চেকমেট পর্ব ৬০
সারিকা হোসাইন
সুফিয়ান চৌধুরীর বাংলো খানা আজ বাহারি আলোকসজ্জায় সেজে উঠেছে।চারপাশে ঝিকমিক আলোর সমাহার।অথিতি আড্ডায় খলবল করছে পুরো বাংলোর এরিয়া।কখনো চাপা কখনো বা উচ্চস্বরের হাসি মাতিয়ে বেড়াচ্ছে চারিধার।অদুরের সাউন্ড বক্সে বাজছে “আজ কইন্যার গায়ে হলুদ গান “।সকলের মধ্যে উচ্ছাস আর কর্মব্যস্ততার তাড়া।
বাংলোর চারপাশে কড়া পুলিশি নিরাপত্তা।হলুদ সন্ধ্যায় উপস্থিত হয়েছেন বড় বড় পুলিশ কর্মকর্তা আর উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী।বাগানের কোণে বিশাল চুলায় বাবুর্চি হাতা খুন্তি নেড়ে নেড়ে রান্না করছেন।বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বিরিয়ানির সুগন্ধ।
পাশেই চটপটি ফুচকা,আইসক্রিম এর স্টল।মন চাহিবা মাত্র হাতের নাগালে পাওয়া যাচ্ছে সব।এক পলক দেখলে মনে হচ্ছে কল্পনার রাজ্য।
পার্লারের মেয়েটা রূপকথার হাতে সুনিপুণ ভাবে মেহেদীর ডিজাইন আঁকছে।শেষ মুহূর্তে শুধালো
“ভাইয়ার নাম লিখবো?
রূপকথা লাজুক হেসে সম্মতি জানালো।সম্মতি পেতেই দক্ষ হাতে পদ্ম ফুলের ডিজাইন এঁকে তার উপর লিখে দিলো “সারফরাজ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রূপকথা কুনুই পর্যন্ত ভরে দুহাতে মেহেদী পড়েছে।নেলি আগেই মেহেদী পরে সেজেগুজে পরিপাটি।সব কিছু ঠিক থাকলে এতোদিন অভিরূপ আর তার বিয়েটাও হয়ে যেতো।দেরিতে হলেও এসব নিয়ে নেলির কোনো মন ভার নেই।রূপকথা সারফরাজ অবশেষে এক হতে চলেছে এই আনন্দেই নেলি আত্মহারা।
রেখা আজ যেনো দুদন্ড দাঁড়ানোর সময় পাচ্ছে না।কোমরে আঁচল গুঁজে রেখা,সেলিনা আগত মেহমান দের খাতির দারিতে ব্যস্ত।কুলসুম গায়ে একটা হলুদ আর খয়েরি মিশেলের শাড়ি পরে এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে কার কি লাগে।মেয়েটার ও আজ আনন্দের শেষ নেই।এতো আনন্দ এতো খুশি,সব কিছু ছাপিয়ে বেদনায় মুষড়ে উঠলো সুফিয়ান চৌধুরীর বুক।যেই মেয়েটা পুরো বাড়ি মাতিয়ে বেড়াতো সেই মেয়ে আগামী কাল মেহমান হয়ে যাবে।তার চিৎকার চেঁচামেচি চাইলেও আর শোনা হবে না।এই বৃহৎ বাংলোর ঘরে একাকী সময় কাটাতে হবে দুই প্রবীণ প্রবীনার।ডাইনিং টেবিলে সুফিয়ান চৌধুরীর পাশের চেয়ারটা খালি পরে থাকবে।কেউ আবদার করবে না মা আজ দুপুরে একটু বিরিয়ানি করো কিংবা বাবা আজ সন্ধ্যায় সমুচা এনো।ডিউটি থেকে ক্লান্ত শরীরে ফিরে ধপ করে সোফায় মাথা হেলালেও এখন থেকে আর কেউ বলবে না
“মাথা টিপে দেবো বাবা?খুব ধকল গেছে কি?একটু লেবু শরবত খাবে?
আচ্ছা আদরের মেয়ে হীন এতো এতো ফাঁকা স্থান কি দিয়ে পূর্ণ করবেন তিনি?
সুফিয়ান চৌধুরীর ভাবনার মাঝেই আমজাদ হায়দার আর এসপি আবির মাহতাব এলেন।আমজাদ সুফিয়ান কে ডেকে বলে উঠলেন
“সে কি ভাইজান আপনি এখানে একা একা কি করছেন?
আকস্মিক পরিচিত গলায় নিজেকে কোনো মতে ধাতস্থ করলেন সুফিয়ান।সংগোপনে চোখের কোনের জল মুছে বলে উঠলেন
“আরে তোমরা ?
আবির মাহতাব বুঝতে পারলেন সুফিয়ান চৌধুরীর মন ভালো নেই।বিষাদের মেঘেরা জমে জমে কালো পাহাড় গড়ে তুলেছে ছোট বুকটায়।সেও এক কন্যা সন্তানের জনক হয়েছে।সন্তানকে এক পলক না দেখলে কেমন হাসফাঁস অনুভুতি হয় এটা তার চাইতে আর কে ভালো জানে?
আবির মাহতাব তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে উঠলো
“ছেলে পক্ষ হলুদ নিয়ে রওনা দিয়েছে স্যার।একটু এদিকটায় আসুন।রূপকথাকে স্টেজে আনতে হবে।ওদিকে সবাই আনন্দে মশগুল।কারোর কোনো ধ্যান নেই ।
সুফিয়ান চৌধুরী তাড়া দেখিয়ে আবিরের স্ত্রী কে আদেশ করলেন
“রোজি যাও তো বোন।গিয়ে রূপকথাকে স্টেজে তোলার ব্যবস্থা করো।
সুফিয়ান চৌধুরীর আদেশ পেতেই দ্রুত পদে ছুটে গেলো রোজি।
বাংলোর বাগান এরিয়ায় বিশাল ফাঁকা জায়গাটায় নানন্দিক স্টাইলে সাদা আর হলুদ তাজা ফুলের সমাহারে সাজানো হয়েছে হলুদের স্টেজ।সারফরাজ ও তার ব্যাবসায়ীক বন্ধু,অভিরূপ ইয়ং ডালা ভর্তি হলুদ,বিভিন্ন গিফট চকলেটস,কেক আর বিশাল বড় এক সাদা গোলাপের গুচ্ছ নিয়ে স্টেজ এর সামনে এসে দাড়ালো।স্টেজে রূপকথা নেই।রূপকথা আজ কিভাবে সেজেছে তা দেখার জন্য সারফরাজ এর মন দুরুদুরু করে কেঁপে উঠলো।হাত পা কেমন শিরশির করছে।অভিরূপ টের পেলো সারফরাজ এর মতিগতি।সে ফিসফিস করে বলে উঠলো
“ভরা জনসমক্ষে আমাদের মন সম্মান নষ্ট করিস না।যদি জ্ঞান হারাস তবে লাত্থি দিয়ে পাশের ড্রেনে ফেলে রেখে চলে যাবো।
অভিরূপ এর কথায় দাঁত কামড়ালো সারফরাজ এরপর হাতের ফুল গুলো বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো রূপকথার অপেক্ষায়।
আবিরের স্ত্রী রোজি, নেলি আর রূপকথা নেলির পরিচিত বিশেষ বন্ধু লাল সামিয়ানার নীচে গান বাজাতে বাজাতে নিয়ে এলো রূপকথাকে।সম্মুখে সারফরাজ কে দেখে থেমে গেলো সকলেই।রূপকথা অবাক নয়নে অনিমেষ দেখলো তার প্রেমিক পুরুষ কে।ধবধবে শুভ্র পাঞ্জাবির উপর হলুদ কটি পড়েছে সারফরাজ।দেখতে রূপকথার রাজকুমার দের মতো লাগছে।ফর্সা গালে খোঁচা খোঁচা ছোট দাড়ি ।টনটনে আদুরে নাক,লালচে ঠোঁটে পরিচিত ভরসা যুক্ত হাসি আর গভীর নীল চোখ।রূপকথা সারফরাজ এর সামনে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যয় এগিয়ে গেলো।এরপর বলে উঠলো
“শেষ পর্যন্ত তুমি আমার হতে চলেছো।
সারফরাজ ঠোঁট কামড়ে মাথা ঝাঁকালো।অন্তরে কেমন প্রশান্তির হাওয়া বইছে।শুধু দীর্ঘ রাত টুকুর অপেক্ষা।
এমন সময় বক্সে বেজে উঠলো গান
“মেরা সাইয়া সুপারস্টার।
রূপকথা আগেই এই গানের ড্যান্স স্টেপ শিখে রেখেছিলো।সে প্রশস্ত হেসে সারফরাজ কে চোখ টিপে নেচে উঠলো।প্রিয়তমার নাচ মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করলো সারফরাজ।রূপকথা আজ কাঁচা হলুদ জামদানিতে নিজেকে জড়িয়েছে।সোনা রঙা অঙ্গে শাড়িখানা কেমন চোখ পুড়িয়ে দিচ্ছে।মাথায় কাঁচা ফুলের টায়রা হাতে শুভ্র গোলাপ আর বেলির কালিয়া গলায় ঝোলানো গাদা ফুলের বড় মালা।চোখ মুখে জাদুকরী অঙ্গভঙ্গি করে নেচে নেচে গান গাচ্ছে রূপকথা ।সারফরাজ এর মনে হলো এটা রূপকথা না।পরীর দেশের ছোট হলুদ একটা পাখি তার সামনে নেচে নেচে হৃদয় পুড়িয়ে দিচ্ছে।
সারফরাজ অমায়িক মুগ্ধ হেসে রূপকথার পানে হাত বাড়ালো।সেই হাত আলতো করে চেপে ধরলো রূপকথা।হাতের ফুলের গুচ্ছ অভিরূপ এর হাতে দিয়ে রূপকথাকে কোলে তুলে স্টেজে উঠে সোফায় বসিয়ে দিলো সারফরাজ।এরপর সেন্টার টেবিলে সাজানো হলুদের বাটি থেকে অল্প হলুদ নিয়ে রূপকথার গালে আর নাকে লাগিয়ে কপালে চুমু খেলো।
সারফরাজ এর হলুদ মাখানো শেষ হতেই হামলে পড়লো রূপকথা।এক খাবলা হলুদ নিয়ে সারফরাজ এর পুরো শরীর মাখিয়ে দিলো।মুহূর্তেই শুরু হলো হাস্য রসের প্রতিধ্বনি মিশ্রিত কড়াকড়ি আর হলুদ ছোড়াছুড়ি।সুযোগ পেতেই উপস্থিত সবাইকে হলুদ মাখালো নেলি আর তাদের বঁন্ধুরা।অভিরূপ কেও ছাড় দিলো না নেলি।বেচারা অভিরূপ পেরে উঠলো না নেলির সঙ্গে।শেষমেশ নেলিকে নিজের সাথে চেপে ধরে নিজ গালের হলুদ নেলির নাকে মুখে মাখিয়ে অভিরূপ বলে উঠলো
“খুব শীঘ্রই এর কঠিন প্রতিশোধ নেবো আমি নেলি হায়দার।ওইদিন কিন্তু কোনো ছাড় পাবে না।মনে রেখো।
বলেই চোখ টিপলো অভি।অভিরূপ কি বোঝাতে চাইছে বুঝতে পেরে লাজুক হেসে নিজেকে কোন মতে ছাড়ালো নেলি।এরপর দৌড়ে পালালো।
নেলির যাবার পানে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো অভিরূপ।এরপর বলে উঠলো
“মাথাই নষ্ট করে দিলো মেয়েটা।উফ কি গরম লাগছে!
রেখা আর সুফিয়ান এসে সারফরাজ আর রূপকথার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন।এরপর পায়েস, মিষ্টি আর কিছু ফল খাওয়ালেন।
সারফরাজ গভীর ভাবে সুফিয়ান চৌধুরীর পানে তাকালো।আজ বড্ড অসহায় লাগছে মানুষ টাকে।আগের হাস্য রসে মজানো সুফিয়ান চৌধুরী আজ কেমন গম্ভীর ,বেদনায় জর্জিত।মুখে প্রাণ খোলা কোনো হাসি নেই।যা আছে পুরোটাই লোক দেখানো মলিন হাসি।সুফিয়ান চৌধুরীকে এমন অবস্থায় দেখে সারফরাজ এর হৃদয় ধক করে উঠলো।তবে কি বিয়ের নামে বাবার থেকে সন্তান কেঁড়ে নিচ্ছে সে?না না এতবড় অপরাধ সারফরাজ কিছুতেই করতে পারে না।বিবেক দগ্ধ হয়ে সারফরাজ সুফিয়ান চৌধুরীর দুই হাত চেপে ধরে বলে উঠলো
“আপনার মেয়ে কখনোই পর হবে না কমিশনার সাহেব।আমরা সবাই এক সাথে থাকবো।যতদিন আপনার রিটায়ার না হয় ততদিন রূপকথা আপনার কাছেই থাকবে।নিজ স্বার্থে আপনাকে নিঃস্ব করার কোনো অধিকার নেই আমার।
সুফিয়ান কিছুক্ষণ নীরব রইলেন।এরপর চেনা পরিচিত সেই প্রশস্ত হাসি ঠোঁটে লেপে চোখ পাকিয়ে ধমকে উঠলেন
“ঘরজামাই থেকে ফ্রিতে খাবার ধান্দা করেছিস হতচ্ছাড়া?
চেকমেট পর্ব ৫৯
সারফরাজ মাথা দোলালো।সুফিয়ান আরেকটু প্রশস্ত হেসে হলে উঠলো
“ঠিক আছে কবুল করে নিলাম।ঘরজামাই মোবারক হো।
সারফরাজ হাতের অজলায় মুখ মুছে বলে উঠলো
“আমিন।