ছায়াস্পর্শ গল্পের লিংক || জান্নাত চৌধুরী

ছায়াস্পর্শ পর্ব ১
জান্নাত চৌধুরী

আইতে পারি চেয়ারম্যান সাহেব ?
চেয়ারম্যান সাহেবের বৈঠক ঘর।
প্রায় সন্ধ্যা , বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, ঘরে হালকা কুপির আলো।
দরজায় ধীরে ধীরে কড়া নাড়ে কেউ। ভিতর থেকে একজন সেবক দরজা খুলে দেয়। ভিতরে ঢোকে মধ্যবয়স্ক এক কৃষক, শীতের শাল কাঁধে জড়ানো, মুখ শুকনো, চোখে তীব্র অনুরোধের ছাপ।
রাজকীয় মডেলে তৈরি চেয়ারে বসে পানের খিলি চিবোচ্ছে চেয়ারম্যান মীর আহনাফ। ডান হাতে গাল ঠেলে পানের পিচ বাটিতে ফেলে
আরে ইসমাইল, তুই এই সন্ধ্যাবেলায়? কি কাম?

মাথা নিচু করে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে ইসমাইল শেখ! মনে ভয় ,চোখে তার প্রকাশ নিয়েই এগিয়ে এসে দাঁড়ায় চেয়ারম্যানের নিকট।
মাফ করবেন চেয়ারম্যান সাহেব… কথা কইতে আসছি।
সন্দিহান সরু চোখে তাকায় চেয়ারম্যান , মুখে চিবোতে থাকা পান কিছু ক্ষণ স্থির করে । ভ্রু জোড়া কুঁচকে পরখ করে ইসমাইলের পা থেকে মাথা অবদ্ধি!
তা কি বলবি জলদি বল শুনি। হাতে সময় নাই। ছোট নবাব শহরে মিটিং শেষ ক‌ইরা আইতেছে
ইসমাইল কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কিছু বলতে নিয়েও আবার শুষ্ক ঢোক গিলে ।‌বুক ধুক ধুক করছে তার । কন্ঠে ভীতি এনে বলে
চেয়ারম্যান সাহেব… আমার মাইয়া… ছোট নবাবরে বিয়ে করবার চাইনা।
ঘরের ভিতর নীরবতা। যেন শব্দ জমে থাকে। চেয়ারম্যান ধীরে উঠে দাঁড়ায়। তাঁর চোখের দৃষ্টি শীতল।
কি বললি তুই?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ইসমাইল একটু কাঁপে। ভয়ে কিছু পিছিয়ে যায় চেয়ারম্যানের কাছে থেকে
ওর মত নাই, সাহেব। মাইয়া বলছে, সে বিয়ে করবো না। আমি জোর করবার পারুম না।
চেয়ারম্যান হাসে, কিন্তু চোখ হাসে না ‌ । অদ্ভুত সেই হাসি ঠোঁট গলিয়ে বের হয় না বাহিরে।
ছোট নবাবের নজর যেই জিনিসে পড়ে ‌, ওই জিনিস সে নিজের ক‌ইরা ছাড়ে। তোর মাইয়ার কপাল ভালো আমার পোলা তারে রক্ষিতা না ক‌ইরা বিয়া করতে চাইছে।
ইসমাইলের চোখ মাটিতে , কন্ঠে নেই কোনো তেজ। চেয়ারম্যান ভুল কিছু বলছে না , ছোট নবাবের নজর এড়িয়ে মেয়ে পাতালে লুকানোর চেষ্টা করাও যেন ভুল।
সে পড়ালেখা করছে, সাহেব। ওর মনে কিছু আছে কিনা জানি না। কিন্তু ও বলে, বিয়েটা হোক মন থেকে… জোর কইরা হইলে সারাজীবন নষ্ট হইবো।
চেয়ারম্যান ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়ায় তবে দুরুত্ব বজায় রাখে ইসমাইলের থেকে ।

—তুই জানোস, তোদের ধানের জমি, তোদের টিউবওয়েল, তোদের ঘরের পেছনের রাস্তাডা—সব আমার নামেই চলতেছে?
ইসমাইলেলচোখে জল , করুন দৃষ্টিতে তাকায় চেয়ারম্যানের চোখ যেন পাহাড় হয়ে পানি ঝড়িয়ে ছাড়ছে ।
—জানি, চেয়ারম্যান সাহেব। কিন্তু মাইয়াডারে বিক্রি করবার সাহস আমার নাই।আপনে যা ঠিক মনে করেন, তাই করেন চেয়ারম্যান সাহেব। কিন্তু মাইয়াডারে জোর কইরা নেবার হক কারো নাই।
মরার পাখা গাজাই ছে তোদের !
বিদেয় হো আমার সামনে থেকে

মিটিং শেষ, গ্রামের নেতারা চলে গেছে। সবার মুখেই ছিল ভয়ে আর গোপন ঘৃণায় ভরা হাসি।
ছোট নবাব, সিগারেটের ধোঁয়া মুখ থেকে ধীরে ধীরে বের করে, শুধু মুখে একটা অদ্ভুত হাসি।, নক, বাড়ির দরজায় তার কড়ার শব্দ পড়ল।
স্বপ্ননীড় — মীর পরিবারের অতি পুরনো বাড়ি, আদিম আমলের গন্ধমাখা, যার প্রতিটা ইট যেন ইতিহাস বয়ে বেড়ায়।
পুরনো আভিজাত্যের ছোঁয়া মেশানো ” এক অতীতের অবচেতন ছায়া, যেখানে ইট-পাথরের ফাঁকে ফাঁকে জমে আছে অপমান, অহংকার, আর জমিদারী গরিমা।
বাঁধানো চৌচালা ছাদ, চুন-সুরকির দেয়ালে এখনো হাতের কারুকাজ, ছাদের কোণে পাখিদের পুরনো বাসা, আলনার পাশে রূপার পানদানি।

বাড়ির ফটকে ঝুলে থাকা লোহার কড়া যেন যুগ যুগ ধরে শুধু প্রবেশের আওয়াজ গিলে ফেলেছে। বাগানে বুড়ো আমগাছ, গায়ে লতাপাতা জড়ানো, যেন দেখলেই বোঝা যায়। বাড়ির ভেতরে ঢুকলে সোঁদা গন্ধ পুরনো কাঠ, ঘাম, ঘুঙুর আর লুকানো আতঙ্কের মিশেল। এক সময়ে এখানে নারীদের হাসি বাজত, এখন শুধু বাতাসে ঘুরে বেড়ায় একটা নীরব অভিমান।
ঝরঝরে বাতাসে দাউদাউ করছে চিরকালীন অন্ধকার। বৃক্ষের পাতা গুঁড়িয়ে পড়ছে মাটিতে, আর বড় গাছের ছায়ায় ছোট নবাবের ছায়া নাচছে।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে, বাড়ির দেওয়ালে ছাপ রেখে যায় তার পায়ের ধাপ, যেন ভয়ংকর এক অদৃশ্য প্রহরী।
অন্দর থেকে আসছে মায়ের পুরনো গর্জন, কিন্তু সে কোনো কথা শোনে না। তার মন এখন অন্য জায়গায়, কখনো না ছোঁয়া আগুনের মাঝে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিতে।

ঘরে ঢুকে এক কোণে বসে পড়ল, চোখ দুটো যেন ঝলমল করছে তার।
রাত্রির নিস্তব্ধতায়, ধোঁয়াটে আলোয় বসে আছে চিন্তা আর অস্থিরতার মাঝে চোখ বন্ধ করে বেতের রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে সে, হঠাৎ কানে আসে দরজার ঠক ঠক শব্দ।
কাষ্ঠের দরজা খুলে,একজন ঢুকল স্বজন-সদৃশ,কিন্তু মুখে রয়েছে কড়া অসন্তোষ সে আর কেউ নয়, মীর আহনাফ। ঘরে ঢুকেই খেপা মেজাজে বলতে থাকে
আরাধ্য তুই আজকের মিটিংয়ে আবারো ঝামেলা পাকিয়েছিস?
বন্ধ চোখ জোড়া ধপ করে মেলে আরাধ্য , একমাত্র বাপের রাগী মুখ দেখেই মন যেন খুশিতে ভরে ওঠে তার !
—শুধু ঝামেলা না আব্বা ..! ঝামেলার সাথে মসলা দিয়ে কষিয়ে ভুনা খিচুড়ি পাকিয়েছি । তার পর জনে জনে ভাগ করে দিয়েছি ..!
আরাধ্য ;

চেঁচিয়ে ওঠে মীর আহনাফ , কন্ঠে তেজ চোখে আগুন ঝড়ে , জমিদারি বংশ কিনা । রক্ত গরম বলেই কথা
—আরে আব্বা কুল কুল , বয়স হ‌ইতাছে আপনার এতো রাগলে মরার হুকুমের আগেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।
শান্ত থাকুন।
কুলাঙ্গার ছেলে কোথাকার ! তুমি কখনো আমার ছেলে হতেই পারো না ..!! কারণ রক্ত কখনোই বেইমানি করে না
—আমি আপনার ছেলে কিনা সেইটা আপনার প্রিয়তমা স্ত্রী মানে আমার মা জননী ভালো জানবে , আপনার সন্তান না হলে দেখুন গিয়ে কার সাথে রাত কাটিয়ে এসেছিলো আপনার স্ত্রী । তার একমাত্র ফল আমি .
নিজের মা সম্পর্কে এসব বলতে বিন্দু পরিমাণ লজ্জা হয় না তোমার?
—আরে আব্বাজান লজ্জা পাওয়া হলো মেয়েদের স্বভাব । আমি তো আর তৃতীয় লিঙ্গ ন‌ই যে লজ্জা পাবো , পুরুষ সিংহ আমি , ওসব লজ্জা শরম আমার জন্য ন‌য়।
আমার মান সম্মান সব ধুলিসাৎ করছো তুমি ?
পুরো ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে আরাধ্য ভয়ংকর সেই হাসি । ব্রাউন কালার মনির চোখ জোড়া ভয়ংকর লাগছে খুব ভয়ংকর । ওটা যেন বজ্রপাতের গর্জন। ঠোঁট বেঁকে উঠে, চোখ জ্বলে, আর সেই হাসিতে জমে থাকে একসঙ্গে দম্ভ, পাপ আর পৈশাচিক আনন্দ।

হাসে… এমনভাবে, যেন ভয়টাই তার খেলনা।
—যেখানে ফারহান ফাইয়াজ আরাধ্যের ছায়ায় আপনার অস্তিত্ব টিকে আছে , সেখানে আমাকে সম্মান শেখাচ্ছেন ।
সম্মান আমার বুড়ো আঙুলে থাকে । চেট দেখালেই নড়ে ওঠে , যেখানে পুরো গ্রামে ছোট নবাবের নামে দু’ মগ পানি বেশি খায় সেখানে আমাকে ক্ষমতা দেখাতে আসবেনা ..!!
চাইছো টা কি তুমি ?
—মীর বংশের ধ্বংস , আপনার ধ্বংস , আর আপনার তৈরি পুরো রাজত্বের ধ্বংস। পুরো ক্ষমতাই চাই আমার
চেয়ারম্যান সাহেব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে ছেলের দিকে চোখ জোড়ায় আচমকাই খুশির ঝলক। ঠোঁটে বাকা হাসি রেখে বলে
ভুলে যেও না বাপজান …
তোমার শরীরের প্রতিটি শিরায় উপশিরায় ব‌ইছে এই মীর বংশের রক্ত ,ক্ষমতার আধিপত্য। এই মীর বংশের রক্তের গরমেই পুরো গ্রাম তোমার দাসত্ব খাটে তোমাকে “ছোট নবাব ” বলে চিনে ।
আমার ধ্বংস চাইলে তোমার সাম্রাজ্য ধ্বংস পথে নেমে আসবে।
ছোট নবাব উঠে দাঁড়াল,

তার চোখে ঝলমল করছে অদ্ভুত ভাবেই চোখ লালা হতে উঠেছে তার । দুজনের মুখোমুখি দাঁড়ানো একজন সময়ের ধারক,আর একজন সময়ের ঘাতক।
চেয়ারম্যানের কন্ঠ শান্ত , কোনো রাগের আবির্ভাব নেই মুখে গাম্ভীর্য এনে বলে ,
ক্ষমতা বিস্তার করো তবে নিজের ধ্বংস ডেকে এনো না।
রাজত্ব তোমার , বিলীন করো না।
রাত্রি গভীর , নিস্তব্ধ শান্ত , রাত জাগা কুকুর গুলো ডেকে উঠছে ঘরের দেওয়ালে পড়ছে দুই মানুষের ছায়া—
বাবা আর ছেলে,
দুজনের মুখেই অদ্ভুত এক হাসি
নিরবতা ভেঙ্গে বিরক্ত স্বরে আরাধ্য বলে “এখন আসতে পারেন আব্বাজান , আমি ভীষণ ক্লান্ত। এত রণরঙের মাঝে একটু নিঃশ্বাস নেওয়ারও অধিকার তো আমার আছে।”
দাঁতে দাঁত খিচে ধরে চেয়ারম্যান । এই ছেলে সাথে মুখ লাগাতে কোনো কালেই ভালো লাগেনি তার । উল্টো ঘুরে ঘর থেকে বেড়ে তে নিবে এমন সময় আবার থেমে যায় তিনি …
যাওয়া আগে একটা কথা জানিয়ে যাই …

সাদা চাদর বিছানো পরিপাটি করে রাখা বিছানার দিকে হেটে যাচ্ছিল আরাধ্য বাবার কথায় হাটা থামিয়ে স্থির হয় সে ভ্রু জোড়া একত্রে করে তাকিয়ে রয়
ওই মাইয়া তোমারে বিয়া করতে নারাজ..!!
মূহুর্তেই যেন শান্ত পরিবেশ গর্জে ওঠে । হৃদয়ে কোথাও একটা আগুন জ্বলে উঠলো । তবুও মুখে এক অদ্ভুত হাসি আরাধ্যের
কি বলেন আব্বাজান , এমনটা সত্যি হয়েছে ?
হে মালিক আমার বিশ্বাস যাচ্ছে না ।
ভরকে যায় চেয়ারম্যান । তার খেপাটে ছেলে এখনো এতো শান্ত রয়েছে দেখে নিজেই নিজেকে জোড় চিমটি কাটে ।
হো হো করে হেসে ওঠে আরাধ্য বিশ্রী সেই হাসি । চার দেয়ালের মাঝেই আটকে রয়েছে সেই শব্দ । মূহুর্তেই রক্ত চোখে তাকায় চেয়ারম্যানে দিকে ।

কি হচ্ছে বুঝতে না পেরেই ফ্যালফ্যাল করে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে চেয়ারম্যান । এই মূহুর্তে তার কি করা উচিত ভেবেই যেন প্রেসার বাড়ছে তার
ওই সমুন্দির মাইয়ার সাহস কি করে হয় , বিয়েতে না মত করার ?
তোর চরিত্র সম্পর্কে গ্রামের সকলেই তো অবগত , মেয়ে যেহেতু এই গ্রামের তাই তোকে বিয়ে না করাই তার জন্য শ্রেয় ! পাগলেও তো নিজের ভালো চায় কিনা ।
আব্বাজান !
এখন চাইছিস টা কি ওইটা বল ?
ডান হাতে দুই আঙ্গুলে কপাল চুলকে নেয় আরাধ্য । প্রায় কয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে আবারো চোখ খুলে
ওর বাপরে তুলে আনা হোক কুঠুরিতে ।

প্রিয়জন হারিয়ে আমার পাখি একটু ছটফট করুক ।
তারপরেই না হয় তাকে খাঁচাতে তুলি ..!!
দুনিয়াতে মেয়ের আকাল পড়েনি .. নিশ্চয়ই ?
মেয়ের আকাল পড়েনি , তবে ওর মতো চঞ্চলা সুন্দরী পুরো দুনিয়াতে কোথাও নেই । যার চোখে আগুন , হাসিতে বিষ , রহস্যময়ী।

ছায়াস্পর্শ পর্ব ২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here