ছায়াস্পর্শ পর্ব ১১
জান্নাত চৌধুরী
রাতের মধ্য প্রহর — গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে পুরো চেয়ারম্যান বাড়ি। রাত নয়টা পার হওয়ার আগেই পুরো গ্রামের মানুষ ঘুমের দেশের পাড়ি জমায়। ঠিক যেন জনমাবন শুন্য এক পরিবেশে
ঘুমের মধ্যেই হালকা নড়ে ওঠে ইফরাহ , ডানপাশ ঘুরে বিছানায় হাত বুলাতেই ঘুম আলগা হয়ে আসে তার। যে জায়গাটায় ঘুমাবে বলে আরাধ্য শুয়েছিল জায়গাটা ফাঁকা।
বেশ কয়েকবার বিছানায় হাত বুলিয়ে ধপ করে চোখ খুলে সে। ঘরের ডিম লাইটের মৃদু আলোতে চোখ বুলায় পুরো ঘরে। না কোথাও নেই মানুষটা , তবে ইফরাহর ঠিক মনে আছে মানুষটা তার সাথে ঘুমিয়ে ছিল।
তবে এখন নেই কেন ? কোথাও কি বেরিয়েছে? তবে সে বুঝলো না কেন ?
দুচোখ বেশি সময় খোলা রাখতে পারেনা সে। মাথা ভারী হয়ে আসছে— ঘুম বারংবার জড়িয়ে নিচ্ছে তাকে! বেশ অনেকটা সময় চোখ মেলে ভাবনার দেশে পাড়ি জমাতে চেয়েও আপাতত ব্যর্থ হয়ে, আবারো নিজেকে সমর্পণ করে ঘুমের কাছে।
আবারো শান্ত হয়ে যায় পরিবেশ। দেয়ালে ঝুলতে থাকা বড় মাপের ঘড়িটা থেকে থেকে সময় পেড়িয়ে যাওয়ার খাবর জানান দিতে থাকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাতের আধারে সীমান্তের গোপন পথে চোরাই মাল ঢুকছে বাংলাদেশ। সিগারেটের নিকোষ কালো ধোঁয়া উড়িয়ে এক এক করে সকল চোরাই জিনিসের হিসাব নিচ্ছে কেউ একজন, পাশেই দাঁড়ানো তার সঙ্গী।
-আজ কয় বক্স মাল আইবো
– বেশি না মাত্র পঁচিশ বাক্স
নিলয়ের উত্তরে বেশ খুশি হয় ছায়া মানবটি। জগদলের এই বর্ডার এড়িয়ার এক পাশে ঘন জঙ্গল , অপরপাশে রয়েছে চা বাগানের সমাহার। জঙ্গলের থেকে প্রায় মাইল খানেক দুরেই ছোট এক বিজিবি ক্যাম্প। তবে , এদিকটায় বিজিবি তেমন পাহারা বসে না। আর এ পথেই সকল চোরাই জিনিস ঢুকানো হয় বাংলাদেশে!
নিলয় এগিয়ে যায় কাঁটাতারের বেড়ার কাছে। অল্প বয়সী দুজন যুবক এসেছে ওপার হতে ।সে এগিয়ে যেতেই এক এক করে বাক্স গুলো তারের বেড়ার এপারে পার করে দিতে থাকে যুবকগন। গুনে গুনে ২৫ টি বাক্স আসার পরেই ছুটে পালিয়ে যায় তারা। নিলয় দক্ষ হাতে বাক্স টেনে ছায়া মানবের কাছে এনে রাখে।
– হিসাব ঠিক আছে
নিলয় ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হে জানায়। সিগারেটের শেষ অংশটুকু মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে দেয় ছায়া মানবটি। তার পাশে থাকা সঙ্গির দিকে হাত বাড়াতে কালো রঙের এক ব্যাগ এগিয়ে দেয় সে । চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে কিছুটা বাঁকা হেসে ব্যাগের জিপার একটানে খুলে ফেলে বের করে এক বান্ডিল টাকা লোকটি। বেশ কচকচে বাংলাদেশী নোটের ৫০০ টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দেয় নিলয়ের হাতে। একসাথে বেশ মোটা অংকের টাকা পেয়ে কুটিল হাসে নিলয়।
– আজ তবে আসি সাহেব। দরকার লাগলে আবার খবর দিবেন, আপনার লাগি এই বান্দার জান হাজির যেকোনো সময় ।
নিলয়ের কথায় ওপর নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে অনুমতি দেয় ছায়া মানবটি। নিলয় অনুমতি নিয়ে বিদায় নিবে ঠিক এমন সময় রুক্ষ ,গম্ভীর কন্ঠ কানে আসে তার
-সাবধান বেইমানি করলে, বেইমানের নাম ঠিকানা সব মুছে যাবে।
থমকে যায় নিলয় ঠিক যেভাবে ঘুরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল, ঠিক একইভাবে আবারো ঘুরে তাকায় ছায়া মানবের দিকে
-শখ কইরা মারা খাইতে চায় কয়জনে! টেকা পাইছি কাজ করছি। ঘরে বউডা পোয়াতি, দুই টনা- টুনির সংসার চলবো এই তো অনেক। নিশ্চিন্তে থাকুন জনাব , জান যাইবো তবে বেইমানি এই নিলয় মন্ডল এর দ্বারা সম্ভব না।
কথা শেষ করে দ্বিতীয়বারের মতো উপর নিচে নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বিদায় নেয় নিলয়। তা যাওয়ার পানি কিছু সময় তাকিয়ে থাকে ছায়া মানবটি। জিন্সের পকেট হতে আরও একটি সিগারেট বের করে রাখে ঠোঁটের কোণে । বেশ যন্ত নিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে , সঙ্গীদের আদেশ করে
– মাল গাড়িতে তোল , ভোরের আগেই ফিরতে হবে।
রাতের কালো অন্ধকারে ইতি টেনে পাখির কিচিরমিচির শব্দ কানে আসছে। প্রকৃতি জানান দিচ্ছে ভোরের আগমনী বার্তা।
শরীরের ওপর মনে হয় প্রায় মন খানিকের মতো ভারী কিছুর ওজন অনুভব হচ্ছে ইফরাহর । চোখে গভীর ঘুম— চোখ খোলার মতো উপায়ান্তর নেই। হালকা কিছুটা নড়তে নিলেই কিছু একটা যেন আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিচ্ছে তাকে।
প্রায় অনেকটা সময় একই ভাবে থেকে , বেশ কষ্ট করে চোখ জোড়া মেলে নিজের সাথে পেঁচিয়ে থাকা জিনিসটির দিকে তাকাতেই , নজরে আসে আরাধ্য নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে আছে তাকে। বিরক্ত হয় ইফরাহ , সরে যেতে চায় আরাধ্যের থেকে।
তবে, লাভ হয় না ! “লোকটা ঘুমের মধ্যে আরও শক্ত করে চেপে ধরে তাকে। মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলে বুঝি পালিয়ে যাবে।
ইফরাহ বেশ কয়েকবার সরাতে চায় নিজের শরীরের উপর থাকা আরাধ্যের হাত , তবে ব্যর্থ হয় সে। কোন দিক দিয়েই যখন পেরে উঠছে না , ঠিক সে সময় উপায় না পেয়েই ডেকে ওঠে আরাধ্যকে।
-এই যে শুনছেন? ভোর হয়েছে উঠবেন চলুন।
ঘুমের ঘোরে কিছুটা নড়ে ওঠে আরাধ্য তবে, এবারেও ছাড়েনা ইফরাহকে। পারলে আরো শক্ত করে চেপে ধরে , দম পাচ্ছে না ইফরাহ । কিছুটা ধস্তাধস্তি করে আবারো ডেকে উঠে সে …
-উঠবেন না, তবে আপনি ঘুমোন আমাকে উঠতে দেন। ফজরের আযান পড়েছে —আমি নামাজ আদায় করতে চাই!
কানের কাছে মাছির মত প্যান প্যান করা শব্দে ,চোখ খোলে আরাধ্য । তবে এ কি ? এ যে তার বাচ্চা বউ ,তার রক্তকমলীনি।
হঠাৎ টুক করে ইফরাহর কপালে এক চুমু দিয়ে বসে আরাধ্য, সাথে যুদ্ধ জয়ের মত এক হাসি দিয়ে বলে ..
-রাতে কি ঠিক ঠাক ঘুম হয়নি বউ— এত সকালে উঠেছো কেন?
আরাধ্যে দিকে ফ্যাল ফেল করে তাকিয়ে থেকে , কিছু সময় আগে ঘটে যাওয়া কাহিনী বুঝতেই ধ্যানে মগ্ন হয়েছিল ইফরাহ। তবে আরাধ্যের করা প্রশ্ন যেন ,ধ্যান হতে টেনে বের করে
আনে তাকে। নিজেকে সামলে কোনমতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে …
– আপনি সরুন আমি উঠবো।
বউয়ের কথা শুনেই তাকে টেনে আরো কিছুটা নিজের কাছে নিয়ে আসে আরাধ্য। তারপর বেশ দুষ্টুমি সুরে বলে
– ধরে রেখেছে বুঝি ?
– ছেড়েও তো রাখেন নি ।
আরাধ্য চোখ জোড়া কেমন ছোট ছোট করে তাকায় ইফরাহর দিকে । দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেই ইফরাহ- আরাধ্যের মুখে মিষ্টি এক হাসির রেখা দেখা যায় , সে হাসিটা আরো কিছুটা ফুটিয়ে তুলে বলে
– বড়দের মুখে মুখে তর্ক করতে নেই বউ!
ভ্রু জোড়া কুঁচকে নেয় ইফরাহ । কিছু সময় আরাধ্যের কালো মনির চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে
– তবে ছোট মেয়েকে বিয়ে কেন করেছেন! বড়দের বিয়ে করতেন, যারা আপনার মুখে মুখে তর্ক করা স্পর্ধা রাখে।
– ছোট নবাবের মুখে মুখে তর্ক করার স্পর্ধা এই গ্রামে অন্তত আর কারো নেই । তা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়…?
– ভুলে যাবেন না ! আপনি ছোট নবাব হলেও বর্তমানে আমার স্বামী। তাই আপনার উপরে কথা বলার অধিকার আমি রাখি।
– মানছো তবে আমি তোমার স্বামী?
কিছুটা দমে যায় ইফরাহ্। তবে গলায় সেই চিরচেনা দম রেখেই আবার উত্তর করে
– অস্বীকার করেছি কবে? বিয়ে হয়েছে আমাদের, কবুল বলেছি মানতে না চাইলেও আপনি আমার স্বামী।
এমন উত্তরে হয়তো বেশ খুশি হয় আরাধ্য । হয়তো এটাই সে চেয়েছিল। জোর করে হোক তার ভালোবাসার মানুষটি তো তার কাছে রয়েছে। তার রক্তকমলীনি তাকে স্বামী বলে মানছে। হোক না জোর করে, তাতে কি এসে যায়। ভালোবাসায় এতটুকু জোর মানে যায়। আজ যদি এই মেয়েটাকে সে না পেতো তবে একা কি থাকতে পারতো ?
উহু। কখনো নয় , কখনো পারত না। এই মেয়েটাকে না পেলে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিত। এই পরিকল্পনাই তো সে করেছিল তাই না। আজ তবে বিধাতা সহায়, জোর করে হলেও তার রানী তার প্রাসাদে এসেছে।
– ছাড়ুন আমাকে- উড়তে দিন।
আরাধ্য কথা বাড়ায় না ছেড়ে দেয় ইফরাহকে।শাড়ির আঁচল ঠিক করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ায় ইফরাহ্। আলমারি হতে কাঁচা শাড়ি আর তোয়ালে নিয়ে চলে যায় গোসলখানায়।
আরাধ্য কিছু সময় তাকিয়ে থাকে সেদিকে! ইফরাহ দরজা লাগাতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় সে।
বালিশের নিচে কালো রঙের সেলফোনটা হাতে তুলে নেয়। কিছু সময় খোঁজা খুঁজির পড়ে খুজে বের করে এক পরিচিত নাম্বার।
ডায়াল করে সেই নাম্বারে স্ক্রিনে উপর জ্বলজ্বল করছে
“রাম ছাগল ” নামে সেভ করা এক নাম্বার
মূহুর্ত খানিকের অপেক্ষা অপর পাশের ব্যক্তিটি কল রিসিভ করতেই। আরাধ্য শান্ত কন্ঠে বলছ ওঠে …
– বেলা ১১ চলে আসিস ।
অপর পাশের মানুষটির উত্তর আশা না করেই কল কেটে ফোন আবারো বালিশে নিচে রেখে দেয় সে।
ইফরাহ বেড়িয়েছে ,ভেজা চুল খোপাতে রেখেই ওযু করে এসে দাঁড়ায় আরাধ্যের সামনে। দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে রেখে শান্ত গলায় বলে ..
– আপনার ঘরের জায়নামাজ টা একটু দেন ।
– নেই।
আরাধ্যের সরল স্বীকারোক্তিতে একটুও অবাক হয় না ইফরাহ। সে আগে হতেই আন্দাজ করছিল এই ঘরে জায়নামাজ নেই। কথা না বাড়িয়ে .. আবারো পা বাড়ায় আলমারির দিকে। নিজের ধোঁয়া একটা কালো সূতি ওরনা বের করে ফ্লোরে বিয়ে। তাতেই নামাজের জন্য দাঁড়ায়।
বিছানায় তখনো গড়াগড়ি খাচ্ছে আরাধ্য, তবে এবার দৃষ্টি তার রক্তকমলীনির উপর। কি পবিত্র লাগছে মেয়েটাকে , স্নিগ্ধতার
প্রতিমা , তার চোখের শান্তি । মাঝে মাঝে ভীষণ কাব্যিক হয়ে ওঠে আরাধ্য। মনে মনে মেলায় বসায় হাজারো কবিতার ছন্দ …
এইযে এখনো কেমন কথা সাজিয়ে ফেলেছে। মনে হাজারো শব্দের গোলমাল লেগেছে তার …
রক্তকমলীনি
আমার স্নিগ্ধতার প্রতিমা , আমার চোখের শান্তি।
অশান্ত দিনের প্রান্তে
ঝরে পড়া রক্তিম আলো
তুমি যেন কোমল স্রোতের মতো
আমার বুকে গেয়ে যাও নীরব গান।
যত জ্বালা যত অস্থিরতা
তুমি ছুঁয়ে দাও, আকাশের মতো বিশালতায়।
চোখ মেলে দেখি শুধু তোমার ছায়া।
যেখানে ক্ষতও হয়ে ওঠে প্রার্থনা।
আমার রক্তকমলীনি,
তুমি আমার মানসিক প্রশান্তি—
অগ্নির ভিতর থেকে জন্ম নেওয়া
শান্ত সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস।
আরাধ্য কথাগুলো মনের মাঝেই চেপে রাখে। চোখ বুঝে বালিশের সাথে মাথা চেপে ধরে সে।
ইফরাহর নামাজ শেষ! হাতে থাকা ওড়না আবারো আলমারিতে রেখে এসে দাঁড়ায় আরাধ্যের সামনে। বেশ শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে …
– রাতে কোথায় ছিলেন আপনি ?
ইফরাহর কথায় না বুঝা নিষ্পাপ শিশুর মতো পিটপিট চোখ করে তাকায় আরাধ্য। দেখে যেন মনে হয়, যে দুনিয়ার কিছুই চেনে না জানে না। ইফরাহ্ দমে যায় না কন্ঠ শক্ত রেখে আবারো বলে …
– কি হলো ,বলুন কোথায় গিয়েছিলেন ?
সোজা হয়ে উঠে বসে আরাধ্য। ডান হাতে বিছানায় পড়ে থাকা বালিশ তুলে নেয় কোলে। তাতে হাতের ভার ছেড়ে দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে উত্তর করে।
ছায়াস্পর্শ পর্ব ১০
– ঘরের তো ছিলাম। ঘুমোচ্ছিলাম,
‘ মিথ্যা বলছেন , আপনি ঘরে ছিলেন না। আমি সারা ঘর খুঁজেছি।’
– বাহ! মাঝরাতে আমায় খুঁজছিলে কাহিনী কি ? ফেলে রাখা কাজটা করার অনুমতি দিতে বুঝে।
‘প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাইছেন ?’
– উহু একদম নয় ।
‘তবে কি স্বীকার করছেন , আপনি মিথ্যা বলেছেন ? ”
– যদি আমি মিথ্যা বলি ,
তবে এ জীবনে আর সত্যের অস্তিত্ব তুমি
খুঁজে পাবে না —রক্তকমলিনী ।
