চেকমেট পর্ব ৫২

চেকমেট পর্ব ৫২
সারিকা হোসাইন

“নিজের কাছের মানুষ হারিয়ে ফেললে কেমন লাগে সারফরাজ?বুকটা বুঝি কষ্টে ফেটে যাচ্ছে তাই না?ব্যথা সহ্য করতে পারছিস তো?কলিজা পুড়ে খাক হচ্ছে না?
রুদ্রের পাঠানো মেসেজ খানা দেখে হাতের ফোনটা দূরে ছুড়ে মারলো সারফরাজ।দামি ব্র্যান্ডেড অনুভূতি হীন ফোন খানা শক্ত টাইলসে বাড়ি খেয়ে খানখান হলো।সেই টুকরো টুকরো চূর্ণ ফোনের পানে তাকিয়ে চুল খামচে ধরে গর্জন করে উঠলো সারফরাজ

“তোকে আমি পিষে ফেলবো রুদ্ররাজ।জাস্ট পিষে ফেলবো।আমার ধৈয্ নিয়ে খেলা করার সাধ তোকে আমি মিটিয়ে ছেড়ে দেবো।এতোদিন বহুবার ক্ষমা করেছি তোকে।ভালো হবার হাজারটা চান্স মিস করে গেছিস তুই।আর নয়।আমার চোখের দৃষ্টি কতোটা ভয়ংকর এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবি তুই।
সারফরাজ এর কথা শেষ হবার আগেই দ্বিতীয় ফোনটায় নোটিফিকেশন সাউন্ড হলো।সারফরাজ নিজের রাগ দমিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই কলিজায় কামড় দিয়ে উঠলো।অবচেতন রূপকথার ছবি স্ক্রিনে ভেসে আছে। রূপকথার কপালের কাছে আর ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বাঁধা।গালে কালসিটে দাগ।চেহারা মলিন।দেখে মনে হচ্ছে দেহে প্রাণ নেই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রূপকথার এহেন অবয়বে সারফরাজ এর বরফ নীল চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।চোখের কোন বেয়ে অল্প জল ও গড়ালো।সারফরাজ নিজের ব্যথিত অনুভূতির সমাধিস্থ করতে না করতেই বার্তা এলো
“আমার সাথে টক্কর দিয়ে তুই ভুল করেছিস সারফরাজ।তোর অন্যায়ের ক্ষমা হবে আমার পায়ের তলায় নিজের জীবন বিসর্জন দেয়ার মাধ্যমে।যদি বেশি চালাকি করার চেষ্টা করেছিস তবে তোর পাখি কোরবানি হবে আমার হাতে।হয় সমস্ত প্রোপার্টি,ক্ষমতা,ব্যাবসা আর দম্ভ আমার হাতে তুলে দিয়ে পরাজয় শিকার করবি,নয়তো তোর প্রাণ বিনিময় করে আমায় খুশি হবি।কিন্তু এটা ভাবিস না রূপকথা তোর।রূপকথা একান্ত আমার।তোর থেকে রূপকথাকে কেড়ে নিয়ে আমার বড্ড আনন্দ হচ্ছে।ফাইনালি তোকে চারিদিক থেকে চেক দিতে পারলাম।এইবার শুধু তোর চেক কাটানোর পালা।লাস্ট চেকমেট আমিই দেবো।তুই চারপাশ থেকে আমার হাতে বন্দি সারফরাজ।পালানোর পথ সব বন্ধ।

রুদ্রের বার্তার ফিরতি উত্তর পাঠাতে চাইলো সারফরাজ।কিন্তু রূপকথার শঙ্কায় মুখের ভাপ টুকুন বের করলো না।অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে বার্তা খানা বার বার নজর বুলালো সারফরাজ।এরপর শক্ত কালচে লাল ঠোঁট কামড়ে ধরে ক্রোধ নিবারণ করলো।ক্রোধের মাত্রা বোধ হয় অনেক বেশি।ধারালো দাঁতের পিস্টনে মুহূর্তেই নিম্ন ভাগের ঠোঁট কেটে রঞ্জন ধারা গড়ালো।হাতের উল্টো পিঠে সেই লোহিত ধারা সারফরাজ মুছে বলে উঠলো
“যা আমার তা একান্তই আমার।তাতে হাত দেয়া তো দূর সামান্য চোখের নজর দিলেও আমি বরদাস্ত করবো না।তোর চোখ আমি তুলে নিয়ে এঞ্জেলোকে দিয়ে খাওয়াবো।তুই আমার জন্য একটু অপেক্ষা কর রুদ্র।জাস্ট রাত টুকু।
বলেই উঠে দাঁড়ালো সারফরাজ।এরপর ছুটলো মায়ার কক্ষে।উদ্ভ্রান্তের ন্যয় ডেকে উঠলো
“মা!

উত্তপ্ত ভ্যাপসা দাবদাহ ভাদ্রের রাত।আকাশের চাঁদটা ক্ষয় হয়ে গিয়েছে দু তিনদিন আগেই।হয়তো আজ অমাবস্যা।আধারের ঘনত্বে এক হাত দূরের বস্তু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
সুবহান চৌধুরীর বিশাল ভুতুড়ে হাভেলির ভাঙা মরিচা ধরা লোহার গেটটার সামনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারফরাজ।মাথার উপরের প্রকান্ড বাবলা গাছটায় বসে বসে নিশাচর এক পেঁচা ভয়ানক ডেকে চলেছে।অদূরের ঘন জঙ্গলটায় জোনাকির মেলা বসেছে।ঝিকমিক আলো জ্বালিয়ে এই ভয়ানক গা ছমছমে অন্ধকার টাকে দূর করতে চাইছে তারা।কিন্তু সামান্য এই পোকার এতো দম আছে নাকি?
হালকা বাতাসের দাপটে ভগ্ন গেট খানা ক্যাচক্যাচ শব্দ করে উঠলো।সেই শব্দে রাতের গুমোট নিস্তব্ধতা সামান্য বিঘ্ন হলো।ঝুলে যাওয়া জানালার আধ ভাঙা কাঠের পাল্লা টাও কেমন অদ্ভুত শব্দে দোলে উঠলো।মনে হচ্ছে কোনো অশরীরি করুন গলায় গুমরে উঠছে।

কিন্তু নির্ভীক হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সারফরাজ।সারফরাজ কে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থেকে নিঃশব্দে নেমে এলো অভিরূপ।এরপর তপ্ত শ্বাস ফেলে শুধালো
“তুই কি সিউর রূপকথা এখানে আছে?এমন ভাঙা ভুতুড়ে বাড়িতে আদৌ কেউ থাকতে পারে?রুদ্রের মতো বিলাস বহুল জীবন যাপন কারী মানুষ এই পরিত্যক্ত নোংরা বাড়িতে থাকবে এটা তোর বিশ্বাস হয়?আই থিংক ড্যানিয়েল তোকে মিথ্যে বলেছে।
সারফরাজ বুকের কাছে দুহাত গুঁজে দীর্ঘ শ্বাস ছুঁড়লো।এরপর চোখ বুঝে মনে করার চেষ্টা করলো মায়ার বলা কথা গুলো।

“আচ্ছা মা তুমি কি আমায় বলতে পারবে তুমি কোথায় বন্দি ছিলে?বা সেই জায়গাটা দেখতে কেমন?
সারফরাজ এর প্রশ্নে মায়া কেপে উঠলেন।চোখের সামনে ধীরে ধীরে পরিস্কার হতে লাগলো বিভীষিকাময় দিন গুলো।অন্ধকার এক কক্ষ,একটা ছোট শক্ত চৌকি,ছোট একটা বাথরুম আর মোটা শিকল।বন্দিশালায় এক বেলা মিলতো ভাত।উহু তরকারি দিয়ে মোটেও নয়।সামান্য পান্তা ভাত,এক চিমটি লবন,একটা পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ।পুষ্টিহীন সেই খাবার খেয়ে শরীর তার সমস্ত তাকত হারায় কিন্তু প্রাণে বেঁচে থাকে নির্জিবের ন্যয়।
সারফরাজ মায়াকে চুপ থাকতে দেখে মায়ার হাত শক্ত করে চেপে ধরে কাতর গলায় বললো

“বলো না মা ওই ঘরটা কোথায়?
মায়া কম্পিত হাহাকার মিশ্রিত শ্বাস ছুড়ে বলে উঠলেন
“ঘরটাতে কখনো আলো আসে না সারফরাজ।যখন কেউ খাবার দিতে আসে তখন অল্প তির্যক আলো দেখা যায়।মাঝে মাঝে অদ্ভুত এক গন্ধ আসে।তাজা বারুদের গন্ধ।কাঠের দরজায় চাপড় দিলে বোঝা যায় দেয়াল টা ফাঁপা।মাঝে মাঝে মানুষের সম্মিলিত গলার স্বর পাওয়া যায়।যেনো তারা কোনো লোহার কলকব্জা নাড়াচ্ছে এমন।
মায়ার উত্তরে সারফরাজ এর বাঁকা ভ্রু সরু হলো।সে আর দাঁড়ালো না।ইয়ং এর কাছে মায়াকে সপে দিয়ে লুইস আর অভিরূপ কে নিয়ে যাত্রা করলো চট্রগ্রাম এর উদ্দেশ্যে।

“কি হলো এভাবে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেতে থাকবি নাকি কথার জবাব দিবি?
সারফরাজ এর ধ্যান ভাঙলো অভির দ্বিতীয় প্রশ্নে।প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই অন্ধকারে পা বাড়ালো সারফরাজ।হুতুম পেঁচা টা এখনও ভয়ানক ভাবে ডেকে চলেছে।মনে হচ্ছে আজ ভয়ংকর কিছু হতে চলেছে।কিন্তু কি হতে চলেছে আজ?
অভিরূপ পেছন পেছন আসতে নিলেই হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দিলো সারফরাজ।এরপর ভারী গলায় বলে উঠলো

“বাড়ির চারপাশে দুজনে মিলে নজর রাখ।আমাকে গার্ড করতে হবে না।এই হাবেলীতে শৈশব কৈশোরে দুই মিলিয়ে সাত বছর কাটিয়েছি আমি।এখানে কোথায় কি আছে তা আমার নখদর্পণে।
বলেই হনহন করে গেট মাড়িয়ে উঠোনের এক কোনে গিয়ে স্থির হলো সারফরাজ।এক সময়ের ফকফকে পাকা উঠোন আজ দুর্বা ঘাসের দখলে।বাড়ির চারপাশেই ঘন ঝোপঝাড়।নিশ্চিত বিষাক্ত সাপ খোপের আনাগোনা আছে এখানে।অথচ এক সময় একটা পাখি পর্যন্ত উড়ে যেতে ভয় পেতো এই হাভেলির উপর দিয়ে।সুবহান চৌধুরীর পরিণতিতে তাচ্ছিল্য হাসলো সারফরাজ।এরপর হাতের টর্চ জ্বালিয়ে এদিক সেদিক কিছু খুজলো।সারফরাজ জানে হাভেলির উঠানের দক্ষিণ পাশে একটা পাতাল ঘর আছে।

সেই ঘরে ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে নানান অস্ত্র,শস্ত্র গোলা বারুদ লুকিয়ে রাখতো সুবহান।কেউ সেগুলো কিনতে এলে সুবহান নয়তো কাবির গিয়ে তাদের সেসব দেখাতো।সারফরাজ কখনো যায়নি সেই ঘরে।যায়নি বললে ভুল হবে।সুবহান যেতে দেয়নি।কোনো না কোনো ভাবে ওই দরজার সামনে থেকে সারফরাজ কে দূরে সরিয়ে রেখেছে সুবহান।পাতাল ঘরের সুড়ঙ্গ মুখে একটা বিশাল বড় শিউলি গাছ ছিলো।শিউলি ফুলের চাদরে সুড়ঙ্গের মুখ ঢাকা থাকতো।কখনো সখনো পুলিশের কাছে কেউ গোপন খবর পাঠালেও পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে কিছু বের করতে পারতো না।কারন কেউ কোন দিন ঠাহর ই করতে পারেনি ফুলের গালিচার নীচে যে পাপের রাজ্য অবস্থান রয়েছে।

ধীরে ধীরে পা চালিয়ে শিউলি গাছের নিচে এসে দাড়ালো সারফরাজ।পায়ের কাছে টর্চের আলো ফেলতেই সারফরাজ এর চোখ জোড়া জ্বলে উঠলো।সুড়ঙ্গ মুখে আলগা ঘাস ছড়ানো।পা দিয়ে নাড়া দিতেই সেগুলো সরে গেলো।রুদ্রের বোকা বুদ্ধিতে সারফরাজ এর উচ্চ স্বরে হাসি পেলো।সেই সাথে রূপকথাকে অপহরণ করার দায়ে রুদ্রের উপর জন্মালো চরম আক্রোশ।রুদ্র যদি সারফরাজ এর সামনে এখন উপস্থিত থাকতো তবে চোখের ওই ভয়ংকর আগুনে পুড়ে নিশ্চিত ভষ্ম হতো।

সারফরাজ হাটু ভাঁজ করে বসে ধাতব ঢাকনাটিতে হাত বুলালো।দীর্ঘদিন কারোর হাত পড়েনি এই সুড়ঙ্গ দরজায় তা দরজার হাল দেখেই অনুমান করা গেলো।সারফরাজ শব্দহীন দরজা খুলতে চাইলো।কিন্ত গুড়গুড় ক্যাচক্যাচ শব্দে আলোড়িত হলো চারপাশ।এক ঝটকায় সুড়ঙ্গ দরজা খোলে কোমর থেকে নিজের বন্দুক খানা হাতে নিলো সারফরাজ।এরপর অন্য হাতে টর্চ নিয়ে নামলো স্টিলের জং ধরা সিঁড়ি বেয়ে।সারফরাজ এর প্রতিটি পায়ের ধাপ ভয়ানক শব্দ সৃষ্টি করছে এই বদ্ধ ঘরে।

সারফরাজ যথা সম্ভব চেষ্টা করলো শব্দ এড়াতে।ধীরে ধীরে সারফরাজ নেমে এলো পাতাল মেঝেতে।চারপাশে টর্চের আলো ফেলতেই চক্ষু হলো বিস্ফারিত।এ যেনো আরেক চৌধুরী হাভেলি।ভেতরে কংক্রিট আর কাঠ মিশ্রিত বড় বড় তালাবদ্ধ কক্ষ,বসার ঘর সহ দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস পত্র দিয়ে ঠাসানো।এখানে কারোর দীর্ঘ দিনের বসবাস চোখে আঙুল দিয়ে টনক নড়াচ্ছে।রুদ্ররাজ ই যে সুবহানের মৃত্যুর পর এই পাতাল ঘরের দেখাশোনা করছে তা যেনো স্পষ্ট হলো।বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চারপাশে নজর বুলিয়ে হাতের টর্চ বন্ধ করে ফেললো সারফরাজ।টর্চের আলো নিভতেই দূরের কোনের এক ঘরের সামনে একটা জ্বলিত মশাল দেখতে পেলো সারফরাজ।সেই ক্ষীন আলো অনুসরণ করে এগিয়ে গেলো সারফরাজ।

কক্ষের সামনে এসে দাঁড়াতেই বাইরে থেকে তালাবদ্ধ দেখা গেলো সেই ঘর।আশেপাশে চতুর নজর বুলিয়ে সারফরাজ নিশ্চিত হলো এখানে কেউ নেই।নয়তো দীর্ঘ সময় ধরে যেসব শব্দ হচ্ছে কেউ থাকলে ঠিক এসে আক্রমন করে বসতো তাকে।রূপকথা আদৌ এখানে আছে কি না সন্দেহ করে সাইলেন্সার লাগানো বন্দুক টি দিয়ে তালায় গুলি করলো সারফরাজ।শক্ত বৃহৎ তালা খানা গুলির আঘাতে চুর্ণ হয়ে খোলে গেলো।সারফরাজ দরজার সিটকিনি খোলে ভেতরে ঢুকতেই উটকো গন্ধে নাক চেপে ধরলো।এরপর হাতের টর্চ জ্বালিয়ে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি মেললো।
টর্চের আলোতে শক্ত ভাঙা কাঠের চৌকিটায় শীর্ণ দেহের রূপকথাকে দেখে সারফরাজ এর শ্বাস থমকে গেলো।সারফরাজ দৌড়ে গিয়ে রূপকথার পাতলা শরীর নিজের বুকে জড়িয়ে কম্পিত গলায় ডেকে উঠলো
“রূপকথা,আমার জান!

কিন্তু রূপকথা চোখ মেলে সারফরাজ কে দেখলো না।সারফরাজ আশেপাশে পানি খুজলো।চৌকির পাশের ছোট টুলে একটা স্টিলের জগ রাখা।রূপকথাকে ফেলে সেই জগ হাতে নিয়ে জগে থাকা পানি রূপকথার চোখে মুখে ছিটালো সারফরাজ।এরপর ঠোঁট চেপে ধরে অল্প পানি দিলো মুখে।কয়েক পল গড়াতেই চোখের পাতা নড়ে উঠলো রূপকথার।নিভু নিভু দৃষ্টি মেলে তাকালো রূপকথা।সারফরাজ এর টর্চের ফকফকে আলো তার চোখ জ্বালিয়ে দিলো।মস্তিষ্ক সজাগ হবার আগেই ভয়ে কুঁকড়ে গেলো রূপকথা।সারফরাজ রূপকথাকে বুকে জড়িয়ে কপালে অসংখ্য চুমু খেয়ে কেঁদে ফেললো।এরপর অস্পষ্ট গলায় বলে উঠলো

“আমি এসে গেছি আর কোনো ভয় নেই।
সারফরাজ এর শরীরের গন্ধে রূপকথা কিছুটা স্থির হলো।এরপর সারফরাজ কে দুই হাতে শক্ত করে খামচে ধরে ভয়ার্ত দুর্বল গলায় উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো
“এখানে আমার অনেক ভয় করছে আমায় নিয়ে চলো সারফরাজ।রুদ্ররাজ আমাকে এখানে বন্দি করে রেখেছে।তোমাকে কষ্ট দেবার জন্য।
সারফরাজ রূপকথার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলো
“হ্য আমরা বাড়ি ফিরে যাবো।আমি এসে গেছি না?আর কেউ ভয় দেখাতে পারবে না তোমায়!রুদ্ররাজ আমার থেকে তোমাকে আর নিতে পারবে না।আম সরি।তোমাকে হসপিটালে ফেলে আমার বাইরে যাওয়া আর উচিত হয় নি।রুদ্রকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।তুমি দেখে নিও।ওকে এর চাইতেও বেশি কষ্ট দিয়ে মারবো আমি।প্রমিস।

“তাই নাকি?
আকস্মিক পুরুষালি গম্ভীর ভারী স্বরে পেছনে তাকালো সারফরাজ।অন্ধকার কক্ষ মশালের আলোয় আলোকিত।কক্ষের দরজায় বুকে হাত ভাঁজ করে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে রুদ্ররাজ।পেছনে চারজন পুরুষ।রুদ্রের গলার স্বর পেয়েই চিৎকার করে উঠলো রূপকথা।
“আমাকে এই শয়তানের সামনে থেকে দূরে নিয়ে যাও সারফরাজ।একে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

ছটফট করতে করতে সারফরাজ এর বুকে লুকাতে চাইছে রূপকথা।লুইস আর অভিরূপ কে টেক্কা দিয়ে রুদ্র কি করে এখানে প্রবেশ করলো সেই চিন্তায় সারফরাজ এর মাথা ঘুরে উঠলো।অভিরূপ আর লুইস ঠিক আছে তো?
সারফরাজ রুদ্রের পানে বন্দুক তাক করার আগেই রুদ্র কোনো বাছবিচার না করে সারফরাজ এর বাহুতে গুলি করে দিলো।গুলি খেয়ে ব্যথায় কোকিয়ে উঠলো সারফরাজ।রূপকথা চিৎকার করে উঠলো সারফরাজ কে জাপ্টে ধরে।সারফরাজ কোনো কিছু ভাবার আগেই রূপকথাকে সারফরাজ এর কাছ থেকে টেনে হিচড়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো রুদ্র।এরপর সঙ্গে আসা গার্ড গুলোকে বলে উঠলো

“ধরে উপরে নিয়ে আয় একে।আমার দাদা জানের অতৃপ্ত আত্মা তৃপ্ত করবো আজ আমি।যেভাবে ও আমার দাদা জানকে মেরেছে ঠিক সেই ভাবেই ওকে মৃত্যু দেবো আমি।
রূপকথা ছটফট করে উঠলো দুর্বল শরীরে।সে রুদ্রের পা জড়িয়ে কেঁদে উঠলো
“সারফরাজ কে ছেড়ে দিন প্লিজ।ওকে মারবেন না।
রূপকথার কাকুতিতে রুদ্রের বেশ হাসি পেলো।রূপকথার চুল চেপে ধরে উপরে তুলে হিসহিস করে বলে উঠলো

“ওর মৃত্যুর পর তুমি আমার হবে ডার্লিং।হবু স্বামীর সামনে কেউ প্রেমিকের জন্য কাঁদে?ছি লোকে মন্দ বলবে তো।এমন আদর সোহাগ করবো যে সব ভুলে যাবে।রানী করে রাখবো রানী বুঝলে?
মাথার ব্যথায় চুলের গোড়া চেপে ধরে ক্লান্ত চোখে আর্তনাদ করে রূপকথা বলে উঠলো
“আমার দেহে এক বিন্দু প্রাণ থাকতে তুই আমায় পাবি না অমানুষ।সারফরাজ এর জীবনের চরম ভুল সে তোকে বাঁচিয়ে রেখেছে।মামাতো ভাই হিসেবে সে তোকে ক্ষমা করেছে বারবার।কিন্তু তুই ক্ষমার অযোগ্য শয়তান নিকৃষ্ট লোক।থু।
বলেই রুদ্রের মুখে থুথু ছুঁড়লো রূপকথা।রূপকথার গায়ের জামা দিয়ে মুখের থুথু মুছে রুদ্র বাঁকা হাসলো।এরপর নিজের বুকের সাথে রূপকথাকে মিশিয়ে সারফরাজ কে কটাক্ষ করে বলে উঠলো

“তোর প্রাণ ভোমরা আমার বুকে।দেখতে বেশ লাগছে না?তোর চাইতে সুদর্শন আমি।তবুও এই বোকা মেয়ে মানতে চাইছে না।কি মন্দ কপাল আমার সালা।
“তুই ভুল করছিস রুদ্র।এর দাম চুকাতে পারবি না।ওকে ছেড়ে দে।
সারফরাজ কে ধরে রেখেছে চারজনে।তবুও যেনো তারা গুলি খাওয়া সারফরাজ কে আটকে রাখতে পারছে না।সারফরাজ হিংস্র বন্য পশুর ন্যয় পুনরায় দাঁত চেপে বলে উঠলো
“তোর বুকের খাঁচা খুবলে ছিড়বো আমি রুদ্র।তোর নোংরা হাত আমি কেটে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো।ওকে ছেড়ে দে।তোর নোংরা স্পর্শে ও অপবিত্র হয়ে যাচ্ছে।
অধিক রক্তপাতে সারফরাজ এর মাথা ঘুরে উঠছে।তার শরীর সায় দিতে চাচ্ছে না।মনে হচ্ছে হাত খুলে পরে যাচ্ছে।তবুও সারফরাজ চিবিয়ে বলে উঠলো

“ক্ষমতা থাকলে হাত ছেড়ে দিয়ে বাহাদুরী দেখা।জিন্দা দাফন করে দিয়ে চলে যাবো শুয়োরের বাচ্চা।
রুদ্র ঠোঁট উল্টে কাঁধ উঁচু করে রূপকথাকে টেনে হিচড়ে এগুতে লাগলো।রূপকথা মাটিতে বসে যেতে চাইলো।সে চিৎকার করে অনুনয় করতে লাগলো
“আমি সারফরাজ কে ছাড়া যাবো না।সারফরাজ কে তোমরা মেরো না।ওকে ছেড়ে দাও।সারফরাজ।সারফরাজ!
কিন্তু রুদ্রের শক্তির কাছে শেষ রক্ষা হলো না রূপকথার।রূপকথাকে কোলে তুলে ছুটলো রুদ্র।
সারফরাজ পেছন থেকে চিৎকার করে বলে উঠলো
“আল্লাহর কসম তোকে মেরে আমি মরবো রুদ্র।তোর প্রাণ না নিয়ে আমি মরবো না।

লুইসের রক্তাক্ত নিথর দেহ পরে আছে সুবহান চৌধুরীর উঠানে,পাশেই বুকে গুলি খেয়ে অচেতন অভিরূপ।সারফরাজ কাতর চোখে অভিরূপ আর লুইস কে দেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।লুইসের সাথে কাটানো দিন গুলো চোখে ভাসতেই সারফরাজ উন্মাদ হয়ে উঠলো।সারফরাজ ভাঙা গলায় ডাকলো
“লুইস,ওয়াক আপ।হেই লুইস।
সারফরাজ এর ডাকে লুইস উঠে না।চোখের জল ছেড়ে দিয়ে সারফরাজ আবার ধমকে উঠে
“আম কলিং ইউ লুইস।হাউ ডেয়ার ইউ?ওয়াননা ডাই?
এরপর অভির পানে তাকিয়ে সারফরাজ বলে উঠে

“ভং ধরেছিস তাই না অভি?আমাকে একা রেখে নাটক হচ্ছে ?ঝুলিয়ে পেটাবো কিন্তু।
রূপকথাকে নিজের কোলে বসিয়ে চেপে ধরে আছে রুদ্র।সারফরাজ এর অসহায় মুখ দেখে তার যেনো আনন্দ আর ধরে না।রুদ্র প্রশস্ত হেসে বলে উঠলো
“তোর বডিগার্ড তো মাথামোটা রে সারফরাজ।পেছন থেকে এতগুলো গুলি করলাম সে রিপিট পর্যন্ত করতে পারলো না।হি হ্যাজ ডিসাপয়েন্টেড মি।কোনো মজা আসে নি।আর অভিরূপ।হি ইজ অ্যা ব্রাভ গাই।সামনে থেকে তেড়ে এসে মারতে চেয়েছিলো আমায়।মরতে মরতে বেঁচে গেছি।আমিও পাল্টা আক্রমণ করলাম।ওমা অমনি লুটিয়ে গেলো।ধ্যাত।সবকটা ফার্মের মুরগি।
কথাগুলো বলেই রূপকথার হাতে বন্দুক গুঁজে দিয়ে নিজেই সারফরাজ কে উদ্দেশ্য করে ট্রিগার চাপলো রুদ্র।এরপর বলে উঠলো

“চল তোর সাথে কিছুক্ষন খেলা যাক!
সারফরাজ কেঁপে উঠলো বুকের ডান পাশে গুলি খেয়ে।রূপকথা শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো।নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো রুদ্রের থেকে।
গুলি খেয়ে ঢলে পড়তে চাইলো সারফরাজ।কিন্তু সারফরাজ এর দুই হাত এখনো পুরুষ চারজনের হাতে বন্দি।
রুদ্র বাম হাত নাড়িয়ে আদেশ দিলো
“ছেড়ে দে।মরার আগে একটু বিষ ঝাড়তে দে।হাজার হলেও ভাই হয় আমার।
সারফরাজ কে লোক গুলো ছেড়ে দিতেই সারফরাজ তেড়ে আসতে চাইলো।সারফরাজ এর পানে তাকিয়ে কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো রুদ্র।এরপর রূপকথার কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে বলে উঠলো

“নীল ডাউন করে আমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চা।যদি ভিক্ষা চেয়ে আমায় খুশি করতে পারিস তবে মাফ করে দেবো।প্রমিস।
সহসাই থেমে গেলো সারফরাজ এর পা জোড়া।সারফরাজ রূপকথার পানে অসহায় নজরে তাকালো।রূপকথা মাথা ঝাকিয়ে বলে উঠলো
“তুমি এই শয়তানের সামনে মাথা নোয়াবে না সারফরাজ।আমি জানি তুমি ওকে চিরতরে শেষ করবে।আমার সারফরাজ এতোটাও দুর্বল নয় তাই না?তুমি মাথা নোয়াবে না।আমার কসম লাগে।
সপাটে রূপকথার গালে এক চড় বসিয়ে রুদ্র বলে উঠলো
“আসল চাবি তবে এখানে?
বলেই রূপকথার গলা টিপে ধরলো।
সারফরাজ চিৎকার করে বলে উঠলো

“ওকে ছেড়ে দে রুদ্র।ওর সাথে তোর কোনো লেনাদেনা নেই।তুই আমাকে যা খুশি কর।কিন্তু ওকে ছেড়ে দে।
রুদ্র বেশ মজা পেলো।সে হাসতে হাসতে বলে উঠলো
‘মাথা নোয়া।জীবন ভিক্ষা চা।তোর নোয়ানো মাথা খুব করে দেখতে ইচ্ছে করছে আমার।
বলেই সজোড়ে রূপকথার গলা টিপে ধরলো।সারফরাজ অনুনয় করে বলে উঠলো
“ওকে ছেড়ে দে রুদ্র।আমি তোর সব শর্তে রাজি।
রূপকথা গুঙিয়ে বলে উঠলো
“আমি মরে গেলেও তুমি মাথা নত করবে না সারফরাজ।

চেকমেট পর্ব ৫১

রূপকথার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নত করে নিলো সারফরাজ।এরপর পা ভেঙে বসার আগেই পুলিশের গাড়ির আলোতে আলোকিত হলো চারপাশ।সেই সাথে ভেসে এলো শক্ত গলা
“জীবনে প্রথম তোকে কারো প্রাণ নেবার জন্য ওর্ডার করছি সারফরাজ।নটির পোলাদের পুঁতে ফেল।আমার মেয়ের জামাইকে মাথা নোয়াতে বলে কোন মাগীর পোয়া ?তার জিভ কত বড় দেখতে চাই আমি।

চেকমেট পর্ব ৫৩