চেকমেট পর্ব ৬২

চেকমেট পর্ব ৬২
সারিকা হোসাইন

সারফরাজ আর রূপকথার আনন্দ ঘন বিয়ের পুরো জাকজমকপূর্ণ মুহুর্ত খুব কাছে থেকে দেখলো রুদ্ররাজ ।বাকি পাঁচ জন মানুষের মতো সেও আজ এই মনোমুগ্ধকর বিয়ের অতিথি।আজ তার পায়ে কোনো শিকল নেই,নেই কোনো পাহারাদার বা জোর পূর্বক আটকে রাখার প্রয়াস।আজ কেউ তাকে চোখে চোখেও রাখছে না।তাকে নিয়ে যেনো কারো মাঝে কোনো ভাবান্তর ই নেই।রুদ্রের মনে হলো এখানে সে এক অযাচিত ,বেমানান।

সারফরাজ রুদ্রকে প্রলোভন ছুড়েছে।যদি আজ রুদ্ররাজ এখান থেকে পালাতে পারে তবে সে চির জীবনের জন্য সারফরাজ এর হাত থেকে মুক্তি পাবে।রুদ্ররাজ পালালো না আজ।সারফরাজ এর খুশি, প্রাপ্তি, জয় সব কিছু দেখে তার মনে হলো তার নিজের জীবনটা বড্ড অর্থহীন।এতদিন অন্ধকারে গা ভাসিয়ে চূড়ান্ত ভুল করেছে সে।সারফরাজ সব দিকেই জয়ী।অথচ সে হেরে গিয়ে মুখ থুবড়ে পতিত হয়েছে সারফরাজ এর পদতলে।শেষ চেকমেট সারফরাজ ই দিয়েছে।তেজী দক্ষ সুকৌশলী সারফরাজ এর কাছে রুদ্র বড্ড অপক্ক হাতের কাঁচা খেলোয়াড়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মায়া চৌধুরী বিশেষ খাতির করে রুদ্রের প্লেটে মুরগির লেগ পিস, ভালো ভালো মাংস তুলে দিয়েছে।সেগুলো গিলতে মরন যন্ত্রনা হয়েছে তার।যে মানুষটি সব ভুলে তাকে এভাবে যত্ন করলো সেই মানুষটিকেই একদিন সে অবর্ণনীয়,,অসহনীয় কষ্ট দিয়েছে।বার বার মানুষটি মুক্তির আকুতি জানিয়েছে কাতর গলায়।অথচ রুদ্র কানেও তুলেনি তা।নিষ্ঠুরের মতো প্রতি মুহূর্তে তাকে ভীত করেছে নিজের কুৎসিত রূপে।আচ্ছা এতো দিন কেনো রুদ্রের কখনো মনে হয়নি যে,মানুষটা তার রক্ত?তার আপন ফুপু?তার বাবার আপন ছোট বোন?সব কিছ জেনে শুনেও কোন মোহে অন্ধ হয়ে এই মানুষটির সাথে এহেন হৃদয়হীন ঘটনা ঘটিয়েছে সে?

এই মুহূর্তে সুবহান চৌধুরীর উপর আকাশসম ঘৃণা জন্মালো রুদ্রের সেই সাথে নিজের কৃতকর্ম আর মন্দ ভাগ্য ভেবে তাচ্ছিল্য হাসলো ।চোখের কোণে কেমন নোনা জলে জমতে চাচ্ছে।এদিক সেদিক পলক ঝাপ্টে সেই জল লুকিয়ে গায়ের সুট টেনে টুনে ঠিক করে এগিয়ে গেলো সারফরাজ এর সামনে।এরপর হাত বাড়িয়ে বলে উঠলো
“কনগ্রাচুলেশন।

রুদ্রকে দেখে ভয়ে জড়সড় হলো রূপকথা।রূপকথাকে বুকে আগলে সারফরাজ শক্ত করে রুদ্রের হাত চেপে ধরলো।আজ কোনো ক্রোধ, জেদ, ক্ষমতাগিরি কিচ্ছু কাজ করলো না কারোর ভেতর।আজ যেনো এক ভাই আরেক ভাইকে অভিবাদন জানালো,ভরসার শক্ত হাত বাড়ালো।সারফরাজ এর হাত শক্ত করে ধরে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রুদ্র।এরপর মায়া চৌধুরীর মায়াবী মুখ পানে তাকিয়ে বলে উঠলো
“তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও ফুপি।যদিও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছি।আদৌ ক্ষমা পাবো কি না জানিনা।কিন্তু আমার পশু সত্তা বলছে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত।আমি সত্যিই অনুতপ্ত।
রুদ্রের কথায় সারফরাজ চুপ রইলো।রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে পুনরায় বলে উঠলো
“আমাকে পাতাল ঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা কর সারফরাজ।যদি পাপের কিছুটা মার্জনা হয়।আমি স্বেচ্ছায় আমার বন্দি দশা কবুল করে নিয়েছি।আমি আজীবন ওখানেই নিজের জীবন কাটাতে চাই।পৃথিবীর বাতাস বড্ড বিষাক্ত ঠেকছে।অন্ধকার ই আমার আপন এখন।
সারফরাজ এক ভ্রু উঁচু করে শুধালো

“রিয়েলি?
রুদ্র মাথা ঝাঁকালো তাৎক্ষণিক।সারফরাজ ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলে উঠলো
“তোকে বন্দি করতে ইচ্ছে করছে না আর।স্পেশালী মা চাচ্ছে না।তুই লস এঞ্জেলস ফিরে যা।সেই ভালো তোর জন্য।
রুদ্ররাজ এর মনে হলো সারফরাজ তার সাথে মজা নিচ্ছে।তাই নিজেই এগিয়ে গেলো আবির মাহতাব এর কাছে।এরপর বলে উঠলো
“স্যার চলুন।
আবির মাহতাব মাথা ঝাঁকালো।এরপর বললো
“চলো।
সারফরাজ এর থেকে বিদায় নিয়ে মায়ার সামনে নত মস্তকে দাঁড়ালো রুদ্র।এবার বুক ঠেলে কান্না পেলো তার।নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারলো না সে।হাটু ভেঙে মায়ার পায়ের কাছে বসে গেলো রুদ্র।এরপর মায়ার পা জড়িয়ে বলে উঠলো

“আমাকে তুমি মাফ করে দাও ফুপি।আমি অন্যায় করেছি।কিন্তু বিশ্বাস করো জেনে বুঝে করিনি।আমি অবুঝ ছিলাম।আমার চোখে কালো অপরাধের পর্দা ছিলো।আজ বহু বছর বাদে সেই পর্দার উন্মোচন হয়েছে।
রুদ্রের কান্না মায়ার বুকে শেল হয়ে বিধলো।তার কাছে মনে হলো সেদিনের সেই দশ বছর বয়সী রুদ্ররাজ তার ভাইপো তার সামনে ঠোঁট ভেঙে বসে বসে কাঁদছে।মায়া নিজেও হাটু মুড়ে বসে রুদ্রকে বুকে জড়িয়ে বলে উঠলো
“তুই তো আমার আব্বা রে রুদ্র।মেয়ের কাছে বাপের কোনো অন্যায় থাকতে পারে? না পারে না।আমি সেসব কিচ্ছু মনে রাখিনি।তুই ও ভুলে যা সব।
সময়ের পরিক্রমায় সমস্ত দ্বন্দ্ব, অভিমান, রাগ,ক্ষোভ জেদ ঝুরঝুর করে বালির বাঁধের ন্যয় ভেঙে গেলো।সারফরাজ আবির মাহতাব কে বললো

“স্যার ওর পাসপোর্ট আর জরুরি ডকুমেন্টস গুলো ওকে ফেরত দিয়ে দিন।আমি ওর সাথে আমার সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাই।আজ থেকে আমরা কেউ কাউকে চিনি না।আজ থেকে আমি ধরে নেবো আমার জীবনে রুদ্ররাজ নামক কোনো ছায়া কখনো ছিলো না আর ভবিষ্যতে ও থাকবে না।
সারফরাজ এর শক্ত গলার কথাটা রুদ্রের বুকে গিয়ে বিধলো।সে মাথা নত রেখে অস্ফুট গলায় বললো
“আমার সাজা কমানোর জন্য থ্যাঙ্কস।কিন্তু আমি আজীবন অন্ধকার কারাবাস ডিজার্ভ করি।
আর দাঁড়ালো না রুদ্র।এখানে দাঁড়ানোর মতো মুখ তার নেই।সে লস এঞ্জেলস ফিরে যাবে এরপর সেখান থেকে রাশিয়া।রুদ্র নামটা সকলের মন থেকে সে মুছে দিতে চায়।রুদ্রের কালো ছায়া আর যেনো কারো উপর না পড়ে।ব্যস এই টুকুই।
সারফরাজ কে পুনরায় শুভকামনা জানালো রুদ্র।সে সারফরাজ আর রূপকথাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো

“তোরা হ্যাপি থাক।আর তোমাকে বিরক্ত করবার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত রূপকথা।চাইবো তোমাদের সাথে আর কখনো আমার দেখা না হোক ।কিন্তু তোমাদের খুব মিস করবো।বেহায়া নির্লজ্জ মন তোমাদের বার বার দেখতে চাইবে।যোগাযোগ ও করতে চাইবে।যদি এমন ধৃষ্টতা কখনো দেখিয়েও ফেলি প্লিজ কেউ রাগ করো না।আমার একাকী জীবন কালো মেঘে ঢাকা।আমি তোমাদের মতো এতটা সুখী নই।আসছি।
রুদ্র পা বাড়ালো।মায়া পেছন থেকে ডেকে বলে উঠলো
“ফুপি অপেক্ষা করব তোর জন্য।ভুলে যাসনা আমাকে।
রুদ্ররাজ পেছন ফিরলো না।শুধু স্তম্ভিত হয়ে মাথা ঝাঁকালো।এরপর লম্বা লম্বা পা ফেলে গলফ ক্লাবের বাইরে বেরিয়ে এলো।বাইরে ইয়ং সহ আবির মাহতাব অপেক্ষা করছেন গাড়ি নিয়ে।রুদ্র কোনো ভনিতা না করে গাড়িতে উঠে বসলো।এরপর বললো

“কোথায় যেতে হবে আমায় এখন?
“এয়ারপোর্ট এ।টিকিট রেডি করা আছে
বলেই গাড়ির ক্ল্যাচে পা রাখলেন আবির মাহতাব ।গাড়ি ছুটতে লাগলো এয়ারপোর্ট অভিমুখে।রুদ্র ফাঁকা দৃষ্টি মেলে গাড়ির জানালায় বাইরে তাকালো।মুক্তির স্বাদ আজ অনুভব করতে পারছে না সে।তার এই ঝকমকে আলো মাখা পৃথিবী থেকে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করছে।মনে হচ্ছে পুরো বিশ্ব এক ঘৃণিত জঘন্য অপরাধী হিসেবে তাকে চিনে।সে যেখানেই গিয়ে দাঁড়াবে সেখানেই আঙ্গুল উঁচিয়ে মানুষ বলবে
“ঐতো নর পিশাচ!

রুদ্রের বিদায়ের পর রূপকথার বিদায় ক্ষন এলো।কিন্তু কেউ কাঁদলো না।হাসিখুশি সুফিয়ান চৌধুরী কে বাঁকা চোখে রূপকথা বলে উঠলো
“বাবা আমি চলে যাচ্ছি।
“তো যাও না।না করেছে কে?
“তোমরা কাঁদছো না কেন?
“এখানে কাদার কি আছে?বিয়ে হয়েছে শশুর বাড়ী যাবে এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম।
“সে কি আমার বিয়ে হয়ে গেলো, আমি পরের ঘরে চলে যাচ্ছি তোমরা কাঁদবে না?
,না মা কাঁদবো না।
সুফিয়ান চৌধুরীর ত্যাড়ামো কথায় রূপকথার মেজাজ সপ্তম আসমানে গিয়ে ঠেকলো।সে রেখাকে উদ্দেশ্য করে মেজাজ দেখিয়ে বললো
“এই তোমাদের ভালোবাসার নমুনা মা?বিয়ের আগে তো স্বামী স্ত্রী মিলে সেই নাটক করলে?এখন কোথায় গেলো সেসব?
রেখা উত্তর করবার আগেই সুফিয়ান চৌধুরী বলে উঠলো

“তোমার গ্রেট মাফিয়া ম্যান ঘর জামাই থাকতে চলেছে।আজ বেয়ান সাহেবা কাঁদবে।কারন তার ছেলে আমাদের বাড়িতে চলে যাচ্ছে।আমরা খামোখা কাঁদতে যাবো কেনো?
সারফরাজ বাঁকা হাসলো।এরপর সুফিয়ান চৌধুরী কে কাঁচকলা দেখিয়ে নিজের ফোন থেকে দুটো টিকিট বের করে বলে উঠলো

“কেমন দিলাম?খুব শখ না?আজ রাতেই চলে যাচ্ছি।ফিরবো এক মাস পর।আপনাকে একদম বিশ্বাস নেই।নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে আমাকে যে গ্যারাকলে ফেলবেন আপনি তা আমি পই পই করে জানি।কোন মতেই নিজের অধিক প্রত্যাশিত মুহূর্ত গুলো আপনার জন্য খারাপ করতে চাচ্ছি না।ক্লোজ ফ্রেন্ডস দের চাইতে মারাত্মক গিরগিটি আপনি।খাটের তলায় গিয়ে বসে থাকেন কিনা এতেও ভরসা নেই।আসছি।
বলেই রূপকথাকে টেনে হিরহির করে চলতে আরম্ভ করলো।এরপর পিছন ফিরে পুনরায় বলে উঠলো
“মা কে রেখে যাচ্ছি।আপাতত সবাই মিলেমিশে ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে সে বিষয়ে মিটিং করতে থাকুন।আমাদের একদম বিরক্ত করবেন না।যদি এমনটি হয়েছে না?দেশে ফিরে সব গুলোকে পিস পিস করবো।
সারফরাজ এর কথায় সুফিয়ান চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে রইলো।এবার তার সত্যিই হাত পা ছুড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।কেমন ভেলকিবাজ ছোকরা এই সারফরাজ ভেবেই মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে।ভোলাভালা সেজে সে সুফিয়ান চৌধুরী কে ঘোল খাইয়েছে।হাজার হাজার টাকা খরচা করে ফুল কিনে ওদের জন্য ঘর সাজিয়েছেন তিনি।আর এই হতচ্ছাড়া বলছে কি এসব?
সুফিয়ান চৌধুরী নানান ভাবনা ভাবতে আরম্ভ করলেন।সারফরাজ অভিকে ডেকে বলে উঠলো

“গাড়ি রেডি কর।ক্যাপ্টেন লিও এয়ারপোর্ট এ অপেক্ষা করছে।
অভিরূপ ফাঁকা ঢোক গিলে দ্রুত পায়ে সারফরাজ এর পাশে এসে কানে কানে শুধালো
“আকাশে আকাম করবি তোরা?
সারফরাজ নাক ফুলিয়ে বলে উঠলো
“চান্দের দেশে গিয়ে করবো।তোর কোনো আপত্তি আছে?
অভি নিঃশব্দে মাথা নাড়ালো।এরপর পাংশু মুখে বললো
“ক্যাপ্টেন লিও সব শুনে ফেলবে।মুখ দেখাবি কি করে?
সারফরাজ চোখ গরম করে অভির চুলের গোছা টেনে ধরে হিসহিস করে বলে উঠলো
“আমাকে এতো নির্লজ্জ আর অধৈর্য পুরুষ মনে হয় তোর?
অভিরূপ নিজেকে ধাতস্থ করে চুল থেকে সারফরাজ এর হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলে উঠলো

“আজকাল মানুষ নাকি রকেটে বাসর সাড়ে শুধু তাই নয়।সৌর জগতের ব্ল্যাক হোল কেও এরা ছাড়ছে না।সব জায়গায় তাদের সিগনেচার পদচারনা।ভাবতে পারছিস অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?
“বাদ আছে কোথায়?
বিস্মিত হয়ে শুধালো সারফরাজ।
অভিরূপ কিছুক্ষন ভেবে বলে উঠলো
“আমাজন জঙ্গলে।এনাকোন্ডার ভয়ে আপাতত ওখানে কেউ যায়নি।
“ঠিক আছে তাইলে আমিই যাচ্ছি ওখানে।তুই গাড়ি রেডি কর শালা।আমার টাইম ওয়েস্টে তুই সবার উপরে।
অভিকে দাঁত পিষে আরে কয়েক দফা গালাগাল করে রূপকথাকে এক ঝটকায় কোলে তুলে বাইরে বেরিয়ে এলো সারফরাজ।পেছন পেছন এলো সকলে।ফুলে ফুলে সজ্জিত সারফরাজ এর কালো ব্র্যান্ডেড গাড়ি।রূপকথাকে গাড়িতে বসিয়ে সকলকে বিদায় জানালো সারফরাজ।এরপর অভিরূপ কে আদেশ দিলো
“চল।

★★মাউন্ট ক্লিফ প্যালেস,ক্যালিফোর্নিয়া
ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তর উপকূলে সমুদ্রের তীরে খাড়া পর্বতের কিনার ঘেষে বানানো দৃষ্টি নান্দনিক পাথর, গ্লাস আর কাঠের সংমিশ্রনে এক প্যালেস।প্যালেসের পাশ ঘেষে বয়ে চলেছে সরু একটি জল প্রপাত,নীচে নীল জলের প্রশান্ত মহাসাগর।চারপাশে বিশাল উচ্চতা বিশিষ্ট রেডউড ট্রি।একেকটা গাছের উচ্চতা প্রায় দুশো থেকে তিনশত মিটার।একেকটার ব্যাস এতোই মোটা যে লম্বা চওড়া পাঁচ ছয় জন মিলে হাত জোড়া দিয়েও বেড় আনতে পারবে না এই দানবীয় গাছের।যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর নাম না জানা গুল্ম উদ্ভিদের ঝোপঝাড়।চারপাশের বাতাসে বনফুলের সুঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে।এখানে রাত নামে দ্রুত।চাঁদের নরম আলো মাটিতে পৌঁছায় খুব কম।রাতের নিস্তব্ধতায় বয়ে চলা সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন মনে প্রশান্তি দেয়।আর সম্মুখ পর্বতের গম্ভীরতা গা ছমছমে অনুভূতির সৃষ্টি করে।
টানা পঁচিশ ঘন্টার জার্নি শেষ করে রূপকথা আর সারফরাজ নিজেদের এই প্যালেসে এসে উপস্থিত হয়।নিজের একাকীত্ব মুহূর্ত গুলোকে আরও বেদনাদায়ক আর গাঢ় করতে এই বাড়িটি বানিয়েছিলো সারফরাজ।এক মাত্র এই প্যালেসে এসেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে নিজের কষ্ট উগলে দেবার চেষ্টা করতো সকলের অগোচরে।জনমানব হীন এই অরণ্যে সারফরাজ এর কষ্টের পরিমাপ কেউ করতে আসেনি ।কেউ জানতেও পারেনি এই ভয়ানক অরণ্যে গভীর রাতে কেউ রোদনজারিতে জর্জরিত।

রূপকথা বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে প্যালেস এর সৌন্দর্য অবলোকন করলো।গভীর রাত।চারপাশ অন্ধকারে নিমজ্জিত।এখানে অন্ধকারের ঘনত্ব হাজার গুণ বেশি।দূর থেকে নেকড়ের পালের হাউলিং শোনা যাচ্ছে সেই সাথে আছড়ে পড়া সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন।সুউচ্চ পর্বতে নাম না জানা পাখি কেমন করুন আর্তনাদে ডেকে উঠলো।রূপকথার একটু ভয় লাগলো।সে সারফরাজ এর হাত চেপে ধরলো।সারফরাজ রূপকথাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো

“যতক্ষন আমার শ্বাস চলছে ততক্ষণ তুমি নিরাপদ ।ঠিক যেমনটি করে মাতৃগর্ভে ছোট্র ভ্রূণ ঘুমিয়ে থাকে তেমন।আমি পাশে থাকা অবস্থায় কোনো ভয় নেই তোমার।চলো ভেতরে চলো।এই প্রাসাদে আজকে থেকেই তোমার শাসন বিচার শুরু হোক।তোমার দাস হতে হৃদয় বেকাবু হয়ে আছে।
শীতের প্রকোপে রূপকথার শরীর থরথর করে কাঁপছে।সে হাটতে পারছে না।প্যালেস এর ভেতর ক্ষীন আলো জ্বলছে।হয়তো মোমের আলো।কীয়ত সময় পাড় হতেই খুট করে খোলে গেলো দরজা।বাড়ির ভেতর থেকে ড্যাভিন বেরিয়ে এলো এঞ্জেলোকে নিয়ে।এরপর মাথা নত করে বললো
“কনগ্রাচুলেশন বস।ভেতরে সব গুছানো আছে ঠিক যেমনটি আপনি চেয়েছেন।আমি আসছি।
বলেই এঞ্জেলোকে নিয়ে পা বাড়ালো ড্যাভিন।এঞ্জেলো সারফরাজ এর কাছে আসার জন্য শব্দ করলো।সারফরাজ শুধু মাথায় অল্প হাত বুলিয়ে বলে উঠলো
“তোমাকে পরে আদর করবো এঞ্জেলো।আজকের আদরে কেউ ভাগ বসাতে পারবে না।সমস্ত আদর ভালোবাসা একজনের জন্যই জমানো আজ।
রূপকথা সারফরাজ কে মিহি কম্পিত স্বরে বললো

“এঞ্জেলো থাকবে না আমাদের সাথে?
সারফরাজ হাস্কি স্বরে বললো
“তোমার আমার মধ্যে তৃতীয় কারো উপস্থিতি তোমার ভালো লাগবে রানী সাহেবা?
লজ্জায় মাথা নুইয়ে রূপকথা বললো
“ও কি করে বিরক্ত করবে?ও তো রাতে ঘুমিয়ে থাকে।
ড্যাভিন কে চোখের ইশারায় চলে যেতে বলে সারফরাজ রূপকথাকে কোলে তুলে কক্ষ অভিমুখে হাঁটা ধরলো।এরপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো

চেকমেট পর্ব ৬১

“বিরক্ত করবে ও।কারন আজ রাতে ও ঘুমাতে পারবে না তোমার চিৎকার চেঁচামেচি তে।আজ আমি তোমার আর আমার মধ্যে কারোর উপস্থিতি চাচ্ছি না।ক্ষমতা থাকলে এই অরণ্যের সমস্ত জীব জন্তুকে চুপ করিয়ে দিতাম আমি।সেই সাথে এই বিরক্তিকর সমুদ্রের গর্জন ।আজ শুধু তোমার দম বন্ধকর ভারী শ্বাসের শব্দ শুনতে ইচ্ছে করছে আর তোমার ক্রন্দনরত মুখে উচ্চস্বরে আমার নাম।

চেকমেট পর্ব ৬৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here