চেকমেট পর্ব ৯

চেকমেট পর্ব ৯
সারিকা হোসাইন

সিয়েরা ন্যাশনাল ফরেস্ট ,ক্যালিফোর্নিয়া
শীতের ঝাপসা কুয়াশা ভেদ করে উকি দিচ্ছে মাউন্ট টেরণ এর সুউচ্চ চূড়া।প্রবাহিত নদী আর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বয়ে চলা ঝর্ণার কলকল ধ্বনী খুব করে কানে বাড়ি খাচ্ছে।ম্যাকাউ আর ফ্লেমিংগোর সুমধুর ডাক হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেবার আগেই তাদের বৃহৎ ডানা ঝাপটিয়ে পালিয়ে যাবার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।হুট করে হুংকার ছেড়ে উঠলো ব্ল্যাক জাগুয়ার।কি ভয়ানক সেই হুংকার।এহেন হুংকারে গাছের পাতার ঝোপে লুকিয়ে থাকা পাখির দল ও পাখা ঝাপটিয়ে নিজেদের ভীতি জানান দিলো।জাগুয়ার এর হুংকার যেনো নেকড়ের পালের কাছে অসহনীয় ঠেকলো।তাই তারাও একসাথে হাউলিং করে জানান দিলো এই বনে তাদের ও রাজত্ব চলে।কিন্তু আসলেই কি এই বনে তাদের রাজত্ব চলে?নাকি এখানে রাজত্ব করার জন্য সত্যিই কোনো রাজা আছে?

ঘড়িতে সকাল ন’টা বেজে কুড়ি মিনিট।
কুয়াশার আস্তরণ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে উঠলো।সূর্য মামা এখনো মুখ তুলে ধরণী দেখেনি।হয়তো ঘন কুয়াশা তাকে ঝাপ্টে ধরেছে।চারপাশ নীরব নিস্তব্ধ। ঘড়ির কর্কশ এলার্ম টিং টিং করে বেজে জানান দিলো সমস্ত নিস্তব্ধতা ভাঙার সময় এসেছে।কিন্তু এই নিস্তব্ধতা ভাঙবে কে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সিয়েরা ফরেস্ট এর পাইন গাছে ঘেরা সমতল ভূমিতে দূতলা বিশিষ্ট বিশাল এক ফরেস্ট হাউজ।কাঠ ,লোহা আর ভারী থাই গ্লাসের নিমিত্তে অভিনব কায়দায় তৈরি করা হয়েছে এই বাড়ি।আলপাইন এরিয়ার সবচেয়ে বিলাসবহুল এবং দৃষ্টি নন্দন ফরেস্ট হাউজ এটি।এই হাউজে বাস করেন আঠাশ কি ঊনত্রিশ বছরের এক যুবক।সমগ্র আলপাইন কাউন্টির কেউ সেই যুবকের নাম জানে না।কেউ কখনো তাকে সামনে থেকে দেখেও নি।শুধু লোক মুখে শুনেছে “হি ইজ এ ডেভিল। ব্যাস এই টুকুই।এতেই কাউন্টির কেউ এই বাড়ি অভিমুখে আসার সাহস করে না।প্রায়শই এই নির্জন বাড়িটি থেকে মানুষের হৃদয় বিদারক চিৎকার ভেসে আসে সেই সাথে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক।কেউ কখনো দেখার বা জানার সাহস করেনি কেনো ওই বাড়িতে মানুষ আকাশ বাতাস ভারী করে চিৎকার করছে। কারন শান্তি পুর্ণ এই কাউন্টি তে কেউ যেচে অশান্তি ডেকে আনতে চায় না।।।।

বালু আর পাথর ভর্তি পাঞ্চ ব্যাগে একের পর এক শক্ত পাঞ্চ করে যাচ্ছে যুবক।একেকটা পাঞ্চ এর ওজন কমপক্ষে নয়শত থেকে হাজার পাউন্ড।প্রত্যেকবার হিট করার সাথে সাথেই পোক্ত হাতের বাইসেপ মাসেল গুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে।অদ্ভুত ভয়ানক চোখ জোড়াতে ঈগলের ন্যয় শিকারি দৃষ্টি।জড় বস্তুর ব্যাগটাও যেনো যুবকের হিংস্র চোখ দুটো দেখে ভয়ে কাঁপছে।ওভাল শেপের আকর্ষণীয় হলদেটে ফর্সা মুখ জুড়ে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।প্রশস্ত চোয়াল আর কালচে লাল ঠোট।স্লিকড ব্যাক হেয়ার স্টাইল এর সাথে জিম করা শক্ত ফর্সা শরীরটা বেশ মোহনীয়।পেশীবহুল বুকের বাম পাশে মুখ হা করে দাঁত বের করে শিকার ধরার জন্য ওঁৎ পেতে থাকা এক ব্ল্যাক জাগুয়ার এর ট্যাটু।জাগুয়ার এর মাথায় একটা দাবার কিং।তার উপর লেখা চেকমেট।

কতক্ষন ধরে এহেন ঘুষা ঘুষির খেলা চললো তার হিসেব রাখলো না এই সুপুরুষ।ঘুষির তোড়ে হাতে প্যাচানো কাপড় ছিড়ে যখন হাতের নরম চামড়া ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলো তখন সে নিজের খেয়ালে এলো।শত শত ক্যালোরি ব্যায়ে শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার।মাসেল এর প্রতিটা খাঁজ বেয়ে বেয়ে সেই নোনতা ঘাম গলে পড়ছে।কোনো রমণী এহেন দৃশ্যে এই অযাচিত ঘর্ম বিন্দুর উপর নিশ্চিত জেলাস ফিল করতো।কিন্তু যুবক নির্বিকার।
হ্যাঙ্গার থেকে ছোট সাদা টাওয়েল নিয়ে চোখ মুখের ঘাম মুছে শাওয়ার নেবার জন্য পা বাড়ালো।
কাঁচ ঘেরা আধুনিক ওয়াশ রুমে শাওয়ার ছেড়ে দেয়ালে দুই হাতের ভর দিয়ে চোখ বুজে ফেললো যুবক।কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিজের জীবনের হিসেব নিকেশ মেলালো।শেষমেশ এসে সমীকরণ মিললো না।এতে যুবক তাচ্ছিল্য হেসে শাওয়ার এর নব বন্ধ করে দিলো।এরপর গায়ে একটা বাথ রোব জড়িয়ে বেরিয়ে এলো।মাথার চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ালো সে।আয়নায় নিজেকে একবার পরখ করলো।ডান চোখের নিচের থ্রি টিয়ার ড্রপস এর ট্যাটু তাকে খোঁচা দিয়ে মনে করিয়ে দিল

“হাউ ক্রুয়েল ইউ আর….
নিজের মনের কথায় ফিক করে হেসে নিম্ন ভাগের লালচে ঠোঁট কামড়ে যুবক ভারী গলায় বলে উঠলো
“পারফেক্ট।
হঠাৎ নিজের পালা কুকুর এঞ্জেলো ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠলো।গায়ের বাথ রোব খুলে একটা টু কোয়ার্টার পরে বাইরে বেরিয়ে এলো যুবক।ঝেঁপের ধারে কিছু নড়তে দেখে ঘেউ ঘেউ করছে এঞ্জেলো।নিজের পশু শিকার এর শর্ট ব্রেক গান শট কাঁধে ফেলে লম্বা লম্বা পায়ে হাজির হলো গার্ডেন এরিয়ায়।এরপর এঞ্জেলোর ক্ষুদ্ধ চোখ অনুসরণ করে দৃষ্টি ফেলতেই বড় পাইথন নজরে এলো।সময় অপচয় না করে নিশানা তাক করে গুলি ছুঁড়লো যুবক।মুহূর্তেই আহত পাইথন ফনা তুলে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে দলিত মথিত করলো চারপাশ।এঞ্জেলো কে নিয়ে যুবক নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়াতেই অল্প সময়ের ব্যাবধানে পৃথিবী ছাড়লো ভয়ানক অজগর।এতে চেহারার কোনো পরিবর্তন ঘটলো না যুবকের।হনহন করে পা বাড়িয়ে রক্তাক্ত অজগর কাঁধে তুলে এঞ্জেলো কে শুধালো

“ডু ইউ লাইক পাইথন মিট সো মাচ?
অবলা কুকুর বুঝলো হয়তো তার মনিবের আদর মাখা কথা।ঘেউ ঘেউ করে নিজের মতবাদ জাহির করতেই যুবক চললো কিচেন এর দিকে।এঞ্জেলো তার সন্তান।তার একাকীত্বের সঙ্গী।সন্তানকে পেট ভরে তার পছন্দের খাবার খাওয়ানো তার একান্ত কর্তব্য।
কিচেনের বৃহৎ চপিং বোর্ডে অজগরের মাথা রেখে নাইফ হোল্ডার থেকে বেছে বেছে সব চাইতে ধারালো চাকু বের করলো সে।এরপর একের পর এক ছুড়ি চালিয়ে পিস পিস করলো অজগরের দেহ।এরপর সেগুলো ভালো করে ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।বারবিকিউ প্যানে টুকরো করে রাখা অজগরের মাংস মশলা সমেত মাখিয়ে ছেড়ে দিলো।এরপর আগুন জ্বালিয়ে ফিরে গেলো নিজের কাজে!

কম্পিউটার এর সামনে উৎসুক হয়ে ভীত সন্ত্রস্ত মুখে বসে আছে রূপকথা।কাঁধ ছাড়িয়ে যাওয়া ঝলমলে কালচে বাদামি চুল গুলো আলুথালু পাখির বাসা।কতোদিন চুল আচড়ানো হয়নি কে জানে?গোলাপি আভা মিশ্রিত কপোল দ্বয়ও আজ বড্ড ফ্যাকাসে।বড় বড় চোখের পলক ঝাপটানোতে তার হৃদয়ের পেরেশানি স্পষ্ট।লালচে ঠোঁট জোড়া কেঁপে কেঁপে উঠছে বার বার।মায়াবী মসৃন চেহারা জুড়ে আতঙ্কের ছাপ।দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে ইতোমধ্যে রক্ত বের হবার জোগাড় হয়েছে।তবুও কিছুতেই মনে শান্তি মিলছে না তার।মা রেখা চৌধুরী মেয়ের এহেন কাণ্ডে বার কয়েক ভরসা জুগিয়ে নিজ কাজে মন দিলেন।ডিউটি থেকে খুব দ্রুত ফিরলেন সুফিয়ান চৌধুরী।রূপকথার আজ মেডিকেল এডমিশন এর রেজাল্ট দেবে।মেডিকেল এ চান্স পাবার জন্য মেয়েটা রাত দিন পরিশ্রম করেছে।সুফিয়ান তাকে প্রতিজ্ঞা করেছে সরকারীতে চান্স না হলেও প্রাইভেট থেকে তাকে এমবিবিএস পড়াবে।কিন্তু রূপকথা তা কানেই তুলছে না।তাকে সরকারি তেই চান্স পেতে হবে।মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে ইউনিফর্ম না পাল্টেই মেয়ের পাশে সুফিয়ান চৌধুরী নিজেও বসে গেলেন।রূপকথা ফ্যাকাসে চোখে বাবার পানে নজর দিয়ে ক্লান্ত ভয়ার্ত স্বরে বললো

‘চান্স হবে তো পাপা?
মেয়েকে সামান্য কাছে টেনে কাঁধে চেপে ধরে সাহস জুগিয়ে সুফিয়ান বললেন
“অবশ্যই হবে।আমার পাপা কতো কষ্ট করেছে এর জন্য তা কি আমি জানিনা?তোর চান্স না হলে দেখবি কারোর চান্স হবে না।
সুফিয়ান চৌধুরীর কথায় ভরসা পেয়ে আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে নজর দিলো রূপকথা।সার্ভার ডাউন।বার বার ঘুরে ঘুরে সময় নিচ্ছে।এরই মাঝে রূপকথার ফুপাতো বোন ন্যালি ফোন করে জানালো ঢাকা মেডিকেল এ তার চান্স হয়েছে।
এই কথা শুনে রূপকথা ফোন কেটে সজল চোখে সুফিয়ান এর দিকে তাকিয়ে ডেকে উঠলো
“পাপা..
হঠাৎ ল্যাপটপের স্ক্রিনে সুফিয়ান এর দৃষ্টি আটকালো।তিন নম্বর মেরিট লিস্ট এ রূপকথার রোল নম্বর ঝকঝক করছে।সুফিয়ান নিজের উচ্ছাস ধরে রাখতে না পেরে হৈ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলেন।ভয়ে আঁতকে উঠে রূপকথা নিজেও স্ক্রিনে নজর বুলালো।নিজের চোখ যেনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না।হাত পা কেমন শিরশিরে হয়ে ঠান্ডা হয়ে আসছে।মাথা কেমন ঘুরছে।খুশিতে হার্ট এট্যাক হচ্ছে।চোখ দুটো তে প্রচন্ড ঘুম।ঢলে পড়ার আগে রূপকথা অস্ফুট স্বরে বললো

“খুশিতে জ্ঞান হারাচ্চি পাপা।
কথাটি বলেই বিছানায় ঢলে পরলো রূপকথা।রেখাকে তর্জন গর্জন করে ডেকে সুফিয়ান বলে উঠলো
“তোমার মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে রেখা।
হাতের কাজ ছুড়ে ফেলে দৌড়ে ঘরে এলেন রেখা।মেয়ে তার সত্যিই জ্ঞান হারিয়েছে।হাতের কাছের মগ থেকে পানি ছুড়ে চোখে মুখে ছিটিয়ে বিরক্তি ভরা কন্ঠে রেখা ধমকে উঠলেন
“চান্স পেতেই যদি এমন অবস্থা হয় তবে অপারেশন থিয়েটারে কি করবি তুই?পেশেন্ট রেখে তো তোর ই চিকিৎসা আগে করতে হবে।

চেকমেট পর্ব ৮

কিছুক্ষন পর পিট পিট করে চোখ মেললো রূপকথা।জিভ দিয়ে ঠোঁটের অগ্রভাগ থেকে অল্প পানি নিয়ে গলা ভেজাতে চাইলো।কিন্তু মুখ বিকৃত করে ধীর গলায় বলল
“কুলসুম শরবতে চিনির বদলে আবার লবন দিয়েছে মা।

চেকমেট পর্ব ১০