ছায়ার মুখোশ পর্ব ১১
তাজরীন খন্দকার
শাশুড়ীর কথার ধারালো ধাঁচে আরিদার মেজাজটা একটু বিগড়ে গেলো। কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘ আপনাদের আগের বউয়ের ভাই যে ফয়সাল, তার সাথে ফাইজা পালায়া গেছে।
আরিদার শাশুড়ী সাথে সাথে আরিদার মুখের উপর হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলো। পাশে তাকিয়ে দেখলো রাশেদ রাইসার জামার বেল্ট বেঁধে দিচ্ছে৷ সে কিছু শুনেনি। আরিদার শাশুড়ী নড়েচড়ে, গলা ঝেড়ে বললো,
‘ বউ একটু ফাইজার রুমে আইয়ো তো।
আরিদা রাশেদের দিকে তাকালো, রাশেদের মুখ আর হাতের ভঙ্গিতে ইশারা দিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘ কি?
আরিদা ঠোঁট উল্টে দুই কাঁধ একসাথে উঁচু করে ইশারায় বুঝলো, সে জানেনা।
ফাইজার রুমে যেতেই তার শাশুড়ী দরজা বন্ধ করে বললো,
‘ বউ কি বলছিলা তখন? কার লগে গেছে ফাইজা?
‘ ক্যান চিনেন না ফয়সালরে?
‘ আমি তো চিনি, তুমি চিনো কেমনে?
‘ দেখা হইছিলো।
‘ আমারে কইলা না ক্যান?
‘ ফয়সাল তো আপনাদের আত্মীয়, কওনের কি আছে?আর আপনে এতো ঘাবড়ায়া গেছেন ক্যান?
আরিদার শাশুড়ী ঢুক গিললো। আর কি বলবে ঠোঁটে আওড়াতে লাগলো। আরিদা বললো,
‘ আমি এখন যাইতে পারি আম্মা?
তখন তার শাশুড়ী বলে উঠলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ না দাঁড়াও,ওদের মধ্যে সম্পর্ক আছে তুমি কেমনে জানছো ?
আরিদা থেমে গিয়ে বললো,
‘ কাল রাইতে ধরা পড়ছিলো, কথা দিছিলো যোগাযোগ বন্ধ কইরা দিবো কিন্তু আমি বিশ্বাস করি নাই,ফোন নিয়া নিছিলাম। তাই আপনার মোবাইল আইনা যোগাযোগ কইরা শেষে বাড়ি থেইকা পালাইছে।
‘ আমারে কও নাই ক্যান?
‘ এই যে কইলাম। আপনার পোলারেও এখন কমু।
বলেই আরিদা যাওয়া ধরলো, আরিদার শাশুড়ী আরিদার হাত ধরে ফেললো।
আরিদা আবাদ পেছন ঘুরে তাকাতেই অনুনয় করে বলতে লাগলো,
‘ রাশেদরে কইয়োনা।
‘ কিন্তু এইটা জানন উচিত। আপনি আটকাচ্ছেন ক্যান? ফয়সালদের সাথে কিসের শত্রুতা?
‘ কোনো শত্রুতা নাই। আমরার মধ্যে হাতাহাতি বা মুখের লড়াই কোনোডাই হয় নাই, শুধু নিরবে নিরবে এই শত্রুতা৷
আরিদা শিরদাঁড়া সোজা করে তার শাশুড়ীর বরাবর দাঁড়ালো, এই প্রথম শাশুড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলার একটা রাস্তা তৈরি হয়েছে। তাই জেরা করার মতোই প্রশ্ন করলো,
‘ তাহলে আমারে কন তো আপনার পোলার বউ কেমনে মরছে?
‘ কেডা? শিরিন? অ অ হায়াত শেষ তাই খোদার ডাকে সাড়া দিয়া চইলা গেছে।
‘ আম্মায়াহ্? এইডা কোনো উত্তর না, হায়াত শেষ হইলেই মানুষ মরে তবে অজুহাত দেখানোর মতোন একটা কারণ থাকে। সেইটা কি আছিলো আমারে কন?
‘ একদিন জ্বরে…
‘ উফফ! এই জ্বরের কথা শুইনা শুইনা বিরক্ত হইয়া গেছি। জ্বরে মানুষ কি এতো সহজে মইরা যায়? ফয়সাল আপনার পোলারে কেন দোষ দেয়? যার ক্ষোভে ফাইজারেও প্রতিশোধের হাতিয়ার বানায়ছে,এইটা কি এমনি এমনি?
‘আল্লাহ আমার ফাইজার কি হইবো আমার ফাইজা!
বলেই বিলাপ করতে লাগলো।
আরিদা তার শাশুড়ী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
‘ আম্মাহ্? এসব এখন থামান৷ কন আমারে সব? কেমনে মরছে? কইলে একটা সমাধান দিতে পারুম। আমারে ভরসা করেন, আমারে এমনে এড়ায়ে গিয়া আপনাদের লাভের চাইতে ক্ষতিই বেশি হইবো।
‘ কি শুনবা?
‘ কেমনে মরলো, মরার আগে তার আর কি সমস্যা আছিলো সব কন।
আরিদার শাশুড়ীর চোখ লাল হয়ে এলো, চোখে পানি টলমল করছে । শাড়ীর আঁচল টেনে চোখদুটো ভিজে উঠার আগেই মুছে নিলো। তারপর অতি দ্রুত বললো,
‘ পাগল হইয়া মরছে শিরিন।
‘ পাগল হইয়া?
হাঁ করে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার শাশুড়ী দিকে।
আরিদার শাশুড়ী কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘ হ্যাঁ একবারে আউলাইয়া গেছিলো শিরিন। চালচলন কাজকর্ম সব!
‘ কখন থেইকা এইটা?
‘ শুরু থেইকা শুনবা?
‘ অবশ্যই শুরু থেইকা শুনুম।
‘ শুনো তাইলে, রাইসা যখন পেটে আছিলো, তখন শিরিনের প্রায়ই পেটব্যথা করতো, ওষুধ খাইলে কমতো। আটমাসের সময় একদিন শিরিনের এমন ব্যথা করতেছিলো, ভাবছে ওষুধ খাইলে ঠিক হইয়া যাইবো। এদিকে রাফি, রাফান বাসায় বিরক্ত করে বইলা রাশেদ এদের নিয়া অফিসে গেছিলোগা, শিরিনরে কইছে ওষুধ খাইয়া ঘুমাইতে। ওরা বাসা লক কইরা চইলা গেলো। এদিকে বিছানায় যাওয়ার পরে ওর ব্যথা বাইড়া গ্যাছে, এতো বাড়ছে যে বিছানা থেইকা হেঁচড়ে ফ্লোর পর্যন্ত নামতে পারছিলনা,আর মোবাইল কই রাখছে সেইটাও খুঁইজা বিছানায় পায় নাই।
হঠাৎ রক্তক্ষরণ হওয়া শুরু হইছে, অসহ্য ব্যথা আর একা বাড়িত রাইসা জন্মাইলো, আর শিরিন জ্ঞান হারাইয়া ফ্লোরে পইড়া রইলো। কতক্ষণ পরে রাশেদ বাসায় আইলো,তাও আইতোনা,রাফানে হাগু দিয়া প্যান্ট নষ্ট কইরা লাইছিলো,তাই পরিষ্কার করতে আইছিলো। খোদা’তালার রহমত,নাইলে ওরা তখনি মইরা থাকতো। আইয়া এই অবস্থায় দেইখা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিছে, দুনিয়ার রিজিক আরো ছিলো বইলা দুইজনই বাঁইচা গেছে। রাইসারে দুইমাস NICU তে রাখছে, ৯০০ গেরাম ওজন আছিলো ওর। চোখও ফুটে নাই। রাইসা ঠিক হইয়া গেলেও শিরিন ঠিক হয় নাই, একা একা কথা কইতো,হাসতো,আর বাচ্চাগুলিরে হুদাই মারতো। মাঝরাইতে হুটহাট শিরিন ফোন দিয়া আমার কাছে মাফ চাইতো, কইতো মইরা গেলে যেন মাফ কইরা দেই। এমনটা আত্মীয় স্বজন সবার সাথেই করছে।
আরিদা ছলছল চোখে তাকিয়ে সব শুনছে। তার শাশুড়ী থেমে একটু দম নিচ্ছে। আরিদা ধাক্কা দিয়ে বললো,
‘ আম্মা এরপর কি আর ঠিক হয় নাই?
‘ হইছে! বছর দুই বছর পর ঠিক হইয়া গেছিলো। কিন্তু এরপর কারো লগে মিশতে চাইতোনা, বাড়িত আইলেও একা একাই থাকতো বেশি। হাঁটতো আর বিরবির কইরা কথা কইতো। কিন্তু আবার আমাদের লগে ব্যবহারের ত্রুটি ছিলোনা। যখন কথা কইতো ভালা কইরাই কইতো, কাজকামও ভালা কইরাই করতো। মনডা ছিলো কুসুমের মতো নরম, আচার-ব্যবহারও ভালা, জীবনেও আমাদের কষ্ট দিয়া কথা কয় নাই।
আরিদা কথার মধ্যে বললো,
‘ সুস্থ হইয়া গেলে আবার মরলো ক্যান?
তার শাশুড়ী বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। আর বলে উঠলো,
‘ রাহাদের জন্মের কারণে।
আরিদার মাথায় এলো,তাইতো! এতো বড় এক্সিডেন্টের পর আবার রাহাদ হয়েছে?
‘ আম্মা রাহাদও এইভাবে হইছে?
‘ না রাহাদ সিজারে হইছে। ভালাভাবেই হইছে। কিন্তু শিরিনের আগেরবারের সমস্যাডা এইবার বেশি মাথাচাড়া দিয়া উঠছিলো। মানুষের সামনে ভালাই থাকতো, কিন্তু একা হইয়া গেলেই জোরে জোরে কানতো,কিছু হইলেই বাচ্চাগুলিরে মাইরা পিঠের ছাল তুইলা ফেলতো। একলা একলা এমন কইরা কথা কইতো যেন কেউ ওর কথা শোনার লাইগা সামনে বইসা থাকে।
‘ এইগুলা ক্যান করতো? ডাক্তার দেখায় নাই?
‘ দেখাইছে, ডাক্তার কইছে পোস্টপার্টাম সাইকোসিস নামে কিছু একটা । বাচ্চার জন্মের পরে নাকি মা’দের অনেক সমস্যা হয়, আর এইটা নাকি কম মানুষেরই হয়। আবার সেই কম মানুষের ভিত্তেও এতো লক্ষণ নাই যা শিরিনের মধ্যে আছিলো, মানসিক রুগি বলতে গেলে ও পাগল হইয়া গেছিলো। বাচ্চাগুলিরে সহ্য করতে পারতোনা, খালি একলা থাকতে চাইতো, আর সুযোগ পাইলে নিজেরেও আঘাত করতো। সহজ সরল শিরিন, যে কোনোদিন ঘরের বাইরে একলা পাও রাখেনা,সে একদিন বিষ কিনবার লাইগা এক দোকানে চইলা গেছিলো, ওই দোকানি রাশেদরে চিনে বইলা সেই খবর পাইছে, এরপর বাসায় আনছে। দিনদিন পাগলামি বাড়ছিলো, মাঝেমইধ্যে বুঝাইয়া সামলানো যাইতো আর মাঝেমইধ্যে এতো বাইড়া যাইতো যে ডাক্তারের কাছে নিয়া ইনজেকশন দিয়া শান্ত করা লাগতো। কিন্তু অইদিন শিরিনের মারাত্মক জ্বর ছিলো লগে পাগলামির মাত্রা এতো বেশি আছিলো যে সবাইরে আক্রমণ করতেছিলো, ডাক্তার তাকে প্রথম একটা ইনজেকশন দিলো যা আগে দিতো(আ্যান্টিসাইকোটিক ইনজেকশন), কিন্তু থামলোনা, ওরে সামলানো যাইতেছিলোনা পরে আরেকটা ইনজেকশন দিলো ( সিডেটিভ বা ট্র্যাঙ্কুইলাইজার ইনজেকশন) দেওয়ার কিছুক্ষণ পর থেমে গেলো। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লো। সবাই শান্ত হইয়া বয়লো, যেন একটু স্বস্তি পাইছে। কিন্তু এরপরই দেখলো শিরিন একবারে ঘুমায়া পড়ছে, তার পেটে নিঃশ্বাসের উঠানামা নাই। নাই নাই একবারেই নাই। আমরার শিরিন আমরারে আর তার চাইরটা বাচ্চারে,দুইমাসে দুধের বাচ্চা রাহাদরে রাইখা একবারে চইলা গেলো।
আরিদার শাশুড়ীর চোখ নাক দিয়ে গড়গড়িয়ে পানি পড়ছে। শিরিনকে যে অনেক ভালোবাসতো স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। আরিদার চোখ বেয়েও পানি পড়ছে, আহ! বাচ্চাগুলো। মার সাথে শেষে তাদের ভালোর সাথে কতো খারাপ স্মৃতি জমা আছে! তারা তো যাই হোক কিছু হলেও মার স্মৃতি মনে করতে পারবে কিন্তু কিন্তু রাহাদ তো মনেই রাখতে পারবেনা তার মায়ের মুখটা কেমন ছিলো!
না না আরিদা কখনোই তাদের ওইরকম করে রাখবেনা যাতে তারা নিজের মাকে হারানোর আক্ষেপে চোখের জল ফেলে!
ছায়ার মুখোশ পর্ব ১০
কিন্তু! কিন্তু! সবকিছুতে রাশেদের দোষ কোথায়? জিনিসগুলো যেভাবে শুনেছে তাতে নির্দিষ্ট করে কাউকেই দোষ দেওয়া যাবেনা। যদি তাই হয় সবাই এতো লুকোচুরি করবে কেন? তার শাশুড়ীর আচরণও তো ঠিক ছিলোনা। রাশেদই বা কেন এসবকিছু বারবার চাপিয়ে যাবে? আর ফয়সালই বা কেন এতো ক্ষুদ্ধ আর প্রতিশোধপরায়ণ হবে?
ফয়সালের সাথে কথা বলা জরুরি।
আরিদা তার শাশুড়ীকে বললো,
‘ আম্মা উডেন, আপনার পোলারে সামলায়া ওদের খুঁইজা বার করতে হইবো।