ছায়ার মুখোশ পর্ব ৮

ছায়ার মুখোশ পর্ব ৮
তাজরীন খন্দকার

শিরিন শুধু আমার স্ত্রী ছিলোনা আমার সন্তানদের মাও ছিলো, আমি কি কইরা তারে মাইরা ফেলতে পারি?
আরিদা রাশেদের দিকে তাক করা তার শক্ত চাহনিটাকে শিথিল করলো। কিন্তু সন্দেহ কাটলোনা, আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করলো,
‘ যদি কিছু নাই কইরা থাকেন, আপনার শালা আপনারে অপবাদ দিতাছে ক্যান? দোষ দেওয়ার কোনো না কোনো কারণ তো থাকবোই।
রাশেদ সামনে পড়ে থাকা একটা শুকনো লাকড়িরকে পা দিয়ে জোরে লাথি মেরে বললো,
‘ হ কারণ আছে, সেইটা হইলো গিয়া আমার এই কপাল। আমার কপালদোষ সব! কপালদোষে জীবনের সবচেয়ে দামী মানুষটারে হারাইছি আর এর মিথ্যা দায় নিয়া ঘুরতাছি, কারে কমু, কে বুঝবো আমারে? এখন খালি তুমিই বাকি আছো আমার বিরুদ্ধে যাওয়ার, যাও পারলে তুমিও আমার নামে একটা মামলা দেও।
আরিদা উত্তর দিলো,

‘ অপরাধ যদি কইরাই থাকেন, মামলা ক্যান প্রাপ্য সাজা পাওনের আগ পর্যন্ত বিরুদ্ধেই থাকুম। আর নির্দোষ হইলে পুরো দুনিয়া আপনার বিরুদ্ধে গেলেও আমি আপনার পাশে থাকুম।
রাশেদ চুপ থাকলো। তারা সোজা সামনের দিকে হাঁটছে। রাশেদ ফয়সালের এসব কথায় বেশ বিব্রতকর অবস্থায় আছে। রাশেদের মাথা যে গরম বুঝা যাচ্ছে, এই মূহুর্তে কিছু জানতে চাইলে ঠিকঠাক উত্তর দিবেনা। তাই আরিদা আর প্রশ্ন করতে চাইলোনা, হাতে অনেক সময় আছে, মাথা ঠান্ডা থাকলে সবকিছুর কৈফিয়ত নিবে।
হাঁটার মধ্যে হঠাৎ তাদের সামনে টুপ করে একটা শিমুলফুল ঝরে পড়লো, একেবারে সতেজ নির্মল। রাশেদের বিষাদময় চেহেরায় একটা হাসি ফুটে উঠলো সে সাথে সাথে নুইয়ে ফুলটা তুলে আরিদার দিকে বাড়িয়ে বললো,
‘ বিরুদ্ধে যাও আর সমর্থন করো শুধু আমারে ছাইড়া যাইয়োনা।
আরিদা ফুল হাতে নিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ আল্লাহ যদি বাঁচায়া রাখে আমি আমার চার সন্তানের ছায়া হইয়াই থাকুম ৷ চিন্তা করনের কারণ নাই। এখন পকেট থেইকা আমার ফোনটা দেন৷ দেখি কি আনছেন?
রাশেদের মুখটা খুশিতে ঝলমল করছে, তাড়াতাড়ি করে ফোনটা আরিদার হাতে দিলো। আরিদা ফোন হাতে নিতে নিতে রাশেদের দাঁত বের করা হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ অত খুশি হওনের কিছু নাই, আমি আপনার ছায়া হমু বলি নাই।
রাশেদ হাসি থামালোনা, উল্টো হাসির সাথে শব্দ যোগ করে বলতে লাগলো,
‘ ওই একই, বাচ্চা মানেই লগে আমি আছি। বয়স হইতে পারে মনডা এখনো বাচ্চাই আছে।
আরিদা নিজের হাসিকে জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ করে ক্যামেরা অন করলো,নিজের জোড়াভ্রু দুটো কুঁচকে সেল্ফিতে রাশেদকে পেছনে রেখে বললো,

‘ হাসি দেন!
রাশেদ মুখ বাঁকিয়ে বললো,
‘ আগে নিজেরে দেখো, মুখটা হুতুমপেঁচার মতন কইরা রাখছো।
আরিদা কিঞ্চিৎ হাসলো আর সোজাসুজি তাকিয়ে একটা ছবি তুললো। যেন ভোটার আইডিকার্ড বানাবে! তারপর সামনের গাছগুলোর একটা ছবি তুললো আর ফোনটা ব্যাগে রেখে দিলো। রাশেদ আস্তে করে এসে আরিদার হাত ধরে বললো,
‘ কক্সবাজার যাবা? তুমি, আমি, সমুদ্র, আর আমার বুকের মধ্যে চাইপা রাখা কিছু দুঃখবিলাস করবো!
আরিদা মারাত্মক অবাক হয়ে রাশেদের দিকে তাকালো। কক্সবাজার? এতো আরিদার স্বপ্ন! টিভিতেই কেবল মাঝেমধ্যে দেখেছে, বাস্তবে সমুদ্র কেমন হয় আরিদা জানেনা। সে অবশ্যই যাবে, রাশেদের দুঃখবিলাস শুনতে হলেও যাবে । কিন্তু সেটা না বলে আরিদা বললো,

‘ আম্মা রাজী হইবোনা।
‘ আম্মারে আমি রাজী করামু, দুই তিন দিনেরই বিষয়, আম্মা রাজী হইবো।
‘ বাচ্চাদের রাইখা যাবেন?
‘ ধইরা নাও এইটা আমাদের হানিমুন। পরে কোনো সময় পরিবার লইয়া যামু। এবার শুধু দুজন যামু।
আরিদা কিছু বলতে চেয়েও বললোনা। দুজনেই চুপচাপ ।
কোকিলের কুউহু কুউহু আওয়াজ কানে আসছে। অন্য পাখিরাও উড়াউড়ি করছে। রোদ থাকলেও রোদের উত্তাপ গাছপালা পার করে গায়ে ঠেকছে না। আর একটা মৃদু বাতাস হাঁটার তালে তালে গায়ে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। রাশেদ আরিদার হাত ধরে আছে, আরিদা আর ছাড়ানোর চেষ্টা করছেনা। তাদেরও কিছু একান্ত সময় দরকার, যা স্মৃতির পাতায় জমা রাখা যাবে। বৃদ্ধ বয়সে মনে করে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠবে!

বিকাল ৫ টায় তারা বাড়িতে গেলো। তাদেরকে পেয়ে বাচ্চারা আনন্দে হৈচৈ শুরু করে দিলো। আরিদা রাহাদকে কোলে নিতেই তার বুকের ভেতরটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। উফফ! তার সন্তান। ওরা তাকে মা ডাকে, এর চেয়ে শান্তি আর কিসে হতে পারে। নিজের অনাগত সন্তান হারিয়ে একটা সন্তানের জন্য কতো হাহাকার ছিলো তার! তাই আল্লাহ তাকে চারটা সন্তান একবারে দিয়ে দিছে। রাইসা রাফান আরিদার কাপড় ধরে টানাটানি করছে,তারাও যেন পারলে কোলে উঠতো!
রাশেদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে আর ভাবছে যে তার সন্তানদের হৃদয়ের এতো কাছে স্থান দিয়েছে তাকে দুনিয়ার সব কিছু এনে পায়ের কাছে ঢেলে দিলেও সেটা কম হবে!
আরিদার শাশুড়ী আরিদাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ বউ আর তাড়াতাড়ি বাড়িত যাওন যাইবোনা। লাগলে ওরা আইয়া দেইখা যাইবো। সবগুলা বাচ্চা কাল থেইকা মাথা খারাপ কইরা দিতাছে।
আরিদা রাশেদের দিকে তাকালো, রাশেদ টেবিলের চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে হাতের নখ খুঁটছে। তার মায়ের কথা শুনেই মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চেহেরা জানান দিচ্ছে বউকে কথা দিয়ে এসেছে, এখন মাকে রাজী করাতে না পারলে মানসম্মান থাকবেনা।

আরিদা হাসছে, কারণ সে আগেই জানতো এটা কোনোদিনও হবেনা। বিয়ের এই কয়দিনে তার শাশুড়ীকে তার ভালোই চেনা হয়ে গেছে। এরপরও দেখা যাক মায়ের বাধ্য ছেলে কি করতে পারে!
অন্যদিকে ফাইজা স্ক্রিনে তাকাচ্ছে আর তাদের সবার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু কিছু বলছেনা, বুঝা যাচ্ছে সে এখানে থাকলেও তার মনোযোগ এখানে নেই। দিনদিন মেয়েটা অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে।
রাত সাড়ে ন’টা। আরিদা সেই আগের মতো রাহাদকে ফাইজার রুমে ঘুম পাড়াচ্ছে। আর রাশেদ বাচ্চাদের নিয়ে তার রুমে। হঠাৎ আরিদার ফোন বেজে ওঠলো। ফাইজা প্রথমে নিজের ভেবে তাড়াতাড়ি নিজের ফোনে তাকালো এরপর আরিদার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ এই রুমে কার মোবাইল বাজতাছে?
আরিদা রাহাদকে কোলে নিয়ে ব্যাগ থেকে নিজের ফোনটা বের করতেই ফাইজার মুখটা হাঁ হয়ে গেলো। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে আরিদার ফোন হাতে নিয়ে বললো,
‘ আরেহ স্যামসংয়ের এস সিরিজের ফোন পাইলেন কই?
আরিদা ফোনটা আনার চেষ্টা করে বললো,
‘ তোমার ভাই দিছে, দেও কে জানি ফোন দিতাছে।
ফাইজা ফোন নিয়ে পেছনে সরে বললো,
‘ দিতাছি দিতাছি, ভাইয়ে পাশের রুম থেইকা ফোন দিছে। জরুরি না। এইটার ক্যামেরা অনেক ভালা, দাঁড়াও একটা ছবি তুইলা নেই।

বলেই নিজের একটা ছবি তুললো তারপর গিয়ে বিছানায় বসলো আর ছবি দেখার জন্য গ্যালারিতে গেলো। গিয়ে তার ছবির পরে আরিদা আর রাশেদের ছবি দেখে বললো,
‘ আপনারা ঘুরতে গেছিলেন? ভালা প্রেম পিরিতিই চলতাছে তাইলে, আবার পাশের ঘর থেইকা ফোনও দেয়।
আরিদা বললো,
‘ বিয়া কইরা প্রেম করা খারাপ কিছু না।
ফাইজা বুক বাঁকিয়ে বললো,
‘ হুউউম।
বলতে বলতেই বিছানার উপর পড়ে থাকা ফাইজার ফোনে একটা ম্যসেজ নোটিফিকেশন এলো, কোনো আওয়াজ হলোনা, শুধু আলো জ্বলে উঠলো। ফাইজা আরিদার ফোনের সবকিছু ঘেঁটে দেখতে ব্যস্ত। স্পষ্ট বাংলায় ম্যসেজ এসেছে,
‘ জান তুমি কি ব্যস্ত?

আরিদা দেখলো ছোট করে লেখার বামপাশে ছেলেটার ছবিও দেখা যাচ্ছে। চেহেরাটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগলো, দেখার জন্য ফোনটা হাতে নিবে তখনি ফাইজা বিষয়টা খেয়াল করে টান দিয়ে তার ফোনটা নিয়ে গেলো। আরিদা মাথা উঁচু করে বললো,
‘ ফয়সাল? ফাইজা এইটা ফয়সাল? তুমি ফয়সালের সাথে প্রেম করতাছো?
ফাইজা চোখ বড় করে বললো,
‘ আপনি চিনেন?
আরিদা জবাব দিলো,
‘ অবশ্যই চিনি, তোমার আগের ভাবির ভাই।

ফাইজার হাত থেকে আরিদার ফোনটা বিছানার উপর পড়ে গেলো। তার নিজের ফোনটাও পড়ে যাওয়ার উপক্রম! কারণ তার হাত থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে চেহেরা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। আরিদা আবার বললো,
‘ কেমনে সম্ভব? ফয়সাল আর তুমি….
ফাইজা এলোপাতাড়ি এসে রাহাদকেসহ আরিদাকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলো, অনুনয় বিনুনয় করে বলতে লাগলো,
‘ আম্মা আর ভাইকে বইলেন না, দোহাই ভাবি। আপনি যা কইবেন আমি তাই করুম। আপনার শাড়িও ফেরত দিয়া দিমু, আপনার মোবাইল নেওয়ারও ইচ্ছা জাগছিলো এইটাও নিমুনা। প্লিজ ভাবি বইলেন না ভাইরে।
আরিদা টেনে ফাইজাকে তার থেকে সরালো। রাহাদ ঘুমিয়ে গিয়েছিলো, ফাইজার এই কান্ডে সে কাঁদতে শুরু করেছে। কিন্তু ফাইজাও হিতাহিত বোধে নেই, প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে।

আরিদা হাত দিয়ে ফাইজাকে শান্ত হতে ইশারা করে চুপ করতে বললো। ফাইজা চুপ হলে আরিদা রাহাদকে আস্তে আস্তে আবার ঘুম পাড়াতে লাগলো। ফাইজা ছটফট করছে আর চোখ মুছছে!
আরিদার কানে ফয়সালের সে সময়কার বলা কথাগুলো ভাসছে! ফয়সাল কি তাহলে বোনের প্রতিশোধ বোন দিয়ে নিবে? তার জন্য ফাইজার সাথে প্রেম করছে? এটা তো সত্যিকার ভালোবাসা হতেই পারেনা। কেননা ফয়সাল প্রচন্ডরকম প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আছে।

ছায়ার মুখোশ পর্ব ৭

আরিদা রাহাদকে ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে দিল, তার ফাইজাকে বললো,
‘ আমি যা কমু তাই শুনবা সত্যি তো?
কাঁদতে কাঁদতে ফাইজা বললো,
‘ তিন সত্যি।

ছায়ার মুখোশ পর্ব ৯