ছায়ার মুখোশ পর্ব ১৬

ছায়ার মুখোশ পর্ব ১৬
তাজরীন খন্দকার

আমরা সবাই-ই কোনো না কোনো কারণে মুখোশ পরে থাকি,হয়তো সেই মুখোশের আড়ালে কারোর অতিমাত্রায় ঘৃণ্য গল্প লুকিয়ে থাকে আর কারোরটা অতি সামান্য। প্রয়োজন না হলে কেউই নিজেকে প্রকাশ করিনা৷ যা চলে গেছে তাতো গেছেই,তার জন্য নিজেকে ছোট করে লাভ কি?
‘ আপনি কি আর কিছু কইবেন না?
আরিদার কথায় রাশেদ থতমত খেলো, ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,

‘ শুরু যখন করছি, শেষও করুম। এমনেও বউয়ের
সান্নিধ্য পাই না, ভালো সাইজা থাইকা লাভ নাই। সব বইলা একেবারেই ধ্বংস হইয়া যামু । আর আমার বুকেও পাথর চাইপা আছে, অনেক চেষ্টা করি তোমারে সব কইতে কিন্তু কওনের সাহস হয়না। তোমার চোখের দিকে তাকাইলে আমার ভয় হয়। আমি টের পাই এই চোখ আমার মতো ঘৃণ্য পুরুষরে ক্ষমা করবোনা।
কথাটা শুনেই আরিদার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। ঘৃণ্য পুরুষ? দাঁড়িয়ে থেকে আরিদার পা ধরে এসেছে। শরীরেও তেমন শক্তি পাচ্ছেনা, মাথাটাও কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। সে জানেনা সে কি শোনার অপেক্ষায় আছে! আদৌ সব সহ্য করতে পারবে কিনা!? তাই গিয়ে পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো আর বললো,
‘ মানতাসার পথ যদি আলাদাই হইয়া থাকে,তাইলে তার লগে আবার কেমনে যোগাযোগ হইলো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ মানতাসা? আমি তো শিরিনরে পাওনের পর মানতাসারে ভুইলাই গেছিলাম। যেটুকু মায়া ছিলো সেটা বুকের এক কোণে চাপা পইড়া গেছিলো। কিন্তু তাও আমি অজানা ক্ষোভে টাকার পাহাড় বানানোর চেষ্টায় আছিলাম।
আমার দুই ছেলে রাফি আর রাফানের জন্মের পরে শিরিনরে আমি আরো বেশি ভালোবাসতাম। সে সবকিছু এতো গুছাইয়া পরিচালনা করতো যে অবাক হইতাম। তার কোনো কাজেই ত্রুটি আছিলোনা! সবাইরে সমানে খুশি রাখনের চেষ্টা করতো, আমার পরিবারের কেউ তার থেইকা সুঁতা পরিমাণ কষ্টও কোনোদিন পায় নাই। নিজেরে ভাগ্যবান মনে হইতো,কারণ পৃথিবীর বুকে থাকা সবচেয়ে রূপবতী আর গুণবতী মানুষটা আমার।
কিন্তু হঠাৎই সব আউলাইয়া গেলো। সাথে আউলাইয়া গেলাম আমিও।

একদিন আমার নাম্বারে বিদেশি নাম্বারে একটা ফোন আইলো, কান্নাজড়ানো গলায় কইলো, আরিয়ানের সাথে তার ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছে সে মানসিকভাবে ভাইঙা পড়ছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে মানতাসা আমারে ফোন দিছে! যার লাইগা একসময় চিৎকার কইরা কইরা কানছি,যার বিয়ার কথা শুইনা ২০ টা ঘুমের ওষুধ খাইয়া মৃত্যুর ঘাট দেইখা আইছি, সে আমার কাছে মানসিক শান্তি চাইতাছে!
এইটুকু শুনতেই আরিদার সারা শরীর কেমন যেন রিরি করে উঠল! সে রাশেদের থেকে চোখ নামিয়ে ফেললো।
কিন্তু রাশেদ থামলোনা, বলতে লাগলো,
‘ মানতাসা কই থেইকা আর কেমনে আমার নাম্বার সংগ্রহ করছে জানিনা,কিন্তু আমি তার কান্নায় একদম গইলা গেলাম। আমার ভেতরে সেই ২২ বছর বয়সের আবেগ জাইগা উঠলো, আমার বুকের কোণে চাপা পড়া অনূভুতি আবার সতেজ হইয়া গেলো। আমি সব ভুইলা গেলাম, ভুইলা গেলাম আমার ঘরে থাকা দুইটা বাচ্চার আদুরে মুখ, ভুইলা গেলাম আমার সংগ্রামী লক্ষী স্ত্রীকে, যার আগমনে আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেছিলো। আমি সারাক্ষণ মানতাসার সাথে কথা কওয়ায় ব্যস্ত হইয়া পড়লাম। আমার কেবল তার লগে কথা কইলেই শান্তি লাগতো। বিকৃত এক শান্তি!

এভাবে চলতে চলতে তার লাইগা আমার হৃদয় এতটাই আকুল হইলো যে তারে আমি দেশে নিয়া আইলাম। তার নামে বিশাল ফ্ল্যাট কিইনা দিলাম, তারে খুশি করতে আর আমার যোগ্যতা দেখাইতে দুইহাতে টাকা উড়াইতে লাগলাম। টাকা খরচ কইরা তখন পৈচাশিক আনন্দ হইতো, এই সেই টাকা যার লাইগা তারে হারাইছিলাম! আবার তার লাইগাই সব কুড়াইছি! তার বাপেরেও সেই যোগ্যতা দেখাইতে গেছিলাম, কিন্তু তার বাপও আমার বাপের মতো, বিছানায় পড়া, তার আবার বোধশক্তিও নাই। মানুষই চিনেনা সে! এতে বড় দুঃখ পাইছিলাম! সে অসুস্থ বইলা এই দুঃখ লাগে নাই, তার কাছে নিজেরে চিনাইতে না পারার লাইগা অনেকদিন কইলজা পুড়ছে!
তাতে কি? মানতাসা আমারে এতটাই ভুলায়া রাখছিলো যে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নিজেরে মনে করতাম। চলতে লাগলো আমাদের অবৈধ সম্পর্ক।
রাশেদ কথা বলতে বলতে আরিদার চোখেমুখে চরম ঘৃণার চাপ দেখতে পেলো। সে তার দিকে তাকাচ্ছেও না। কিন্তু পরক্ষণেই রাশেদ চোখ নামিয়ে নিলো, এই ঘৃণা তার প্রাপ্যই!
সে আবার বলতে লাগলো,

‘ হাহাহাহা হারানো ভালোবাসা ফিরা পাইয়া কি খুশি আমি!মনে হইতেছিলো আমি যেন মানতাসার ফিরা আওনের অপেক্ষাতেই আছিলাম, মধ্যে দিয়া কেবল নিজের প্রয়োজন মিটাইছি। কিন্তু তাতে যে আবার দুই সত্তা বিস্তার করতাছে, তা তো আর ফালাই দিতে পারি না, তাই মন চাইলে বাসায় যাইতাম নাইলে যাইতাম না, গেলেও মাঝ রাইতে যাইতাম, ভোরে বের হইয়া আইতাম।
শিরিনরে দেখলে আমার কেমন যেন লাগতো, তখন পাপবোধটা জেগে উঠতো তাই ওর মুখোমুখিও হইতে চাইতাম না। চোরের মতোন সাংসারিক সব জিনিসপত্র নিয়া যাইতাম আর যত দ্রুত পারতাম চইলা আসতাম। কিন্তু এর মধ্যে শিরিনের পেটে যে আমার আরেক সন্তান বাইড়া উঠছিলো তা আমার জানা ছিলোনা। জানা থাকবো কেমনে? আমারে জানানোর মতন সময়ও শিরিন আমার কাছে পায় নাই। আমি শুধু মনে করছিলাম শিরিন মোটা হইতাছে! কিন্তু মানতাসা আমার জীবনে ফিরা আওনের আগেই হয়তো সেই ছোট্ট প্রাণ তার ভেতরে আইসা গেছিলো৷ যখন শিরিন তা জানতে পারছে তখন আর আমারে কাছে পায় নাই।

আমার এই বদলাইয়া যাওয়া শিরিন কেমনে সহ্য করছে জানিনা,ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণার পাহাড় হইছিলো বোধহয়, যার প্রভাব আমার সন্তানের উপর পড়ছে তাই সময়ের দেড়মাস আগেই দুনিয়ায় আইয়া পড়ছিলো। এদিকে আমি এই ঘটনার এক সপ্তাহ আগে জানছিলাম শিরিন গর্ভবতী।
হঠাৎ একদিন সকালে নাস্তা না কইরাই বের হইয়া যাইতেছিলাম, দেখলাম শিরিনের গায়ে ওড়না নাই, সে পেটে হাত দিয়া চাপ দিয়া ধইরা আছে, আমি অবাক হইয়া গেলাম তারে দেইখা। প্রশ্ন করলাম, ‘ শিরিন তোমার পেট এতো বড় ক্যান? গ্যাস নাকি?
শিরিন আমার দিকে না তাকাইয়াই বলছিলো,
‘ কোনটা গ্যাস আর কোনটা কি তা রাফি রাফানের সময় দেখেন নাই?
আমার সারা শরীর শিউরে উঠছিলো। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এইটা কি শুনছি! নিজেরে অপরাধী মনে হইলো। সেইদিন আর আমি কোথাও যাই নাই। সারাদিন শিরিনের লগে ছিলাম, কাজ নিয়া নানান রকম অজুহাত দিলাম, এতগুলো মাস তার লগে আমার সম্পর্কের স টুকুও নেই অথচ আমার বানানো সব অজুহাত বিশ্বাস কইরা নিলো,কতো সরল ছিলো আমার শিরিন!

রাফি, রাফান পেটে থাকতে আমি শিরিনের যথেষ্ট খেয়াল রাখতাম,ভারী কাজে হাত লাগাইতে দিতাম না। কিন্তু এইবার আমি জানিইনা? সেই অপরাধবোধ থেইকা এক সপ্তাহ আমি ওর কাছাকাছিই ছিলাম, শুনলাম শুরু থেইকাই তার মারাত্মক পেটব্যথা করে, কোনোদিন আমারে কইলোওনা, ডাক্তারও দেখাইলোনা। তারই ৮ম দিন রাফি রাফানরে লইয়া বের হইলাম, শিরিন বিশ্রাম চাইতেছিলো, কিন্তু যাওয়ার লগে লগেই একা বাসায় তার প্রসব হইলো, তাদের দুজনের এই গুরুতর অবস্থায় আমি মানতাসারে পুরোপুরি এড়ায়া গেলাম। শিরিন আমারে আবার পাশে পাইয়া সব ভুইলা গেলো, সে জানলোওনা তাকে আমি কতো বড় ধোকা দিছি! ধীরে ধীরে তারা সুস্থ হইলো, কিন্তু আমি আবার অসুস্থ হইয়া যাইতে লাগলাম। আমি আবারও মানতাসার ফাঁদে পা দিলাম, আমি কোনোভাবেই সেই মায়াজাল থেইকা বাইর হইতে পারলাম না। আম্মা মাঝেমধ্যে আমার বাসাত আইলে, বা আমরা গেলে কইতো শিরিন কেমন জানি হইয়া গেছে, একা একা কথা কয়! আমি পাত্তাই দিতাম না৷ বাচ্চাদের মারতো জানতাম, বাচ্চাদের মায়েরা মাইরাই থাকে, ছোটবেলায় আম্মাও আমরারে অনেক মারছে।

ওইদিকে মানতাসা আমার বউরে তালাক দিয়া ওরে বিয়া করার লাইগা প্ররোচিত করতো। কিন্তু শিরিনরে ছাইড়া দেওয়ার শক্তি সাহস কোনোটাই আমার আছিলোনা। এসব নিয়া মানতাসার লগে প্রায়ই ঝামেলা হইতো, কথা বন্ধ কইরা দিতাম। তখন আমি শিরিনের কাছে আইতাম। শিরিন আমারে সাদরে গ্রহণ কইরা নিতো। আবার যখন মানতাসার টাকার প্রয়োজন হইতো, আবার আমারে কীভাবে জানি ভুলায়া ফেলতো। আমি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছিলাম আমি জানিনা। আমার এমন দুটান পরিস্থিতি, শিরিনের খারাপ মানসিক অবস্থা কয়টা বছর কাইটা গেলো।

আমাদের এমনি এক বেখেয়ালিতে শিরিন আবারও কীভাবে কন্সিভ কইরা ফেললো দুজনের কেউ জানিনা। প্রথমবার আমি শিরিনের লগে মারাত্মক রাগারাগি করছিলাম,নষ্ট কইরা দিতেও কইছিলাম কিন্তু সে করে নাই। আগেরবারের অবস্থার লাইগা আমার ভয় হইতেছিলো,কিন্তু সে কইলো কিছুই হইবোনা আর। পরে আমিও মাইনা নিছিলাম বিষয়ডা। কিন্তু এটা শোনার পরে মানতাসা আমার লগে অসহ্যরকম খারাপ আচরণ শুরু করে, সে মানতেই পারেনা তার সাথে থেকেও আমার বউয়ের কীভাবে বাচ্চা হয়!? বিয়ে না করি কিন্তু সে শর্ত দিছিলো আমার বউয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা না হোক। কিন্তু শিরিনের কাছাকাছি গেলে আমি দুনিয়ার সবই ভুইলা যাইতাম, আর একটু সইরা গেলেই পাপের দুনিয়ায় রাজ করতাম।

মানতাসা এবার আমারে দুইটা অপশন দিলো, যেকোনো একজন। হয় তারে নয়তো বউরে। ভাবছিলো আমি তারেই বাইছা লমু, কিন্তু আমি ততদিনে আমার সুখের জীবনটারে যে আমি নিজ হাতে একটু একটু কইরা ধ্বংস কইরা ফালাইছি তা হারে হারে বুঝতে পারছিলাম, তাই আমি বাইছা নিলাম যেকোনো একজন। শিরিন! আমি আমার ঘরে জান্নাত রাইখা বাইরের জাহান্নামে পুড়ছি! নিজেরে যথেষ্ট শক্ত আর সংযত করলাম। কেননা যতদিন শিরিনরে মনেপ্রাণে ভালোবাসছিলাম দুজন দুজনের সুখ দুঃখের ভাগিদার আছিলাম কেবল ততদিনই আমার জীবনডা সত্যিকার অর্থে সুখী আছিলো। মানতাসা তো কেবল মোহ!
কিন্তু যখন আমি শিরিনরে বাইছা লইলাম আর ওরে ত্যাগ দিলাম তখন মানতাসা আর এইটা মানতে পারলোনা। সে ঠিক আজকের মতোই একদিন আমার বউয়ের সামনে গিয়া সব বইলা দিলো।

চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা শিরিন ওইদিন সেন্সলেস হইয়া গেছিলো। এরপর আমারে আর ক্ষমা করে নাই! বাচ্চা হওনের আগ পর্যন্ত আমি তার তার পাশে ছায়ার মতো লাইগা আছিলাম, কিন্তু তারে আর খুশি হইতে দেখি নাই। আমার সামনে নিজেরে গুটায়া রাখতো, শুইয়া থাকতো। আমি প্রায়ই বালিশ ভেজা পাইতাম। আর একা হইলেই তার নিজের সব ক্ষোভ বাচ্চাদের উপর ঝাড়তো, অনেক মারতো! বাচ্চাগুলো ভয়ে ওর কাছে যাওয়া ছাইড়া দিলো। আমি পুরোপুরি অসহায় ছিলাম,কতশতবার মাফ চাইছি, তার হিসাব নাই। আমার মাফ চাওয়ায় বিরক্ত হইয়া কইতো আমার উপ্রে অভিযোগ নাই। কিন্তু আমি বুইঝা গেছিলাম আমার উপর তার পাহাড়সমান অভিযোগ। আমি চাইতাম সে আমার উপর চিল্লাক, দরকার হইলে বাচ্চাদের না মাইরা আমারে মারুক,কিন্তু আমার সাথে শিরিন ভালো খারাপ সব ব্যবহারই ছাইড়া দিলো। এতগুলো বছর আমারে ভরসা কইরাই যে সে ভুল করছে সে হয়তো তার লাইগাই ভেতরে ভেতরে প্রায়শ্চিত্ত কইরা মরতেছিলো! আর আমি প্রতিদিন মরতেছিলাম ক্ষমা না পাওনের আক্ষেপে!

তবে আমি এর উপযুক্তই আছিলাম। আমার মতো পাপীর ক্ষমা হয় নাকি?
তারপর নয়মাসের সময় এক ক্রিটিকাল অবস্থায় অস্ত্রোপচারে রাহাদের জন্ম হইলো, তখন থেইকা সে পাগলই হইয়া গেছে বলা যায়। কতো চেষ্টা! কতো চেষ্টা! কোনোভাবেই তারে কেউ স্বাভাবিক করতে পারে নাই। ডাক্তার কইছিলো তারে সময় দিতে, ভালো পরিবেশ দিতে, তাই দিছিলাম। রাহাদের জন্মের পরে শহরে যাই নাই, ফাইজাই পালতো রাহাদরে। আম্মা বাকিসব করতো। আমি বাড়িত থাকতাম আর আমি শিরিনরে সময় দিতাম। কিন্তু আমি যে আশেপাশে আছি শিরিন এইটা মনেই করতোনা। কেউ আশেপাশে থাকলে সে মারাত্মক বিরক্ত হইতো। বাচ্চাদের পাইলে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হিংস্র হইয়া উঠতো।কিন্তু আশেপাশে কেউ না থাকলে সে মনে করতো কেউ আছে, একলা একলা কথা কইতো, হাসতো! কতো কথা তার ভিতর!

দূর থেইকাই দেখা যাইতো কিন্তু কেউ কাছে গেলেই তা বন্ধ হইয়া যাইতো। মাঝেমইধ্যে এমন করতো যে মনে হইতো যে তার উপর অন্য কিছু আছর করছে। গ্রামের সকলে এইটাই বলাবলি করতো। কিন্তু সত্যিটা আমরা জানতাম। এইভাবেই দুইমাস গেলো, শিরিন আর সুস্থ হইলোনা। সেদিন ১০৬° জ্বর,তাও তার গায়ে এতো জোর আছিলো যে পারছিলোনা হাসপাতালের সব ভাইঙাচুইরা গুঁড়া কইরা দেয়! তারে একটা ইঞ্জেকশনে কাজ হইতেছিলোনা পরে আরেকটা পাওয়ারফুল ইঞ্জেকশন দিলো আর তাতেই তার সব পাগলামি থাইমা গেলো, সাথে থাইমা গেলো তার নিঃশ্বাসও! শিরিনের হার্টে সমস্যা আছিলো, যা আমাদের জানা ছিলোনা। আর তার লাইগাই সেই ইঞ্জেকশন মৃত্যুর কারণ হইয়া দাঁড়াইছে। এর আগের কোনো টেস্টে তা ধরা পড়ে নাই, সেবার পরিস্থিতি এতো বেসামাল আছিলো যে টেস্ট কইরা চিকিৎসা দেওয়ার উপায় ছিলোনা, আগের সবকিছু দেইখা ইমারজেন্সি চিকিৎসা দেওয়া হইছিলো, আর তাই কাল হলো শিরিনের। আমারে ক্ষমা না কইরাই চিরদিনের জন্য চইলা গেলো।
রাশেদ থামলো, আর কাঁদতে লাগলো। আরিদার হাত পা থরথরিয়ে কাঁপছে। সে সেই কাঁপার মধ্যে বললো,

‘ তারপর?
রাশেদ চোখ মুছতে মুছতে বললো,
‘ তারপর তো তুমি জানোই।
আরিদা নাকের পাঁপড়ি ফুলে উঠলো, রক্তিম চোখ,এলোমেলো চেহেরা। শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে টেবিলে আঘাত করে বললো,
‘ তারপর আমারে বিয়া করলেন ক্যান? ক্যান বিয়া করলেন হ্যাঁ? ক্যান আপনার পাপী জীবনে আমারে জড়াইলেন?
রাশেদ পিঠ দিয়ে ঠেলে চেয়ার পেছনে সরাতে লাগলো, আরিদাকে তার ভয় লাগছে। আরিদা আবারও জোরে টেবিলে থাপ্পড় মারলো, এতটাই জোরে দিলো যে তার হাত লাল হয়ে গেলো,যেন আরেকটু হলে তা ফেটে রক্ত পড়তো! রাশেদ ভয়ে জুবুথুবু হয়ে বললো,

‘ আমি চাই নাই। আমি আমার জীবনে আর কিছুই চাই নাই। শিরিনের মরনের পর মানতাসা আমারে বিয়ার প্রস্তাব দিছিলো, যার অপেক্ষায় সে আছিলো। আমি রাজী হই নাই। আমি পাপের প্রায়শ্চিত্ত কইরাই বাকি জীবন কাটাইয়া দিতে চাইছিলাম, কিন্তু আম্মা চায় নাই, বাচ্চাগুলির দোহাই দিয়া আমারে নতুন কইরা শুরু করতে কইছিলো। গরীব দেইখা বিয়া করাইলো যেন সবকিছু মাইনা নিতে পারে।
আর আমি নিজেরে স্থির করলাম আর কাউরে ঠকামুনা, ভেতরের কষ্ট ভেতরেই থাকুক, কিন্তু যে আমার জন্য আইছে তারে সবটা দিয়া সুখী রাখুম।

কিন্তু আম্মা নিজে বিয়া করাইয়া নিজেই আবার অন্য রকম হইয়া গেলো, বউয়ের থেইকা আলাদা রাখতে চাইলো। আম্মা চায়না আমার আর সন্তান হোক,এই বাচ্চাগুলির কথা চিন্তা কইরা হয়তো। আবার হইতে পারে শিরিনের পোস্টপার্টামের ভয়ংকর অবস্থা দেইখা, হয়তো ডর ঢুইকা আছে। বাচ্চাগুলি ছোট, এখন বাড়তি চাপ নিতে পারবানা। শিরিনের মরনের পর ঘরের সবাই অন্য রকম হইয়া গেছে, আচরণও কেমন রূঢ়। তাই ভালা কইরা নিজেও কইলোনা তোমারে, আমারেও কইতে দিলোনা। কইলো মাইয়া মানুষরে কিছু কইলেই বিপদ, গোড়া খুঁইজা বাইর করবো। আর সবচেয়ে বড় কথা, উপরে ভালা দেখাইলেও ভেতরে ভেতরে আমারেই ঘরের কেউ ভালা পায়না, ঠেকায় পইড়া আমার পক্ষ লয়। আর আম্মা তো মানতাসার ব্যপারডা শুরু থেইকা শেষ পর্যন্ত জানে তাই অপরাধীর মতো আম্মার সামনে সবসময় ভীত থাকি। আমার আম্মা খারাপ মানুষ না আরিদা!
আরিদা একদৃষ্টে টেবিলের উপরে থাকা চামচগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। রাশেদের কথা থেমে যেতেই সে সেখান থেকে একটা কাঁটাচামচ তুললো, টেবিলের উপরে রাখা রাশেদের হাতের দিকে দুই সেকেন্ড তাকিয়ে আচমকা চামচটা তার হাতের উপর জোরে বসিয়ে দিলো আর গর্জন করে বললো,

‘ কিন্তু আপনি একটা খারাপ মানুষ! নিকৃষ্ট আর বিবেকহীন। কেমনে পারলেন এমন একটা নিষ্পাপ মানুষরে ঠকাইতে, কেমনে পারলেন হ্যাঁ? কেমনে পারলেন?
টাটকা রক্ত ছিঁটকে পড়তে লাগলো, টেবিলের একাংশ লাল হয়ে ভেসে আবার ফ্লোরে টপটপ করে পড়তে লাগলো। আরিদা দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। এটা কি করেছে সে? কীভাবে করেছে? আরিদা প্রচন্ড রাগে হুশ হারিয়ে ফেলেছিলো। কিন্তু রাশেদ একটা টুঁ শব্দও করলোনা, দাঁত খিঁচিয়ে চামচটা নিজের অন্য হাতে তুললো।
আরিদা পিছিয়ে যেতে যেতে বললো,

ছায়ার মুখোশ পর্ব ১৫

‘ বুঝতে পারি নাই, পারি নাই,কীভাবে করলাম!
রাশেদ পাশ থেকে টিস্যু টেনে নিয়ে হাতে চেপে ধরে বললো,
‘ কাঁটাচামচ না নিয়া ফলের লগের ছুড়িটাই নিয়া বুকে বসায়া দিতা, আমি হাসতে হাসতে নষ্ট জীবন থেইকা মুক্তি নিতাম।

ছায়ার মুখোশ শেষ পর্ব