ভারী ভারী দুটো ব্ল্যাংকেট মুড়িয়ে শুইয়ে রুম হিটার চালু করে বাইরে বেরিয়ে এলো।এরপর কোনো মতে তাড়াহুড়ো করে নিজের পোশাক পাল্টে কিচেনে এলো।ঝটপট চুলা জ্বালিয়ে মশলা চা বানিয়ে রূপকথার কক্ষে দৌড়ালো।
নিজের অবস্থার অবনতি দেখে রূপকথার ভয় হতে শুরু করলো এবার।তার মনে হচ্ছে তার জ্বর আসবে।জ্বর এলে ভারী বিপদ।তাকে সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে সারফরাজ এর জন্য।এদিকে কাশতে কাশতে গলাটাও ব্যাথা করছে।নিউমোনিয়া কি হয়ে গেলো তবে?
সারফরাজ রূপকথার সামনে চায়ের পেয়ালা ধরে ভারী গলায় বলে উঠলো
“নাও ,এটা খেয়ে নাও।
রূপকথা বাধ্য বাচ্চার ন্যয় ভারী কম্ফোরটার সরিয়ে উঠে বসে চায়ের কাপ টা নিলো।এরপর তাতে চুমুক বসালো।একটা চেয়ার টেনে তাতে বসতে বসতে সারফরাজ রূপকথাকে শুধালো
“আচ্ছা একটা কথা বলো,তুমি কি পৃথিবীতে নতুন?
রূপকথা ঢের বুঝলো সারফরাজ তাকে বকাঝকা করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।তাই রূপকথা আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো
“যদি একটাও বকা আর ধমক দিয়েছো তো আমি দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যাবো।তখন রুদ্ররাজ এসে ধরে নিয়ে আমায় বিয়ে করে ফেলবে।তখন মজা বুঝবে।
সারফরাজ ঠান্ডা চোখে রূপকথাকে পরখ করে অন্যত্র দৃষ্টি সরিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলো।চা টা শেষ করে রূপকথা আবার শুয়ে গেলো।এরপর বলে উঠলো
“চলে যাও লাইট অফ করে।আমার ঘুম পাচ্ছে।আমি ঘুমাবো।
সারফরাজ হাত ঘটিতে সময় দেখলো।কেবল রাত আট টা বাজে।রূপকথাকে কখনো এমন টাইমে ঘুমুতে দেখেনি সে।শরীর নিশ্চিত খারাপ হচ্ছে তাই জন্যই চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
“কি হলো যাও।
রূপকথার পুনরায় আওয়াজে লাইট নিভিয়ে বেরিয়ে এলো সারফরাজ।এরপর মায়ার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
সারা সন্ধে রূপকথার দেখা না পেয়ে নিজ কক্ষে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছেন মায়া।আজ বড্ড ঠান্ডা পড়েছে।সারফরাজ দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করলো
“মা ঘুমাচ্ছ?
সারফরাজ এর গলা পেয়ে ঠোটের কোনে হাসির রেখা টেনে মায়া উঠতে উঠতে বলে উঠলো
“না রে বাবা।ঠান্ডা জন্য শুয়ে আছি।আয়।
সারফরাজ মায়ার বিছানার কোনে বসে মায়াকে জড়িয়ে চোখ বুঝে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো।ছোট বেলার নিত্য দিনকার অভ্যেস ছিলো এটি।বাইরে থেকে ফিরেই মায়ের গন্ধ নেয়া।অদ্ভুত এক প্রশান্তি কাজ করে মনের মধ্যে।মনে হয় সমস্ত হতাশা,বিপদ,ভয় সব কেটে যায় এই গন্ধে,এই স্পর্শে।
মায়া সারফরাজ এর চোখে মুখে হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন
“কিছু হয়েছে?মন খারাপ?
“না,ভালো লাগছে তোমার গন্ধ নিতে।
মায়া অল্প হাসলেন।এরপর বললেন
“মেয়েটা কোথায়?
সারফরাজ বিরক্তি ভরা গলায় জবাব দিলো
“আর বলোনা মা।মেয়েটা বড্ড অবুঝ।বাইরের বরফ এ সে এতো সময় ধরে ভিজেছে আবার সেই বরফ খেয়েছে।রাতে জ্বর না এলেই হয়।
মায়া উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে উঠলেন
“সর দেখি একবার দেখে আসি।
মায়ার কোমর জড়িয়ে মায়ার কোলে মাথা রেখে সারফরাজ আদুরে গলায় বলে উঠলো
“ঘুমাচ্ছে।সকালে যেও।এখন আমার মাথাটা একটু টিপে দাও।ওই ছোট বেলার মতো।
সারফরাজ এর মাথা টিপতে টিপতে মায়া বলে উঠলো
“তোর নানা আমাকে একটা বদ্ধ ঘরে অনেক বছর বন্দি করে রেখেছিলো সারফরাজ।ওই ঘরে না ছিলো কোনো আলো না ছিলো কথা বলার মানুষ।আমার একাকিত্বের কল্পনার সঙ্গী ছিলি তুই।তোকে এক পলক দেখতে,একটু আদর করতে মরিয়া হয়ে উঠে ছিলাম আমি।আব্বাকে অনেক অনুরোধ করেছি আমাকে মুক্ত করে দিতে।কিন্তু আব্বা আমার উপর এতটুকু রহম করেন নি।আব্বা কেমন যেনো নিষ্ঠুর হয়ে গেছিলেন।আম্মার মৃত্যু,ভাইজানের মৃত্যু আব্বাকে হৃদয় হীন বানিয়ে দিয়ে ছিলো।আব্বা মনে করেন এসবের জন্য আমিই দায়ী।
সারফরাজ ব্যথিত গলায় শুধায়
“বাবা কখনো সন্তানদের উপর এতোটা কঠোর হতে পারে মা?
সারফরাজ এর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মায়া বলে উঠলেন
“আমার প্রতি আব্বার আকাশ সম ঘৃণা জন্মেছিলো।সন্তান ছাড়া,পরিবার ছাড়া কতটা জন্ত্রনা অনুভূত হয় সেটা তিনি আমাকে বোঝাতে চেয়ে ছিলেন।
সারফরাজ চট করে উঠে বসে শুধালো
“আচ্ছা মা একটা কথা বলো।তুমি রুদ্রের কাছে কিভাবে পৌঁছালে?আর সে বিদেশই বা কিভাবে এলো?
ঝাপসা স্মৃতি হাতড়ে মায়া বলতে লাগলেন
“বড় ভাইজান আগে থেকেই অবৈধ সব কাজের সাথে জড়িত ছিলো।নেশা পানিও গিলতেন প্রচুর।বড় ভাবি গোপনে আমাকে সব জানায় একদিন।আমার সঙ্গে ভাবীর যোগাযোগ ছিলো দীর্ঘদিন।বড় ভাবীকে ভাইজান প্রচুর মারধর করতেন।মার খেতে খেতে শরীর পঁচে গেছিলো তার।তোর বয়স যখন ছয় হঠাৎ একদিন খবর পেলাম ভাবি হার্ট এট্যাকে মারা গেছেন।তোর বাবা আমায় নিয়ে গেলেন চিটাগাং।কিন্তু আব্বা আমায় হাভেলির গেট থেকেই যা তা করে বের করে দিলেন।বড় ভাইজানের ছেলে রুদ্র তখন আট কি নয় বছরের।ছেলেটা ঘুরে ঘুরে কাঁদছিলো সারা বাড়ি ময়।আব্বার অপমান হুমকি ধামকি অগ্রাহ্য করে আমি রুদ্রকে বুকে জড়ালাম।কিন্তু তার চোখের ঘৃণা আমাকে থমকে দিলো।তার চোখ জোড়া দেখে মনে হলো সেগুলো আমায় হুংকার ছেড়ে বলছে
“আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী।তোমাকে আমি ছাড়বো না।
ওই টুকুন ছেলের এমন ভয়ানক চোখ দেখে আমি বেশ ভীত হলাম।কোনো মতে তোর বাবার হাত ধরে বেরিয়ে এলাম ভাবীর দাফন হবার আগেই।তোর বয়স যখন আট হঠাৎ একদিন বিধ্বস্ত হয়ে তোর বাবা বাড়ি ফিরলেন।তাকে কেমন অস্থির আর অপরাধী দেখাচ্ছিলো।বিয়ের দশ বছর জীবনে তাকে এতোটা অসহায়,ভগ্ন কখনো দেখিনি আমি।মানুষ টা বড্ড সহজ আর প্রাণ খোলা ছিলেন।কিচ্ছু লুকাতেন না আমার কাছে।রাতে তুই ঘুমানোর পর তাকে শক্ত করে চেপে ধরলাম।ঘটনা যা শুনলাম তাতে আমি হতবাক না হয়ে পারলাম না।
বড় ভাইজান মাদক,অস্ত্র আর নারী পাচার কাজে বর্ডারে ধরা পড়ে গুলি খেয়ে মারা গেছেন।সব চাইতে লোমহর্ষক যা ছিলো তা হলো সঙ্গে রুদ্রও ছিলো।বর্ডার আর্মিদের উপর বড় ভাইজান বন্দুক চালিয়ে ছিলেন।নিজেকে কলঙ্কিত করে গায়ের পোশাকে দাগ ফেলে ভাইজনকে বাঁচাতে চেয়ে ছিলেন তোর বাবা।কিন্তু উপর থেকে কড়া আদেশ ছিলো ভাইজনকে ক্রস ফায়ার করার।তোর বাবা নিজের কাছের এক মেজরের সাহায্যে রুদ্রকে ওই স্পট থেকে সরিয়ে চিটাগাং পৌঁছে দিয়ে ছিলেন।নয়তো রুদ্র কিশোর জেলে পঁচে মরতো।ঘটনার কয়েকদিন পর তোর বাবার….
বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন মায়া।বাকি ঘটনা সারফরাজ জানে।
বাড়ির আঙিনায় খেলা করছিলো সারফরাজ।মায়া ঘরের কাজে ব্যস্ত।এমন সময় কয়েকজন লোক একটা বড় কার্টুন তাদের ঘরের দরজায় ফেলে বলে উঠেছিলো
“আপনার জন্য একটা পার্সেল এসেছে মায়া চৌধুরী।
বলেই লোক গুলো আর দাঁড়ান নি।মায়া অবাক হয়ে সেই কার্টুন খোলতেই কর্নেল সাদাফ শাহজাইন এর কাঁটা মুন্ডু আর টুকরো টুকরো দেহ পাওয়া গেছিলো।সারফরাজ নিজেও বাবার এহেন অবস্থা দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো।সাদাফ সাহজাইন এর দাফনের পর অনেক মামলা মোকদ্দমা হয়েছে।কিন্তু খুনিকে পাওয়া যায়নি।মায়া জানতেন কে করেছে এই কাজ।কিন্তু নিজের বাবাকে জেলে পাঠাতে চান নি তিনি।শুধু সুবহান চৌধুরীর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন
“আমাকে বিধবা করে দিলেন আব্বা ?আমার ছেলেটা যে এতিম হয়ে গেলো আব্বা?আমার জীবনের রঙ গুলো এভাবে কেড়ে নিলেন আপনি?সাদা থানে জড়িয়ে দিলেন আমাকে?আমার উপর এতোটাই ঘৃণা আপনার আব্বা?
সুবহান বিনা বাক্যে নিজের লোক দের আদেশ দিলেন
“ওকে অন্ধকার করে বন্দি করে রাখ।পরিবার ছাড়া সন্তান ছাড়া কেমন অনুভূত হয় তা ওকে বোঝা।
লোক গুলো সুবহানের আদেশে মায়াকে টেনে হিচড়ে একটা ঘরে বন্দি করে দেয়।দিনে এক বেলা খাবার পাওয়া যেতো।স্বামী শোক,সন্তান ছেড়ে আসা,ঠিক মতো খাবার না পাওয়া আর ঘটঘুটে অন্ধকার ঘর মায়াকে অন্য এক জগতে পৌঁছে দিলো।মুক্ত জীবন থেকে মিললো বন্দি জীবন।
এদিকে সুবহান নাতি রুদ্রকে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করেলন।কারন আর্মি বহর তখনো গায়েব হওয়া রুদ্রকে খুজছিলো।রুদ্র বিদেশ গিয়ে পড়াশোনা করে বাহ্যিক মানুষ তো হয়েছে বটেই কিন্তু ভেতরে ঠিকই পশুই রয়ে গিয়েছে।
মায়া আরো কিছু বলতে চাইলেন।কিন্তু ভুলে গেলেন।সারফরাজ এর পুরো ঘটনা আর জানা হলো না।
সিয়েরা ফরেস্টে ভোরের আলো ফুটলো আজ তীক্ষ্ণ রূপে।সকাল থেকেই সূর্যের ভারী তেজ।সারফরাজ সকাল সকাল নিজের রান্না বান্না শেষ করে রূপকথার কক্ষে ঢুঁ মারলো।মেয়েটা এখনো বেঘোরে ঘুমুচ্ছে আর বিড়বিড় করে কি যেনো বলছে।সারফরাজ কপাল কুঁচকে ব্যস্ত পায়ে রূপকথার বিছানার পাশে এসে দাড়ালো।এরপর কপালে হাত ছোয়াতেই চমকে উঠলো।জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।সারফরাজ রূপকথার গায়ের কমফোরটার সরিয়ে ঝাকিয়ে ডাকলো
“এই রূপকথা!রূপকথা
রূপকথা অল্প চোখ মেলে তাকিয়ে সারফরাজ কে দেখলো।এরপর সারফরাজ কে জাপ্টে ধরে উঁচু গলায় গেয়ে উঠলো
“ও আমার গায়ে প্রেমের জ্বর,
কেউ দে না সারফরাজ রে খবর
সারফরাজ আমার শীতেরই চাদর
রূপকথার অদ্ভুত গানে সিরিয়াস মুহূর্তে হা হা করে হেসে উঠলো সারফরাজ।রূপকথা সেই হাসি তোয়াক্কা না করে শরীরের অসহনীয় ব্যথা,মাথার জন্ত্রনা ,দাঁতের শিরশিরানী আর জ্বরের ঘোরে পাগলের ন্যয় চিৎকার করে গাইতে লাগলো
“বাঙ্গি ফাটা বালি বালি
তরমুজ ফাটা লালে লাল
সাঁতার না জানিলে কেমনে পাড়ি দিবি প্রেমের খাল,
ও বন্ধু কাছে আয়, ফুলের মধু ঝরে যায়।
রূপকথার গানে সারফরাজ এর মাটিতে গড়াগড়ি দেবার অবস্থা হলো।
পরের গানের সুর তুলতেই সারফরাজ রূপকথার মুখ চেপে ধরে থামানোর চেষ্টা করে সুফিয়ান কে কল করলেন।কেবলই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন সুফিয়ান।এমন সময় সারফরাজ এর কল পেয়ে কপাল কুঁচকে রিসিভ করে বলে উঠলেন
“ঘুমের বারোটা বাজাতে ফোন করেছিস?
“আপনার মেয়ে আমার সম্মানের বারোটা বাজাচ্ছে।আমাকে বাঁচান।
“কি করেছে?
রূপকথার মুখ ছেড়ে দিলো সারফরাজ।রূপকথা ভাঙা ভাঙা গলায় তালহীন গাইতে থাকলো
“পঁচিস ছাব্বিশ বয়স হইলো জানোস না রে কিছু
মিছামিছি ঘুরস রে তুই আমার পিছু পিছু
গাধা চ্যাঙড়া কেন বুঝস না
আমার মনে কি যে চায়
মেয়ের গান শুনে সুফিয়ান বুক চেপে বলে উঠলেন
চেকমেট পর্ব ৪৮
“ইন্নালিল্লাহ,আস্তাগফিরুল্লাহ।লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লাবিলাহ।গানের লাইন বেশি গভীরে যাবার আগে শিগগির ডাক্তার ডাক।নইলে তোকে আমি গুলি করে খুপড়ি উড়িয়ে দেবো হতচ্ছাড়া।